#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_২৬
বাড়িতে প্রবেশ করতেই সামরান দেখলো ড্রয়িংরুমে মায়া,সিমি বসে আছে। তাদের সামনে আরো একজন মেয়ে আছে। কিন্তু সামরান তার চেহারা দেখতে পাচ্ছে না। শুধু পেছনের অংশ দেখতে পাচ্ছে। মৃদু হেসে সামরান কয়েক পা এগিয়ে গেল। সামরানের দিকে চোখ পড়তেই মায়া উঠে দাড়ালো। মায়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সামরানের দিকে তাকিয়ে সিমির দিকে একবার তাকালো। মৃদুস্বরে বলল,
–এসেছেন আপনি?
–হ্যা মাত্র! খেয়েছেন আপনি? দু হাত পকেটে রেখে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল সামরান
–হ্যা খেয়েছি। মায়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
আমার ফ্রেন্ড। যদিও আমার অনেক সিনিয়র তবে আমার ক্লাসমেট। মায়ার কথা শেষ হতেই ফাইজা উঠে দাড়ালো। পেছনে ফিরতেই সামরান কে দেখে ঘোরে চলে গেল ফাইজা। ফাইজা কে দেখে সামরান রীতিমতো ধাক্কা খেল। যাকে সামরান দেখতে চায় না কেন সেই মানুষ সামরানের সামনে বার বার আসে? কেন? মায়া যদি জানতে পারে তবে কি হবে? সামরান কে যদি ভুল বোঝে? এই একজনের কারণেই আজ সামরান এমন। এই মেয়ে কুৎসিত বলেছিলো বলেই সামরান নিজের অন্তরআত্মা ও কুৎসিত বানিয়ে দিলো। অন্তঃকরণে অন্ধকার ছড়িয়ে দিলো। বিষের চেয়েও বিষাক্ত করে দিলো নিজের অন্তর। যেই নারীকে সামরান সম্মান করতো সেই নারীকেই সামরান ঘৃণা করতে শিখেছে৷ নারীর সম্মান নিয়ে খেলতে শিখেছে। আজ যখন নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে তখন কেন এই মেয়ে সামনে এলো? আবারো এলোমেলো করে দিবে নাতো সামরান কে? মায়া যদি এসব জেনে যায় তাহলে তো ভুল বুঝে দূরে সরে যাবে। মায়াকে ছাড়া কি করে থাকবে সামরান? পারবে না সে মায়ার অভাব কাটাতে। এসব ভাবতে ভাবতে সামরান দু কদম পিছিয়ে গেল। হাতের মুঠো শক্ত করে নিলো। দাতেঁ দাতঁ চেপে দৃষ্টি নত করে নিল। ফাইজা একটু এগিয়ে এলো। মৃদু হেসে বলল,
–হাই!কেমন আছেন?
সামরান নিজের হাতের মুঠো আরো শক্ত করে নিল। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে সামরানের। ফাইজা সামরানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সামরানের থেকে দৃষ্টি যেন সরছেই না। ৪বছর আগে যাকে দেখেছিলো সেই মানুষটির সাথে এই মানুষের কোনো মিল নেই! ৪বছর আগে যাকে দেখেছিলো সে কেমন অদ্ভুত ছিলো। আর আজ যে সামনে আছে তাকে এক কথায় সুদর্শন পুরুষ বলা যাবে। শ্যামবর্ণ চেহারাটি থেকে ফাইজার চোখ সরছে না। আনমনে বলে উঠলো,
–মায়া ঠিকই বলেছিলো, আপনি ব্ল্যাক ডায়মন্ড। যাকে দেখলে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব!
