#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৯
“রয়েল এসএস গ্রুপ অফ কোম্পানি” কিনে নিয়েছেন সামাদ মালিক। পুরো কোম্পানি সামরানের হাতে দিয়ে তিনি শান্তি পেলেন। বিনিময়ে সামরান ছোট্ট একটি “থ্যাংকস” বলে বিদায় নিল। ছেলের যাওয়ার পথপানে চেয়ে রইলো সামাদ মালিক। নিজের ছেলের সাথে তার এমন কঠিন সম্পর্ক মেনে নিতে তার অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু তিনি বাধ্য!
নতুন কোম্পানিতে সামরানের আগমনের সাথে সাথেই সবাই নতুন বসকে সাদরে বরণ করে নিল। ম্যানেজার ফুলের তোড়া এগিয়ে দিতেই সামরান হাসি মুখে গ্রহণ করে নিল। ম্যানেজার একে একে সব স্টাফদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
— স্যার ইনি আমাদের অনেক সিনিয়র স্টাফ। আমীর মির্জা ওনার নাম। আশা করি ওনার কাজে আপনি নিরাশ হবেন না।
সামরান আমীরের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো।
— হুম! আমি শুনেছি আপনার নামে। আপনি আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।
সামরানের কথা কিছুই বুঝলো না আমীর। তারপরও মুখে হাসির রেখা টেনে নিল। আর বললো,
— থ্যাংক ইউ স্যার!
সামরান নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। কি মনে করে যেন থমকে দাড়ালো। ম্যানেজার এর দিকে তাকিয়ে বললো,
–মি.চ্যাটার্জি আপনি মি.মির্জা কে নিয়ে আমার কেবিনে আসুন।
— আচ্ছা স্যার।
সামরান নিজের কেবিনে চলে যায়। কেবিনে প্রবেশ করে গায়ের কোট খুলে রেখে দিলো সামরান। শার্টের হাতের বোতাম খুলে শার্টের হাতা ফোল্ড করে নিল। তারপর চেয়ারে গিয়ে বসলো। ম্যানেজার আমীর কে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করতেই মৃদু হাসলো সামরান।
— স্যার আপনি আমাকে ডেকেছেন? মৃদুস্বরে বলে আমীর। সামরান ম্যানেজার কে ইশারা দিয়ে যেতে বলে।
–মি.চ্যাটার্জি ইউ মে লিভ। আমার দরকার হলে ডাকবো আমি আপনাকে।
–ওকে স্যার। বলেই ম্যানেজার চলে গেলেন।
ম্যানেজার চলে যেতেই সামরান সোজা হয়ে বসে। আমীরের উদ্দেশ্যে বলে,
–বসুন না। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
–স্যার আমি ঠিক আছি।ইতস্ততবোধ করল আমীর।
সামরান হালকা হাসলো আর বললো,
— কিছু হবে না বসুন।
আমীর সামরানের সামনে বসে পড়ে। সামরান ফোন করে দু কাপ কফির কথা বলে।
–আমি অনেক প্রশংসা শুনেছি আপনার নামে। এই কোম্পানিতে আপনার মত যোগ্য কেউ নেই। আপনি হয়তো জানেন এই কোম্পানি আমার বাবা কিনেছেন। আমি শুধু এসেছি দেখতে। প্রথমদিন প্রথম মুহুর্তে অনেক ভালো লাগল আমার। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।
–কি সমস্যা স্যার? আপনি নির্দ্বিধায় বলুন।
নিচের দিকে তাকিয়ে হাতের দু আঙ্গুলে কপাল চুলকে আমীরের দিকে তাকালো সামরান।
— আমি চাই আপনি এই পুরো কোম্পানির দায়িত্বে থাকুন আমার অনুপস্থিতিতে। আমার আরো একটা কোম্পানি আছে যার কারণে আমি এখানে বেশি সময় দিতে পারবো না। তাই আমক চাই এই পুরো কোম্পানি বিশ্বস্ত কারো হাতে তুলে দিতে। আর এই মুহুর্তে আপনি ছাড়া আমি আর কাউকে দেখছিনা। আর আমার সম্পুর্ন বিশ্বাস আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না। একদমে কথা গুলো বলে তবেই থামলো সামরান।
আমীর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামরানের দিকে। এত বড় পদ পাবে আমীর ভাবেই নি। নিজের কর্মজীবনে এটাই আমীরের সর্বোচ্চ সাফল্যের চুড়া।
–কিন্তু স্যার?
