প্রেমের খেয়া পর্ব ১৩+১৪

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_১৩

সূর্য ঠিক মাথার উপরে। দুপুর ১১টা কি ১২টার পথে ক্লান্ত ঘড়ি। মায়া পুরো তন্দ্রানিবাস ঘুরে ঘুরে দেখছে। তন্দ্রানিবাস এর সামনে বিশাল মাঠ। বাচ্চাদের খেলা করার জায়গা। চারপাশে নানান রকম ফলের গাছ। বাচ্চারা যেখানে খেলা করে সেখানে ছোট ছোট দুর্বা ঘাস। শুধু হাটার রাস্তাতে ইট বিছানো। মাঝখানে গোল ঘাসের স্তুপ। আর চারপাশে রাস্তা। গাছের ছায়া তলে হাটছে মায়া। গরমে ক্লান্ত লাগলেও আশ্রম দেখে ভালোই লাগছে। সামরান কথা বলছিলো সেই সুযোগে মায়া চলে এলো। সামরানের এখনো দেখা নেই। এতক্ষণ কিসের কথা বলছে লোকটা। মায়ার বিরক্ত লাগছে। আনমনেই হাটছে মায়া। হঠাৎ হাতে টান পড়ে। মায়ার পদযুগল থেমে গেল। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো সামরান। মায়া সামনে ফিরতেই সামরান হাত ছেড়ে দিলো। দুহাত প্যান্ট এর পকেটে রেখে মৃদু হাসলো।

–কলেজ যাবেন না?

–আজ যাবো না। এমনিতেও এখন গিয়েও আর লাভ নেই। অন্যপাশে তাকিয়ে বলল মায়া।

–কেমন লাগলো আশ্রম?

–ভালোই!এটা কি আপনার?

— নাহ আমার না! আমি এত পূন্যের কাজ করি না।

সামরানের কথা শুনে মায়ার ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিল সামরান। মায়া সামরানের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল। কি সুন্দর চোখ সামরানের!
চোখের মণিগুলো বাদামী রঙের। একদম মায়ার স্কেচ এর মতো। কালো কুঁচকুচে ভ্রু জোড়া যেন সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ার নির্লজ্জের মত তাকিয়ে থাকে সামরানের দিকে। সামরান মায়ার দিকে তাকাতেই দেখলো মায়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে একটু এগিয়ে গেল সামরান। মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

–“এইভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি মানুষ থেকে চিলে পরিণত হবো”। সামরানের এহেন কথায় মায়া চমকে সামরানের দিকে তাকালো। সামরান হেসে সামনের দিকে পা বাড়ালো। মায়া সামরানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

— কি বললো উনি এটা? চিলে পরিণত হবে মানে?

মায়া সামরানের পেছনে ছুট লাগালো। সামরান গাড়িতে গিয়ে বসলো। মায়ার সাইডের দরজা খুলে পকেট থেকে ফোন বের করে মনোযোগ সহকারে ফোন দেখতে লাগলো।
মায়া গাড়িতে বসে সামরানের দিকে তাকালো।

–আপনি কি বললেন ওটা?

–কোনটা? ফোনের দিকে তাকিয়েই বলল সামরান।

–ওইযে চিল…সামরান মায়ার দিকে তাকালো। মায়া আর বলতে পারলো না। সামরান একটু পাশে এসে বসল।সামরান পাশে আসায় মায়া পিছিয়ে গেল। গাড়ির দরজার সাথে ঠেকে গেল মায়া। সামরান মৃদু হেসে বলল,

— আপনি অনেক ছোট,এত বড় কথা বুঝবেন না।

–আমি এএতোটাও ছছোট ননা। কাপাস্বরে বলল মায়া।

সামরান হেসে অন্যদিকে তাকালো। সামরানকে হাসতে দেখে মায়া আবারো ভ্রু কুঁচকালো। ইচ্ছে করছে সামরানের মুখে তালা লাগিয়ে দিতে। মায়াকে হাসতে নিষেধ করে নিজেই সবসময় প্রাণঘাতি হাসি দেয়। বুকের মধ্যে পাহাড় সমান সাহস নিয়ে মায়া বলেই ফেলল,

–আপনি কি সবসময় এভাবে হাসেন?