ফাইজার কথা শুনে সামরান ত্রস্তনয়নে তাকালো। ফাইজার দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর দমিয়ে রাখা শান্ত আগুন যেন দাবানলে পরিবর্তন হলো। চোখ দুটি লাল বর্ণ ধারণ করলো। কপালের রগ ফুলে উঠেছে। দপদপ করছে। মায়ার চোখে পানি টলমল করছে। এই বুঝি গড়িয়ে পড়বে। অতি কষ্টে ঢোক গিলে দম ছাড়লো মায়া। কেন যেন দম আটকে আসছে। ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সামরানের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফাইজার থেকে চোখ সরিয়ে মায়ার দিকে তাকাতেই মায়ার ফ্যাকাশে মুখ দেখে সামরান শান্ত হয়ে গেল। ফাইজাকে এড়িয়ে মায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এক হাতে মায়ার গাল স্পর্শ করলো। সামরান কে এগিয়ে আসতে দেখে মায়া মাথা নত করে ফেলেছিলো। গালে সামরানের হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা তুলে তাকালো।
— আপনি ঠিক বলেছেন, আমি ব্ল্যাক ডায়মন্ড। আমার মূল্য অনেকক! জানেন কেন? আপনার জন্য! আপনি হলেন সেই মিউজিয়াম যার ভেতর আমাকে রাখার পর আমি মূল্যবান হয়ে গেছি। আমার দাম এত হয়ে গেছে যে কারো হাত লাগানোর স্বাধ্য নেই। আমি ব্ল্যাক ডায়মন্ড। হ্যা আমি ব্ল্যাক ডায়মন্ড। আপনার ব্ল্যাক ডায়মন্ড! বলেই মুখে হাসির রেখা টেনে নিল সামরান। মায়া মাথা নিচু করে নিলো। মায়াকে পেছন থেকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ঘুরে দাড়ালো সামরান। ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলল,
— এসেছেন যখন রাতে খেয়ে দেয়ে একেবারে যাবেন। আমার বউ খুব ভালো রাধতে পারে। মিস করবেন না। বলেই মায়ার মাথায় চুমু দিলো সামরান। মায়া আবারো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ফাইজার চোখে পানি। ফাইজা সামরানের দিকে তাকিয়ে রইলো। সামরান মায়াকে নিয়ে উপরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। পেছন থেকে ফাইজা ডেকে উঠলো। সিমি বিরক্তি নিয়ে তাকালো।
–কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?
ফাইজার কথা শুনে সামরান থেমে গেল। পেছনে তাকিয়ে বলল,
–নতুন বিয়ে করেছি কত কাজ থাকতে পারে। আসছি। বলেই মায়াকে নিয়ে চলে গেল। ফাইজা চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। সিমি তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ফাইজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
–তোর জায়গা কোথাও নেই দেখেছিস? ভাইয়া আমার বোন কে অনেক ভালোবাসে। বাধা হয়ে দাড়াস না ফাইজা। দোহাই লাগি…
— আমি কি খুব দেরী করে ফেললাম সিমি?
— তোর কিছুই নেই। না কিছু তোর ছিলো। তাই ভুলে যাওয়াই ভালো।
ফাইজা চোখ বন্ধ করতেই কয়েক ফোটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ে।
মায়াকে রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় সামরান।
মায়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। মৃদুস্বরে বলল,
–আমাকে কেন নিয়ে এলেন? কি ভাববে ও?
–ও কি ভাববে তা তো জানিনা। তবে এক্ষুণি আমার দেওয়া কাজ করে না দিলে আমি কিন্তু ভালো ভাববো না! এগিয়ে এসে বলে সামরান।
সামরানের কথা শুনে মায়া মাথা তুলে তাকালো,
–কি কাজ?
— এগুলো খুলুন। নিজের শার্টের বোতামের দিকে ইশারা করে বলল সামরান।
–এগুলো? কিন্তু…
–চুপ!বেশি কথা একদম না। যা বলছি তাই করুন।
মায়া সামরানের শার্টে হাত রাখলো। বোতাম গুলো আস্তে আস্তে খুলে দিলো।
–সরিয়ে দিন। মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল সামরান।
মায়া শার্টের কলার সরাতেই সামরানের ঘাড়ে চোখ পড়লো মায়ার। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো মায়ার। মুহুর্তেই চোখ পানিতে৷ ভর্তি হয়ে উঠলো। হাত উপরে তুলে সামরানের ঘাড়ে স্পর্শ করলো। সামরানের মুখে হাসি। অশ্রুসিক্ত নয়নে সামরানের দিকে তাকালো মায়া। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল
–ব্যাথা পান নি?
–কিসের ব্যাথা?
–কেন করলেন এটা?
