ভালোবাসি প্রিয় পর্ব ৩৩+৩৪

#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৩৩
#সুলতানা_সিমা

দিহানের মাথায় বাজ পড়লো। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা যে তারই ভালোবাসার মানুষ এটা বিশ্বাস হচ্ছেনা তাঁর। দিহানের মনে হচ্ছে তার বুকের ভেতর কেউ আগুন লাগিয়ে দিছে। বুকটা পোড়ে যাচ্ছে তাঁর। অরিন এভাবে ইশিকে মারবে ভাবতেই পারেনি সে। না না শুধু ইশি নয় তার মাকেও মারতে চেয়েছে অরিন। এই দুইটা মানুষকে মারার কথাই তো বার বার বলতো। দিহান ভাবতো সব রাগের কথা কিন্তু সত্যি সত্যি মেরে দিবে কে জানতো। দিহানের চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। ধোঁকা খাওয়ার জল। দু পা এগিয়ে এসে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অরিনকে একটা থাপ্পড় দিল। অরিন মাটিতে গিয়ে পড়লো। শরীরের শক্তি সব ক্ষয়ে গেছে তাঁর,নিজেকে টিকিয়ে রাখার শক্তি নেই এখন। দিহান ঘৃণা ভরা চোখে অরিনের দিকে তাকাল। অরিন গালে হাত দিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে আছে, সে বুঝতেই পারছে না কী এমন করেছে সে।

দিহান অরিনকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের দিকে নিয়ে যায়। অরিন পেটে হাত দিয়ে আর্তনাদ করে উঠে। ধমকের স্বরে বলে “দিহান কী করছেন এসব? ছাড়ুন।” দিহান শোনেনা অরিনের কথা। বাইরে থেকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে ঢুকে। বাড়ির মানুষ বলতে লারা দিশা আর লুপা শুধু বাড়িতে আছে। মেহমান অনেকেই চলে গেছে। যারা ছিলো তাঁরা ড্রয়িং রুমে বসে কান্না করছিলো। এভাবে অরিনকে নিয়ে আসায় সবাই অবাক হয়। দিশা এগিয়ে আসতেই হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দেয় দিহান। অরিন বলেই যাচ্ছে “কী হয়েছে আপনার এমন করছেন কেন?” ধস্তাধস্তির কারণে অরিনের হাত থেকে ফোন ছিটকে পড়ে যায়। রুমে এনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে অরিনকে। তারপর দরজা লক করে চলে যায় হসপিটালে। অরিনকে ঘরে বন্দি রেখে যাওয়ার একটাই কারণ অরিন যেন পালিয়ে না যায়।

কাঁদতে কাঁদতে দিশা নিজের রুমে চলে যায়। কী হচ্ছে এসব কিছুই তাঁর মাথায় আসছেনা। অশান্তিতে ভরে গেছে পুরো শান্তি নীড়। লারা অরিনের ফোনটা ফ্লোর থেকে তুলে হাতে নেয়। আপাতত ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে তাঁর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিছে। এখনো ভয় কেটে যায়নি তাঁর। লুপার পাশে বসে কাঁদতে লাগে সে। এই বাড়িতে এসেছে থেকে অশান্তি দেখছে সে। একটা না তো আরেকটা অশান্তি লেগেই আছে।

সারারাত অরিন রুমে বন্দি থাকে। এতকিছু ঘটে গেছে সেটা তাঁর জানার বাইরে। সকালে দরজা খোঁলে দিহান এসে রুমে ঢুকে। দিহানের চোখ মুখ শুকনো। চেহারায় বিষন্নতা ও রাগ। অরিন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দিহানের চোখ লাল হয়ে আছে। ফুলা চোখ দুটো দিয়ে আগুন ঝরে পড়ছে। দাঁতে দাঁত চেপে তাকাল অরিনের দিকে। তারপর অরিনের হাত ধরে নিচে নিয়ে আসে। নিচে এসে অবাক হয় অরিন। সাদা কাপড় দিয়ে কাউকে ঢেকে রাখা আছে,সবাই পাশে বসে কান্না করছে। দিহানের মায়ের হাতে ব্যান্ডেজ। ছয় সাতজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। অরিন দিহানের দিকে তাকাল তার চোখ দিয়ে দিহানকে প্রশ্ন করল এসব কী। কিন্তু দিহান যেন আজ এই চোখের ভাষা বুঝতেছেনা। অগ্নি চোখে চেয়ে থাকল অরিনের দিকে। অরিন কাঁপা গলায় বললো ”

_কা কা কার লাশ এটা?
_কেন তোমার শত্রু ইশির।” দিহানের কথায় ৪৪০ ভোল্টের শকড খেল অরিন। অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল” ইশি আপুর লাশ?” দিহান চেঁচিয়ে বলে উঠল “হ্যাঁ ইশির লাশ। তুমিই তো মেরেছো ইশিকে।” দিহানের কথায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে চারদিকে। স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। সবার কানে যেন তালা মেরে গেছে।এসব কী বলছে দিহান ইশিকে অরিন মেরেছে? লারা এগিয়ে এসে বলল”

