গল্প: প্রিয় পরিনতি!
পর্ব: ১২!
লেখক: তানভীর তুহিন!
তামান্না যাবার আগেই আবিদ বেহুশ হয়ে যায়। কারন ওরকম হাইডোজের ড্রাগস আর সাথে দুই বোতল মদ এর নেশা আবিদের শরীর নিতে পারে নী।কারন আবিদ এসব কখনও ধরে নী।শুধু সিগারেটেই সীমাবদ্ধ থাকতো ওর নেশা। আর আবিদ খুনাক্ষরে টের ও পায় নী ওই সিরিঞ্জে এমন হাইডোজের ড্রাগ থাকবে। ও বুঝেছিলো ঘুমের জন্য কোনো কিছু হবে হয়তো তাই বডিতে ইনজেক্ট করে নিয়েছিলো। এদিকে তামান্না আবিদের দড়জা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে কিন্তু ওপাশ থেকে সব নিস্তব্ধ। তামান্নার কিছুই মাথায় ঢুকছে না। বারবার শুধু আত্মহত্যার কথা মাথায় আসছিলো কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?আবিদ যথেষ্ট শক্ত মনের মানুষ, ও তো এতো সেন্টিমেন্টাল না!
তামান্না ইসুকে দিয়ে নিচ থেকে দাড়োয়ান ডাকালো।আর দাড়োয়ানকে দিয়েই দরজা ভাঙানো হলো। রুমে ঢুকেই আবিদকে দেখতে পেলো ফ্লোরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। রিনা বেগম আবিদ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো।তামান্না রুমে এগিয়েই দেখতে পেলো দুটো মদের বোতল পড়ে আছে। কিন্তু মদ খেয়ে তো এতো তাড়াতাড়ি বেহুশ হবে না। তাহলে কী স্লিপিং পীল খেয়েছে? চারপাশটা দেখলো কিন্তু স্লিপিং পীলের কোনো খোসা দেখতে পেলো না। ইসু আর তামান্না মিলে আবিদকে খাটে শোয়ালো। তারপর তামান্না ডাক্তার ফোন দিলো। এই ডাক্তার ওদের দুই ফ্যামিলিকেই ভালোভাবে চেনে। আর আবিদের বাবা রাশেদ তালুকদারেরও খুব ভালো বন্ধু। তামান্না সব খুলে বলাতে ডাক্তার সাহেব কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন।ডাক্তার তামান্নাকে বলে, ” শোনো আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি। আর ওর শরীর কী ঘামছে? ”
– ” হ্যা আঙ্কেল। প্রচুর ঘামছে! ”
– ” ফ্যানটা হাইস্পিডে ছেড়ে দিয়ে। ওর পাগুলো ম্যাসাজ করতে থাকো। আমি আসছি! ”
তামান্না ডাক্তারের কথা অনুযায়ী ফ্যান ছেড়ে আবিদের পাগুলো ম্যাসাজ করতে থাকলো।
প্রায় ১০ মিনিট পর ডাক্তার সাহেব এলো সাথে দুজন কম্পাউন্ডার নিয়ে। রিনা বেগম সাথে দুজন কম্পাউন্ডার দেখে আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লেন, ” ভাই আবিদের যাতে কিছু না হয়। ওর মারাত্মক কিছু হলে হসপিটালে নিয়ে চলুন! ”
– ” ভাবি আমায় একটু দেখতে দিন! ”
ডাক্তার আবিদের নার্ভ চেক করতে গিয়ে দেখলো কিছুটা যায়গা ফুলে আছে। তারমানে আবিদ শরীরে কিছু ইনজেক্ট করিয়েছে তার সাথে দুই বোতল মদ খেয়েছে? ডাক্তার তাড়াতাড়ি একটা পাইপ এর মতো নল বের করলো। আর রিনা বেগমকে বললো ভাবি বড় একটা গামলা নিয়ে আসুন। রিনা বেগম দৌড়ে গামলা আনতে চলে গেলো। তারপর ডাক্তার আবিদকে একটা ইনজেকশন পুশ করালো যার ফলে ওই ড্রাগসের প্রভাব মাত্রাটা কমে আসবে।ডাক্তার আগে থেকেই এমন কিছুটা সন্দেহ করেছিলো তাই ল্যাব থেকে আসার সময় এসেন্সিয়াল এক্সারসরিজ নিয়ে এসেছিলো। রিনা বেগম গামলা নিয়ে আসতেই। ডাক্তার সাহেব কম্পাউন্ডারদের সাহায্যে আবিদকে আধশোয়া করে গ্লাভস পড়ে আবিদের মুখের মধ্যে থেকে গলা অবধি পাইপটা নামিয়ে পাম্প করে। ফলে আবিদ বমি করে দেয়। তারপর ডাক্তার সাহেব রিনা বেগমকে বলে, ” ভাবি দুইটা লেবু চিপে নিয়ে আসেন। কোনো পানি মিশাবেন না! ”