–আজীবনের সাইন।
–আমি চাইনি..
–আমি তো চেয়েছি। আপনি খুশি হন নি?
মায়া একবার সামরানের ঘাড়ের দিকে তাকালো। ঘাড়ে ফুলে আছে। ঘাড়ে ‘MaYa’ লেখাটিতে স্পর্শ করে বলল,
–অনেক হয়েছি। তবে আর কোনোদিন এমন কিছু করবেন না কেমন?
মায়াকে কাছে টেনে নিল সামরান।
–খিদে পেয়েছে আজ! অনেক।
মায়া দুপায়ের তালুতে ভর দিয়ে একটু উঁচু হলো। কিন্তু সামরানের কান অবধি পৌঁছালো না। মুচকি হেসে সামরান একটু ঝুকলো। মায়া দুহাতে গলা জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
–সবাই নিচে অপেক্ষা করছে আমার যাওয়া উচিত।
বলেই মায়া খিলখিলিয়ে হেসে দিল। সামরান চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লো।
–আপনি এত দুষ্টু কেন?
–জানি না। নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো মায়া। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। পেছনে ফিরে বলল,
–জলদি আসবেন কেমন?
–আচ্ছা। মুচকি হাসি হাসলো সামরান।
সন্ধ্যা নেমেছে। বাহিরে প্রচন্ড জোরে বাতাস বইছে। হয়তো বৃষ্টি হবে। ফাইজা যেতে পারে নি। বাড়িতেই রয়ে গেল। সামাদ মালিক বাড়ি নেই। সামনে নির্বাচন তাই তিনি পার্টির কাজে ঢাকা গিয়েছেন। ফাইজা কে বাড়িতে দেখে শেহেরজাদ অতি কষ্টে রাগ দমন করলো। নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ঘরে ঘরে পায়চারী করছে শেহেরজাদ। সিমি রুমে প্রবেশ করতেই সিমির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। শক্ত কন্ঠে সিমিকে বলল,
–কেন এসেছে ওই মেয়ে?
–আমি জানি না….দৃষ্টি নত করে বলল সিমি।
শেহেরজাদ দুইহাতে সিমির বাহু চেপে ধরলো। ব্যাথায় সিমির চোখের কোণে জল জমাট বাধলো।
–আমার ভাই এর মাইন্ড যদি বদলে যায় আমি কিন্তু কাউকে ছাড়বো না। সিমিকে ছেড়ে দিয়ে শেহেরজাদ বেরিয়ে গেল। সিমি হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে নিল।
রুমে বসে কফি খাচ্ছিলো সামরান। দরজায় ঠকঠক শব্দ পেয়ে ভেতরে আসার অনুমতি দিলো। কফির মগ টেবিলে রেখে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো ফাইজা। ধপ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায় সামরান। ফাইজা সামরানের সামনে এসে দাঁড়ায়,
–সামরান?
সামরান এড়িয়ে যেতে চাইলে ফাইজা হাত ধরে নেয়।
হাতের মুঠো শক্ত করে নেয় সামরান।
–কেন এমন করছো তুমি? আমি ভুল করেছি মানলাম। আমাকে একটা সুযোগ অন্তত দিতে। দেখো আমি এখনো তোমার জন্য নিজেকে কারো বাধনে বাধিনি। আমি এখনো তোমাকে চাই সামরান। আমাকে একটি বার সুযোগ দাও। প্লিজ।
সামরান এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো। পেছনে ফিরে ফাইজার গাল চেপে ধরলো। ফাইজা ব্যাথায় ‘আহ্’ বলে চোখ বন্ধ করে নিলো। সামরান দাতেঁ দাতঁ চেপে বলল,
–ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট ওকে? আমার থেকে যত দূরে থাকবে ততই তোমার জন্য মঙ্গল। আমি কিন্তু আগের মত নেই। আমার পথে কাটা হতে এসো না। তোমার কি হবে তুমি নিজেও জানো না। নিজেও শান্তিতে থাকো আমাকেও থাকতে দাও। নাহলে….ফাইজা কে ছেড়ে দিলো সামরান। চলে যাও এখান থেকে। আমার রুমে আসার দুঃস্বাহস আর দেখাবে না। পরিণতি খুব খারাপ হবে।
ফাইজা দূচোখের অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে সামরানের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ফাইজা বেরিয়ে যেতেই সামরান ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। দুহাতে মাথা চেপে ধরলো।