_এসব কী বলছো দিহান ও কেন মারবে ইশিকে?
_কারণ ইশিকে ওর সয্য হতনা। ও নিজেই আমাকে বলেছে ও ইশিকে মেরে দিবে,বিশ্বাস না হলে ওকেই জিজ্ঞেস করুন। আরে ওতো আমার মাকেও মারতে চেয়েছে।” দিহানের কথায় দ্বিতীয় বারের মতো ঝাটকা খেল সবাই। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকল অরিনের দিকে। লারা বুঝতে পারছেনা দিহান সত্যি বলছে কিনা। অরিন লারার দিকে জিজ্ঞাসুক চোখে তাকাল। লারার বুক ধুক করে উঠল। তাহলে কী অরিন তাকে সন্দেহ করছে? হ্যাঁ সে বলেছিলো এই বাড়িতে সে খুন করবে কিন্তু পরবারের সবার মায়ায় আঁটকে গিয়ে সে এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। নীল অরিনকে গিয়ে বলল” অরিন দিহান এসব কী বলছে তুমি কিছু বলছো না কেন?” অরিন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। একটার পরে আরেকটা ধাক্কা সে সামলাতে পারছে না। দিহানের বাবা এসে বললেন”

_বউমা এসব কী বলছে দিহান?” এই প্রথম দিহানের বাবার মুখে সে বউমা ডাক শোনলো। কিন্তু তাঁর ভেতরে গিয়ে সে ডাক স্পর্শ করতে পারলো না। অনুভূতি শূন্য হয়ে গেছে সে। অরিন লারার দিকে তাকাল। লারা তো বলেছিল এই বাড়িতে কাউকে না কাউকে খুন করে দিবে সে। খুন সে ঠিকই করেছে কিন্তু তাঁর দোষ অরিনের ঘাড়ে চাপিয়ে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে? ভাবতেই অরিনের চোখ থেকে দুফোঁটা জল গাল গড়িয়ে পড়লো। জীবনে সে শুধু ধোঁকা খেয়ে এসেছে। প্রথম লুপা তারপর লারা। সবাই তাকে টিস্যুর মতো ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলছে।

একের পর এক প্রশ্ন সবাই করে যাচ্ছে অরিনকে, কিন্তু অরিন জবাব দিচ্ছেনা তাঁর মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেছে। উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। অরিনের চুপ থাকা দেখে সবাই ধরেই নেয় খুন অরিন করেছে। দিহানের বড় চাচ্চু অরিনের দিকে তাকিয়ে বলেন” বাবা হয়ে নিজের যুবতি মেয়ের মুখ কাফনে ঢাকার কষ্ট বুঝবে না তুমি মা। তোমায় মেনে নেইনি আমি,দোষ আমার ছিলো আমাকেই মেরে দিতে, আমার মেয়েকে কেন মারলে?’ “বলেই ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। দিশা ইশির লাশ ধরে বিলাপ করে কান্না করে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে অরিনকে বলে”

_ভাবী এটা তুমি কীভাবে করলে ভাবী। আমার কলিজাটা তুমি কীভাবে আলাদা করে দিলে? এখন কার সাথে ঝগড়া হবে আমার। কে আমাকে বকে আবার বুকে টেনে নিবে? খুব করে বলছিলো, দিশা তুই বিয়ে করে নে তোর বিয়ের পরে আমি বিয়ে করবো। তোর বিয়েতে আমি তোর লেহেঙ্গার মতোই লেহেঙ্গা পড়বো। তোর বরের জুতা লুকিয়ে তাঁর থেকে ১০হাজার টাকা নিবো। কত শখ করে দুহাত ভরে মেহেদী পড়েছিলো। আমাকে এসে দুহাত দেখিয়ে বলেছিলো,দেখ দিশা তোর আগেই মেহেদী পড়ে নিয়েছি আমি। দেখ তোর আগে সেজেগুজে রেডি আমি। কে জানতো জীবনের শেষ সাজ সেজেছে সে।”

দিশার কথা গুলা শোনে সবার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। ইশি মায়ের মাথাটা লারার কাঁধে পড়ে আছে। লারা দু’হাতে উনাকে জড়িয়ে উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে আবার নিজেও কাঁদছে। দুহাতের চুড়ির দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি। দিশার বিয়ের শপিং করার সময় এই চুড়িগুলা কিনে এনে মায়ের হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে বলেছিলো। “এতো টাকা কামাই করো তবুও কিপ্টামি যায়না। নতুন কিছু কিনতে গেলেই শুধু আছে আছে করো।” হাত দুটো সামনে তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলেন”

_ ইশি রে,ইশি তুই দেখ তোর মায়ের হাতে তোর দেওয়া চুড়িটা কেমন জ্বলজ্বল করছে। দেখ রে ইশি তোর মা চুলে বেণি করেছে। তুই তো বলতি, আম্মু তুমি বুড়ি হওনি তবুও কেন বুড়িদের মতো থাকো। দেখ তোর মা আজ তোর মনের মতো সেজেছে উঠ।” কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। দিহানের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ইশির সাথে কাটানো প্রতিটা মূহুর্ত চোখে ভেসে উঠছে। ইশিকে দৌড়ানো ইশির থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে খাওয়া ইশিকে মারা সবকিছু চোখে ভাসছে। ছোট থেকে এই পর্যন্ত ইশিকে সে কখনো চাচাতো বোন ভাবেনি নিজের বোন ভেবেছে। বোন কম বন্ধু বেশি ভেবেছে ইশিকে আর আজ কিনা তারই ভালোবাসার মানুষ তাঁর বোনকে মেরে দিলো? একটুর জন্য তো তাঁর মাও মরে যেতো। তার মায়ের হাতে গুলি লাগার দৃশ্য চোখে ভাসতেই। রাগে দিহানের মাথার রগ টগবগ করে উঠে। পুলিশকে সাথে নিয়ে এসেছে সে। একজনের হাত থেকে হ্যান্ডকাফ নিয়ে এসে অরিনের সামনে ধরে বলে”

আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি অরিন। বিয়ে করে ভালোবেসেছি। লোকে তোমাকে কালো বলে অবহেলা করলেও আমি তোমাকে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী নারী বলেছি। মন উজার করে তোমায় ভালোবেসেছি, বুকে আগলে রেখেছি। আমার অতীত ভুলে গিয়ে তোমায় আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখেছি। কিন্তু তুমি বেইমানি করেছ। একটা খুনি কখনো আমার বউ হয়ে থাকতে পারেনা। আজ এই মূহুর্তে তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ। এই সম্পর্ক থেকে আমি তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। এখন থেকে তোমার স্থান দিহানের বুক নয়, কারাগার। ইউ আর আন্ডার এরেস্ট।”

ধাক্কার পর ধাক্কা অরিনের হৃদপিণ্ড থামিয়ে দিচ্ছে। এসব কী হচ্ছে তাঁর সাথে? অসহায় চোখে একবার লারার দিকে তাকাল লারা ইশির মাকে নিয়ে ব্যস্ত। দিহানের দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলল”
_বিশ্বাস করুন আমি মারিনি ইশি আপুকে। আমি তো ওইসব রাগে বলতাম। আপনি অন্তত আমায় বিশ্বাস করুন প্লিজ।” দিহান অরিনের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে বলল”
_বিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়ে বিশ্বাস করতে বলছো? একবার ধোঁকা দিয়েছো বার বার দিতে পারবে না।” বলেই অরিনকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসে। অরিন চিৎকার করে কেঁদে বলছে আমি মারিনি ইশি আপুকে প্লিজ আমায় নিবেন না। আমি সত্যি বলছি। অরিনের আর্তনাদ কারো হৃদয় স্পর্শ করেনা। সবাই ঘৃণা ভরা চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়িতে তুলার সময় অরিন দিহানের পা জড়িয়ে ধরে মিনতি করে বলে “প্লিজ আমার কথাটা বিশ্বাস করুন আমি মারিনি উনাকে”তবুও দিহানের মায়া হয়না। গাড়িতে উঠানোর পরে লারা আর লুপা দৌড়ে এসে দিহানকে বলে ”

_এ এ এসব কী করছো দিহান। কোনো সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া এভাবে অরিনকে নিতে পারোনা তুমি।
_সাক্ষী আমি নিজেই আর প্রমাণ? প্রমাণ তো তাঁর হাতের পিস্তল। আর কী প্রমাণ চাই ভাবী?
_ভাইয়া অরিনকে নিয়না ভাইয়া প্লিজ ওকে নিয়না। [লুপা] ” অরিন ঘৃণা ভরা চোখে লারা আর লুপার দিকে তাকায়। কতো সুন্দর অভিনয় জানে এই দুটো মানুষ। ঘৃণায় তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অরিন। দিহান অরিনকে নিয়ে থানায় যায়। হয়তো সমাজ বলবে তার বউ একজন খুনি হয়তো অনেকজনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে কিন্তু এতে তাঁর কিচ্ছু যায় আসেনা। অপরাধী যেই হোক সে অপরাধী। থানায় নিয়ে অরিনকে গাড়ি থেকে নামানোর সময় দেখল অরিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। দিহানের কাছে সব কিছুই নাটক মনে হলো। অরিনকে ছুঁতেও তার ঘেন্না লাগছে এখন। তবুও কোলে তুলে তাকে হাজতে রেখে আসে। আসার সময় দিহানের বুকটা পোড়ে যাচ্ছিলো কিন্তু কী হবে কোনো ধোঁকাবাজের জন্য মায়া লেগে।

দুপুরের দিকে ইশির দাফন হয়। দিশার বিয়ের ডেট পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইশির মা বাবা কাউকেই শান্ত করা যাচ্ছেনা।জিহানও দরজা বন্ধ করে কেঁদেই যাচ্ছে। দিশাকে তো এক সেকেন্ডের জন্যেও শান্ত করানো যাচ্ছেনা। তার সাথী হারিয়ে গেছে কীভাবে সে শান্ত হবে। দিহান ইশির কবরের পাশে বসে কান্না করে যাচ্ছে। তাঁর মনে হচ্ছে তাঁর ভুলে সে ইশিকে হারিয়েছে। আগে যদি বিয়ের কারণটা ঘেটে দেখতো তাহলে হয়তো আজ তার পরিবারটা এভাবে এলোমেলো হয়ে যেতনা। অরিনকে বিশ্বাস করে সে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে।

