প্রেমের খেয়া পর্ব ২৪+২৫

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_২৪

বিগত ৩০মিনিট ধরে বাসর ঘরে বসে আছে মায়া। অনুষ্ঠান শেষ হতেই সিমি মায়াকে বাসর ঘরে নিয়ে এসেছিল। বাসর ঘর দেখে মায়া খানিকটা অবাক হলো। পুরো রুম জুড়ে অলকানন্দা ফুল। মানুষ অলকানন্দা ফুল দিয়ে বাসর সাজায় নাকি? মায়ার জানা নেই। তবে রুমটি অসম্ভব সুন্দর লাগছে। পুরো রুম জুড়ে এক মিষ্টি ঘ্রাণ ছেয়ে আছে। অনেক্ষণ হলো মায়া একাই বসে আছে।ভারী সাজ,ভারী গহনায় প্রচন্ড অস্বস্তিবোধ করতে থাকে মেয়েটি। বার বার হাতে থাকা মোটা বালাগুলো নেড়ে দিচ্ছে। সামরান এখনো আসছে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে মায়া বিছানা ছেড়ে নেমে দাড়ালো। ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মায়া। একে একে হাতের বালা গুলো খুলে ফেলে। দুইহাতের কবজি মালিশ করে দেয়। ইশশ হালকা লাগছে এখন। তারপর গলার হার গুলোও খুলে ফেলে। গলার পাশে লাল দাগ বসে গেছে। এত ভারী গহনা পরে থাকা যায়? গলায় হাত দিয়ে মালিশ করে কানের দুল খুলে ফেলে। পুরো গহনা খোলার পর মায়া নিজের দিকে একবার তাকালো।

–ইশশ!কেমন লাগছে এখন? এতক্ষণ কেমন যেন লাগছিলো। আমি এভাবেই ঠিক আছি। ড্রেসিংটেবিলের উপর থাকা টিস্যুবক্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে মায়ার মুখ মুছতে থাকে। কিন্তু মেকাপ সে কি এত সহজে যায়? মায়া ওয়াশরুমে গেল। চোখ মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে সাবান দিয়ে ভালো করে মুখ ধুয়ে নেয়। রুমে এসে মুখ মুছে নেয় মায়া। চুলের বাধন খুলে দেয়। চুলের বাধন খুলে দিতেই ঘন কালো চুল খুলে পুরো পিঠে ছড়িয়ে গেল। কোমর অব্ধি গিয়ে ঠেকেছে। মায়া দু হাত পেছনে দিয়ে হাত খোপা করার জন্য চুল গুলো দু হাতের মুঠোই নিলো। তখনই দরজা খোলার শব্দে মায়া আয়নার দিকে তাকালো।

রুমে প্রবেশ করেই সামরান দরজা লাগিয়ে দেয়। পেছনে ফিরতেই মায়াকে এইভাবে দেখে সামরান থমকে দাঁড়ায়। মায়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আয়নায় মায়া সামরানকে দেখে চুল থেকে হাত সরিয়ে নিলো। চুল গুলো আবারো সারা পিঠ ঢেকে নিল।

সামরান ভ্রু কুঁচকে মায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মায়ার পেছনে দাড়ালো। আয়নায় মায়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,

–এসব কি? মেকাপ,জুয়েলারি কোথায় আপনার?

–খু-খুলে ফেলে-ফেলেছি….

–কেন? বলেই ভ্রু কুঁচকে নিল সামরান।
মায়া শুকনো ঢোক গিলে চোখ সরিয়ে নিল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

–অনেক অস্বস্তি হ-হচ্ছিলো তাই..