চোখ বন্ধ করে নিলো সামরান। হঠাৎ ফোনের মেসেজ টুন বেজে উঠলো। পাশে থাকা ফোন হাতে তুলে দেখল একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজ ওপেন করতেই সামরানের চোখ মুখের রঙ বদলে গেল। বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে উঠে দাড়ালো। হাতে থাকা ফোন শক্ত করে চেপে ধরলো।
#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_২৭
সামরানের হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে একটি ভিডিও। কিছু কিছু সিন যোগ করে একটি ভিডিও বানানো হয়েছে। সামরানের অবৈধ অস্ত্রের কারখানা, বে-আইনি অস্ত্রের ডিল করা। সব এই ভিডিওতে আছে। সবশেষে যেটা আছে সেটা হলো আজকে সকালের ভিডিও। আহসান মুনির কে খুন করার পুরো দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফোন আরো শক্ত করে চেপে ধরলো সামরান। রাগ দরদর করে বেড়ে চলেছে। ভিডিও শেষে একটি আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এলো,
— মি.মালিক!তোমার মায়া এসব দেখার পর কেমন রিয়েকশন দেবে কোনো ধারণা আছে? এসব দেখার পর কি সে তোমার সাথে থাকবে? আমার তো মনে হয় না। কারণ তুমিও জানো। তেলে জলে মেলে না সামরান মালিক। কখনো মেলে না। তুমি তো সেই তেল, আর তোমার মায়া জল। তোমাদের মিলন অসম্ভব। তার উপর এসব জানলে সে কখনোই থাকবে না। ছেড়ে দেবে তোমায়। আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেবে তোমাকে। পারবে তার অবহেলা সহ্য করতে। নাউ চয়েস ইস ইউরস, তুমি কি করবে? এই রাস্তা ছেড়ে দিলে কিন্তু এই ভিডিও তোমার বউয়ের কাছে চলে যাবে। শুধু তাই না, তোমার বউ নিলামে উঠবে। পারবে তো সইতে? নাউ ডিসিশন ইজ ইউরস!!
শেষের লাইনটা পড়ে সামরান ফোন বিছানায় ছুড়ে মারলো। ফ্লোরে বসে পড়লো। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে।
–আমি এই রাস্তা ছাড়বো না। কিছুতেই ছাড়বো না। আমার অলকানন্দা নিলামে উঠবে না। কিছুতেই না। দরকার পরলে আমি এই পৃথিবীর বুকে যত মেয়ে আছে সবাইকে নিলামে তুলে দেব তারপরও আমার অলকানন্দা না। তার কাছে আসার সমস্ত রাস্তা আমি বন্ধ করে দেব। কেউ তার একটু ঝলক ও দেখবে না। দেখতে দেব না আমি। সে শুধু আমার। শুধু আমার।
পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। বাহিরে প্রকৃতির তান্ডব, আর ভেতরে সামরানের বুকের ভেতর চলতে থাকা তুফান এর তান্ডব। কিভাবে সামাল দেবে সামরান? নিজেকে এত আড়ালে রাখার পরও কেন এসব হচ্ছে? কে করছে এসব?
হাজারো প্রশ্ন সামরানের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। সমস্ত প্রশ্নেরা মাথায় একজোট হয়ে জমাট বেধেছে। কে দেবে এত প্রশ্নের উত্তর? কার কাছে পাবে এত উত্তর?
রাতে খাবার টেবিলে সেলিনা মালিক খেতে আসেন নি। কারণ ফাইজা! মায়া প্লেটে খাবার সাজিয়ে ঘুরে দাড়াতেই সামরানের দেখা। মায়ার হাতে খাবারের প্লেট দেখে সামরান ভ্রু কুঁচকালো।
–কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
–আম্মা খেতে আসেনি। তাই..
–ওহহ!(ফাইজার দিকে একবার তাকালো সামরান) আমাকে দিন আমি নিয়ে যাচ্ছি।
–আচ্ছা এই নিন। প্লেট সামরানের হাতে দিতেই শেহেরজাদ এসে হাজির হলো।
–কোথায় যাচ্ছিস?