কবরের পাশে বসে কান্না করছে দিহান। আর দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়সি একজন পুরুষ। লম্বা নিয়ে মোটাতাজা গায়ের রং কালো। এই লোকটার নাম হচ্ছে জামিল খান। এই মেরেছে ইশিকে। তবে তাঁর টার্গেট ভুল হয়েছে, সে মার‍তে চেয়েছিলো জিহানকে ভুল নিশানা লেগে মারা গেলো ইশি। তাতে তাঁর কিচ্ছু আসে যায় না। সে শান্তি নীড়ের কাউকে মারতে পেরেছে এটাই তো অনেক। দিহানকে এভাবে কাঁদতে দেখে এক শয়তানি হাসি দেয় জামিল। হাতের পিস্তল ঠোঁটের কাছে এনে লম্বা একটা চুমু খায় পিস্তলে। জামিল খান হচ্ছে শান্তি নীড়ের সব থেকে বড় শত্রু। কিছুদিন আগে ইশির মা একটা ছেলের বিরুদ্ধে কেস লড়েন। ইশির মা কেসে জিতে যান সে ছেলের ফাঁসির রায় হয়। ফাঁসিও হয়। ওই ছেলেটা জামিলের ছেলে ছিলো। আজ সুযোগ বুঝে সে তাঁর ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়ে নিলো। কিন্তু মাঝখানে কাকতালীয় ভাবে ফেসে গেলো অরিন। শান্তির হাসি হাসতে হাসতে চলে যায় জামিল। আজ তাঁর শান্তি লাগিছে শান্তি নীড়ে অশান্তির চিৎকার শুনে খুব শান্তি লাগছে।

লারা রুমে ঢুকে অরিনের ফোনটা ড্রয়ার থেকে বের করে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। জিহান উপুড় হয়ে শুয়ে কান্না করছে। জিহানকে স্বান্ত্বনা দেএয়ার ভাষা জানা নাই তার। অরিনের ফোনটা নিয়ে একটু আড়ালে যায় সে। যেহেতু অরিন ওই মুখোশধারীর সাথে দেখা করতে গেছিলো তাহলে তাদের কথা মেসেজেই হয়েছে। লারা অরিনের ইনবক্সে ঢুকে। লুপার নাম্বার থেকে,”আজ তোমার শেষদিন” হ্যাঁ কেন?” এই দুইটা মেসেজ এসেছে। টাইমটা দেখে নিলো লারা। মেসেজ টাইম দেখে লারার কপাল কুঁচকে গেলো। ফোন হাতে নিয়ে লুপার রুমে এলো সে। লুপা খাটে বসে কান্না করছে। লারা অরিনের ফোন থেকে মুখোশধারীর নাম্বারে ডায়েল করল ফোন বন্ধ পেল। লারা লুপাকে বলল”

_কান্নার নাটক করছো কেন? এখানে তো দেখার জন্য কেউ নেই।” লুপা মুখ তুলে চাইলো। তাঁর চোখের পানিটা মিথ্যে নয়। অবাক হয়ে বলল”
_কী বলছো এসব নাটক করবো কেন?
_কারণ নাটক না করলে যে তোমার মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে।” লুপা কেঁপে ওঠে। চেহারায় একরাশ ভয় ফুটে ওঠে। লারার বুঝতে বাকি নেই তাঁর আন্দাজের ডিল ঠিক জায়গায় পড়েছে গিয়ে। আগে থেকেই লুপা তার সন্দেহের খাতায় আছে। লারা তীক্ষ্ণ গলায় বললো”
_তুমি সেই মুখোশধারী? এত বড় ধোঁকা। আমি না হয় পর অরিন তো তোমার বন্ধু ছিলো,তাহলে ওকে কেন ব্যবহার করলে?” ধরা পড়ে গিয়ে লুপা চুপসে যায়। লারা আবারও বলে”
_ছিঃ! কী জঘন্য তুমি। তোমার মতো বন্ধু যার আছে তাঁর ধ্বংস অনিবার্য।” রাগে লারার শরীর কাঁপছে। লুপা কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বললো ”
_ভাবী।
_চুপ। তোমার মুখে আমাকে কোনো সম্বোধন করবে না।
আরে তুমি এমন হবেনা কেন তোমরা তো সবাই এমন। প্রথমে তোমরা মিহানকে মেরে দিয়েছো, তারপর মা মেয়ে মিলে আমাদের বানিয়েছো তোমাদের দাবার গুটি।
_আমার আম্মুকে টানবে না এখানে, আমার আম্মু এসবে জড়িত না।
_বললে আর আমি বিশ্বাস করে নিলাম? তোমার আম্মু ছাড়া তুমি একা এতোদূর চলে এসেছো?