সামরান কিছু বললো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মায়ার হাতের কুনুই বরারর ধরে একটান দিতেই মায়া সামনে ফিরে গেল। ঘুরে যেতেই মায়ার অনেক চুল সামনে এসে পড়ে। সামরান একহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে। অন্য হাতে চুল গুলো সরিয়ে পেছনে রেখে দেয়। ঘাড়ে হাত রাখতেই মায়া চোখ কুঁচকে বন্ধ করে নেয়। সামরান মৃদুস্বরে বলল,

–ভালো করে নিজের বউকে দেখলামই না। দেখলাম না আমার অলকানন্দা কে বউসাজে কেমন লাগে?

মায়া চট করে সামরানের দিকে ত্রস্তনয়নে তাকালো।

–কি বললেন?

–শুনতে পান নি?

মায়া মাথা নিচু করে নেয়।
সামরান হাত সরিয়ে পেছনের চুলগুলো মায়ার বাম পাশের কাধে রাখে। ডান পাশের উন্মুক্ত কাধে সামরান চুমু দেয়। সামরান চুমু দিতেই মায়া এক হাতে সামরানের শেরওয়ানি খামছে ধরে। সামরান সরে আসে। পিছিয়ে যেতে যেতে বলে,

–শাড়ি বদলে নিন। ফ্রী ফিল করবেন।
মায়া থরথর করে কাপঁতে থাকে। এক হাতে পেছনে থাকা ড্রেসিংটেবিলের কোণা চেপে ধরে। একটু আগে যা হল তার জন্য মায়া মোটেও প্রস্তুত ছিল না। প্রথমবার নিজের শরীরে কারো স্পর্শ পেয়ে মায়ার যেন ভেতরটা ভেঙে চুরে খান খান হয়ে যাচ্ছিলো। সামরান একটি সুতির পাঞ্জাবী পড়ে নেয়। মায়া শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। শাড়ি বদলে বের হতেই দেখলো সামরান বিছানায় শুয়ে আছে। মায়া হাতের টাওয়াল সোফার উপর রেখে দিলো। সামরান মায়ার দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসে পড়লো। এতক্ষণ আধশোয়া অবস্থায় হেলান দিয়ে ছিলো….

–আপনি গোসল করেছেন?

–হ্যা অনেক গরম লাগছিলো।

–এসি ছিলো তো। বললেই আমি স্পিড বাড়িয়ে দিতাম।

–না থাক। এসি আমার সয় না।

সামরান চুপ করে রইলো। মায়ার চুল থেকে পানি পরছে। পানি পরতে পরতে কোমরের অংশ ভিজে গেছে। হাফ সিল্ক এর শাড়ি হওয়ায় ভিজে যাওয়াতে মায়ার কোমরে শাড়ি লেপ্টে আছে। নড়াচড়াতে শাড়ি অনেকটা সরে গেছে। পিঠের ভেজা অংশের দিকে তাকিয়ে সামরান চোখ বন্ধ করে মাথা ঘুরিয়ে নিলো। একটু পর উঠে গিয়ে টাওয়াল নিয়ে মায়ার সামনে দাঁড়ায়।

–মোছা হয়নি। পানি ঝরছে এদিকে আসুন আমি মুঁছে দিই। বলেই মায়ার চুল মুছে দিতে থাকে সামরান। মায়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামরানের দিকে। সামরান চুল মুছতে মুছতে বলে উঠে,

–কি দেখছেন এমন করে?

–আপনি এত কিউট কেন? মায়ার কথা শুনে সামরানের হাত থেমে যায়। মায়ার চেহারার দিকে তাকাতেই মায়া লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।

–এত লজ্জা পেলে চলবে?

–একটা সত্যি কথা বলবেন? মাথা উঁচু করে সামরানের দিকে তাকালো মায়া।

–বলুন!

–আমাকে ভালোবাসেন?

–নাহলে কি বিয়ে করতাম?

–সোজা ভাবে বলুন না!

–কি হয়েছে?