–মায়ের রুমে..
–চল আমিও যাবো।
–চল। দুই ভাই সেলিনা মালিকের রুমের দিকে পা বাড়ালো। দরজার সামনে গিয়ে সামরান দরজায় নক করলো। দরজার শব্দ শুনে সেলিনা মালিক ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। সামরান খাবারের প্লেট নিয়ে পাশে গিয়ে বসলো। শেহেরজাদ বিছানার উপর উঠে বসলো।
–কি ব্যাপার? এখানে কি?
–তুমি খেতে যাওনি কেন? এই নাও আমরা খাবার নিয়ে এসেছি। বলেই প্লেটের ঢাকনা সরিয়ে দিলো সামরান।
সেলিনা মালিক হালকা হাসলো,
–তোরা খেয়েছিস?
–নাহ খাইনি।
–আয় আমি খাইয়ে দিই।
–সত্যি খাইয়ে দিবে!! একটু এগিয়ে বলে শেহেরজাদ। সেলিনা মালিক হাসলেন,
–হ্যা খাইয়ে দেব। আয়!
ভাত মাখিয়ে সেলিনা মালিক দিতে গিয়ে থমকে গেলেন। কাকে আগে দেবে? দুজনই যে সামনে! দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতে থাকা ভাতের লোকমার দিকে তাকালো সেলিনা মালিক। সামরান কিছু বলার আগে শেহেরজাদ বলে উঠে,
–আমাকে আগে দাও,ওকে পরে দেবে।
–কি কারণে? আগে আমি!আমি বড়।
–এই কারণেই তো তুই পরে খাবি। বড়দের আগে খেতে হয় না। ছোটরা আগে খায়।
–এই!এটা কোন হাদিসে আছে?
–আমার হাদিসে। মা তুমি দাও তো। ওর কথায় কান দিও না।
–একদম না। মা আমার অনেক খিদে পেয়েছে আমাকে আগে দাও। সেলিনা মালিক দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আজ কত বছর পর তার দুই ছেলে এমন জেদ করছে। নিজের অজান্তেই সেলিনা মালিকের চোখের কোণে পানি এসে গেল। চোখের পানি আড়াল করে নিলেন।
–কাউকে আগে খেতে হবে না। আগে আমি খাবো তারপর তোরা। বলেই হাতে থাকা ভাত নিজেই খেয়ে নিলেন সেলিনা মালিক। সামরান ফিক করে হেসে দিলো।
–তুমি খেয়েছ এটাই অনেক। আমার খাওয়া হয়ে গেছে এবার আগে ওকে দাও আমাকে পরে দিলেও চলবে।
–না না আগে ওকে দাও আমি পরে খেয়ে নেব।
সেলিনা মালিক ভ্রু কুঁচকে নিলেন। সামরানের দিকে তাকাতেই সামরান আর সেলিনা মালিক হেসে দিলো একসাথে। শেহেরজাদ নিজেই নিজের মাথায় হালকা চড় বসালো।
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মায়া সবটা দেখছিলো।
চোখের কোণে জমে থাকা জল আঙুল দিয়ে মুছে নিলো।
— এত বড় বড় ছেলেরা অথচ তাদের মা তাদের কাছে সব। ছোট বাচ্চাদের মত এখনো তারা মায়ের কাছে বায়না ধরছে। কত সুন্দর দৃশ্য, ইশশ!এমন সন্তান ঘরে ঘরে হোক। একটি ওয়াদা আমি নিজেই নিজের কাছে করছি, এই পরিবারে আর কোনো আঁচড় আমি লাগতে দেব না। যেই সুখের দেখা এই মুহুর্তে তারা পেয়েছে তা আমি আজীবন ধরে রাখবো। এমন মুহুর্ত প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণে হোক। এদের বিচ্ছেদ না হোক। আমি হতে দেব না। এই পরিবারের সুখ শান্তি আমি হারিয়ে যেতে দেব না। যত বড় তুফানই আসুক না কেন। এদের এই সম্পর্কে আর ফাটল ধরবে না। কক্ষনো না। বলেই হালকা হাসলো মায়া।
রাত ১২টা ৫৫ মিনিট!! ১টা বাজতে আর ৫মিনিট বাকি। ডিভানে বসে আছে শেহেরজাদ। সিমি এখনো রুমে আসলো না। এই মেয়েকে আজকাল কাছে পাওয়াই যায় না। কোথায় কোথায় যে থাকে। সিমির কথা ভাবতে ভাবতেই সিমি রুমে এসে হাজির হলো। ওয়ারড্রব থেকে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো শেহেরজাদ বসে আছে।
–একিই ঘুমান নি আপনি?
