প্রেমের খেয়া পর্ব ১১+১২

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_১১

সামাদ মালিকের সামনে বসে আছে থানার ওসি। ওসির চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। দুটি ছবি সেন্টার টেবিলে রেখে হাতে থাকা রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিলেন। ছবি দুটির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে সামাদ মালিক। ভেতরটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো। দুটি মেয়ের বিভৎস রুপ। মৃত্যুর আগে হয়তো অনেক অত্যাচার এর স্বীকার হয়েছে মেয়ে দুটি। ওসি সোজা হয়ে বসে পড়লো।

— এসব কি হচ্ছে? পরপর ৪টা খুন। সব ভিকটিম মেয়ে। এর আগে অনেক খুম ধামাচাপা দিলেও এবার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সামনেই নির্বাচন। এমন চলতে থাকলে আপনার টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে।

–কে বা কারা খুন করেছে? কেন করেছে? কোনো ক্লু পান নি?

— স্যার ভিকটিমদের বডিতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে টর্চার করা হয়নি। আর অনেকবার রেপ করা হয়েছে। আঘাতের পরিমাণ এতোটাই গুরুতর যে কিছু বোঝা বড় দায়। আর এদের পরিচয় ও জানিনা। তদন্ত করেও কোনো কুল কিনারা পাচ্ছি না। আমার মাথায় এটা আসছেনা খুন হচ্ছে কিন্তু শুধু মেয়েদেরই কেন? হাতে গোনা ৩জন ছেলের লাশ পেয়েছিলাম। তার নরমাল মাডার। কিন্তু এভাবে যদি মেয়েরাই লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে আমাদের ভিত নড়ে যাবে। কে করছে? আড়ালে কে আছে আমার মাথা কাজ করছে না। ওসি মাথা চেপে ধরলো।

সামাদ মালিক পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে এসব? আসলেই বুঝতে পারছেন না। ছবি গুলোর দিকে যতবার তাকাচ্ছে ততবারই ভেতরটা কেঁপে উঠছে। কলিজা মোচড় দিচ্ছে বারংবার। এতটা নির্দয়ভাবে কে করছে আঘাত। আড়ালে বসে থেকে কে করছে এত পাপ?
এক রাশ চিন্তা ভর করে সামাদ মালিকের মাথায়। কিছু ভাবতে পারছেন না তিনি। চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সামনেই নির্বাচন আর এখনই এসব। না জানি কি হবে?

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সিমি। বার বার শাড়ি পরার চেষ্টা করছে! কিন্তু না কিছুতেই শাড়ি পরতে পারছে না। অতি কষ্টে এই একটা শাড়ি জোগাড় করেছিলো সেটাও পরতে পারছে না সিমি। বার বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছে। বিয়ের আগে শেহেরজাদ একবার বলেছিলো তার বউ সবসময় শাড়ি পরবে। কিন্তু সিমি আজ পর্যন্ত শাড়ি পরে দেখাতেই পারলো না। অতি কষ্টে চোখে জলরাশিরা ভিড় জমালো। দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিলো সিমি। হুট করেই হাতে টান পড়ে। টাল সামলাতে না পেরে সিমি বিছানায় পড়ে গেল। চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। আস্তে ধীরে চোখ খুলে তাকাতেই দেখলো শেহেরজাদ। দুপাশে হাত ঠেকিয়ে ঝুকে আছে সিমির উপর। শেহেরজাদ কে দেখে ভয় কাটলেও পরক্ষণে মনে পড়লো সিমি পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে আছে। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে শেহেরজাদের দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে চাদর নিতে গেলে শেহেরজাদ হাত ধরে নেয়। কন্ঠে মাদকতা এনে বলে,

— কি করছিলে তুমি?

— ককিছু ননা! আমি শশুধু চেষ্টা করছিলাম।
কন্ঠ জড়িয়ে আসছে সিমির। শেহেরজাদ কাছে এলেই এলোমেলো হয়ে যায় সিমি। সিমির এলোমেলো কথা শুনে শেহেরজাদ সশব্দে হাসলো। শেহেরজাদের হাসির কারণ বুঝলো না সিমি। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকালো। হাসি থামিয়ে শেহেরজাদ বলে,

— “ক্লোজ ইউর আইস”!