লারার কথায় লুপা চিৎকার করে বলে” হ্যাঁ এসেছি একাই এসেছি একা লড়তে জানি আমি। [ধরা গলায়] আমার আব্বু আম্মুকে বোকা পেয়ে যে যেমন খুশি তেমন নাচায়। এই পরিবারে আমার আব্বুকে কেউ দাম দেয়না। কারও পক্ষে একটা কথা বললে চামচা বলে ডাকে। আর আমার আম্মু, সব সময় আমার আম্মুকে ঠকায় সবাই। সবকিছুতে আমার আম্মুকে নিন্দা করে সবাই, আর আমার বোকা আম্মু সবকিছু হেসে উরিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত আমার ভাইয়ের মৃত্যুটাও হেসে উরিয়ে দিয়েছে।” এইটুকু বলে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়ে লুপা। লারা লুপার কথার আগামাথা কিছুই বুঝেনা। মিহানের কথা উঠতেই লারার ভিতর কিছুটা কেঁদে উঠে। কিন্তু বাইরে থেকে শক্ত গলায় লুপাকে বলে” এটা তোমাদের পরিবারের ব্যাপার এখানে আমাদের টেনেছো কেন? এই মিথ্যে চোখের জল দেখিয়ে কী প্রমাণ করতে চাও,বাড়ির এই ঘটনায় তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছো?” লুপা হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। চোখে জল ঠোঁটে হাসি অদ্ভুত লাগছে তাকে। লারা নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল” কেন করছো এসব? নিজের বাড়িতে অশান্তি দেখে কী সুখ পাচ্ছো তুমি?” লুপা ভাঙ্গা গলায় বলল”

_ভাই হারানোর কষ্ট কেমন তা জানো?” লারার বুকটা ধুক করে উঠল। লুপা আবারও ভাঙ্গা গলায় বলল”

_আমার ভাই তো তোমার ভালোবাসা ছিলো তাইনা? আচ্ছা কখনো মনে হয়েছে সে খুব খারাপ?” লারা লুপার দিকে তাকালো। লুপা জানতো সে মিহানের গার্লফ্রেন্ড ছিলো? লারা লুপার থেকে চোখ সরিয়ে নিল। লুপার চোখে হাজার কষ্টের মেলা বসেছে। মিহানের মাঝে কখনো কোনো খারাপ কিছু পায়নি সে। মিহানকে ভালোবাসার প্রথম কারণ ছিল মিহান খুব ভদ্র একটি ছেলে। চোখের পানি মুছে লুপা বলতে লাগলো”

_আমার ভাইয়া ছোট থেকেই ঢাকায় নানুদের ওখানে থেকে পড়াশোনা করতো। মাঝে মাঝে বাড়ি আসতো। এসে দু-একদিন থেকে আবার চলে যেতো। তাই আমাদের এখানকার কেউ তাঁকে চিনতো না বললেই চলে। যখন আমার এসএসসি পরিক্ষার রেজাল্ট দেয় তখন ভাইয়া বাড়ি এসেছিলো। একদিন সন্ধ্যায় ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাইরে যায়। আমার আবদার ছিলো আইসক্রিম খাওয়ার। ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কেউ একজন ভাইয়াকে ফোন দিয়ে একটা জায়গায় যেতে বলে। ভাইয়া আমাকে সাথে নিয়ে যায়। কেননা ততক্ষণে রাত হয়ে গেছিলো আমাকে একা কই রেখে যেতো। একটা একতলা বাড়ির সামনে ভাইয়া গাড়ি নিয়ে যায়। আমাকে গাড়িতে বসিয়ে ভাইয়া ভিতরে যায়। ভাইয়া ভিতরে যাওয়ার দুইমিনিট পরে একদল পুলিশ দৌড়ে গিয়ে ওই রুমে ঢুকে। আমি প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারিনি পরে দেখি আমার ভাইয়াকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ভাইয়া তাঁদের বার বার বলছে সে কিছু করেনি এখানে তাঁকে ফোন দিয়ে আনা হইছে। কিন্তু পুলিশ শোনেনি ভাইয়ার কথা।

আমি ড্রাইভ জানতাম তাই নিজেই গাড়ি নিয়ে বাড়িতে আসি। বাড়িতে আসার পরে সবাইকে বলি “ভাইয়া আমাকে গাড়িতে বসিয়ে একটা ঘরে গেছিলো এখন ওই ঘর থেকে ভাইয়াকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে”। সবাই থানায় যেতে প্রস্তুতি নেয় তকনই টিভিতে লাইভ দেখায় ভাইয়া নাকি রেপিস্ট । পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে রেপ করেছে। খবরটা দেখে সবাই থম মেরে বসে থাকে। আমার বলার ধরনটা এমন ছিলো যে সবাই নিউজটা সত্যি ধরে নেয়। আমি সবাইকে বলি ভাইয়াকে কেউ ফাসাচ্ছে কেউ শোনেনি আমার কথা। থানায় যায়নি কেউ,আমাদের পরিবারের মানসম্মান বলে নাকি একটা কথা আছে। ভাইয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মেয়ের পক্ষের লইয়ার ছিলো আমার বড়মা। মেয়ে নিজের মুখে বলেছে ভাইয়া তাকে রেপ করেছে। ভাইয়ার বিরুদ্ধে সব সাক্ষী ছিলো। সব কিছু এমন ভাবে সাজানো হয়েছিলো যে বিপক্ষদের বিশ্বাস না করে উপায় ছিলোনা। সব দোষ ভাইয়ার দিকে আসতো। যে দেশে রেপিস্টদের বিচার হয়না সে দেশে আমার ভাইয়ার ফাঁসি হয়। আর এই রায় দেয় আমার বড়মা।