শেহেরজাদ উঠে এসে সিমির সামনে দাড়ালো,
–কই ছিলে তুমি? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম আর তুমি?এতক্ষণে আসার সময় হলো তোমার?
–সরি আসলে..
–হুশশশ!আর কিছু বলতে হবে না। সিমির হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বেডে বসালো। তারপর নিজে গিয়ে সিমির পেছনে বসলো। সিমি একটি লং থ্রি পিস পরেছে। পেছনে গলা বড়, আর ফিতা দেওয়া। পিঠের উপর ছড়িয়ে থাকা চুল শেহেরজাদ আলতো করে সরিয়ে দিলো। সিমি বুঝতে পারছে না শেহেরজাদ কি করছে। সিমিকে অবাক করে দিয়ে সিমির জামার ফিতা খুলে দিলো শেহেরজাদ। কাধ থেকে জামা সরিয়ে সিমির জামা নিচে নামিয়ে দেয়। ড্রেসিং টেবিল সামনে থাকায় আয়নায় শেহেরজাদ কে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সিমি। গলা শুকিয়ে আসছে। নিঃশ্বাসের মাত্রা বেড়ে গেল সিমির। শেহেরজাদ একবার আয়নার দিকে তাকালো। সিমি ঢোক গিলে শেহেরজাদের চোখে চোখ রাখলো। সিমির দিকে চোখ রেখেই শেহেরজাদ এক হাত বাড়িয়ে বেড সাইড টেবিলের উপর থাকা মলম টা নিলো। সন্ধ্যায় সিমিকে রাগের বশে এত শক্ত করে ধরেছিলো যে সিমির বাহুতে রক্ত জমাট বেধে আঙুলের ছাপ বসে গেছিলো। শেহেরজাদ সিমির থেকে চোখ সরিয়ে বাহুতে থাকা দাগের দিকে তাকালো। সিমি এতক্ষণে বুঝতে পারলো শেহেরজাদ কেন এসব করছে। আয়নায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শেহেরজাদ অতি যত্নে হাতের দাগে মলম লাগিয়ে দিচ্ছিলো। সিমির চোখে পানি টলমল করছে।
–এমন কেন আপনি? কেন এমন? নিজেই কষ্ট দেবেন আবার নিজেই আদর করবেন! নিজের দেওয়া ক্ষততে নিজেই এত যত্ন সহকারে ওষুধ কেন দেন আপনি? আমি কি এসবেরই যোগ্য? মনের কথা মনে চেপে রেখে সিমি আবারও দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই প্রশ্ন গুলো শুধু সিমির মনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। বাহিরে আসার উপায় নেই। কার সামনে রাখবে এসব প্রশ্ন? সামনে যে আছে সে যে নিজের রাগ ছাড়া কিছুই বোঝে না। সে কি বুঝবে সিমির মনের সেসব কথা, যা সিমিকে প্রতিনিয়ত পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে?