— ককিনন্তু…? সিমির ঠোঁট দুটি কাপঁছে। শেহেরজাদ হুট করেই কাঁপা ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে,

–এবার করো বন্ধ।
সিমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। কি করতে চাইছে শেহেরজাদ? আবার কোন বিপদ ডেকে আনলো বুঝে উঠতে পারছেনা সিমি। ভ্রু কুঁচকে মৃদু হাসলো শেহেরজাদ। আস্তে করে বলল,

–কি হলো? বন্ধ করো..!

শেহেরজাদের কথা এবার ধমক মনে হলো সিমির। সাথে সাথেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। সিমির মুখের এহেন ভঙ্গি দেখে শেহেরজাদ একটু ঝুকলো। হালকা ভাবে ফু দিলো। তারপর হেসে একটু দূরে সরে আসে। পকেট থেকে একটা খাম বের করে সিমির সামনে ধরে বলে,

— এদিকে তাকাও!
সিমি আস্তে আস্তে তাকালো। খামটি সিমিকে দিয়ে একটু দূরে সরে এলো। কিন্তু সম্পুর্ণ সরে এলো না শেহেরজাদ। সিমি ভ্রু কুঁচকে খামের দিকে একবার তাকালো তারপর শেহেরজাদের দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই শেহেরজাদ ইশারায় খামটি খুলতে বললো।

সিমি খামটি খুলে ফেলে। ভেতরে থাকা ভাজ করা কাগজটা মেলে ধরতেই সিমির চোখ চিকচিক করে উঠে। ছলছল নয়নে শেহেরজাদের দিকে তাকাল। অস্ফুটস্বরে বললো,

— আমরা বাংলাদেশ যাচ্ছি?

— যেতে চাও না?

সিমি শেহেরজাদের প্রশ্নের উত্তর দিলো না। এক টানে শেহেরজাদ কে নিজের সাথে মিশিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। শেহেরজাদ ভড়কে গেলো। এই প্রথম এভাবে জড়িয়ে ধরলো সিমি। সিমি খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো,

–থ্যাংক ইউ শেহের। থ্যাংক ইউ সো মাচ। বলেই শেহেরজাদের গালে চুমু দিলো। আরো এক দফা অবাক হলো শেহের। যদিও স্বামী স্ত্রীর মাঝে এসব কমন ব্যাপার। কিন্তু শেহেরজাদ আর সিমির সম্পর্ক আর ১০টা সম্পর্কের মত না। সিমিকে যতবারই কাছে টেনে নিয়েছে ততবার সিমি মৃত মানুষের ন্যায় শক্ত হয়ে ছিলো। আজ সিমির এমন খুশি দেখে শেহেরজাদ নিজেও খুশি। মাথা তুলে সিমির মুখোমুখি হয়ে বলল,

— হায় হায়!! এই সামান্য জিনিসের জন্য এত ফায়দা? আগে জানলে অনেক আগেই করতাম। বলেই দুষ্টু হাসি দিলো শেহেরজাদ। সিমি লজ্জা পেয়ে গেলো। নিজের কাজে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে দৃষ্টি নত করে নিলো সিমি। শেহেরজাদ সিমির চোখের পাতায় গম্ভীর চুম্বন একেঁ দিলো।

মায়া সারা বিকেল অপেক্ষা করেছে। কিন্তু রাহাদ এলো না। অনেকবার ফোন করার পরও পেলো না। রাহাদের ফোন অফ আসছে। আসবে বলে আসলো না রাহাদ। মায়ার রাগ হলো। পাহাড় সমান অভিমান নিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম আসছেনা। এই ঘুমটাও না বড্ড শয়তানি করে৷ কি দরকার এত জালাতন এর? একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চাওয়া কি পাপ?