এইটুকু বলে ভিজে যাওয়া চোখ মুছে আবার বলতে লাগে লুপা।”
এই বাড়ির কেউ পরিচয় দেয়নি ভাইয়া এই বাড়ির ছেলে বলে। আসে পাশের কয়েকজন জানতো ভাইয়া শান্তি নীড়ের কেউ। মেজো আব্বু [দিহানের বাবা] তাঁদের বলে দেয় ভাইয়া নাকি জিহান ভাইয়ের বন্ধু ছিলো। তবুও কেউ বলেনি ভাইয়া তাদেরই কেউ। এতে নাকি মানসম্মান নষ্ট হবে। কিছুদিন পর জানতে পারা যায় এই সব কিছু করেছে আমাদের পূর্ব শত্রু জামিল খান। জামিল খান নাকি আমার ফুপিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। ফুপির সাথে নাকি সম্পর্কও ছিলো। দাদু বিয়ে দেয়নি সে খারাপ বলে। সেই থেকে সে আমাদের পরবারের সব থেকে বড় শত্রু হয়ে উঠে এই জামিল খান।

সবাই যখন জানলো ভাইয়া নির্দোষ ছিলো তবুও সবাই চুপ থাকে কিছু বলেনি কেউ। এতেও নাকি মান সম্মান নষ্ট হবে। লোক নাকি বলবে তাঁরা নিজের স্বার্থে পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলো। বুঝতে পারছো ভাবী কতো বড় অন্যায় হয়েছে আমার ভাইয়ের সাথে। আরে কোনো অশিক্ষিত মানুষ ওতো এমন করবেনা যা আমার শিক্ষিত পরিবার করেছে। সেই থেকে আমাদের আত্মীয় স্বজনের সাথে আমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যায়। আমার মামারা খালারা কেউ আমাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখেনা। এতকিছুর পরেও এই বাড়িতে এত খুশি। কিন্তু খুশি থাকতে পারিনা আমি। আমার বুকে আমার ভাই হারানোর যন্ত্রণা আমায় খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মায়ের কান্না করা দেখে আমার মনে প্রতিশোধের স্পৃহা জাগায়। প্রতিশোধের আগুন আমায় ক্ষণে ক্ষণে পোড়ায়। আমি প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে গেছিলাম। তাই এটা ভাবিনি কে বন্ধু কে শত্রু। আমার শুধু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দুটো মানুষের প্রয়োজন ছিলো,যেন তাদের দিয়ে আমি এই বাড়ির সম্মান নষ্ট করে দিতে পারি। আমি ভাইয়ার ডাইরিতে তোমার ছবি পাই। তোমাদের লাভ লেটার সব কিছু পড়ি আমি। তারপর তোমাকে আমার কাজের জন্য সিলেক্ট করি। অরিন তো আগে থেকেই আমার চোখে ছিলো।”

এতটুকু বলে থামে লুপা। ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। লারাও ডুকরে কেঁদে উঠে। মিহান যোগাযোগ বন্ধ করে দিছিলো বলে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে রুমে বন্ধ থাকতো সারাদিন। এসব নিউজ তাঁর চোখে পড়েনি। তারপর একদিন মিহানের এক বন্ধুর কাছে ফোন দিয়ে জানতে পারে মিহানকে তাঁর মা খুন করে দিয়েছে। আসলে সত্যিটা এই ছিলো। লুপা আবারও বলল”

একসময় আমার মনে হয় আমি ভুল করছি। এভাবে কারো জীবন নিয়ে খেলা আমার ঠিক হচ্ছেনা। তাই তোমার বাবাকে ছেড়ে দেই। আমার কারণে বাড়িতে এতো অশান্তি দেখে আমার ভালো লাগতো না। মরে যেতে ইচ্ছে করতো আমার। দেশের বাইরে চলে যেতে চাই আব্ববু বারণ করে। নীল ভাইয়াকে সব কিছু বলতে চাই। কেন জানি মনে হয় উনাকে বললে উনি আমায় একটা সমাধান দিবেন। কিন্তু বার বার কথা এড়িয়ে গিয়ে আমার কথা শুনেননি। [কিছুক্ষণ চুপ থেকে] আমি খুব খারাপ গো ভাবী। আমি এই বাড়ির শত্রু। কিন্তু এই বাড়ির কেউ আমার ভেতরের কান্নাটা দেখেনা ভাবী। আজ আমার ভাই থাকলে বিয়ে করতো বাচ্চা হতো সবার মতো আমার বোকা মাও ছেলের বউকে নিয়ে নাতি নাতনির স্বপ্ন দেখতো। হ্যাঁ আছে আরেকটা ভাই, কিন্তু ও বড় হতে হতে যদি আমার আব্বু আম্মুর কিছু হয়ে যায়। এসব ভাবলেই আমার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে। এই বাড়িতে আমার ভাইয়ের একটা ছবিও নাই এ নিয়ে আমার আম্মু আব্বু কিছু বলতেও পারেনা, কারণ তাঁরা ছোট। এতো অবহেলা, এতো অবহেলা সয্য কে করবে বলো?”

