প্রিয় পরিণতি পর্ব ১১

গল্প: প্রিয় পরিনতি!
পর্ব: ১১!
লেখক: তানভীর তুহিন!

আবিদ বাইক চালাচ্ছে বেপড়োয়া ভাবে। চোখগুলো লাল হয়ে আছে। পানিও গড়িয়ে পড়ছে চোখ বেয়ে। ঠোটের কোনে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। বরাবরের মতো পারদর্শিতার সাথে ধোয়া ত্যাগ করছে আবিদ। বাইকটা একটা মদের দোকানের সামনে থামালো। দোকানে ঢুকে বললো “তিন বোতল উইস্কি দিন!”
তিন বোতল উইস্কি প্যাক করে দেওয়া হলো। আবিদ প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দিতেই খেয়াল হলো মানিব্যাগটা আসলে কোথায়। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসলো। বাইক চালিয়ে সোজা বাসার পার্কিং-এ চলে আসলো। বাইক পার্ক না করেই বাইকটা ধুম করে ফেলে দিলো। ফলে বাইকের লুকিং গ্লাসগুলো ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো। লিফট থেকে নেমে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বাসার কলিংবেল চাপলো। রিনা বেগম এসে দরজা খুললো। ছেলেকে দেখেই বুঝতে পারছে যে ছেলে মোটেই স্বাভাবিক নয়। চুলগুলো এলোমেলো, ঘেমে নেয়ে গেছে, চোখ রক্তবর্ন, শার্টের ইন খোলা, আর গায়ে কোর্ট ও নেই। রিনা বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, ” কীরে আবিদ তোর এই অবস্থা কেনো? ”
– ” আমার রুমের দরজায় আমি যাতে একটা টোকার শব্দও না পাই! ” কথাটা বলেই আবিদ তার রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। রিনা বেগম কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করলেন!
– ” আবিদ কী হয়েছে? ”
– ” আমায় একা ছেড়ে দাও! ”

কথাটা বলেই আবিদ রুমে ঢুকে সজোরে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। রিনা বেগম ভালো করেই জানে যে তার ছেলে এখন ঠিক কতটা রেগে আছে। কিন্তু আবিদ এভাবে রেগে গেলো কেনো? এখন তো ডাকাও যাবে না। ঘর ভাঙচুর করা শুরু করবে তাহলে। রিনা বেগম নিরুপায় হয়ে চিন্তা আর মনে একটা স্পষ্ট প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়েই সংসারের কাজে মন দিলেন।

আবিদ রুমে ঢুকেই সামনের দেওয়ালে নিজের একটা হাসিমুখের ছবি দেখতে পেলো। পাশে একটা ফুলের টব ছিলো। ফুলের টবটা ছুড়ে মারলো ছবিটার দিকে। মুহুর্তেই ফুলের টবটা আর বাধানো ছবির কাচ, ফ্রেম গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো। খুব কষ্ট হচ্ছে আবিদের। কখনও আবিদের এরকম কষ্ট হয় নী। মেঘ কীভাবে পারলো এভাবে বলতে? একটাবার বোঝার চেষ্টা করলো না? ও আমায় বলছিলো যে আমার দায়িত্বহীনতার কারনে ওর ভাই এরকম করেছে! আবিদ আর ভাবতে পারে না। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে টানা শুরু করে। নিচে বসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ধোয়া ছাড়তে থাকে।

মেঘ কোনো মতে বাসায় এসেছে। মেঘের পা দুটো থরথর করে কাপছে। নিজেকে রুমে বন্ধ করে নিয়ে চিৎকার করে কেদে ফেললো মেঘ। ” এতোদিন ধৈর্য্য ধরে। আজ কেনো অকারনেই ধৈর্য্যহারা হয়ে গেলি? ” মেঘের চিৎকার শুনে ওর মা দৌড়ে এসে ওর দড়জায় ধাক্কা দিতে দিতে বলে, ” এই মেঘ কী হইসে? কাদছিস কেনো? দরজা খোল মেঘ! ” মেঘ কাদতে কাদতেই বলে, ” একটু একা থাকতে দাও মা! ”
– ” কী হইসে? কাদছিস কেনো? কী হইসে ক্যাফেতে রাতুল তোকে কিছু বলছে? ”
– ” মা প্লিয আমায় একটু একা ছাড়ো! ” কথাটা বলেই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকে মেঘ। মেঘের মা আর কিছুই খুজে পায় না বলার জন্য। তাই এই আশা নিয়েই চলে যায় যে কাদা শেষ করে হয়তো কিছু বলবে। মেঘ অনবরত কেদে যাচ্ছে। আর ভাবছে কীভাবে করতে পারলো সে এটা? শুধু একটাবার ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেই হতো যে সকালে কী হইছিলো? সেটা না করে কী করলাম এটা আমি? কথাগুলো ভাবতেই মেঘের আত্মাটা চিৎকার করে উঠছে। কী করলো এটা? মেঘ কান্না করতে করতেই তামান্নাকে ফোন দেয়!