একটুবাদে রিনা বেগম লেবুর রস নিয়ে আসে। ডাক্তার আবিদের মুখ চেপে চেপে প্রায় অর্ধেক গ্লাস লেবুর রস ভেতরে ঢোকাতে সক্ষম হয়। রিনা বেগম বলে উঠে, ” ভাই এসব বাসায় না করে হসপিটালে নিয়ে চলুন! ”
– ” না ভাবি। আবিদকে হসপিটালে নেওয়া যাবে না। তাহলে রাশেদের মান-সম্মান নষ্ট হবে। আর আমি আমার বন্ধু রাশেদকে যতটুকু চিনি ও মানতে পারবে না যে ওর ছেলে ড্রাগস নিয়েছে। শুধু শুধু আবিদ আর ওর বাবার এতো ভালো সম্পর্কটা নষ্ট করবেন না। রাশেদকে আজকে রাতের ব্যাপারে কিছু বলার প্রয়োজন ই নেই! ”
ড্রাগসের কথা শুনে তামান্না,ইসু,রিনা বেগম যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। আবিদ আর ড্রাগস?
– ” ওর আব্বুতো কাজের জন্য শহরের বাইরে গেছে। তিনদিনবাদে আসবে। আমি কিছু বলবো না কিন্তু ওর মারাত্মক কিছু হয় নী তো?
– ” হয় নী তবে হতে পারতো। যদি ওই ড্রাগসটা আবিদের শরীরে আরো প্রভাব ফেলতো। কারন ও ড্রাগ এডিক্ট না তো তাই ওর নার্ভসগুলো অতোটা ড্রাগস নিতে পারে নী তার উপরে দুই বোতল মদ। ধীরে ধীরে ওর নার্ভসগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিতো, কিছু নার্ভস বাজে ভাবে ড্যামেজড হতো। ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করতো। কিন্তু এখন চিন্তার কোনো কারন নেই দুই-তিন ঘন্টার মধ্যে আবিদের সেন্স আসবে। আর এই ড্রাগসের ব্যাপার বাইরে যাতে না যায়। পুলিশ কেস হয়ে যাবে যেটা ওর বাবা আর ওর মান-সম্মান নষ্ট করে দিবে! ”
– ” আচ্ছা! ”
– ” কিন্তু আবিদ আজ ড্রাগস আর এলকোহল কেনো নিলো? ”
পাশ থেকে তামান্না সংক্ষিপ্ত করে সবটা বলল!
– ” শুনুন ভাবি। আবিদ যে ড্রাগসগা নিয়েছে সেটা মোস্ট এডিক্টিভ একটা ড্রাগ খেয়াল রাখবেন যাতে ও এটা আর না নিতে পারে। সমস্যাটা ওর ব্যাক্তিগত তাই আমি মাঝে ঢুকছি না। ওর শরীর মদ সহ্য করতে পারলেও এই ড্রাগস দ্বিতীয়বার সহ্য করবে না।আমি চলে যাচ্ছি। ওর হুশ এলে বাকি লেবুর রসটা খায়িয়ে দিয়েন! ”
– ” আচ্ছা ভাই। থ্যাংকস এতো রাতে কষ্ট করলেন! ”
– ” আবিদকে সেই ছোটোবেলা থেকে দেখছি মারা-মারি করে, রাগ বেশি সেটা জানতাম। কিন্তু এসব কী ভাবি? নিজের ক্ষতি করছে ও একটু নজর দিবেন প্লিয। আবিদের কিছু হয়ে গেলে রাশেদ বাচবে না ভাবি! ”
– ” আমি খেয়াল রাখবো ভাই! ”
তামান্না ডাক্তারকে লিফট অবধি দিয়ে গেলো।যাবার সময় মেঘকে ফোন দিলো। মেঘ বারান্দায় চুপ-চাপ বসে ছিলো। এখন আর কান্না আসছে না। সন্ধ্যা থেকে এতো কাদায় হয়তো চোখে আর পানিই নেই। তামান্না ফোনে সব খুলে বলার পরেই মেঘ পাগলের মতো বলা শুরু করলো, ” আমি আবিদকে দেখতে আসি? ”
– ” আবিদ এখন ঠিক আছে। কিন্তু তুই আসবি ও যদি জানে আরো রেগে যাবে। তারপর কীভাবে সামলাবো? জানিস তো ও রাগ পুষে রাখে। এদিকটা সামলিয়ে নেই। আমি কথাদিচ্ছি সব স্বাভাবিক করে দিবো শুধু কয়েকটা দিন টাইম দে আমায়!”