মায়া দুপায়ের আঙুলে ভর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে দাড়ালো। দুহাতে সামরানের গলা জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

–ভালোবাসা কি জানিনা তবে আমার আপনাকে অনেক ভালো লাগে। যার মূল কারণ আপনার রঙ। মায়া সরে আসে। সামরান মৃদু হেসে সরস গলায় বলে —

–ফর্সা হলে?

–বিয়েই করতাম না।

মাথা উঁচু করে সামরান গগন কাপানো হাসি হাসলো। তারপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

–ভালোই হয়েছে কালো হয়ে বলুন।

–আপনিতো কালো না।

–তাহলে?

–কেন বলবো? ভ্রু কুঁচকে নেয় মায়া। সামরান হাতের টাওয়াল সোফায় ছুড়ে মারে। মায়ার কোমর ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। একহাতে মায়ার গাল স্পর্শ করে বলে–

–আমি মরে যাবো। বিশ্বাস করুন আমি সত্যিই মরে যাবো যদি আপনি কোনোদিন আমার কাছ থেকে দূরে সরে যান।

–আমি যাবো না তো!

শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সামরান মায়াকে। মায়ার দম বন্ধ হয়ে আসে। সামরান কে নিজের থেকে সরিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে,

–এইভাবে শক্ত করে কে কাকে ধরে? হায় আল্লাহ কিভাবে ধরলেন আর একটু হলেই দম বন্ধ হয়ে যেত।

–সরি সরি আর এমন করে ধরবো না।

–ধরবেনই না। দূরে দূরে থাকুন।

সামরান আবারো একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। এইবার কোলেই তুলে নিলো। বিছানায় শুয়ে পাশে শুয়ে পড়ে। মায়া তাকিয়ে রইলো সামরানের দিকে। মায়ার দিকে সামরান মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে এগিয়ে মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে–

–আমি এতটা ভালো কাউকে বাসিনি,যতটা ভালো আমি আপনাকে বেসেছি অলকানন্দা। সামরানের কথা শুনে মায়া চোখ বন্ধ করে নিল। সামরান মায়ার গলায় আলতো ভাবে চুমু দিলো। মায়া চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়। কাপাস্বরে বলল–

— আজ থাক!

মায়ার কন্ঠ কানে যেতেই সামরান থেমে গেল। মায়ার থেকে সরে এসে বলে,

–ভাগ্যিস আমি মাতাল হয়ে যাইনি। নাহলে এই আওয়াজ কানে পৌঁছাতো না।

মায়া হাসলো। সামরান মায়ার বুকে মাথা রেখে বলল,

–আমি এখানে ঘুমাই কেমন? আপনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিন। খবরদার আমাকে সরানোর চেষ্টা করবেন না।
সামরানের এমন কথা শুনে মায়া ঠোঁট কামড়ে হাসলো।

সকালে সূর্যের আলো মুখে পড়তেই মায়ার ঘুম ভেঙে যায়। সোজা হয়ে বসতে চাইলেই মায়া নিজের উপর ভারী কিছুর আভাস পেল। নিজের দিলে তাকাতেই দেখলো সামরান পেটের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। মায়া মুচকি হেসে সামরানের চুলে হাত রাখে।

–সামরান? সামরান!!উঠুন,দেখুন সকাল হয়ে গেছে।

মায়ার ডাকে সামরানের কোনো পরিবর্তন হলো না। মায়া আবারো ডাকলো,

–এই সামরান!!উঠুন না। সকাল হয়ে গেছে। সামরান মায়ার পেটে আরো মুখ গুজে দিলো। দাঁড়ির খোচা লাগতেই মায়া মৃদু আর্তনাদ করে উঠল,

–আহহ!
সামরান ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।

–কি হলো আপনার? আপনি ঠিক আছেন?

মায়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। দু হাত বিছানায় ঠেকিয়ে ভর দিয়ে উঠে বসে মায়া।

–এই অল্প আওয়াজ কানে গেল কি করে? এতক্ষণ ডাকছিলাম কই সেটা তো কানে গেল না?