পাপ শব্দটি মনে পড়তেই সামরানের কথা মনে পড়ে গেল মায়ার। সামরানের চোখ, ঠোঁট, নাক সবকিছু চোখের সামনে ভাসছে মায়ার। লোকটা শ্যামবর্ণ সাথে যথেষ্ট মায়াবী। দিক-বেদিক না ভেবে মায়া কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে বসে পড়লো। মায়ার একটি বিশেষ গুন। অবিকল দেখতে মানুষের মতোই মায়া ছবি আঁকতে পারে। স্কেচ ও বলা যায়। সামরানের কথা বলার ধরণ, চাহনী, সব ভাবতে ভাবতে কপাল থেকে চোখ পর্যন্ত একেঁ নিলো মায়া। চোখ দুটির দিকে তাকাতেই মায়ার বেহায়া দৃষ্টি আটকে গেল। ছবিতে চোখ দুটি কত সুন্দর।

–আচ্ছা ছবিতে কি বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুললাম আমি? নাকি উনি বাস্তবেও এতোটাই সুন্দর। ধ্যাত!আমি তো স্যার কে কখনো ভালো করে দেখলামই না। অযথা একটু বেশিই একেঁ ফেললাম।
বলেই কাগজ হাতে তুলে ছিড়ে ফেলতে চাইলো মায়া। কিন্তু সেই চোখ দুটির চাহনী যেন জীবন্ত চাহনী। মায়া ছিড়লো না। রেখে দিলো। চোখ দুটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মায়া। ডায়রীর ভাজে কাগজ টি রেখে মায়া বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুম্ব তলিয়ে গেল মায়া।

মধ্যরাত। হালকা বৃষ্টি পড়ছে। মৃদু বাতাস তো আছেই। উড়ছে রুমের পর্দা। বারান্দায় আলো জ্বলছে। রুমে ডিম লাইট সব মিলিয়ে যথেষ্ট আলোয় আলোকিত মায়ার রুম। ফোন বেজে উঠলো মায়ার। দুবার রিং হওয়ার পর ঘুম ঘুম চোখে রিসিভ করে কানে ধরলো। জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

–কে?

ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজই এলো না। ফোন কাটার শব্দ পেয়ে মায়া ফোন রেখে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবারো ফোনের রিং বেজে উঠলো। মায়া আবারো রিসিভ করে কানে ধরলো। এবারও কোনো ব্যাতিক্রম হলো না। ওপাশের সাড়া শব্দ পেল না মায়া। ফোন কেটে যেতেই ফোন রেখে আবারো শুয়ে পড়লো মায়া।
তৃতীয় বারের মত ফোন আবার বেজে উঠলো। এবার একটু দেরীতে ফোন আসলো যার দরুন মায়া গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে বাধ্য হলো। কিন্তু ফোনের রিংয়ের শব্দ কানে পৌছতেই মায়ার রাগ চরম এ উঠে গেল। এক লাফে উঠে বসে ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো। সমস্ত রাগ, সমস্ত বিষাদ ঢেলে দিলো ফোনের অপরপাশের ব্যাক্তির উপর,

— কেরে ভাই তুই? তোর কোনো কাজ নেই? এই রাতের বেলা কোন সুখ দুঃখের কথা শোনানোর জন্য আমায় বিরক্ত করছিস? আমি কি বলেছি আমি শুনবো না? না তো? তাহলে? তোর চোখে ঘুম না থাকতে পারে আমারতো আছে? ক্ষ্যামা দে ভাই। ঘুমাতে দে। আর একবার ফোন করলে ট্রাস্ট মি আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা। একদমে কথা গুলো বলে ফোন কান থেকে সরিয়ে নিতে গেলেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো সুরেলা কন্ঠ। মায়া ফোন রাখতে পারলো না। ফোনের দিলে একবার তাকিয়ে ফোনা আবারো কানে ধরলো। এবার মায়া চুপ করে শুনছে। ভ্বসে আসছে এক মধুর গান। এই গানের অর্থ মায়ার জানা নেই।

♪♪♪♪♪♪♪
তুমি চাঁদের জোছনা নও
তুমি ফুলের উপমা নও…!

তুমি চাঁদের জোছনা নও
ফুলের উপমা নও..!
নও কোনো পাহাড়ি ঝর্ণা
আয়না তুমি হৃদয়ের আয়না….
(মায়া স্তব্ধ হয়ে গেল। ঠোঁট দুটি নিজ দায়িত্ব একে অপরকে ছেড়ে আলাদা হয়ে গেল। কাপঁছে মায়ার ঠোঁট। অপরপাশ থেকে আবারো ভেসে এলো)

সাঝের বেলার রাঙা গোধুলি
বর্ষাকালের ভরা নদী।
তোমার রুপের কাছে হার মেনে
যায় যেন সবই….!