লারা কান্না আঁটকাতে পারছেনা। আসলেই কে করবে এতো অবহেলা সয্য। সব সময় হাসি খুশি থাকা মানুষগুলার ভেতরে এতো কষ্টে থাকে তা আন্দাজই করতে পারেনি লারা। মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিতেই চোখের পানি মুছে লুপাকে বলল”

_তুমি অরিনকে মারতে চেয়েছেছিলে কেন? আর এই মেসেজ কেন দিয়েছ আজ তার শেষ দিন?
_আমি অরিনকে বলেছিলাম চলে যেতে সে যায়নি তাই রাগ হচ্ছিলো আমার। তাই মেরে দিতে চেয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম এই বাড়িতে থাকলে ও মরে যাবে। আর ওই মেসেজে শেষ দিন বলতে এটা বুঝিছিলাম আমার খেলায় ওর শেষ দিন। আর কোনোদিন জ্বালাবো না ওকে। কিন্তু কে জানতো ও ইশিকে মেরে দিবে।
_না লুপা ও মারেনি ইশিকে ওর উপর আমার বিশ্বাস আছে।
_আমি অরিনের হাতে পিস্তল দেখেছি ভাবী।

আমিও দেখেছি।

দরজার সামনে থেকে এক গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসতেই সেদিকে তাকিয়ে এক ঝাটকা খেল দুজন।
#ভালোবাসি_প্রিয়
#পর্ব_৩৪
#সুলতানা_সিমা

শুকনো একটা ঢোক গিলে লুপা কিঞ্চিৎ ভয়ার্ত স্বরে বলল”
_ভাইয়া তু তু তুমি এখানে?” দিহান রুমের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল” হ্যাঁ।” দিহানের গলার স্বর গম্ভীর শোনালো। লুপা ভয় পেয়ে ঘামতে লাগে। দিহান কী সব শুনে ফেলছে? যদি সব শুনে ফেলে তাহলে দিহান তাকে খুন করে ফেলবে। লুপার চেহারায় ভয়ের চাপ। দিহান আবারও গম্ভীর গলায় বললো” এই বাড়িতে কারো মুখে যেন আমি এই খুনির নাম না শুনি। কথাটা যেন মাথায় থাকে।” দিহানের কথা শোনে বুঝা গেল সে শুধু শেষের কথা গুলা শোনেছে আগের কিছু সে শোনেনি। লুপা স্বস্থির নিশ্বাস নিলো। দিহান চলে যেতে লাগলো। পিছন থেকে লারা দিহানকে বলল”

_দিহান কারো হাতে পিস্তল দেখা মানে এই দাঁড়ায় না সে কাউকে খুন করেছে। তুমি তো অরিনকে ভালোবাসো তুমি অন্তত অরিনকে বিশ্বাস করো। কোনো প্রমাণ ছাড়া কেন তাকে সন্দেহ করছো?”

দিহান থেমে গেলো। পিছন ঘুরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো। এই হাসির মাঝেও তাঁর একরাশ কষ্ট লুকিয়ে আছে। কাটা গলায় বলল”
_সন্দেহ করছি আমি? কোনো প্রমাণ নাই? কী করিনি ওর জন্য আমি? নিজের বাবা মা নিজের পরিবার সব ছেড়ে দিয়েছিলাম। কথায় কথায় বলতো আমার মাকে খুন করে দিবে। একদিন নয় অনেকদিন বলেছে। তবুও আমি একটা বকা দেইনি ওকে। কখনো একটা ধমকও দেইনি। ও ভুল করলেও ভালোবেসে বুঝিয়েছি। আমি ভাবতাম ও যা বলছে রাগের মাথায় বলছে। বিশ্বাস করতাম ওকে,তাই এসব কথায় আমি কান দিতাম না। ইশিকে মারার ঘন্টাকয়েক আগে আমায় বলেছে, ইশি আমার পাশে আসলে সে নাকি সবাইকে মেরে দিবে। হ্যাঁ ইশি তো আমার পাশেই ছিলো তাইতো ও মেরে দিয়েছে। আমার মাকেও মারতে চেয়েছে। কীভাবে বিশ্বাস করবো আমি। যখন সব কিছু নিজের চোখের দেখা নিজের কানে শোনা।
_আমি বুঝতে পারছি দিহান তুমি এমন একটা জায়গায় আছো যেখান থেকে অরিনকে দোষী মনে হচ্ছে। কিন্তু অরিনের উপর বিশ্বাস রাখা উচিৎ। এভাবে অরিনকে শাস্তি দিয়না, পরে আফসোস করতে হবে।
_কার জন্য আফসোস করবো? যে আমাকে এতিম করে দিতে চাইছিলো। যদি গুলিটা আমার মায়ের বুকে লাগতো তখন? আরে তোমরা কী বুঝবা? কখনো ধোঁকা খেয়ে দেখেছো?” লারাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় দিহান। লারার শান্তি লাগছে না অশান্তি লাগছে তাঁর। এভাবে অরিন ফেসে যাবে জানলে কখনোই অরিনের হাতে পিস্তল দিতনা সে।