তামান্না বসে বসে নুডুলস খাচ্ছিলো। মেঘ ফোন দিতেই রিসিভ করে হতভম্ব হয়ে গেলো তামান্না। ওপাশ থেকে শুধুই ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে। কে কাদছে? অল্পকিছুতে কাদার মানুষ তো মেঘ না। তাহলে কী হলো?
– ” এই মেঘ। মেঘ কী হইছে? মেঘ! ” কথাগুলো বলতে বলতেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো তামান্না!

মেঘ চিৎকার দিয়ে কাদতে কাদতে বলছে, ” আপু সব শেষ আপু। আপু আবিদ… মেঘ কান্নায় ভেঙে পড়ে আর কিছুই বলতে পারে না। কারন আবিদ আর মেঘের মধ্যে ঝগড়া প্রচুর হয়েছে। কিন্তু তা কোনো বাইরের লোক কখনো জানে নী বড়জোর জানলে তামান্না,জুলফিকার কিংবা তন্বী জানছে। এমনকি ওরা দুজন দুজনকে কখনও অপমান করে কথা বলে নী। এমনকি এই তিনবছরে আবিদ কখনও তামান্নাদের সামনেও মেঘকে তুই করে বলে নী। কিন্তু আবিদ মেঘকে তুই করে বলতো। যখন রেগে যেতো, তা চ্যাটে,ফোনে কিংবা যখন শুধু দুজন একলা থাকতো তখনই। আর সেই আবিদ আজ ভরা ক্যাফেতে মেঘের সাথে এভাবে কথা বলেছে মানে আবিদ আসলেই খুব কষ্ট পেয়েছে। মেঘ কান্নাটা কিছু নিয়ন্ত্রনে এনে কিছু না লুকিয়ে সবটা নিরপেক্ষভাবে বলে তামান্নার কাছে। তামান্না এটা শুনেই পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে মাকে বলে, ” আমি আবিদদের বাসায় যাচ্ছি। ফিরতে দেড়ী হবে! “। তারপর মেঘকে বলে,” কী করেছিস এসব? আবিদকে এতটুকুও চিনিস না নাকি? ”
– ” আপু আমার হুশ ছিলো না। আমি মেনে নিতেই পারছিলাম না যে আমার ভাইয়া এভাবে না বলে চলে যাবে! ”
– ” শোন তুই যেভাবেই হোক আবিদের সাথে এখন ফোনে কথা বল! ”
– ” আপু ও রেগে ফোনটা ক্যাফেতেই ভেঙে চলে গেছে! ”
– ” শোন আমি তোকে একটু বাদে ফোন দিচ্ছি। আমি অলরেডি গাড়িতে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। আমি ইশুর সাথে কথা বলে জানাচ্ছি তোকে! ”
– ” আচ্ছা আপু! ”

ফোনটা রাখতেই যেনো মেঘের কান্না বেড়ে যায়। কেদেই যাচ্ছে মেঘ কিছুতেই মানতে পারছে না যে ওদের সম্পর্কে এ দিনটাও দেখার বাকি ছিলো!!

তামান্না ইসুর ফোনে ফোন দিলো।
– ” হ্যালো ইশু আবিদ কই রে? ”
– ” ভাইয়া তো একটু আগে বের হইছে। এই প্রায় আধাঘন্টা হবে! ”
– ” কি বলিস? কোথায় গেছে জানিস? ”
– ” না কিন্তু ভাইয়াকে স্বাভাবিক লাগছিলো না। আমি ডাকলাম শুনলো না! ”
– ” শোন মেঘ আর আবিদের মধ্যে খুব বড় ঝগড়া হইসে। আবিদ বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই তুই মেঘকে ফোন দিয়ে আবিদের কাছে দিবি। ঠিক আছে! ”
– ” কীহ? কিসের ঝগড়া? ”
– ” এতোকিছু বলার টাইম নাই। তোকে যেটা বললাম সেটা কর। আমি তোদের বাসায় আসতেছি বাকিটা এসে বলবো! ”
– ” আচ্ছা ঠিকাছে! ”

তামান্না মেঘকে ফোন দিয়ে বললো যে আবিদ বাসায় নেই। বাসায় এলেই ইসু ফোন দিয়ে আবিদের কাছে দিবে। তখন যাতে মেঘ আবিদের সাথে কথা বলে আবিদকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে।মেঘ শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলো, ” বাসায় নেই মানে? কোথায় গেছে? ”
– ” দেখ আমিও জানি না। তুই বরং অপেক্ষা কর বোন। আমি তোর পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছি। দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করিস না! ”
– ” খোদা যাতে সবটা ঠিক করে দেয় আপু! আর সহ্য হচ্ছে না! ”