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায় মায়া। মৃদু বাতাসে উড়ছে চুল। কান থেকে ফোন সরিয়ে একবার দেখে নিলো। শুকনো ঢোক গিলে আবারো কানে ধরলো ফোন। ভেসে এলো আবারও কয়েকলাইন গান..

বাবুই পাখির সাজানো বাসা
ময়না পাখির কথা গুলো।
তোমার গুণের কাছে
সব কিছু হার মেনে গেল।

চেয়ারের হাতল চেপে ধরলো মায়া। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো,

–“কে”?

মায়ার কথার কোনো উত্তর এলো না। বিনিময়ে ভেসে এলো সেই সুরেলা কন্ঠের গান,

তুমি চাঁদের জোছনা নও
তুমি ফুলের উপমা নও

তুমি চাঁদের জোছনা নও
ফুলের উপমা নও..!
নও কোনো পাহাড়ি ঝর্ণা
আয়না তুমি হৃদয়ের আয়না……!

ফোন কেটে গেলো। মায়া এখনো ফোন কানে ধরে রেখেছে। ফোন সরিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো রাত ২টা বাজে। চোখ বন্ধ করে নিলো মায়া। এই মধ্যরাতে কে করলো এমন সর্বনাশা কান্ড। আজ যে আর ঘুম হবেনা মায়ার। মায়ার ঘুম কেড়ে নিয়ে কে শান্তি নিদ্রায় ডুব দেবে?

হঠাৎ একটি মেসেজ এলো। মেসেজের টুন বেজে উঠতেই মায়া চমকে উঠলো। মেসেজ ওপেন করতেই দেখলো আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ।

— “এই পুরো গানটি আমি আপনার সাথে গাওয়ার তীব্র ইচ্ছে পোষণ করি। আপনি যা গাইবেন তা কিন্তু আমি গাইনি ছেড়ে দিয়েছি। শুভ রাত্রি!!”

অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো মায়ার। কিভাবে ঘুমাবে সে? দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকাচ্ছে বার বার। এই মৃদু ঠান্ডায় ও মায়া ঘেমে নেয়ে একাকার। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_১২

সূর্যের কিরণ শেহনাজের চোখের পড়তেই ঘুম ভেঙে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৭টা বাজে। পাশ ফিরতেই আমীর কে পেলো না শেহনাজ। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। দু হাতে চুল খোপা করতে করতে বাহিরের দিকে এগিয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে পায়চারী করছে আমীর। চেহারায় অস্থিরতা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে। এত সকালে আমীরকে এভাবে দেখে শেহনাজ আরো একদফা অবাক হলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আমীর এর সামনে দাঁড়ায়। আমীর চোখ তুলে শেহনাজের দিকে তাকালো।
লাল হয়ে আছে আমীরের চোখ জোড়া। রাতে যে এক মুহুর্ত ও ঘুমায়নি এটাই তার প্রমাণ। এক হাত এগিয়ে দিয়ে আমীরের কপাল, গাল, গলা স্পর্শ করলো শেহনাজ।

–কি হলো? ঠিক আছেন আপনি? এত অস্থির কেন দেখাচ্ছে?

শেহনাজের কথা শেষ হতেই আমীর ঝাপটে জড়িয়ে ধরে শেহনাজকে। আমীরের এহেন কান্ডে শেহনাজ ভড়কে গেল। কি হলো মানুষটার? এতোটা অস্থির কেন দেখাচ্ছে? আমীরের অস্থিরতা শেহনাজ কে ভেঙে দিতে প্রস্তুত। এক টা সময় এই মানুষটার জন্যই নিজের মা বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছে। আমীরের মন খারাপ শেহনাজ মেনে নিতে পারেনা। আমীরকে ভালো রাখতে শেহনাজ সব করতে প্রস্তুত। এক হাতে আমীরকে জড়িয়ে ধরে শেহনাজ। অপর হাতে আমীর এর পিঠ মালিশ করতে থাকে আস্তে আস্তে। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল,

–কি হয়েছে আমীর?
আমীর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শেহনাজ কে। শেহনাজ বুঝতে পারছেনা, কি এমন হলো?