–কোনো কিন্তু নয় মি.মির্জা আমি জানি আপনি পারবেন। এক হাত বাড়িয়ে আমীরের হাতের উপরে রাখলো সামরান। আমীর সামরানের হাতের দিকে তাকিয়ে আবারো তাকালো। একদিনে এসে ছেলেটি আমীরের স্থান বদলে দিলো। রাস্তা থেকে তুলে সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়ার মত। আদৌ কি এর যোগ্য সে?
–স্যার আমি নিজের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করবো। আপনি চিন্তা করবেন না আপনার আমানত আমি সামলে রাখবো।
হাসলো সামরান,
— আমার আমানতের খেয়ানত করবেন না মি.মির্জা। কারণ আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি আপনাকে দিয়েছি। যার মালিক আমি। তবে আমার অনুপস্থিতিতে আপনি।
সামরানের কথায় আমীর মৃদু হাসলো।
— চিন্তা করবেন না স্যার। আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা আমীর মির্জা করবেনা।
–আমি আপনার সন্তান সমতুল্য। তাই আমাকে স্যার না নাম ধরে ডাকলে খুশি হবো।
সামরানের এহেন কথায় আমীর অনেক অবাক হলো। ইতস্ততবোধ করলো। সামরান তা বুঝতে পারলো। আমীরের অস্বস্তি কাটাতে বললো,
–আপনার ছেলে থাকলে কি আমার বয়সী হতো না?
–তা হতো কিন্তু?
–কোনো কিন্তু না। আমার নাম সামরান। আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকবেন। আর এই হলো এগ্রিমেন্ট পেপার এখানে আপনার সাইন প্রয়োজন। আজ থেকে এই অফিস এই কোম্পানি আমার না আপনার। বলেই হাসলো সামরান।
–কল্পনাও করিনি হুট করে এত পরিবর্তন হবে আমার।
–আমাদের জীবনে এমন অনেক কিছুই হয় যা আমরা কখনো কল্পনা করিনা। এমন এমন জিনিস আমরা পেয়ে যাই যার অবস্থান আমাদের স্বপ্নের বাহিরে। অন্যদিকে তাকিয়ে বললো সামরান।
আমীর তাকিয়ে রইল। অচেনা এই মানুষটি যেন মুহুর্তেই আমীরের মনের গভীরে জায়গা করে নিলো। ছেলেটির ব্যবহার, আচার-আচরণ আমীরের মনে ধরেছে। ইশশশ! না জানি কোন সৌভাগ্যবান মানুষের ঘরে জন্ম হয়েছে এই ফেরেস্তা রুপী মানুষ।
আমীরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সামরান বললো,
— জান সবাই কে সুখবর দিয়ে আসুন। এত বড় সুখবর মিষ্টিমুখ তো বান তা হে। বলেই ফিক করে হেসে দিলো সামরান। আমীরও হেসে দিলো।
দিল্লি থেকে কিছু লোক এসেছে। বিশাল বড় হলরুমে বসে আছে তারা। কোনো বিশেষ মানুষের অপেক্ষা করছে। বার বার দেয়ালে ঝুলতে থাকা বিশাল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। অপেক্ষার অবসান ঘটছে না। কালো কোট পরিহিত একজন লোক সামনে এসে দাঁড়ায়,
–স্যার আসতে লেট হবে। ততক্ষণ আপনারা অপেক্ষা করুন।
— আমরা কি দেখতে পারি মেয়েগুলোকে?
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো তারপর বললো,
–বেশিক্ষণ সময় নেবেন না। স্যার জানতে পারলে কিন্তু সমস্যা হবে।
–ওকে!
–আসুন!
কোট পরিহিত লোকটিকে অনুসরণ করে চার জন ভেতরে গেলো। ২৭টি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটি রুমের সামনে গিয়ে দরজা খুলে দিল লোকটি। লোকগুলো ভেতরে প্রবেশ করলো। রুমে রয়েছে অনেক মেয়ে। মেয়েগুলোর হাত-পা বাধা। লোকগুলোকে দেখে মেয়েগুলো ভয়ে ছটফট করতে লাগলো। বাধা থাকা সত্ত্বেও তারা ছোটার চেষ্টা করছে। একজন লোক একটি মেয়েকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে বললো,
— লুকিং গুড!