মায়ার কথায় সামরান মায়ার দিলে ফিরে তাকালো।

— কেন হাসা উচিৎ নাকি?

–না! হাসবেন না।

–হাসলে?

–হাসা পাপ!বলেই মায়া অন্যদিকে তাকালো।

সামরান এবার সশব্দে হাসলো।

ড্রয়িংরুমে বসে আছে সেলিনা মালিক। পাশেই সামাদ মালিক। সামাদ মালিকের হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে একটি ছবি। ছবিটির দিকে যতবার তাকাচ্ছে ততবার সেলিনা মালিকের মুখের হাসি প্রশস্ত হচ্ছে। হাসি মুখে সামাদ মালিকের দিলে তাকিয়ে বললেন,

–আমি যদি ভুল না হই, এই মেয়েটাই সে!যার জন্য আমার সামরানের মাঝে কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেছে।

–কি করতে চাইছো তুমি? সামাদ মালিক বুঝতে পারছেন না।

–কিছুনা। ছেলের বউ ঘরে তোলার উপযুক্ত সময় এটাই। বলেই হাসলো সেলিনা মালিক।

— মানেহ্?সামরান রাজি হবে?

— হবে! আমি নিজে ওকে বলবো।

–তাহলে আর দেরী কিসের? আজকেই তাহলে যাওয়া যাক।

— সন্ধ্যা নামার পালা।

In london**

সকাল ১০টা!! সিমি আর শেহেরজাদ London heathrow airport এ দাঁড়িয়ে আছে। সব কমপ্লিট করে দুজনে ফ্লাইট এ বসে পড়ে। ১১টার ফ্লাইট।

সিমির চোখ মুখে খুশির ছাপ স্পষ্ট। এই চার বছরে একমুহুর্তের জন্য ও শেহেরজাদ সিমিকে এত খুশি দেখেনি। আজ সিমির খুশি দেখে একদিকে যেমন ভালো লাগছে। অন্যদিকে এটা ভাবতেই শেহেরজাদের রুহ কেঁপে উঠলো যে,আজ পর্যন্ত তার প্রিয়তমার আপন হয়ে উঠতে পারেনি। সিটে মাথা এলিয়ে এক দৃষ্টিতে সিমির দিকে তাকিয়ে রইলো শেহেরজাদ।

— বাংলাদেশেই তুমি আটকে রইলে। তোমার বাংলাদেশের নেশা আমি কাটাতে পারিনি। আমি কি তোমার কেউ না সিমি? কই এত খুশি তো তুমি আগে হওনি। আমার কোনো কাজেই তোমাকে এত টা খুশি আমি হতে দেখিনি তাহলে আজ কেন? বাংলাদেশে গেলে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো না তো? সিমিকে হারিয়ে ফেলার কথা ভাবতেই শেহেরজাদের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। সাথে সাথে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। শেহেরজাদ মনস্থির করে নেয় সে বাংলাদেশ যাবেনা। কিন্তু অনেকটা দেরী হয়ে যায়। আকাশ পথে উড়ছে বিমান। এখন চাইলেও আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেকটা সময় ব্যয় করে ফেলেছে শেহেরজাদ। নিজের অস্থিরতা নিজের মাঝে চাপা দিয়ে সিটে বসে পড়লো ছেলেটি। সিটে মাথা এলিয়ে সিমির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বাংলাদেশ যাওয়ার খুশিতে এতোটাই বিভোর ছিলো যে,পাশে থাকা শেহেরজাদের ছটফটানি, অস্থিরতা সিমির নজরে পড়লো না। সিমির এহেন ভাব দেখে শেহেরজাদের ভয়ের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ কেমক দ্বারা ভুল করলো শেহেরজাদ? তবে কি সিমিকে সত্যিই হারিয়ে ফেলবে?