–কি হলো বলুন না।

মায়া কিছু না বলে সামরানের গালে হাত রাখে,

–মাথা রেখে যে ঘুমাচ্ছিলেন এই সুচের মত অস্ত্রগুলোতে আহত হয়ে গেছি আমি।

সামরান এক হাতে গাল স্পর্শ করলো,

–দাঁড়ির খোচা?

–হুম। সামরান এগিয়ে এসে মায়াকে চেপে ধরে মায়ার গালে গাল ঘষে দিল।

–এবার ঠিক আছে?

–বাপরে এত ভয়ংকর কারো দাঁড়ি হয়?

–আমি নিজেও ভয়ংকর।

–বুঝেছি।

মায়ার কাছে এগিয়ে এসে মায়ার গালে হাত রেখে বলে,

–আপনাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে..

–এই ভাবে সরাসরি কে প্রশংসা করে?

–আমি করি!

–লজ্জা দেওয়ার বাহানা!

–মোটেই না।

–হুম বুঝলাম বলেই মায়া বিছানা ছেড়ে নেমে গেল।

–কোথায় যাচ্ছেন?

–৭টা বাজে। আমি এতক্ষণ ঘুমাই না জনাব।

–এত সকাল?

–এত না অনেক বেলা। উঠলাম আমি আপনি ঘুমান।

–আমারো আর ঘুম হবে না। বলেই বিছানা ছেড়ে নেমে দাড়ালো সামরান।

মায়া ফ্রেশ হতে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে আসতেই সামরান কে ওয়াশরুমে যেতে বলে। সামরান ধরতে এলেই মায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,

–একদম না! আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন।
ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে সামরান ওয়াশরুমে চলে গেল।

ডাইনিং টেবিলে বসে আছে সবাই। সিমি আর মায়া মিলে খাবার টেবিল সাজিয়েছে। সেলিনা মালিক আসতেই মায়া চেয়ার টেনে দিলো। সেলিনা মালিক টেবিলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন,

–বাহহ!! কে করলো এসব?

–আমরা দুজন। মায়া হেসে উত্তর দিলো।

–স্মেলস গুড। খাবারটাও দারুণ হবে। চেয়ারে বসতে বসতে বলে সেলিনা মালিক।

শেহেরজাদ এসে পাশে বসে পড়ে,

–বাহহ এত খাবার। তবে আমি এসব খাবো না। আমাকে গ্রিন টি দাও।

–আজকে খেয়ে নিন। শেহেরজাদ সিমির দিকে তাকালো,

–হ্যা ভাইয়া আপু অনেক যত্ন করে বানিয়েছে।
শেহেরজাদ হাসলো মায়ার কথায়।

–এমনিতেও খিদে পেয়েছে। দাও দাও খেয়ে নি।
সিমি হাসি মুখে শেহেরজাদের প্লেটে পরোটা আর মাংস তুলে দিলো।

সামরান এসেই মায়ার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে,

–আমার একটু বের হতে হবে আমি যাই কেমন।
সেলিনা মালিক ভ্রু কুঁচকে নিলেন,

–খেয়ে তারপর যা।

–অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। এসে খাবো।

মায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো পাশে। সামরান যাওয়ার আগে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

–আমি আসছি কেমন। আপনি খেয়ে নিন। বলেই মায়ার কপালে চুমু দিয়ে লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল। মায়া পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে গেল। উপস্থিতি সবাই মায়ার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু আগে যা হলো তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। মায়া লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। মনে মনে আল্লাহ নাম জপতে থাকে। এ কেমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো। সামরান এর এহেন কাজে মায়ার চারপাশ ভারী লাগছে। সেলিনা মালিক চুপচাপ খাওয়া শুরু করলেন। শেহেরজাদ মুচকি হেসে খাওয়াই মনোযোগ দিলো। আর মায়া সে নতনয়ন অবস্থায় থর থর করে কাঁপছে। সিমি কাধে হাত রাখতেই ত্রস্ত নয়নে তাকালো। সিমি মুচকি হেসে ইশারায় স্বাভাবিক হতে বলল। মায়া চোখ বন্ধ করে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিল। আর মনে মনে সামরান কে এক দফা ধুয়ে দিলো। লোকটা এমন কেন? আজ ফিরুক বাড়ি ইচ্ছে মত ধুয়ে দেবে।