আমীর কে নিজ থেকে আলাদা করে সোফায় বসিয়ে দিল শেহনাজ। ফ্যান ছেড়ে দিয়ে এসে পাশে বসে।

–কি হয়েছে? সারা রাত কেন ঘুমান নি আপনি?
আমীর শেহনাজের দিকে তাকালো।

–শেহনাজ আমি মায়াকে হারাতে চাই না। চোখে পানি টলমল করছে তার। শেহনাজ আঁতকে উঠে।

–কি হয়েছে?

–কাল রাতে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছিলো। আমীর ফোন বের করে একটি ছবি শেহনাজকে দেখালো। ছবিটি দেখতেই শেহনাজ মুখে আঁচল চেপে ধরলো। চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। অশ্রুসিক্ত নয়নে আমীরের দিকে তাকালো। আমীর শুকনো ঢোক গিলে বলল,

— অপরিচিত লোকটি বলেছে মেয়ের এই অবস্থা যদি দেখতে না চাই তাহলে যেন বিয়ে দিয়ে দিই। আমীরের কন্ঠ জড়িয়ে আসছে। হাত কাপঁছে আমীরের। শেহনাজ আমীরের হাত শক্ত করে ধরে বলল,

— আমীর আমার মায়া এখনো ছোট। এই বয়সেই বিয়ে টা কিভাবে?

— আমাদের মেয়েকে আমরা কম ভালোবাসি না শেহনাজ। কিন্তু যদি সত্যিই এমন কিছু হয় আমাদের বুক চিরতরে শূন্য হয়ে যাবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি ওর বিয়ের ব্যবস্থা করবো। শেষোক্ত কথা গুলো বলার সময় আমীরের চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। চেহারায় কঠোরতা জানান দিচ্ছে।

শেহনাজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

–মায়াকে কিভাবে বলবেন?

–আমি সামলে নেব। তুমি চিন্তা করো না। আমি চাইনা ওর কোনো ক্ষতি হোক। বলেই উঠে দাড়ালো আমীর।
শেহনাজ ছলছল নয়নে আমীরের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ডাইনিং টেবিলে নাস্তা দিয়ে সেলিনা মালিক রান্নাঘরে গেল। কাজের মেয়েটি হাতে হাত লাগিয়ে সাহায্য করছে। সামরান বাসায় আছে। সকালের নাস্তা হয়তো বাসায়ই করবে তাই সেলিনা মালিক তাড়াতাড়ি করে নাস্তা রেডি করলেন।

শার্টের হাতের বোতাম লাগাতে লাগাতে সিড়ি দিয়ে নামছে সামরান। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাড়াহুড়োই আছে। সেলিনা মালিক ডাক দিলেন,

–সামরান!!

–জ্বী মা!

— খেয়ে যা। নাস্তা দিয়েছি।

–মা দেরী হয়ে যাচ্ছে। আজ না।
সেলিনা মালিক নাস্তার প্লেট নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়,

— হা কর!আমি খাইয়ে দিচ্ছি দেরী হবে না।

–মা!অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সামরান।

–হা কর! সেলিনা মালিকের ছোট্ট ধমকে সামরান বাধ্য ছেলের মত হা করলো। সেলিনা মালিক সামরানের মুখে মাংস আর পরোটা পুরে দিলেন। পরোটার দুই টুকরো খেয়েই সামরান পানি খেয়ে নেয়।

— আর না দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার। আসছি! রুমাল দিয়ে মুখ মুছে সেলিনা মালিকের কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়ে সামরান। সেলিনা মালিক মৃদু হাসলেন।

৯টা বাজছে। মায়া এখনো রুম থেকে বের হয়নি। শেহনাজ রুমে প্রবেশ করতেই বিছানা খালি দেখে একটু অবাক হলো। শেহনাজ ভাবলো মায়া বাথরুমে। রুমের জানলা খুলে দেওয়ার জন্য পা বাড়ায় শেহনাজ। ফ্লোরে চোখ পড়তেই শেহনাজের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। ফ্লোরে ঘুমাচ্ছে মায়া। খোলা চুল গুলো সারা ফ্লোরে ছড়িয়ে আছে। শেহনাজ ছুটে গিয়ে মায়াকে ডাকে। শেহনাজের ডাক শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মায়া।

— ছোট আম্মু তুমি?