মেঘ ফোনটা ফ্লোরে রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে এই সকালবেলাও আবিদ কত ভালোভাবে কথা বলছিলো। সেই আবিদই এখন বলছে ওর জীবনে মেঘ নামের কারো অস্তিত্ব নেই। আসলেই প্রেম ক্ষেত্রে সবকিছুই হঠাৎ, অনিশ্চিত, অকারন, অনাকাঙ্ক্ষিত!!!
রাতুল খাওয়ার সময় মেঘকে ডাকতে এলো। মেঘ বলে দিলো সে খাবে না। রাতুল ও চিৎকার করে বললো ভুল স্বিদ্ধান্তের মাশুল দে বসে বসে। মেঘ কর্ণপাত করলো না।
রাত প্রায় তিনিটার দিকে আবিদ হুশে এলো। মাথাটা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি পাচ্ছে না আবিদ। মাথা ঘুরছে, চোখ ঝাপসা এমনকি শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তারের কথা অনুযায়ি রিনা বেগম আবিদকে লেবুর রস খাওয়ানো শুরু করলো। আবিদ মুখ থেকে ফেলে দিলো। দৃষ্টির ঝাপসাভাব কাটতেই আবিদ খেয়াল করলো সবাই কাদছে। আবিদ জিজ্ঞেস করলো, ” কাদছো কেনো তোমরা? ”
তামান্না কাদতে কাদতেই জিজ্ঞেস করলো, ” আবিদ তুই ড্রাগস কীভাবে নিতে পারলি? ” কথাটা শোনা মাত্রই আবিদের কান খাড়া হয়ে গেলো। নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছিলো না আবিদ। তারমানে ওই সিরিঞ্জে ড্রাগ ছিলো কোনো ঘুমের ঔষধ না। আবিদ ওর মাকে এদিকে ডাকলো, ” বিশ্বাস করো আম্মু। আমি জানতাম না ওটা ড্রাগ ছিলো। আমার প্রচুর রাগ হচ্ছিলো, সন্ধ্যার কথাগুলো মনে পড়তেই খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই একটু ঘুমাতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু ওটা ড্রাগস ছিলো আমি বুঝি নী। বাবা কী জানে এসব? বাবা কোথায়?”
– ” তোর বাবা বিকালেই শহরের বাইরে গেছে কেউ ওনাকে কিছু বলে নী আর তুই ও কোনোদিন বলিস না। নিতে পারবে না মানুষটা। তোর ডাক্তার আঙ্কেল আসছিলো উনি সব দেখে গেছেন। কী প্রয়োজন ছিলো এসবের আবিদ? ”
– ” মা আমি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাই না! ”
রিনা বেগম কাদতে কাদতে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।সাথে ইসুও রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তামান্না আবিদকে নিয়ে ছাদে এসেছে।তামান্না বলা শুরু করলো,” মেঘ বুঝতে পারে নী। খুব কাদছিলো মেয়েটা। তুই ওর সাথে সব মিটিয়ে নে। ওর ভাইকে ম্যানেজ আমি করবো!”
