ফাল্গুনের ঢেউ পর্ব -১৫

#ফাল্গুনের_ঢেউ
পর্ব – ১৫ #ওই_নাম্বার
লেখিকা – Zaira Insaan

কানে দিতে না দিতেই কে যেন এসে ধাক্কা মেরে ফেল দিল মোবাইলটা। মিহি রেগে পিছনে ফিরে দেখে সম্পদ দ্রুত হাঁটতে গিয়ে ওর সাথে ধাক্কা লেগেছিল। সম্পদ মেকি হেঁসে স্যরি বলে সেখান থেকে কেটে পড়ে। মিহি নীচ থেকে ফোনটা উঠিয়ে দেখে ইতিমধ্যে কেটে গেছে কল টা। মিহি এবার প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে সেই নাম্বারটিকে ব্লক মেরে চলে যায়। রাত হয়ে গেল ঘুরতে ঘুরতে। ঝাউ বন থেকে এসে হোটেলে নেমে পড়লো। আজকেই শেষ রাত এখানে। আগামীকাল আরো কয়েকস্থান ভ্রমণ করে ঢাকায় ফিরে যাবে।
___________

পর্দা ভেদ করে সূর্যি উঁকি দিচ্ছে রুমে রুমে। প্রভাতের আলো ফুটেছে কিঞ্চিৎ পূর্বে। সূর্যি আজ মিষ্টি হেঁসে আলো ছড়াচ্ছে। পিটপিট করে চোখ খুলে সর্বপ্রথম দৃষ্টি গেল মোবাইলের সময়ের দিকে। সাত টা বাজতে আলো অনেক সময় আছে। বিরাট হামি তুলে নুয়ে হয়ে বসে পড়লো মিহি। পাশে তনু ও বন্নি আকারহীন ভাবেই ঘুমুচ্ছে। মিহি এদের ডাকতে ডাকতে বলে,,

“আর কত ঘুমাবি তোরা? উঠ।”

বলে চাদরটা সা করে টেনে নিয়ে দুজন থেকে। ঘুম ভাঙল ওদেরও। মিহি তড়িগড়ি করে বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়।
___________

বাস করে হিমছড়ি ‌জায়গায় রওনা দিল সবাই। যেতে অনেক সময় লাগল। ঘড়ি তে সোয়া আটটা বাজে।‌‌ নাস্তা খেয়ে বেড়িয়ে গেছে। পৌঁছে দেখে অনেক মানুষের ভীড়। কাঁটা কাঁটা দাঁড়ালো পাথরে অতি সাবধানে হাঁটতে লাগলো। মেইন উদ্দেশ্য ওই চিকন ফাকের ঝর্ণা দেখা। বেশিরভাগ মানুষ ওইটা দেখার জন্যই যায়। ওরা যেতেই লোকজনের সংখ্যা আরো দ্বিগুণ বাড়লো। প্রায় জ্যাম জ্যামে অবস্থা। কিন্তু মজা লাগছে সবারই। কয়েকজন যুবক সেই ঝর্ণার মাঝে দাঁড়িয়ে সেইই হিরোর মত পোজ দিচ্ছে বন্ধুদের সাথে। হাসি ঠাট্টা মশকরা করতে লাগল এক এক জন। নীলয় এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফ মেরে যেতে গিয়ে ধপাস করে পানিতে পরে যায় উষ্ঠা খেয়ে। সবাই সহ অজানা লোকরাও দম ফেটে চিৎকার করে হেঁসে দিল।‌ সম্পদ এসে তুলল হেঁসে হেঁসে বলল,,

“লাফালাফি করস ক্যান? বলদ।”

নীলয় মুখ কালো করে ফেলল। বন্নির দিকে আড়চোখে তাকালো তারপর আস্তে করে সেখান থেকে সরে আসলো। বন্নির হাসি পেলেও হাসলো না। গোমরা মুখ ধারণ করে অন্য পাশে চলে গেল। এর অর্থ কেউ বুঝলো না এমনকি নীলয় ও না। সবাই আগের মত স্বাভাবিক হয়ে গেল।‌ হিমছড়ি থেকে কিছুক্ষণ ঘুরার পর ইনানী বীচের জন্য রওনা হলো। বাসে করে অর্ধেক যাওয়ার মাঝেই এক মেয়ে জোরে জোরে কাঁশতে লাগল।‌ সবাই ঘুরে তাকালো ওই মেয়েটার দিকে। নেহা গলা ঝেড়ে টেড়ে স্বাভাবিক হয়ে বলে,,
“স্যরি।”

স্নিগ্ধের খটকা লাগলো বলল,,

“ঠিক আছো তুমি?”