আবিদ ওর একটা বন্ধু ড্রাগস রাখে তার কাছেই এসেছে। এসে বললো, ” খুব কষ্ট আর রাগ হচ্ছে। জেগে থাকলে নিজেকেই খুন করে ফেলবো। প্রচুর ঘুমানোর মতো কিছু একটা দে! “। ওর বন্ধু একটা সিরিঞ্জ লোড করে দিয়ে বললো,” নে বাসায় যেয়ে মেরে নিস এটা। শান্তির ঘুম হবে! ”
– ” আমি এসব মারতে পারি না। তুই ই মেরে দে! ”
– ” দেখ গা কাপবে কিন্তু বাসায় যেতে পারবি তো? ”
– ” কলিজা কাপছে আমার।তুই মার! ”

হাইডোজের একটা ড্রাগস নিজের রক্ত মিশিয়ে মদের দোকানে গেলো আবিদ। ড্রাগস ওর জেগে থাকার উপরে আয়ত্ত করে নিয়েছে। দৃষ্টি কিছুটা আবছা লাগছে। বাসা থেকে বের হবার সময় মদ কেনার জন্য টাকা নিয়ে এসেছে। দুই বোতল উইস্কি নিয়ে বাসায় এলো আবিদ। কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই ইসু মেঘের কাছে ফোন দিলো। ইসুর নাম্বার দেখেই মেঘ ফোন রিসিভ করে পাগলের মতো বলা শুরু করলো, ” আবিদ ভুল হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারি নাই। আমি হুশেই ছিলাম না। মাফ করে দাও প্লিয আবিদ! এই আবিদ! ”
– ” ভাবি আমি ইশু। ভাইয়া আসছে মনে হয় আমি দিচ্ছি দাড়াও! ”

ইসু দড়জা খুলে দেখলো আবিদ এসেছে। একদম বদ্ধ উন্মাদ লাগছে আবিদকে। ইসু ফোনটা আবিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ” ভাইয়া নে ধর মেঘ ভাবি ফোন করছে। কান্না করতেছে খুব! ”
– ” কে মেঘ? আমি মেঘ নামের কাউকে চিনি না। আমার জীবনে মেঘ নামের কারো অস্তিত্ব নেই। এর পর থেকে এই বাসায় যে মেঘের নাম তুলবে তাকে ক্ষুন করবো আমি! ” চিৎকার দিয়ে কথাগুলো বলে উঠে আবিদ। আসলে ওই হাইডোজের ড্রাগসের ফলে আবিদের হিতাহিত জ্ঞানই নেই। আবিদের এমন রুপ দেখে ভীষন ভয় পেয়ে যায় ইসু। আর ফোনের ওপাশ থেকে আবিদের মুখে এই কঠোর কথাগুলো শুনে মেঘের কলিজাটা যেনো ছিড়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। চোখ বন্ধ করে ফেলে মেঘ চোখের পানিগুলো বেয়ে নিচে পড়ে যায়। ফোনটা পাশে রেখে কাদতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে মেঘ। এ কান্না যেনো থামবেই না। কি থেকে কী হয়ে গেলো? কেনো হলো এগুলো? আবিদ আমি পারবো না তোমায় ছাড়া বাচতে! আবিদ আমি পারবো না তোমায় ছাড়া নিজের জীবন সাজাতে! চিৎকার দিয়ে কেদে ফেলে মেঘ!

আবিদ রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মদের বোতলের ছিপি খুলে বোতলে চুমুক দেয়। পানি আর সোডা মেশানো ছাড়া মদগুলো ঢক ঢক করে গিলতে থাকে আবিদ। ঝাঝে গলাটা ছিলে যাচ্ছিলো আবিদের, মদের ঝাঝে কপালে ভাজ পড়ে গেছে কিন্তু আবিদ থামলো না। উন্মাদের মতো দু বোতল মদই শেষ করায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। উদ্দেশ্য একটাই মদ খেয়ে ঘুমিয়ে গেলে আর কষ্ট হবে না।

এদিকে তামান্না জ্যামে আটকে যাওয়ায় আবিদদের বাসায় পৌছাতে লেট হয়ে যায়। রাস্তায় মেঘের কাছে ফোন দিয়ে জানতে পারে যে আবিদ কী কী বলেছে মেঘকে নিয়ে। তামান্না মেঘকে আশ্বস্ত করে যে সে সব ঠিক করে দিবে। তামান্না আবিদদের বাসায় যখন পৌছায় তখন আবিদের শরীরে একটা হাইডোজের ড্রাগ লিকুইড, আর দু বোতল মদ দৌড়াচ্ছিলো। আসলে তামান্না আবিদের বাসায় যেতে বড্ড দেড়ি করে ফেলে।।

চলবে!
#thetanvirtuhin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here