চোখ জোড়া বন্ধ করে শ্বাস নিতে থাকে শেহের। দম যেন আটকে আসছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি ঝাপ দিতে! কিন্তু উপায় নেই।

সন্ধ্যা ছুই ছুই। সূর্য ডুবে গেলেও এখনো ধরণী আবছা আলোই আলোকিত হয়ে আছে। মাগরিবের আযান পড়ছে চারদিকে। মায়া কোচিংএ গেছে এখনো আসেনি। ফিরতে ৭টা কি ৮টা বাজবে। নামাজ শেষ করে শেহনাজ জায়নামাজ ভাজ করে রাখে৷ হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। অসময়ে কলিংবেলের শব্দ শুনে শেহনাজ অবাক হলো। গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে দরজা খুলতেই দেখলো দুজন মধ্যবয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো স্বামী-স্ত্রী! একজনকে না চিনলেও অপরজন কে দেখে শেহনাজ অবাক হলো। তারই সিটির মেয়র সামাদ মালিক। কিন্তু তার ঘরে কেন এসেছে?

–আসসালামু আলাইকুম আপনারা?

— আমরা আপনার অপরিচত তবে পরিচিত হওয়ার জন্যই এসেছি। বলেই হাসলো সেলিনা মালিক।

–আসুন না ভেতরে আসুন। শেহনাজ সেলিনা মালিক আর সামাদ মালিক কে ড্রয়িংরুমে বসতে দেয়। সোফায় ভসে চারপাশটা একবার দেখে নিলো সেলিনা মালিক।
ড্রয়িংরুমটা ছোট। অত বড় না। তবে বেশ পরিপাটি। দেওয়ালে প্রজাপতি টাঙানো। আর রয়েছে প্রতিটি পর্দায় ফুল আর ঝুমকা । নিশ্চিত হাতের বানানো। পর্দা নড়াচড়া করলেই টুংটাং শব্দে মৃদু আওয়াজ তুলে পরিবেশকে মাতিয়ে তুলছে।

শেহনাজ ভেতরে গিয়ে আমীর কে জানালো। আমীর এসে সালাম দিলো।

–আসসালামু আলাইকুম। মেয়র সাহেব আপনি?

–ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেন আসতে পারিনা। মৃদু হেসে বললেন সামাদ মালিক।

–না না তা কেন হবে। আপনি এসেছেন এটা তো আমার সৌভাগ্য।

–কেমন আছেন বলুন? আর বাড়িতে আর কে কে আছে?

–আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আমরা তিনজন। আমার মেয়ে কোচিংএ গেছে।

–ওহহ!! তাই জিজ্ঞেস করছিলাম তাকে দেখছিনা তো তাই। এখানে তার জন্যই আসা।

— আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। আমীর সামাদ মালিকের কথা বুঝতে পারছেন না।

— মানে এটাই যে। আমার ছেলের জন্য আমি আপয়ার মেয়ে কে নিয়ে যেতে চাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

সামাদ মালিকের কথা শুনে আমীর বড়সড় ধাক্কা খেল।

–কি বলছেন? আমার মেয়ে আপনার ছেলের বউ হিসেবে। কিন্তু আপনি বড় মানুষ আমার মেয়ে মানিয়ে নিতে পারবে….

আমীর কে থামিয়ে দিলো সেলিনা মালিক..

— ভাইজান! আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। আমি আপনার মেয়েকে বউ না আমার মেয়ে করে নিয়ে যাবো। আর সবাই সব কিছু একদিনেই মানিয়ে নিতে পারেনা। আস্তে ধীরে মানিয়ে নিতে হয়। আপনি আপত্তি করবেন না প্লিজ।

— আমার মেয়ে অনেক ছোট। মাত্র এসএসসি পাশ করেছে। আপনারা সবাই অনেক শিক্ষিত।

— কি যে বলেন না। আমি নিজেও কম লেখাপড়া নিয়েই এসেছিলাম। আর অল্প শিক্ষিত তাতে কি। পড়ালেখা করিয়ে বেশি শিক্ষিত বানিয়ে নেব। বলেই হাসলো সেলিনা মালিক।

–হ্যা আপনি আর অমত করবেন না। আপনার মেয়ের কোনো অসুবিধে আমাদের পরিবারে হবে না। মাথার তাজ হয়ে থাকবে।

— ঠিক আছে। কিন্তু আমি আপনাদের ছেলেকে দেখতে চাই।

— ছেলে তো সাথে আসেনি। তবে চাইলে ছবি দেখতে পারেন। বলেই ফোন এগিয়ে দিলো সেলিনা মালিক।

আমীর ফোন হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ফোনের স্ক্রিনে থাকা মানুষ টি আর কেউ না। তারই অতি পছন্দের পাত্র সামরান মালিক।

–উনি আপনার ছেলে?