আফজাল মুনির সকাল থেকেই ব্যস্ত। আজ তাদের স্যার আসবে। এই প্রথম সেই মানুষটিকে দেখবে যাকে দেখার ইচ্ছে আফজাল মুনিরের অনেক দিনের। রাহাদ নিজেও আছে। আফজাল মুনির সব গুছিয়ে রেখেছেন। পুরো হল অন্ধকার করে রেখেছে। আবছা আলো আসছে। হঠাৎ গাড়ির শব্দে পেছনে ফিরে তাকালো আফজাল মুনির। গাড়ির হেড লাইটের আলোয় কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। একহাত চোখের সামনে রেখে আলো থামানোর বৃথা চেষ্টা চালালো আফজাল মুনির। শব্দ গাড়ির দরজা খুলে যায়। কারো এগিয়ে আসার শব্দ কর্ণকুহরে স্পষ্ট আঘাত হানছে। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলো। চারদিকে আলো জ্বলে উঠতেই আফজাল মুনির ত্রস্তনয়নে চারপাশে তাকালো।
তারপর সামনে তাকাতেই মুখের হাসির রেখা ফুটে উঠলো আফজাল মুনিরের। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে আফজাল মুনির। তার পেছনে রয়েছে চারজন কালো পোশাক পরিহিত গার্ড। এই একটা মানুষ কে দেখার অনেক ইচ্ছে ছিলো আফজাল মুনির এর। আজ সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলো। সামনে থাকা গম্ভীর মানুষটির দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো আফজাল মুনির।

–কেমন আছেন স্যার?
#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_২৫

–স্যার!বড় স্যার এসেছেন।

গার্ডের কথা শুনে পেছন ফিরে তাকালো রাহাদ। মুখে বিশ্বজয়ের হাসি হেসে ঘুরে দাড়ালো।

–আমি আসছি তুমি যাও।
গার্ড চলে যেতেই বেসিনে গিয়ে হাতে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে নিল। টিস্যুপেপারে হাত মুছতে মুছতে হলরুমের দিকে এগিয়ে গেল রাহাদ। হলরুমে পা রাখতেই দেখলো আফজাল মুনির দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনেই বিশাল চেয়ারে কেউ একজন বসা। পেছন থেকে দেখার বৃথা চেষ্টা চালালো রাহাদ। বসে থাকা লোকটির বসার ভঙ্গিমা ভারী অদ্ভুত। চেয়ারের হাতলে কুনুই ঠেকিয়ে একবার হাত মুষ্টিবদ্ধ করছে আবারো হাতের মুঠো খুলে দিচ্ছে। কালো শার্টের হাতা কুনুই অবধি ভাজ করা। রাহাদ এগিয়ে গেল। রাহাদ কে দেখে আফজাল মুনি হাসলো।