নেহা হাসি মুখে বলে,,

“ইয়াহ স্যার, আ’ম ফাইন।”

স্নিগ্ধ সামনে ফেরলো। বাস যতদূর যাচ্ছে ততই যেন খারাপ লাগা বাড়ছে নেহার। বুকের বা পাশে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে ঘষতে লাগলো। মাঝে মাঝে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। এর অবস্থা দেখে প্রচন্ড মাত্রায় ভয় পেয়ে গেল স্পৃহা। সব স্যারদের চিৎকার মেরে ডেকে বলে,,

“স্যার, দেখেন নেহা….।”

কথা পুরোপুরি শেষ হতে না হতেই জ্ঞান হারালো নেহা। সবাই ইতিমধ্যে ভড়কে গেল। হৈচৈ হয়ে গেল বাসে। নেহার আশেপাশে ভীড় জমতেই স্নিগ্ধ সবাই কে একডাক দিয়ে ওর কাছ থেকে সরালো। অজ্ঞান হলে আশে পাশে ভীড় জমাতে নেই এতে রোগীর আরো ক্ষতি হোওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। বাস আর সোজা না গিয়ে উল্টো পথে যেতে লাগল। সেদিকে হাসপাতাল আছে। হাসপাতাল পৌঁছে দ্রুত নেহা কে নিয়ে যাওয়া হলো। নেহা কে রুমে ঢুকিয়ে রুমের বাহিরে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। কিয়ৎক্ষণ বাদে ডাক্তার আসলো ফোঁস করে আফসোসের নিঃশ্বাস ফেলে দৃষ্টি নামিয়ে বলল,,

“হার্ট অ্যাটাক করে মারা গিয়েছে মেয়েটি।”

থমকালো সবগুলো। কর্ণকুহরে শ্রবণ করা কথা কোনতেই বিশ্বাস করার নাম হচ্ছে না কারোর। ডাক্তার সাহেব আরো বলেন,,

“ও তো আগের থেকেই অসুস্থ ছিল। চিকিৎসা নিলে সুস্থ থাকত।”

অত্যন্ত মাত্রায় ভড়কে গেল সবাই। নেহা আগের থেকে অসুস্থ থাকলে ট্রিপে এসেছে কেন? কথা আর বাড়ালো না কেউ।
___________

ঢাকায় ফিরেছে লাশ নিয়ে। অতিদ্রুত নেহার পরিবারকে জানাতে হবে। শ্রাবন্তী নেহার মায়ের সাথে যোগাযোগ থাকাতে কল করে পাড়ুই কে। পাড়ুই ওপাশ থেকে রিসিভ করে হাসিমুখে বললেন,,

“কিরে শ্রাবন্তী ঢাকায় ফিরেছিস তোরা? আর নেহার ফোনে কল ঢুকে না কেন?”

শ্রাবন্তী কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। অনেক শিক্ষার্থীরা নেহার শোকে টপটপ পানি ঝড়ছে। কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল পাড়ুই। অস্থির কন্ঠে বলেন,,

“কি হয়েছে শ্রাবন্তী কে কাঁদছে?”

শ্রাবন্তী ভারী গলায় বলে,,

“আন্টি…।”

ওতটুকু বলে দম আটকে যায় তার। গলায় কেউ দা দিয়ে কোপ দিচ্ছে মনে হচ্ছে। গলা ও মস্তিষ্ক ভারী হয়ে আসাতে কোন কথা তুলে বলা রাহা হচ্ছে না। পাড়ুই কিছুটা আন্দাজ করে বলেন,,

“নেহা ঠিক আছে তো?”

তার নীরবেই সম্মতি জানালো। পাড়ুই ধপাস করে নীচে বসে পড়েন মাথায় হাত দিয়ে। মোবাইল ছিটকে পড়েছে দূরে। হঠাৎ মায়ের রুম থেকে নিজের রুমে যাচ্ছিল অহি। মাকে হতভম্ব হয়ে নীচে বসে থাকতে দেখে দ্রুত পথে ছুটে আসলো অহি। পাড়ুই কে ধরতে ধরতে বলে,,

“কি হয়েছে মা?”