–হ্যা কেন?

— আমি ওনার কর্মচারী। বলেই মৃদু হাসলো আমীর।

–কর্মচারী না। শশুড় মশাই বলুন। তাহলে সব ঠিকঠাক। এবার আয়োজনের পালা। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা উচিৎ।

— হ্যা সময় করে একদিন আসুন। সব ঠিক করে নিই।

–হুম। আমরা কাল বসি। আর একটা কথা বিয়ের আগে ছেলে মেয়ে কেউই কাউকে দেখবে না।

–কি বলেন ভাবীজান আজ কালকার ছেলে হয়ে মেনে নেবে কি?

— আমার ছেলে আমার আদেশ মাথায় করে রাখে। আমার ছেলে হাজারে একটা। নিজের ছেলে বলে বলছিনা। খাটি সোনা সে।

–(আমিও জানি সে শুধু খাটি সোনা না একজন আদর্শ সন্তান, এক সুদর্শন মানুষ) তাহলে তো ভালোই। আমরা কাল বসে দিনক্ষণ ঠিক করে নিই।

— হ্যা। আজ তাহলে উঠি কেমন?

— কিছু মুখে দিলেন না যে।

–কালকে সব ঠিক করে একেবারে মিষ্টি মুখ করবো বলেই হেসে দেন সামাদ মালিক। উঠে দাঁড়িয়ে আমীর কে জড়িয়ে ধরে। সেলিনা মালিক শেহনাজ কে জড়িয়ে ধরে বলে,

–আসছি ভাবী। কালকের জন্য শুভকামনা রইলো।

–সাবধানে যাবেন। সামাদ মালিক আর সেলিনা মালিক বিদায় নিল। শেহনাজের মন ভার হয়ে এলো। তার ছোট্ট মেয়েটা টাকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই দু ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো।

বিঃদ্রঃ নাইস, নেক্সট না বলে গঠনমূলক মন্তব্য করুন😓আমার কেন জানিনা লিখতে ইচ্ছে করছেনা। আপনাদের মতামত প্রয়োজন। কেমন হচ্ছে জানান।
#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_১৪

আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। হালকা বাকাঁনো চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে ধরণী। আকাশ ও একদম পরিষ্কার। চকচকে আকাশের বুকে আজ চাঁদটা কাএ অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। সামরানের ফার্মহাউস আজ আলোয় ভরপুর। চারদিকে আলোয় ঝলমল করছে। যে ফার্মহাউসে লাইট থাকা সত্ত্বেও সামরান অন্ধকার করে রাখতো সেই ফার্মহাউসের সবর্ত্র ছড়িয়ে আছে আলো। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে মধুর কন্ঠস্বর। এ আর কারো নয় স্বয়ং সামরানের কন্ঠ। তন্দ্রা ফার্মহাউসের দরজার সামনে এসে দাড়াতেই বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌছে গেল। সামরান গান গাইছে? কই এত দিনে একবারও তো গাইতে দেখেনি। অনুরোধ করেও সামরান কে গান গাওয়াতে পারলো না! তবে আজ কেন? তন্দ্রা ভেতরে প্রবেশ করল। দরজা খোলা থাকায় ভেতরে আসতে অসুবিধে হলো না।

দরজা খোলার শব্দ শুনে সামরান থেমে গেল। পিয়ানো থেকে নিজের আঙুল তুলে নিল। পেছনে ফিরে তন্দ্রা কে দেখে ভ্রুযুগল কুঁচকে নিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তন্দ্রার সামনে এসে দাঁড়ায়।

–তুমি এখানে?

–কেন আসতে পারি না?

— অসময়ে কেন?

–সামরান এ তোমার কেমন পরিবর্তন? তুমি পিয়ানো কবে কিনেছো? আর এসব কি সামরান? তুমি গান গাইছো? কাকে ডেডিকেট করে গাইছো সামরান? এক নিঃশ্বাসে প্রশ্নগুলো করে তবেই থামলো তন্দ্রা।

দুহাত পকেটে রেখে সামরান সটান হয়ে দাড়ালো।

–কৈফিয়ত চাইছো?