–স্যার আপনাকে বলেছিলাম না আমাদের মধ্যে একজন এর কাজ অনেক ভালো এই হলো সেই ছেলে। আফজাল মুনিরের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বসে থাকা লোকটি চেয়ার ঘুরিয়ে নিলো। চেয়ার ঘুরে রাহাদের সামনে থামতেই রাহাদ চমকে গেল। বড়সড় একটা ধাক্কা রাহাদ খেল। দু পা পিছিয়ে গেল। সামনে বসে থাকা লোকটিকে আরো দুইবার দেখেছে রাহাদ। হাতে থাকা ভেজা টিস্যু মাটিতে পড়ে গেল। সামনে বসে থাকা লোকটি আর কেউ না। স্বয়ং সামরান মালিক। সামরান কে মায়ার সাথে দেখেছিল রাহাদ। আর বিয়েতে। রাহাফ ভাবতেও পারে নি সামরানই সেই লোক যার কথায় এত বড় সাম্রাজ্য উঠছে আর বসছে।
চেয়ারে বসে থাকা সামরান রাহাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। রাহাদকে কিছুক্ষণ দেখে চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে আফজাল মুনিরের সামনে ফিরলো সামরান। সামনে থাকা সেন্টার টেবিলের উপর দুই পা তুলে দিয়ে আফজাল মুনিরের দিকে তাকাতেই আফজাল মুনির উঠে দাড়ালো। গার্ডদের ইশারা দিতেই একটি ল্যাপটপ এনে সামরানের সামনে রাখলো। সোজা হয়ে বসে ল্যাপটপ সামনে টেনে নিলো সামরান। যেই রুমে মেয়েদের রাখা হয়েছে সেই রুমের সিসিটিভি ফুটেজ অন করতেই দেখলো মেয়েদের বেহাল দশা। ভ্রু কুঁচকে এলো সামরানের। আফজাল মুনিরের দিকে তাকালো,

–আমি জিনিসে হাত দিতে নিষেধ করেছিলাম।
সামরানের শক্ত কন্ঠ শুনে আফজাল মুনির চমকে তাকালো,

–স্যার আসলে, অনেক উত্তেজনা সৃষ্টি করছিলো তাই।

–তাই?

–সরি স্যার।

–আই ডোন্ট লাইক দিস ওয়ার্ড ওকে?

— ওকে স্যার।

–অল ডান? সাপ্লাই কবে হবে?

সামরানের কথা শেষ হতেই রাহাদ সামনে এসে দাঁড়ায়। আহসান মুনির কে দিতেই সে সামরানের সামনে এসে মাথা নিচু করে বলে,

–স্যার সাপ্লাই তো হবে। তবে একজন কে লাগবে। আর আমরা আশা রাখি তার ডিমান্ড ও অনেক।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সামরান।

–কাকে? কে সে?

–আছে একজন। আপনি চাইলে আমরা শো করতে পারি। আহসান মুনিরের কথা শুনে আফজাল মুনিরের দিকে একবার তাকালো সামরান।

–শো মি!

সামরানের সামনে থাকা এলইডি টিভির পর্দা জ্বলে উঠে। পুরো রুম অন্ধকার হয়ে যায়। টিভির পর্দায় ভেসে উঠে একটি হাসোজ্জল চেহারা। সম্পুর্ণ ছবি ভেসে উঠতেই সামরান চেয়ার ছেড়ে ধপ করে উঠে দাড়ালো। সাথে সাথেই কপালের রগ ফুলে উঠলো। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়লো হিংস্রতা। হাতের মুঠো শক্ত করে নিলো। সামনে থাকা ছবিটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামরান। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে স্ক্রিনে হাত রাখলো। স্ক্রিনে ভাসছে তারই মায়ার হাসোজ্জল চেহারা। গালে স্পর্শ করে সামরান চোখ বন্ধ করে নিলো। রাহাদ হালকা হাসলো হাসি লুকিয়ে আহসান মুনির কে আবারও ইশারা দিলো। আহসান মুনির সামরানের দিকে কয়েকপা এগিয়ে গেল,

–দেখেছেন স্যার মেয়েটিই এমন প্রতিটি পুরুষের হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। এই একটি ছবির ডিমান্ড অনেক। ভাবুন এই জলজ্যান্ত মেয়ের ডিমান্ড কত হবে। বয়স অনুযায়ী রুপ হাজার গুন বেশি।