পাড়ুই কিছুই বললেন না। মাথায় আকাশ পাতাল ভেঙে পড়লো। দূরে অবস্থিত মোবাইল থেকে কান্নার শব্দ এখনো ভেসে আসছে। তিনি হামাগুড়ি দিয়ে হাতরিয়ে মোবাইল টা নিয়ে কানে দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,,

“ক..কই তোরা……আ.. আমার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আয়।”

ভাঙা গলায় কাঁদতে লাগলেন তিনি। অহির বুঝতে বাকি রইল না যে কি ঘটল ওখানে। সেও নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে পড়লো।
___________

পরিস্থিতি, পরিবেশ বেশ খারাপ। এমনটা হবে কেউ ভাবেনি নেহার ছোট বোন অহি বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। উঠলে ‘আপা’ বলে ডাক দিয়ে কুড়ি মিনিটের মধ্যে আবারো জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।‌ তার প্রতি বড্ড মায়া জমছে সবার। হাস্যজ্জল মেয়ে নেহা এভাবে সবার হৃদয়ে দাগ কেটে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে নিল। নেহার অত্যন্ত ক্লোজ বান্ধবীরা আজকে এখানে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে যে অনেকদিন যাবত অসুস্থ ছিল তা জানেন না নেহার মা। জানানোর পর আফসোসের সুর টেনে কেঁদে কেঁদে নিজেকে মারছেন রীতিমত। চোখ দুটো বিরাট আকারে ফোলে গিয়ে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। বাকিরা সেখান থেকে চলে আসলো মিহি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত নয়টা বাজে। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে ভীড়ের ফাঁক থেকে নিঃশব্দে চলে আসে। বাকিরা সবাই এক এক করে চলে আসছে। স্যার টিচাররাও নিজেদের বাড়ি চলে যান।‌ গেট থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটতে শুরু করলে স্নিগ্ধ পেছন থেকে ডেকে উঠে। মিহি পেছন ফিরে তাকালো মুখ মলিন করে স্নিগ্ধ গাম্ভীর্য ভাব ধরে রেখে বলে,,

“গাড়িতে ওঠো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।”

“না স্যার লাগবে না। ইমন ভাই আসবেন এখনি।”

স্নিগ্ধ তাকালো প্রশান্ত চোখে। মিহি আর কিছু না বলে উল্টো পথে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো। স্নিগ্ধ একপানে চেয়েও রইল ওকে যতদূর দেখা যায় ততদূর পর্যন্ত দেখে থাকবে। যেতে যেতেই কোয়াশায় মিশে গেল মিহি। আর দেখা যাচ্ছে না তাকে। স্নিগ্ধ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে বসে স্ট্রার্ট দিয়ে চলে গেল।
___________

মিহি এসে সোজা রুমে ঢুকে লক করে দিল। নেহার সাথে অতটা স্মৃতি জড়ানো না থাকলেও যা স্মৃতি হয়েছিল তা বেশ কষ্ট দিচ্ছে মিহি কে। সকাল টা শুরু হয়েছিল খিলখিল হেসে কিন্তু শেষ হয়েছে দুঃখের দহনের অন্ধকারে। আলমারি খুলে তোয়াল নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। অনেকক্ষণ পর এসে চুল মুছতে মুছতে মোবাইল হাতে নেয় অন করে দেখে ২৮ টা মিসড কল! পিলক চমকে ওঠে, নাম্বারটা ভালোভাবে দেখে মনে পড়ে মুঠোফোন টাতে কল এসেছিল মিহি বিরক্ত হয়েই ব্লক মেরেছিল। তবে?‌ এ মোবাইল ও দেখি একি নাম্বারে কল! সন্দেহ হতে লাগলো তার। কে হতে পারে ভাবতে লাগল। ভাবতে না ভাবতেই পুনরায় কল আসলো মিহি কিছু সেকেন্ড অপেক্ষা করে রিসিভ করল, বলল,,

“হ্যালো! কে বলছেন?”

“হাই! আমি শুভয় তোমার বয়ফ্রেন্ড।”

নাম শুনার সাথে সাথে বুক ধ্বক করে উঠলো মিহির।

(চলবে…)

[ গল্পটা কি আপনাদের ভালো লাগছে না? না লাগলে দ্রুত ইতি টানবো। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here