–না সামরান। আমি জানতে চাইছি তোমার এত পরিবর্তন কেন? বলেই তন্দ্রা সামরানের দিকে এগিয়ে গেল। সামরান কে স্পর্শ করতে নিলেই সামরান পিছিয়ে যায়। সামরান কে পিছিয়ে যেতে দেখে তন্দ্রা আরো অবাক হলো।

— আমি এখন কিছু চাইছিনা! তুমি আসতে পারো।

–সামরান! তুমি আমাকে ইগনোর করছো? দূরে সরিয়ে দিচ্ছো তুমি আমাকে? সকালেও আশ্রমে তুমি নিজেকে আমার থেকে দূরে রেখেছো। কেন সামরান?

— হ্যা দিচ্ছি! শুধু তোমাকে কেন? তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তাকেও দূরে সরিয়ে দিতাম।

— এ কেমন দ্বারা পরিবর্তন তোমার সামরান? আমি মেনে নিতে পারবো না। তুমি তো জানো আমি তোমাকে…

–ব্যস তন্দ্রা!!( এক হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিয়ে) আমি চাইনা আমার শরীরে আর কোনো নারীর স্পর্শ লাগুক। কারণ…. বলেই সামরান অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

— কারণ? ভ্রু জোড়া কুঁচকে প্রশ্ন করে তন্দ্রা।

— তোমাকে বলতে বাধ্য নই। ইউ মে লিভ!!

— তুমি তোমার নেশা ছেড়ে দিতে পারবে?

— তুমি ভুল করছো! নারী আমার নেশা না। আমার টাইম পাসের মাধ্যম ছিল।

–কিন্তু সামরান…

–তন্দ্রা! যাও। আমার মুড নষ্ট করো না। তুমি তো জানোই আমি এত বেশি ভালো না। সো লিভ!!

ছলছল নয়নে কিছুক্ষণ সামরানের দিকে তাকিয়ে থাকে তন্দ্রা। তারপর চলে গেল। তন্দ্রা চলে যেতেই সামরান চোখ বন্ধ করে একটি বড় নিঃশ্বাস টেনে নেয়।

–আর না! আর কাউকে আমি স্পর্শ করবো না। আমি এমন একজনের মায়ায় আটকে যে পবিত্রতার রাণি।আপনি তো পবিত্র অলকানন্দা। আমার শুদ্ধতার রাণী। আমার অলকানন্দা। আপনাকে দেখার পর থেকে অন্য নারী আমার কাছে ফিকে পড়ে গেল। যে কাজে কেউ বাধা দিতে পারেনি, সেই কাজে আপনার নিষ্পাপ মুখশ্রী বাধা হয়ে দাড়ালো। আপনাকে পাওয়ার তীব্র নেশা আমাকে মাতাল করে দিয়েছে। আমার আপনাকে চাই। অন্যকাউকে আর না। আমার তৃপ্তি আপনি,আমার নেশা আপনি,আমার মুগ্ধতা আপনি। আমার প্রেম সাগরে #প্রেমের_খেয়ার মালকিন আপনি। রকিং চেয়ারে বসে মাথা এলিয়ে দিল।

আমীর আর শেহনাজ বসে আছে সোফায়। তাদের সামনেই বসে আছে মায়া। অনেক্ষণ ধরেই সবাই চুপচাপ বসে আছে। কোচিং থেকে আসার পর মায়াকে ডেকে সামনে বসালেও এখনো কিছুই বলে নি তারা। মায়া দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল।

— কি হলো? তোমরা চুপ করে আছো কেন? কিছু বলছো না যে? বলো না কি বলবে?

আমীর শেহনাজের দিকে তাকালো। শেহনাজ অসহায় দৃষ্টিতে আমীরের মুখপানে চেয়ে রইল।

–মায়া!

— হ্যা ছোট আব্বু।

–আমরা তোমার জন্য পাত্র ঠিক করেছি। তোমার বিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে। কাল উনারা আসবেন বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে। মায়ার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেও আমীরের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো।

আমীরের কথা শুনে মায়া সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল।

— এএসব ককি বলছো ছোট আব্বু।

–হ্যা এটাই সত্যি। তুমি খুব ভালো থাকবে। আর উনারা মানুষ ও অনেক ভালো।

মায়া হাটু গেড়ে বসে পড়ে আমীরের সামনে। আমীরের কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠে। মায়া কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,

— আমি এখানেও ভালো আছি ছোট আব্বু। আমি এখনই বিয়ে করবো না আব্বু। প্লিজ আমাকে বিয়ে দিও না। প্লিজজজ!!

