প্রাণ_ভোমরা পর্ব ২

#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২)

লাল টকটকে গোলাপটির ঠিক মধ্যিখানে এক মানবী বসে আছে। পিঠ ঢেকে আছে তার ঘন কালো এলোকেশীতে! দূর থেকে বয়ে আসা বাতাসে চুলের নিম্নভাগ ক্ষণে ক্ষণে উড়ছে। সৃষ্টি হচ্ছে এক মোহনীয় দীপ্ত! যার প্রবল আকর্ষন গিয়ে ঠেকে হৃদ্যের বক্ষস্থলের নরম হৃদয়ে। মনে প্রবিষ্ট হয় সীমাহীন কৌতুহল। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে সদ্য ফুটিত গোলাপটির কাছে। কে এই রমণী? কোথা থেকে উদয় হলো? তাও তার গোলাপ বাগানে? যে কিনা সরাসরি জায়গা করে নিয়েছে ফুলের অভ্যন্তরে। এত সাহস?

হৃদ্য কপট রাগে সামনে এগিয়ে আসলেও চোখ জুড়ে তার বিস্ময়। অজ্ঞাত রমণীর মুখটির এখনো দেখা মিলছে না৷ কী অদ্ভুত! সে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও চেহারা দেখতে পারছে না। তার চোখে কি ছানি পড়ল?

হৃদ্য গাঢ় দৃষ্টি রাখে ছোট্ট ফুলটির মধ্যে। মেয়েটি এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেও এখন আর চুপ করে নেই। ময়ূরী নীল হাত দুটি দিয়ে ফুলের পাপড়ি থেকে কিছু কুড়াচ্ছে। পা দুটোতে অদ্ভুত সুন্দর পুষ্পরেণুর নুপুর। ঝুনঝুন শব্দ তুলছে কি? না এত ঝুনঝুন শব্দ নয়,আচ্ছন্নে জড়িয়ে ফেলা মায়া ধ্বনি। হৃদ্য মুহূর্তকাল পার করে দিল সেই পা জোড়ায় মুগ্ধদৃষ্টি নিবদ্ধ করে। হঠাৎই তার খেয়াল আসে। চারপাশে তাকায়। গভীর নিশ্বাস টানে। সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি সুবাস মিশে যায় তার দেহের অভ্যন্তরে। মুহূর্তেই ভালো লাগার দুলুনি শুরু হয় রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আবেশে চোখ বুঁজে আসে। ঠোঁটে মাতাল হাসি উঁকি দেয়। বুকে শুরু হয় অস্থিরতার ঝড়। হাতদুটো কাঁপছে! এই মোহিত নারীকে ছোঁয়ার প্রবল ইচ্ছে কাজ করছে। কী করে ছুঁবে? একটু কি স্পর্শ করবে অঙ্গুলি দ্বারা?

হৃদ্য অপেক্ষা করতে পারছে না। সে ফুলটির আরো নিকটে চলে আসে। ডান হাতটির তর্জনী সাবধানে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটির কাছে। পরম আদরে একটু ছুঁবে। একটুতেই কি বুকের ঝড় কমবে না? না কমলে বেশি ছুঁবে। হৃদ্য আবিষ্ট চাহনি ফেলে মেয়েটির চুল স্পর্শে যেতে ধপ করে শব্দ হলো। দূর থেকে ভেসে আসছে উদ্বিগ্নমাখা চিৎকার,

“হৃদ্য? হৃদ্য বাবা! কিভাবে পড়লি? ব্যথা পেয়েছিস?”

মায়ের শঙ্কিত গলায় ঘুম ভেঙে গেল হৃদ্যের। ঝট করে চোখ মেলে। মায়ের মুখটি পরিষ্কার হয়ে আসতে উঠে বসে। দ্রুত চোখ বুলায় চারপাশে। অস্থির দৃষ্টি চারপাশে ফেলতে ফেলতে বলল,

“আম্মু,কিছু টাকা দেও তো। আমাকে এখনি নার্সারিতে যেতে হবে।”

হৃদ্যের মা শায়লা হক কপাল কুঁচকে নিলেন। একটু আগে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠা চিন্তার ভাঁজ গায়েব। সেখানে ধরা পড়ল আগ্রহ। কৌতুহলি কণ্ঠে বললেন,

“আজ কী স্বপ্ন দেখলি?”