–এখানে কেন ঘুমাচ্ছিস? শরীর ঠিক আছে?

— হ্যা আছে। রাতে একটু গরম লাগছিলো তাই আমি এখানে শুয়ে পড়েছি। অন্যমনস্ক হয়ে বলে মায়া।

–ওহহ!কলেজ যাবি না? দেরী হয়ে যাচ্ছে তো। তাড়াতাড়ি আয়।

–আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি৷ বলেই মায়া বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো।

শেহনাজ বিছানা গুছিয়ে। পড়ার টেবিল ঘুছিয়ে দেয়। ডায়রীর ভাজে কাগজ দেখে হাতে ডায়রী তুলে নেয় শেহনাজ। আচমকা আমীরের আওয়াজ কানে আসে..
ডায়রী রেখেই শেহনাজ রুম ছাড়ে।

গোসল করে বেরিয়ে মায়া আয়নার সামনে দাড়ালো। চোখ ফুলে আছে। নিজেকে পরিপাটি করে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
খাবার টেবিলে বসতেই আমীর মৃদু হাসলো।

— গুড মর্নিং আম্মাজান।

–গুড মর্নিং ছোট আব্বু।

–কি ব্যাপার চোখ মুখ এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন? মায়ার মাথায় হাত রেখে বলে আমীর

— রাতে অনেক গরম পড়েছে। ঘুম হয়নি তাই হয়তো?

–ওহহ!জলদি খেয়ে নে। কলেজে দেরী হয়ে যাচ্ছে।

–আচ্ছা। মায়া খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের গাড়িটি। মায়া গাড়ির কাছে গিয়ে আগে ড্রাইভিং সিটে উকি দিলো। নাহ আজ ড্রাইভার এসেছে। পেছনের সিটের দরজা খুলে বসে পড়ে মায়া।

–শুভ সকাল!!

কাঙ্ক্ষিত কন্ঠস্বরটি শুনে মায়া চমকে পাশে তাকালো।গাড়ির সিটের সাথে পিঠ ঠেকে যায় মায়ার। সামরানকে আশা করেনি মায়া। এই লোক ভুতের মত কেন সবসময় উপস্থিত হয়ে যায়? মায়াকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সামরান মায়ার সামনে হাত নাড়ালো।

— কি হলো? কি দেখছেন?

— ননা মানে আপপনি?

–আমাকে দেখে কেন আপনি চমকে যান? ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করুন।

— না আসলে খেয়াল করিনি আমি তাই। সরি স্যার। বলেই মাথা নোয়ালো মায়া। গাড়ি স্টার্ট দিলো ড্রাইভার।
মায়া আড়চোখে সামরানকে দেখছে। কালো রঙের শার্ট পরেছে সামরান। উপরে ব্লু ব্লেজার। শার্টের হাতা ফোল্ড করে রেখেছে। চোখে সানগ্লাস। হুট করেই মায়ার স্কেচ এর কথা মনে পড়ে গেল। সামরানের চোখ দুটি দেখতে চায় মায়া। কিন্তু কিভাবে দেখবে? সানগ্লাস পরে আছে সামরান। কিভাবে খোলাবে এটা। মায়া ভাবতে থাকে। মায়ার ভাবনাচ্ছেদ ঘটিয়ে সামরান বলে উঠে,

— রাতে কি ঘুমান নি?

— না! অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিলো মায়া। হুট করেই খেয়াল হলো লোকটি কিভাবে জানে যে মায়া ঘুমায়নি রাতে। দিক-বেদিক না ভেবে জিজ্ঞেস করেই ফেললো মায়া,

–আপনি কিভাবে জানলেন?

–আপনার চোখ মুখ দেখলে আমি কেন সবাই বলবে। বলেই মৃদু হাসলো সামরান। গাড়ি জ্যামে আটকা পড়েছে। গাড়ির গ্লাসে হঠাৎ ঠকঠক শব্দ হয়। সামরান গ্লাস নামিয়ে দিলো। একটি ১০/১২বছরের ছেলে খেলনা বিক্রি করতে এসেছে।

–স্যার এইটা নেন। মাত্র ৩০টাকা স্যার।

সামরান একটু অবাক হলো,

— এগুলো তো বাচ্চাদের।

— নেন না স্যার। একটা নেন। সকাল থেকে একটাও বেচবার পারি নাই স্যার।

সামরান চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিলো।

— এখানে কত টাকার খেলনা আছে?