মায়া আব্বু ডাকলো আমীরকে। আমীর শেহনাজের দিকে তাকালো। শেহনাজ নিজের চোখের পানি মুছে নিল। আমীরের কলিজা কাপঁছে। মেয়েটা কিভাবে কাদঁছে।
দুহাতে মায়াকে তুলে পাশে বসালো আমীর।

— মায়া তুই বড় হয়েছিস মা। কোনো মেয়েই সারাজীবন থাকে না মা বাবার কাছে। একদিন না একদিন তো যেতেই হবে। কেন অমত করছিস?

— আব্বুহ্ আমি এতোটাও বড় হয়নি বলো। আমি তোমাদের ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবো না। তোমরা আমাকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিও না আব্বু। আমি পারবো না! বিশ্বাস করো আমি পারবোনা…কথা বলতে বলতে মায়া আবারো মাটিতে বসে পড়লো। আমীরের পা দুহাতে জড়িয়ে আমীরের কোলে মাথা রেখে অঝোর ধারায় কাদঁছে মায়া। কিভাবে থাকবে সে এই মানুষ দুটিকে ছাড়া। প্রাণ টা যে সেই মুহুর্তেই বেরিয়ে যাবে।

শেহনাজ উঠে এসে মায়ার পাশে বসে।

— মায়া!! এমন করে না মা। দেখ পরিস্থিতি ভালো না। না জানি কখন কি হয়ে যায়। তুই এমন করিস না।

আমীর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। কঠোর কন্ঠে ধারণ করে বলল,

–শেহনাজ ওকে বলে দাও, ও যেন আর অমত না করে। নাহলে আমাকে আজীবনের জন্য হারাবে। বলেই আমীর চলে গেল ভেতরে। মায়া আমীরের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখের পানি অনবরত গড়িয়েই যাচ্ছে। দুচোখের পানি মুছে উঠে দাড়ালো মায়া। ধীর পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে। হাটুতে মুখ গুঁজে কাদঁতে থাকে নিঃশব্দে।

আমীর রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে আমীর। সকালে আননোন নাম্বার থেকে পাঠানো ছবি গুলোর দিলে তাকিয়ে বলে,

— আমি চাই না। আমার লক্ষি মেয়েটির গায়ে একটুও আঁচড় লাগুক। আমায় ক্ষমা করে দিস। তুই অনেক ভালো থাকবি। সেভ থাকবি। আমি কঠোরভাব না দেখালে তুই যে রাজী হবি না। আমীরের চোখ লাল হয়ে যায়। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে সামনে দেওয়ালে টাঙানো মায়ার ছবির দিকে তাকিয়ে রইল আমীর। কেন এমন পরিস্থিতি এল? তার মেয়েকে কেন এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে?
এ সময় এখানেই থেমে যাক। কিন্তু হায়! সময় যে বহমান। সে কি থেমে থাকবে আদৌ…..

এক হাতে কোট ঝুলিয়ে অপর হাতের আঙুলে গাড়ির চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো সামরান। গুনগুন করে গান গাইছে । ড্রয়িংরুমে বসে ছিল সেলিনা মালিক আর সামাদ মালিক। সামরান কে এইভাবে বাড়ি প্রবেশ করতে দেখে সামাদ মালিক আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে সেলিনা মালিকের মুখপানে তাকালো। সামরান তো এমন না।

সেলিনা মালিক সামরান কে ডাক দিলো,

— সামরান!!

মায়ের আওয়াজ শুনে চাবি ঘোরানো বন্ধ করে দিল সামরান। পেছনে ফিরে তাকালো,

— জ্বী মা।

— আমার কিছু কথা ছিল। ফ্রেশ হয়ে জলদি এসো।

–আমি ফ্রেশই আছি। তুমি বলো না। বলেই সামরান সোফায় গিয়ে বসে পড়ল। সেলিনা মালিক সামরানের মুখোমুখি বসে পড়ে।

–কাল আমরা এক জায়গায় যাবো।

— ওহহ আমাকে যেতে হবে। আচ্ছা আমি যাবো।

— তোমাকে যেতে হবেনা।

— তাহলে?