সামরান চোখ খুলে নিলো। পেছনে ফিরে আহসান মুনিরের গলা চেপে ধরলো।

–কি বললি? ডিমান্ড? সব পুরুষের হৃদয় নাড়িয়ে দেয়? তোরও নাড়িয়েছে তাই না? চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে সামরানের। হুট করেই এমন একটা পরিস্থিতি উপস্থিত হবে কেউই ভাবতে পারে নি। আফজাল মুনির আঁতকে উঠলো। কিন্তু সামনে এগোনোর সাহস আফজাল মুনিরের নেই। পেছনে হাত দিয়ে কোমরে থাকা রিভলবার বের করে আহসান মুনিরের কপালে ঠেকিয়ে সামরান মাথা বাকা করলো,

–তোর বেচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। গুড বাই। বলেই সামরান শুট করে দিলো। আহসান মুনির ছিটকে খানিকটা দূরে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। কারেন্ট বোর্ডের দিকে তাকিয়ে সামরান রিভলবার তাক করলো। শুট করতেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো পুরো রুমের লাইট বন্ধ হয়ে গেল। আগুনের লাল আভায় সবাইকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সামরানের এহেন রুপে সবাই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। চোখের সামনে নিজের ভাইয়ের লাশ পড়ে থাকতে দেখেও আফজাল মুনির ভাইয়ের লাশের কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। একটু এগিয়ে গিয়ে সামরান লাশের পাশে বসে পড়ে। হাত দিয়ে রক্ত স্পর্শ করে, রক্তমাখা হাত চোখের সামনে ধরলো,

–“সে আমার জান, তার দিকে তাকানোর অপরাধের শাস্তি শুধুই মৃত্যু! যেটা স্বয়ং আমি দেব”! রক্তবর্ণ চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। মুহুর্তেই হিংস্র হয়ে উঠেছে মায়াবী মুখশ্রী টা। কপালের রগ ফুলে উঠেছে শক্ত হয়ে গেছে চোয়াল। সামরানের কথা শুনে কয়েকপা পিছিয়ে গেল আফজাল মুনির। কোন সর্বনাশ ডেকে আনলো? সামরান হিংস্র আগে শুনেছে আজ দেখেও নিল। থর থর করে কাপঁছে আফজাল মুনির। রাহাদ আফজাল মুনির এর দিকে একবার তাকালো তারপর সামরানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়,

–স্যার মেয়েটি আপনার কে হয়?

রাহাদের কন্ঠ কানে পৌঁছাতেই সামরান পেছনে ফিরে তাকালো। রাহাদ এর দিকে তাকিয়ে বলল,

–ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। আদারওয়াইস পরিণাম খুব খারাপ হয়ে যাবে। একটা কথা সবাই কান খুলে শুনে রাখো আমি সব মেনে নিলেও আমার জিনিসে কেউ নজর দেবে সেটা মেনে নেব না। আমার জান,আমার মায়ার দিকে যে হাত বাড়াবে তার হাত আমি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেব। আজ থেকে আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করবে না। আজ থেকে আমার রাস্তা আলাদা আর তোমাদের রাস্তা আলাদা। কথা বলতে বলতে সামরান আফজাল মুনিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়,

— একটা মেয়েও কোথাও যাবে না। সবাইকে সুস্থ শরীরে নিজের বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করো।

–ক–কিন্তু ক্লাইন্ট?

–ক্লাইন্টদের তাদের দেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে দাও। আজ এই মুহুর্তে এই বিজনেসের ইতি টানবো আমি। আর কোনো মেয়ে পাচার হবে না। আর তোমরা ভালো হয়ে যাও। আমাকে আর তোমাদের সাথে পাবে না। যেটা বলেছি সেটা মাথায় রেখো। একটা মেয়েও কোথাও যাবে না। সবাইকে তাদের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করো। সামরান লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল। সামরান চলে যেতেই রাহাদ আফজাল মুনিরের সামনে এসে দাড়ালো।