— ২৭০টাকার স্যার।

–সব দাও আমায়? ছেলেটি সামরানের হাতে খেলনার ঝুড়ি তুলে দিলো। সামরান একটি এক হাজার টাকার নোট বের করে ছেলেটিকে দিলো। ছেলেটি বলল,

–স্যার আমাকে কাছে তো খুচরা নাই।

— লাগবেনা খুচরো। বাকি গুলো তোমার বকশিস। তোমার খেলনা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। বলেই হাসলো সামরান।

ছেলেটি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। সামরান কেন ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ির সারির মাঝে হারিয়ে গেল ছেলেটি। সামরান গ্লাস তুলে দিলো। মায়া সামরানের দিকে তাকিয়ে রইলো।

–আপনি বিবাহিত?

মায়ার কথা শুনে সামরান মায়ার দিকে তাকালো।

— আমাকে দেখতে বিবাহিত লাগে?

— না মানে এগুলো কিনলেন যে? এগুলো তো আপনার কোনো কাজে আসবে না।

সামরান অধর বাকিয়ে হাসলো।

–আমার কাজে লাগবে কবে বললাম? আর আপনি দেখেন নি ছেলেটি কত খুশি হয়েছে?

–দেখেছি কিন্তু এগুলো নিয়ে কি করবেন আপনি? এগুলো তো আপনার কাজেই আসবেনা। এক প্রকার অপচয়!

— না তো অপচয় না।

— তাহলে? ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল মায়া।

— দাড়ান দেখাচ্ছি। ড্রাইভার! গাড়ি “তন্দ্রা নিবাস” এর দিকে ঘুরিয়ে নিন।

–আচ্ছা স্যার।

একটু পর গাড়ি এসে থামলো একটি অনাথ আশ্রমের সামনে। সামরান নেমে মায়ার সাইডের দরজা খুলে দিলো।

–আসুন।

মায়া সামরানকে অনুসরণ করে হাটা দিলো। কিছুদূর যেতেই অনেকগুলো বাচ্চা এসে সামরানের সামনে দাঁড়ায়। সামরান হাটু ভাজ করে বসে খেলনার ঝুড়িটি ওদের সামনে ধরে। ওরা খুশিতে গদগদ হয়ে সব খেলনা নিয়ে ছুটে চলে গেল। সামরান হাত ঝেড়ে উঠে দাড়ালো। মায়ার মুখে অজান্তেই হাসি ফুঠে উঠলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামরানের দিকে।

–“এই লোকটা এত ভালো কেন”? মনে মনে আওড়ালো মায়া।
মায়ার দিকে ফিরে তাকালো সামরান।

–অপচয় হয়নি দেখেছেন?

–দেখেছি। হেসে দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলে মায়া। হঠাৎ একটি মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

–আরে সামরান তুমি এখানে?

মেয়েটি এসে সামরান কে জড়িয়ে ধরে। মায়ার একটুও ভালো লাগেনি। মায়া সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলে। সামরান মায়ার দিকে তাকালো। মায়ার মুখ কালো দেখে সামরান মেয়েটিকে দূরে সরিয়ে দিলো

–অফিস যাচ্ছিলাম তাই ভাবলাম এদিকে একটু আসি।

–ওহহ!ভালোই করেছো এসে। তা এই মেয়ে কে? মায়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো মেয়েটি।

— সামওয়ান স্পেশাল!!বলে মায়ার দিকে তাকালো। মায়া সামরানের বলা কথা শুনে সামরানের দিকে তাকালো।

এটা কি বললো উনি? সামওয়ান স্পেশাল মানে?

সামরানের সামনে থাকা মেয়েটির মুখ কালো আবরণে ঢেকে গেল। সামরানের দিকে একবার তাকিয়ে মায়ার দিকে আবারও তাকালো মেয়েটি।

চলবে………….
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here