হৃদ্য ব্যস্তভঙ্গিমায় উঠে দাঁড়ায়। পশ্চিমের জানালা খুলে দেয়। ঘরে আলো ও হাওয়া প্রবেশের ব্যবস্থা করে বলল,

“পরে বলব। অনেক বেলা হয়ে গেছে,আম্মু। বেরোতে হবে।”

হৃদ্যের কথাটি কর্ণপাত করলেন না শায়লা হক। তিনি ছেলের বিছানায় বসলেন। উৎসুক নয়ন ফেলে বললেন,

“এবারও বুঝি তোর পুষ্পরানিকে ছুঁতে পারলি না? মুখটা দেখেছিস? কেমন দেখতে? স্বর্গীয় রূপসীর মতো?”

সূর্যের কিরণ এসে পড়েছে হৃদ্যের চুলে,মুখে,ঘাড়ে। সেন্ডো গেঞ্জি পরে থাকায় কাঁধের দুপাশ খোলা। রোদের আলোয় বাম পাশের গাঢ় তিলটি চিকচিক করছে। হৃদ্য দুই হাতের সাহায্যে গেঞ্জি খুলে ফেলল। তোয়ালে মাথায় বাঁধতে বাঁধতে বলল,

“উহু,তোমার ছেলের বউয়ের মতো।”

শায়লা হক বিছানা ছাড়লেন। দ্রুত পায়ে ছেলের কাছে এগিয়ে এলেন। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বললেন,

“সেকি! তুই বিয়ে করে ফেলেছিস? কবে,কোথায়,কিভাবে? আমাকে তো জানালি না৷ তোর বাবা জানে? তোদের কি প্রেমের বিয়ে? বউকে কোথায় রেখেছিস? বাসায় আনিসনি কেন?”

মায়ের সংখ্যাতীত প্রশ্নে হৃদ্য একপাশে ঠোঁট টেনে হাসল। মায়ের দু কাঁধে দু হাত ফেলে বলল,

“আনব তো। সময় হলে।”
“কবে?”

মায়ের দ্রুত প্রশ্নে হৃদ্য পূর্বের হাসিটি ঠোঁটে ফিরিয়ে আনল। আয়নায় নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল,

“তোমার ছেলে আরেকটু বড় হোক। বিয়ের বয়স হোক তারপর।”

_____________________________

এক ভ্যান চারাগাছ নিয়ে বাড়ির সামনে এসে থামল হৃদ্য। শুধু কি লাল গোলাপের চারা আনলে হবে? তার পুষ্পরানির তো মতিগতির ঠিক নেই। একেক স্বপ্নে একেক ফুলের মধু আহরণ করে। নার্সারীতে যত রঙের গোলাপ চারা ছিল সবগুলোই উঠিয়ে নিয়ে এসেছে হৃদ্য। ভ্যানচালকের ভাড়া মিটিয়ে দুই হাতে দুটো চারা উঠিয়ে নিল। তারপর চোখ রাখে বাকি চারার দিকে। চারাগাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উপরের দিকে তাকাল। এতগুলো চারাগাছ নিয়ে তিনতলায় উঠবে কিভাবে? একার পক্ষে কি সম্ভব? সে অনুরোধের চোখে তাকায় ভ্যানচালকের দিকে। সাথে সাথে ভ্যানচালক বলল,

“পঞ্চাশ ট্যাকা বেশি দিতে অইব।”

হৃদ্যের দিক থেকে মত-অমতের আশা করল না সে। দু হাতে দুটো চারাগাছ সাবধানে তুলে নিয়ে বলল,

“কয় তলায় যামু?”

হৃদ্য এবারও কিছু বলল না। সে সোজা গেইটের ভেতর ঢুকে পড়ল। যার মানে এই,’ আমাকে অনুসরণ করো।’

সিঁড়ি কেটে মূল দরজার সামনে দাঁড়াতে হৃদ্যের ভ্রূজোড়া কিঞ্চিৎ সংকুচিত হয়। অজান্তেই প্রশ্ন আসে,’দরজা খোলা কেন? হৃদ্য সামনে তাকায়। মূল দরজার বিপরীতে সরাসরি তাকালে বিশাল আকারের ঘড়ির দিকে নজর পড়ে সর্বপ্রথম। তারও পড়ল। এগারোটা বেজে পাঁচ। সে দ্রুত তাদের দৈনন্দিন রুটিন মনে করার চেষ্টা করল। এই সময় তার বাবা অফিসে,তার একমাত্র আপু রিধি ইউনিভার্সিটিতে থাকার কথা। সে যেহেতু বাইরে,তারমানে বাসায় মা একা। তিনি এ সময় বিশ্রামে থাকেন। এভাবে দরজা খোলা রেখে বিশ্রাম? কোনো বিপদ হয়নি তো? অসুস্থ হয়ে পড়েনি তো? তিনি তো আবার হাঁপানি রোগি! হৃদ্যের শঙ্কিত ভাবনার মধ্যে পেছন থেকে ভ্যানচালক বলল,

“কই থুম? বাইরেই রাইখা দিমু নাকি ভিতরে দিয়া আসুম?”