_____________________
ঘড়ির কাটায় ১টা পেরিয়েছে সে অনেক্ষণ হলো। সময় আপন গতিতে বয়ে চলেছে। রাতও গভীর হচ্ছে। সামরান রুমে পায়চারী করছে। খাওয়া শেষে আসার সময় মায়াকে বলেছিলো মায়া যেন তাড়াতাড়ি রুমে আসে অথচ মায়ার কোনো দেখা নেই। সেই ১০টাই সামরান রুমে এসেছে আর এখন ১টার বেশি বাজে অথচ মায়ার দেখা নেই। বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে সামরান। বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো সামরান। মায়া আস্তে করে রুমে প্রবেশ করলো। রুমে আগে উঁকি দিয়ে দেখতেই দেখলো রুম খালি। আস্তে আস্তে ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলো মায়া। রুমে আসার অনেক চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ফাইজা এত কথার ঝুড়ি খুলে বসেছিলো যে মায়া উঠে আসতেই পারছিলো না।
–লোকটা কি রাগ করলো? ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখ খিচে বন্ধ করে নিল মায়া। এক হাতে কপাল চাপড়ে নিজেকে নিজেই বকে দিলো,
–ছিঃ মায়া! দেড়টা বাজে আর তুই এখন রুমে এসেছিস। লোকটা কি ভাবলো। বুকে কয়েকটা ফু দিয়ে মায়া বারান্দার দিকে পা বাড়ালো। বারান্দায় সামরান দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে সামরানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় মায়া। সামরান মায়ার উপস্থিতি টের পেতেই বারান্দা ছেড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই মায়া হাত ধরে নিলো। সামরান পেছনে ফিরে হাতের দিকে তাকালো। মায়া হাত ছেড়ে দিলো।
— সরি!
–কি কারণে সরি?
–আমি তাড়াতাড়ি আসতে পারিনি তাই!
–আরেহ না!আপনি তো অনেক তাড়াতাড়ি এসেছেন। আমি এত তাড়াতাড়ি আপনাকে আশাই করি নি। আর একটু পর আসতেন। সামরানের কথার সুরে ভেসে এলো একরাশ অভিমান। মায়া চোখ তুলে তাকালো সামরানের দিকে। সামরান চোখ সরিয়ে নিলো। অন্যদিকে তাকাল। মায়া একটু এগিয়ে এলো,
–সরি আর হবে না।
–দরকার নেই,
–সরি তো!
–কেন? আপনি কেন সরি বলছেন? সরি তো আমার বলা উচিৎ। আই এম সরি!!
–না না আমি সরি। প্লিজ! অসহায় মুখ করে বলল মায়া। সামরানের কোনো পরিবর্তন হলো না। বাহিরে বৃষ্টি পড়ছে। প্রচন্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকালো। যার শব্দ শুনে মায়া ছুটে এসে দ্রুত সামরান কে জড়িয়ে ধরলো। আকস্মিক এমন হওয়াই সামরান টাল সামলাতে না পেরে দু কদম পিছিয়ে গেল। পরক্ষণেই বারান্দার দরজা পেছনে এক হাত দিয়ে ধরে নিজেকে সামলে নিল। মায়া এখনো সামরান কে জড়িয়ে আছে। একটু ঘুরে সামরান বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে দাড়ালো। মায়ার হেলদোল নেই, এখনো জড়িয়ে আছে। সামরান এবার দুহাতে মায়াকে জড়িয়ে ধরলো। এক হাত মায়ার কোমরে অন্য হাত পিঠে। মাথা হালকা সরিয়ে মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
–ছাড়ুন আমাকে!
–নাহহ! মায়ার মোহময়ী কন্ঠ শুনে সামরান চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল,
–আমার সমস্যা হচ্ছে!
–হোক! আমার জন্য একটু সমস্যা পোহাতে পারবেন না।
–আপনি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনছেন।
— চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন না। এত কথা কেন বলছেন?
সামরান হাতের বাধন আরো শক্ত করে দিলো। মৃদুস্বরে বলল,
–আপনার শরীর এত ঠান্ডা কেন?
–পরিবেশটাই এমন। একটু সরে এসে সামরানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল মায়া। সামরান এক টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
–জাদু জানেন আপনি!
সামরানের কথা শুনে মায়া সরে আসতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। সামরানের হাতের বাধন অনেক শক্ত ছিলো। যার দরুন শত চেষ্টা করেও সরে আসতে পারলো না মায়া।
সামরান চোখ বন্ধ করে রইলো। মায়াকে মোড়ামুড়ি করতে দেখে সহাস্যমুখে বলল,
–বলেছিলাম,নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনছেন। আপনি শুনলেন না। এখন সহ্য করুন।
সামরানের এহেন কথায় মায়া মুচকি হাসলো। দু পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সামরানের গলা দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
চলবে……???
#