–এত দূর এসে এখন সব শেষ করা মানে কি জানেন আপনি? আমাদের আজীবন জেল এ পচে মরতে হবে। এইখান থেকে একটা মেয়েও বাড়ি ফেরত গেলে আপনার আমার কি হবে জানেন? আর ক্লাইন্ট থেকে যেই টাকা নিয়েছেন তার ফেরত দিলেও ক্লাইন্ট কি এই শেষ মুহুর্তে এসে সব মেনে নেবে? মি.মুনির আপনার ভাইকে চোখের সামনে এইভাবে মেরে দিলো আর আপনি? চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলেন? সে চাইলেই বেরিয়ে যেতে পারবে এই দুনিয়া থেকে কারণ সে নিজেই এই দুনিয়া বানিয়েছে। কিন্তু কারো সামনে আসেনি। আপনি, আমি, আমরা সবাই কিন্তু চাইলেও বের হতে পারবো না। কি নেই এই দুনিয়াই? টাকা,মান-সম্মান,সব আছে। কেন এই পথ ছেড়ে দেব আমরা। উনি সামান্য একটা মেয়ের জন্য আপনার ভাইকে মেরে দিলো। আপনি এইভাবে সব মেনে নেবেন? বললেই কি সব শেষ করা যায় মুনির সাহেব? এতদিন যে মেয়ের আশা ধরে বসে ছিলাম আমরা আজ এসে শুনতে হলো তার নামও মুখে নেওয়া যাবে না। এটাই কি চেয়েছিলাম আমরা?

রাহাদের কথা শুনে আফজাল মুনির উঠে দাঁড়িয়ে যায়,

–নাহ কক্ষনো না। আমি এই দুনিয়া ছাড়বো না। আর যে আমার ভাইকে মেরেছে তাকেও না। আমিও দেখি ওই মেয়েকে কি করে বাঁচায় উনি। তারই সামনে যদি আমি ওই মেয়েকে নিলামে না তুলেছি তবে আমার নামও আফজাল মুনির না। আমার মৃত ভাইয়ের কসম আমি এর প্রতিশোধ নিয়ে তবেই শান্ত হবো। আমার ভাইয়ের প্রতিটি রক্তবিন্দুর মূল্য তাকে দিতে হবে। আমিও দেখি তার জান কে সে কতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখে। কথা গুলো বলেই আফজাল মুনির ভেতরে চলে গেলেন। রাহাদ অট্টহাসি হেসে সামরানের চেয়ারের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চেয়ারে হাত বুলিয়ে চেয়ার নিজের দিকে ঘুরিয়ে বসে পড়ে।

–আহহ!শান্তি। এই চেয়ারে বসার মজাই আলাদা। এই রাজ্য,এই চেয়ার আজ থেকে আমার। এটাই তো চেয়েছিলাম আমি। আপনি প্রতিশোধের নেশায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবেন আর আমি..আবারো হাসলো রাহাদ। চেয়ারের হাতলে হাত বুলিয়ে বলে,

–মি. সামরান মালিক, একটা মেয়ের জন্য এত বড় আলিশান রাজ্য কে ছেড়ে দেয়? মস্ত বড় বোকা তুমি। এবার তুমি দেখবে কি কি হবে। নিশানা যখন নিজের দিকে এলো তুমি খেলা থেকে চলে যাবে এটা কি হয়? তুমি ছাড়লেও আমি তো ছাড়বো না। তোমারই সামনে তোমার প্রিয়তমাকে নিলামে তুলে দেবো। শান্তি তো সেখানেই সামনে থেকেও তুমি কিছু করতে পারবে না। ৫০লাখ, ৫৫লাখ,৬০লাখ,উফফফ আমার তো তর সইছে না। এই রাজ্য তুমি বানিয়েছো রাজত্ব আমি করবো। চারপাশে আগুন জ্বলছে। আর রাহাদ মাঝখানে চেয়ারে বসে হাসতে থাকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here