হৃদ্য চমকে ওঠে। কোনো রকমে বলল,

“এখানেই রাখ।”

কথাটি শেষ করেই ভেতরে দৌড় দিল। বসার রুমে পা পড়তে থমকে যায়। সোফাতে হৃদ্যের বাবা জনাব আজিজুল হক বসে আছেন। তিনি একা নন। পাশের ফ্ল্যাটের রতন মিয়াও আছেন। যার সাথে দেখা হলে আংকেল বলে সম্বোধন করে হৃদ্য ও রিধি। কিন্তু এই সময় বাবা বাসায়? হৃদ্যের মনে সন্দেহ জাগে। চোখে,মুখে সন্দেহ নিয়েই বাবার দিকে এগিয়ে আসে। আজিজুল হক ও রতন মিয়া, দুজনের মুখই হাস্যোজ্জ্বল। কিছু একটা নিয়ে রসিকতা চলছে বোধ হয়। সামনেই টি-টেবিলে চা ও বিস্কুট দেওয়া। কথার ফাঁকে আজিজুল হক চায়ের কাপ তুলে দিলেন রতন মিয়ার হাতে। সেই সময় হৃদ্য প্রশ্ন করে বসল,

“বাবা?”

আজিজুল হক খোশগল্পে মশগুল ছিলেন বিধায় খানিকটা চমকালেন। মুহূর্তেই নিজেকে ধাতস্ত করে বললেন,

“হুম। কিছু বলবি?”

হৃদ্য আরেক পা সামনে এগোয়। বাবার পুরো শরীরে চোখ বুলায়। বাম হাতটি সোফার পেছনের অংশে মৃদু চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“তুমি এ সময় বাসায়? শরীর ঠিক আছে তো?”

আজিজুল হক সামান্য হাসলেন। সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন। ছেলের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইলেন। সুযোগ পেলেন না। তার আগেই হৃদ্যের মা শায়লা হক চলে আসেন। বললেন,

“সব ঠিক। ঠিক না হলেও ঠিক থাকতে হবে।”

হৃদ্য পেছন ঘুরে। মায়ের হেয়ালি কথার মানে খোঁজে। না পেয়ে জিজ্ঞেস করল,

“মানে?”

শায়লা হকের ঠোঁটেও হাসির রেখা স্পষ্ট হল। সহাস্যে বললেন,

“আজ রিধিকে দেখতে আসবে।”
“আপুকে দেখতে আসবে মানে? আপু কী চিড়িয়াখানার জন্তু যে দেখতে আসবে?”

আজিজুল হক গলা পরিষ্কার করার ভঙ্গিমায় কাশলেন। যার মানে এই,’এখানে তোর বাবা,মা বাদে আরো একজন আছে। কথাবার্তা সামলে বল।’

বাবার সতর্কতা টের পায় হৃদ্য। রতন মিয়ার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে আনতে শায়লা হক ধীরে বললেন,

“বিকেলে পাত্রপক্ষ আসবে,রিধিকে দেখার জন্য। তুইও বাসায় থাকবি।”

মায়ের কথায় হৃদ্যের বিস্ময় সপ্তমাকাশ ছুঁলো। চোখ কপালে তুলে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিমায় বলল,

“পাত্র? রিধি আপুর বিয়ে? কি করে সম্ভব? আমি তো এ ব্যাপারে কিছু জানি না।”
“এখন তো জানলি।”

হৃদ্য দ্রুত বিস্ময় কাটিয়ে ওঠে। মুখের ভাব কঠিনতায় ছেয়ে আসে। খানিকটা কঠিন স্বরে বলল,

“রিধি আপু তো আরো দু বছর আগেই বিয়ে করবে না বলে ঘোষনা দিয়েছিল। তারপরেও তোমরা… ”
“রিধির অমতে কিছু হচ্ছে না। বরংচ তার স্বইচ্ছায় সব হচ্ছে।”

হৃদ্যের মুখের কঠিন ভাব কেটে যায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে শায়লা হক পুনরায় বললেন,

“রিধি কাল রাতে আমার রুমে আসে। সরাসরি বলে,সে বিয়ে করবে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা যেন পাত্র দেখা শুরু করি।”
“আপু বলল,আর তোমরা একদিনের মধ্যে পাত্র বের করে ফেললে? তার হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণ জানতে চাইলে না?”
“চেয়েছিলাম। তোর বাবা বাধা দিয়েছিল তাই আর জানা হয়নি।”
“কেন?”
“তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর।”