— তোমার জন্য আমি পাত্রী পছন্দ করে এসেছি। কালকে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে যাবো।

সেলিনা মালিকের কথা শুনে সামরানের মুখের হাসি মুহুর্তেই উধাও হয়ে গেল।

–হোয়াটটটট!! সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায় সামরান।

ভ্রু কুঁচকে সেলিনা মালিক সামরানের মুখের দিকে তাকালো। সামরান থতমত খেয়ে গেল।

–এসব কি মা। কিসের বিয়ে? আমি বিয়ে….

–সামরান!!!

–কিন্তু মা!! চোখ বন্ধ করে একহাতে নিজের মাথার চুল চেপে ধরল সামরান। নিজের মায়ের মুখের উপর কথা বলার অভ্যাস সামরানের নেই। কিভাবে বাধা দেবে সামরান। সেলিনা মালিক উঠে সামরানের সামনে এসে দাঁড়ায়,

— আমি যা করেছি তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ অবশ্যই আছে। তুমি এত দিক না ভেবে বিয়ের প্রস্তুতি নাও।

অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামরান। সেলিনা মালিক চলে গেল। সামাদ মালিক উঠে সামরানের সামনে দাড়ালো।

–কংগ্রেচুলেশন!!
সামরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামাদ মালিকের দিকে তাকাতেই সামাদ মালিক বাকা হেসে ভেতরে চলে গেল। সোফায় থম মেরে বসে রইল সামরান।

_________________

মালেশিয়া থেকে ক্লাইন্ট এসেছে। ২০জন মেয়ে দরকার। লম্বা, চওড়া মানুষ গুলো সোফায় বসে আছে। সবার পরনে নামীদামি পোশাক। আর তাদের সামনে রয়েছে টাকার ব্রিফকেস। এডভান্স করে তবেই যাবে।

সামনে থাকা বিশাল ডিভানটি খালি। পায়ের আওয়াজ শুনে পেছনে ফিরে তাকালো সবাই। পাঁচ জন লোক এগিয়ে আসছে। সবারই পরনে পাঞ্জাবী। এগিয়ে এসে তিনজন ডিভানে বসে পড়ে। আর দুজন ডিভানের দুই সাইডে দাঁড়িয়ে যায়। ডিভানে বসে থাকা একজন হাসি মুখে বলে উঠল,

— কেমন আছেন? আসতে কোনো অসুবিধে হয়ে নি তো।

— না হয় নি!!

— পরিচয় দেওয়া যাক। আমি আফজাল মুনির।আর এরা আমার চার ভাই। আহসান মুনির,আহমাদ মুনির,আমজাদ মুনির, আজাদ মুনির। আপনারা হয়তো শুনেছেন এই ব্যবসা আমাদের পাঁচ ভাইয়ের।

–হ্যা আমরা শুনেছি। এটাও শুনেছি বিভিন্ন নামকরা দেশের সাথে আমরা ডিল করে থাকেন তাই আপনাদের কাছে আসা। আশা করি নিরাশ হবো না আমরা।

— একদমই না। আপনাদের ডিমান্ড আমরা পুরণ করবো। আর আপনারা আমাদের। বলেই হাসলো আফজাল মুনির।

সোফায় বসে থাকা একজন লোক ইশারা দিতেই একটি গার্ড এসে সমস্ত ব্রিফকেস খুলে দেয়। টাকায় মালেশিয়ান ডলার চকচক করছে।

আফজাল মুনির হাসলেন। লোকটি বললেন,

— এডভান্স। বাকি গুলো পরে।

–অবশ্যই। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন।ডেট এর আগেই আপনাদের ডিমান্ড পুরণ করে দেব। লোকগুলো উঠে দাড়ালো। হ্যান্ডশেক করে চলে গেল।

আফজাল মুনির ফোন বের করে কার নাম্বার যেন ডায়েল করলেন। নিজের অন্য ভাইদের দিকে তাকিয়ে বলল।

–আমি স্যার কে জানিয়ে দিচ্ছি। তোরা এগুলো ভেতরে নিয়ে যা! বলেই ফোন কানে ধরে বাহিরে বেরিয়ে গেল আফজাল মুনির।

চলবে……
চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here