কালো কোট পরিহিত লোকটি তাদের সেখান থেকে নিয়ে এল। এই সমস্ত মেয়েদের দিল্লির বড় বড় ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যাবে। ফাইভ স্টার হোটেলে এদের নামে লাখ টাকার বর্ষণ হবে। “কল গার্ল” এই এক নামে যাদের সবাই চিনবে।
আর কিছুদিন পর এদের পরিচয় শুধু এটাই হবে। বাংলাদেশ থেকে শুধু দিল্লিই নয়। মুম্বাই,কানাডা,ইতালি,ফ্রান্স আরো বিভিন্ন নামকরা দেশে
মেয়ে পাচার করা হয়। টাকার বিনিময়ে সুন্দর সুন্দর মেয়েদের জীবন নিলামে তুলে দেয়া হয়। বিগত ৩বছর ধরে এই কাজ হয়ে আসছে। আর এই ৩বছরে আড়াই হাজারের ও বেশি মেয়ে দেশ বিদেশে পাচার হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই এই কাজের মেইন লিডার কে দেখেনি।
যার কথায় গড়ে উঠেছে এত বড় নরকরাজ্য তাকে দেখার সাধ্য কারো হয়নি। রাতের অন্ধকারের চেয়েও বেশি অন্ধকার বিরাজমান এই রাজ্যে। শত শত মেয়ের আর্তনাদ,আর্তচিৎকার ভেসে বেড়ায় এখানে। শোনার মত লোকের বড্ড অভাব!!
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায় সামরান। কেবিন থেকে স্টাফ হল স্পষ্ট দেখা যায়। কাঁচের ওয়ালের পর্দা সরিয়ে হল রুমে তাকালো সামরান। আমীর মির্জা সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করছে। মুখে মোহনীয় হাসি। সামরান হালকা হাসলো। দু-হাত পকেটে রেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল,
–আপনার হাসি-কান্না দেখার দায়িত্ব আমার। আর আমার সুখ,শান্তি,হাসি দেখার দায়িত্ব আপনার। আমার বিষন্নতা আপনার জন্য সুখকর হবে না। আশা করি আপনি আমার বিষন্নতার কারণ হয়ে দাড়াবেন না। বি কেয়ারফুল!
সুইমিংপুলের পাড়ে বসে আছে সিমি। পা দুটি পানির ভেতরে। হাটু সমান ডুবিয়ে রেখেছে। আর পানির ভেতরেই পা নাড়ছে। ডায়রিতে কি যেন লিখছে আপনমনে।
শেহেরজাদের গাড়ি বাড়ির কাছে আসতেই শেহেরজাদ গাড়ি থামিয়ে দিলো। বাড়ি থেকে কিছুদূর গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো। গেটের কাছে আসতেই গার্ড হর্ন দিতে চাইলে শেহেরজাদ ইশারায় না করলো। আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। সারাবাড়ি সিমিকে খুঁজেও পেলো না শেহেরজাদ। ছাদে উঠে আশেপাশে তাকাতেই দেখলো সুইমিংপুলের পাড়ে বসে আছে সিমি। শেহেরজাদ সুইমিংপুলের উদ্দশ্যে পা বাড়ালো।
দরজা খোলার শব্দ কানে যেতেই সিমি ডায়রির পাতা ছিড়ে পানিতে ডুবিয়ে দিলো। উঠে পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো শেহেরজাদ। ছুটে গিয়ে শেহেরজাদের সামনে দাড়ালো,
–আপনি এ অসময়ে? আর হর্ন বাজলো না যে?
–জরুরী না যে সবসময় আমার আসার খবর তোমার কানে পৌঁছবে। কিছু জিনিস মাঝে মাঝে চুপিসারে করতে হয়। বলেই শেহেরজাদ পুলের দিকে পা বাড়াতেই সিমি হুট করে জড়িয়ে ধরে শেহেরজাদ কে। আচমকা এমন হওয়াই শেহেরজাদ অবাক হয়ে গেলো। দুহাতে সিমির কোমর জড়িয়ে ধরে বললো,
–কি ব্যাপার আজ এত মুড?
-ননা মমানে! এসেছেন যখন আমার সাথেই থাকুন না। এদিক ওদিক কেন ছুটছেন।
সিমির কথায় না চাইতেও ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো শেহেরজাদের। সিমিকে সরিয়ে দিতে চাইলে সিমি আরো জড়িয়ে ধরে। শেহেরজাদ সিমিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
–আমার স্পর্শ কিন্তু মরণব্যাধি রোগের ন্যায় যন্ত্রণা দেবে।
চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো সিমি। সিমির উদ্দেশ্য অন্য। তাই শেহেরজাদের সবকিছুই এখন মেনে নিতে হবে। সিমিকে নিজের থেকে সরিয়ে একটু ঝুকে ঘাড় বাকিয়ে সিমির ঠোঁটে গভীরভাবে চুমু দিলো শেহের। সিমির চোখ বন্ধ হয়ে আসে। শেহেরজাদ চোখ খুলে নেয়। চোখ জোড়া পুলের পানির দিকে স্থির!
চলবে….??