মায়ের কথার বিপরীতে আর কোনো কথা বলল না হৃদ্য। ঘাড় বাকিয়ে এক পলক বাবাকে দেখল। পরমুহূর্তেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সোজা হেঁটে চলে রিধির রুমের দিকে। সিদ্ধান্ত যার,কারণটা তার থেকেই উদ্ধার করা বেশি যুক্তিযোগ্য। কিছু তো একটা সমস্যা আছে। সে তার আপুকে খুব ভালো করেই চেনে। যে মেয়ে সকালে পরোটার সাথে ডিম খাবে নাকি ভাজি খাবে এই সামান্য সিদ্ধান্ত নিতে ঘন্টা পার করে দেয়,সে কিনা হুট করে বিয়ের পিড়িতে বসে পড়ছে? অবিশ্বাস্য!

____________________________

রিধি ঘুম থেকে উঠে স্নাগারে ঢুকে পড়ে। মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিতেই শরীরের লোমগুলো কণ্টিকার ন্যায় দাড়িয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ শকের মতো কেঁপে উঠে সর্বশরীর! নিমিষেই তীব্র ঠান্ডা অনুভব ছড়িয়ে পড়ছে শিরা-উপশিরায়। খানিকটা ভীত ও ক্লান্ত ছাপ পড়ছে চোখে,মুখে। দুর্বল ঠেকছে খুব। গোসলটা করে বের হতে পারবে তো? দ্বিতীয়বার আর ঠান্ডা পানি ছোঁয়ার সাহস পেল না রিধি। গিজারের সাহায্যে পানি গরম করে নিল। মাথাব্যথা কমানো,ক্লান্তভাব,মুখের ফোলা ভাব,নাকের সর্দি ইত্যাদিতে দারুন কাজ করে কুসুম গরম পানি। অকারণে উদ্বিগ্নবোধ দূর করতেও রিধি প্রায়শই গরম পানি ব্যবহার করে। এতে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়,শরীরের লোমকূপ খুলে দেয়। ফলে শরীর আরামবোধ করে,কোমল ও মোলায়েম থাকে। তবে এটা দৈনিক রুটিনে থাকলে ক্ষতি।

গোসল শেষে চুল শুকিয়ে নেয় রিধি। হাতে,পায়ে দামী প্রসাধনী মেখে হালকা বেগুনি রঙের জামদানি শাড়ি পরে নিল। গয়না পরতে পরতে আয়নায় নিজেকে পরখ করে দেখছে। চোখের চারপাশের ফোলা ভাবটা কেটে গিয়েছে,কিন্তু কালচে ভাবটা এখনও স্পষ্ট! কী করে দূর করবে? খানিকটা সময় ভাবনায় কাটাল রিধি। ভাবনার মধ্যেই তার চোখ দুটো টলমল বিলে রূপান্তর হলো। অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ার পূর্বেই চোখের এক কোণে টিস্যু চেপে ধরল। তারপর শুরু হলো চেহারায় কৃত্রিম সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার সাজ।

হৃদ্য রুমে ঢুকে শুরুতেই কিছু বলল না। বেশ সময় নিয়ে আপুকে খুঁটিয়ে দেখল। পরিশেষে সন্দেহি সুরে বলল,

“তোর কি নিজের সৌন্দর্যের উপর সন্দেহ আছে,আপু?”

হৃদ্যের প্রশ্নে আড়চোখে তাকাল রিধি। প্রতিত্তোরে নীরব থেকে পুনরায় নিজের সাজে মনোযোগ দিল। হৃদ্য নিজ থেকেই আবার বলল,

“এত সাজছিস কেন? ওরা তো তোকে দেখতে আসছে,বিয়ে করতে নয়।”

রিধি ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিক মাখতে মাখতে বলল,

“রঙটা ঠিক আছে তো? শাড়ির সাথে মিলেছে?”

হৃদ্য বিরক্ত নিয়ে তাকাল রিধির দিকে। বিছানায় বসে চড়া গলায় বলল,

“তুই না সিভিল সার্ভিসের ক্যাডার হবি? জেলা প্রশাসক হয়ে রাস্তার পাশে মূত্র ত্যাগ করা গর্বিত পুরুষদের পেছনে লাঠি চার্জের কঠিন আদেশ জারি করবি? যেখানে-সেখানে থুতু ফেলা খচ্চর মানুষগুলোর জিহ্বায় গুড়োমরিচ লাগিয়ে দিবি? খাদ্যের..”
“আইলেনারটা ঠিক আছে? চোখ টানা লাগছে তো? ঠিক করে দেখে বল তো কোন চোখটা সাজানো বেশি সুন্দর হয়েছে?”