– ” ওর ভাই আমায় কী বলেছিলো আমার এখন ঠিক মনেও নেই। কারন উনি আমার জন্য আউটসাইডার ছিলেন। আর ভুল বুঝেই সবটা বলেছিলেন এখানে ওনার কোনো দোষ নেই। কিন্তু মেঘ? মেঘ তো আমায় চিনতো নাকি? তারপরেও এসব কীভাবে বলতে পারে? চিৎকার করে বলছিলো যে আমাদের সম্পর্ক নাকি শেষ হয়ে গেছে আর সেজন্য নাকি সব দ্বায় আমার। ”
– ” দেখ ওর মাথা ঠিক ছিলো না! ”
– ” আমার মাথা সম্পূর্ন ঠিক আছে। আসলে তফাৎটা কোথায় জানিস? ও চিৎকার দিয়ে কাদতে পারছে। কিন্তু সেটা আমি পারছি না। আমি এখন ঠিক আছি। এই সাড়ে তিনবছরে এমন একটা দিনও আসে নী যেদিন আমার মনে হয়েছে যে স্বম্পর্কে একঘেয়েভাব এসেছে। আজও মনে হচ্ছে না। কিন্তু ওর এভাবে আমায় বলা উচিৎ হয় নী। এটা কথার কথা নয় যে, ” আমি ওকে ছাড়া বাচবো না! ” এটা নির্মম সত্য।তাই ওকে ছাড়তে পারবো না। কিন্তু কিছুটাদিন দূড়ে থাকুক একটু কষ্ট পাবার প্রয়োজন আছে কারন আমিও পেয়েছি। যেটা প্রকাশের অধিকারই নেই আমার। কারন আমি ছেলে। আমি যদি এখন তোর সামনে কান্না করি তাহলে সেটা তোর কাছে অবাস্তব আর অকারন মনে হবে। বাসায় চিৎকার দিয়ে কাদবো? আমায় সেন্টিমেন্টাল ভাববে। বাইরে কাদবো? মানুষ ছ্যাকাখোর ভাববে। কিন্তু কী করবো বল? কাদতে একটু ইচ্ছে করছে কিন্তু কাদার উপায়ই নেই। তাই ওই কাদুক আমি বরং কিছুটাদিন চুপ থাকি। এতোদিন সব ঝামেলা ঝগড়া আমি ক্রিয়েট করেছি আমি মিটিয়ে নিয়েছি। কিন্তু এখানে আমার দোষ ছিলো না তাই মিটিয়ে নেবার দ্বায় আমার না।সব দ্বায় সময়ের কাছেই দিয়ে দিলাম সময়ই নিজের সময় মতো সব ঠিক করে দিবে। আমার একথাগুলো তোর কাছে কেমন মনে হচ্ছে আমি জানি না কিন্তু আমি এখন ওর সাথে কথা বলবো না। আর আমি তোকে এসব বলেছি যে এগুলো আশা করি তুই মেঘকে বলবি না!! কথাগুলো বলেই আবিদ ছাদ থেকে নেমে যায়। তামান্না আবিদের কথার কিছুই বুঝতে পারে না। যেই আবিদ সব জিনিস সহজ ভাবে নিতো সেই আবিদই কঠিন করে ফেলছে সবটা ইচ্ছে করে? কিন্তু কেনো?
পরের দিন তামান্না মেঘকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয় দেয় যে আবিদকে কিছুটাদিন সময় দাও। এখন ওর সাথে তুমি কথা বললে আরও জটিল হয়ে যাবে সবটা তাই ওর রাগটা নামতে দাও।মেঘও মেনে নেয় সবটা। মেনে নেয় সবটা নিজের শাস্তি হিসেবে!
কেটে গেছে সাতদিন……..
রাতুল মেঘের রুমে এসেছে, ” মেঘ তুই যেভাবে জীবন যাপন করেছিস। এভাবে একটা মানুষ বাচতে পারে না! ”
– ” প্রেম করে বিয়ে হয়ে গেছে তো তোমার। তাই এই কষ্টটা তুমি বুঝতে পারবে না ভাইয়া। আমি এখন এডাল্ট, টিনেজ নই যে আবেগের বশে এসব করবো। ”
– ” তোর এসব শোনার ফালতু টাইম নেই। কারন তোর কথা শোনা মানে ওই ফালতু ছেলেটার কথা শোনা! ”
মেঘ কর্ণপাত করলো না!!
– ” শোন আমার হসপিটালের জুনিয়র ডাক্তার আদনান। ও যথেষ্ট ভদ্র আর সামাজিক। আমার মতে ও তোর জন্য উপযুক্ত। ওর সাথে তোর বিয়ে দিতে চাই আমি! ”
চলবে!
#thetanvirtuhin