মোটা স্বরের ভাষণে ব্যাঘাত ঘটানো আপুর দিকে রাগ চোখে তাকাল হৃদ্য। কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে বলল,

“কী হয়েছে আপু? আমরা কি তোকে কষ্ট দিয়েছি? হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছিস যে?”

রিধির চোখের শূভ্র অংশজুড়ে রঙহীন পূর্ণ অনুভূতিময় পানির আভাস ঘটেছে। বুকের কোথাও একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করছে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখের কোণে টিস্যু চেপে ধরে বলল,

“দুটোই খারাপ হয়েছে। শুধু তোর জন্য। সাজার সময় বিরক্ত না করলে হতো না? যা এখান থেকে। আমাকে আবার প্রথম থেকে সাজতে হবে।”

রিধির নরম স্বরের হুকুমটি মানতে পারছে না হৃদ্য। সে গম্ভীর মুখ করে বসে রইল। রিধি ফেসওয়াশটা হাতে নিয়ে কঠিন স্বরে বলল,

“এখনও বসে আছিস যে? যেতে বলেছি না?”

হৃদ্য এ পর্যায়ে উঠে দাঁড়াল। সামনে এক পা ফেলে নরম গলায় বলল,

“আমার আপুর কাজলবরণ চোখ। সেখানে কয়লা দিয়ে বানানো কাজল রেখার প্রয়োজন নেই।”

হৃদ্য চলে যেতে তিন নাম্বার টিস্যুটাও জলে ভিজে গেল। অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করল রিধি। গভীর নিশ্বাস টেনে কপালে কালো টিপ পরল। ফোনের সামনের ক্যামেরা অন করে একটি ছবি তুলল। তারপর মেসেঞ্জারে ঢুকে পড়ে। ইনবক্সের সবার উপরে থাকা ‘নীরব পাখি’ নামক আইডিতে ছবিটা সেন্ড করে নিচে লিখল,’ কেমন লাগছে? পাত্রের পছন্দ হবে তো? আমি তো ভেবেই রেখেছি,সে হু বললেই আমি কবুল বলে ফেলব। ভাবনাটা কেমন?’

মেসেজ সিন হলো সাথে সাথে। কিন্তু রিপলাই এলো পুরো আঠারো মিনিট বাদে। ছোট্ট করে লিখেছে,’টিপটা বাঁকা হয়েছে। ঠিক করে নিও।’

রিধি ফুঁপিয়ে উঠল। মোবাইলটা ছুঁড়ে মারল বিছানায়। এক টানে শাড়ির আঁচল খুলে ফেলল। কাঁধের দিকের সেফটিপিন আলগা হয়ে নরম চামড়ায় ফুঁড়ে গেল। লাল রক্ত বেগুনি ব্লাউজে কালো বৃত্ত তৈরি করল।

_______________________________

চিন্তিত হৃদ্য নিজের রুমে প্রবেশ করতে পায়ের তলায় ধারালো কিছু ঢুকে গেল। অজান্তেই গলা থেকে আহত ধ্বনি বেরিয়ে আসে। চোখ পড়ে মেঝেতে। তার বিছানার পাশের টেবিলে থাকা গ্লাসটা নিচে ভেঙে পড়ে আছে। কাঁচের টুকরোর পাশেই মাঝারি আকারের নুড়ি পাথর। হৃদ্য আহত পা নিয়েই বারান্দার দিকে অগ্রসর হয়। বারান্দায় প্রবেশের দরজার কাছে কাগজ মোড়ানো বলের মতো কিছু দেখতে পেল। সে সময় ব্যয় করে না। সেটি তুলে নেয়। লেখায় চোখ পড়তে সেখানে ভ্রমরের মুখটি ভেসে ওঠে। হৃদ্যের ঠোঁটে হাসি ফুটে। বারান্দায় রেলিংয়ের কাছ ঘেষে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ ভ্রমরদের বারান্দার দিকে তাকিয়ে থেকে চাপাস্বরে ডাকে,

“পুচকি?”

বিপরীত দিক থেকে কোনো সাড়া এলো না। হৃদ্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। পুনরায় কিছু বলার জন্য উদ্যত হতে ভারি শব্দ হলো। হৃদ্য হতভম্ব! ভ্রমর বারান্দায় প্রবেশের দরজাটা লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেন? সে কি কোনো ভুল করল?

চলবে

[গল্পের নতুন পর্ব একদিন পর পর দেওয়া হবে। রাত নয়টার পর।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here