দিহান নিজের রুমে গিয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে। বাইরে থেকে যতটা শক্ত দেখাচ্ছে থেকে ভেতর থেকে সে ততটাই দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। কতো বিশ্বাস করতো সে অরিনকে। কী করেনি অরিনের জন্য? নিজের সব ছেড়ে দিয়েছিলো। আর এই অরিন কিনা এভাবে তাঁর দিকে বিষাক্ত তীর ছুঁড়ে মারল? দিহানের ভিতর বুকটা ভারি লাগছে। এতো ভারি যে মনে হচ্ছে পুরো পৃথীবির পাহাড় তাঁর বুকের উপর রাখা আছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর এখনো ভাতের প্লেট রাখা আছে। অরিন তাকে বলে গিয়েছিলো তাঁর কাজ শেষ করে এসে এক সাথে খাবে। এই কাজে গিয়েছিলো অরিন? রাগে দিহান উঠে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সব কিছু ছুঁড়ে ফেলল। চিৎকার করে বলতে লাগলো”
_বেইমানি করেছো অরিন। তোমাকে আমি খুন করে দিবো। ধোঁকা দিয়েছো আমায়।

ইশির মায়ের কান্না কিছুতেই থামছে না। লুপার মা প্লেটে করে ভাত নিয়ে বসে আছেন উনার হাতে। খাওয়ানোর জন্য অনেক্ষণ থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিন্তু খাওয়াতে পারছেন না। কান্না করতে করতে একটু পর পর অজ্ঞান হচ্ছেন শুধু। দিশা দরজার পাশে এসে দাঁড়াতেই তাঁর বড়মা তাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠেন। দিশা দৌড়ে গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁন্না জুড়ে বসে। ইশির মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন”
_দিশারে এই দিশা আমার ইশির এ কী হয়ে গেলো। আল্লাহ কোন পাপের শাস্তি দিল আমায়। আমার কলিজাটা পোড়ে যাচ্ছে রে দিশা আমার কলিজাটা পোড়ে যাচ্ছে।” কিছুক্ষণ কেঁদে হঠাৎ কঠিন গলায় বলে উঠলেন” আমি এই মেয়ের ফাঁসি দিব। বাঁচতে দিবনা এই ডাইনিকে, নিজের হাতে ফাঁসি দিবো আমি। আমার সন্তানকে যে মেরেছে তাকে আমি বাঁচতে দিবনা। ” লুপা মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন। সন্তান হারানোর কষ্ট কেমন তা উনি অনেক আগেই জেনেছেন। উনার ইচ্ছে করছিল বলতে ভাবী দেখছো সন্তান হারানোর কষ্ট কেমন। আমি কাঁদতাম বলে তুমি না আমায় বলতা এমন সন্তানের জন্য কেঁদে কী হবে। এখন বুঝতে পারছো ভাবী সন্তানের মৃত্যু মেনে নেওয়া কতোটা কঠিন।” ঠোঁটের কাছে আসা কথা গুলাও গিলে নিলেন তিনি। তাঁদের মতো হৃদয়হীন তিনি নয়। তাঁরা তো সবাই হৃদয়হীন। তাইতো নিজের কষ্ট ছাড়া অন্যদের কষ্ট অনুভব করার শক্তি নেই তাঁদের।

____________________________

জেলের ভেতর দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে বসে আছে অরিন। ধোঁকা খেয়েছে সে, অনেক বড় ধোঁকা। নিজের সব থেকে কাছের বন্ধু ধোঁকা দিয়েছে তাঁকে। এর থেকে বেশি কষ্ট আর কী হতে পারে। বন্ধুকে নাকি মানুষ সুখ দুঃখের কথা বলে, যদি এই বন্ধুটাই হয় জীবনের সব থেকে বড় কষ্টের কারণ। তখন? মূর্তির মতো বসে থাকা অরিনের চোখ থেকে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। লুপার থেকে ধোঁকা খেয়ে লারার কাছে ছুটে আসছিলো সে। শেষমেষ লারাও তাকে ফাসিয়ে দিলো। ঠোঁট কামড়ে নিজের কষ্টটা কমাতে চেষ্টা করলো অরিন। এত কষ্টের মাঝেও দিহানকে খুব মিস করছে সে। সারাটা রাত কেটে গেলো তাঁর পাষাণ স্বামীটা একবারও এসে দেখা দিলোনা। সেই যে জ্ঞান ফিরেছে থেকে সে অপেক্ষা করছে দিহানের জন্য, এখনো তাঁর অপেক্ষার ফলাফল জিরো। এই পাষাণ মানুষটার জন্যেও তাঁর মনটা কাঁদছে। সে কিছু খেয়েছে কিনা,বাসায় আছে নাকি বাইরে আছে, কেমন আছে। এই চিন্তাগুলা চেপে ধরেছে তাঁকে। বার বার সে বলছে এই পাষাণ স্বামীটার কথা আর ভাব্বে না, তবুও সে ভাবছে। হয়তো স্বামী নামক শব্দটার উপর নারী জাতি দূর্বল বলে না চাইতেও তাঁর জন্য চিন্তা হচ্ছে।

_আপু।” কান্নাজড়িত গলায় কারও আপু ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে থাকাল অরিন। তানভী দাঁড়িয়ে আছে। পরনে স্কুল ড্রেস, কাঁধে ঝুলানো একটা ব্যাগ,হাতে একটা পত্রিকা। অরিন তৎক্ষণাৎ ওঠে এসে হন্তদন্ত হয়ে বলল”

_তানভী তুই? তুই এখানে কেন এসেছিস?” তানভী ডুকরে কেঁদে উঠে বলল”
_আপু আমার জন্য এসব হলো তাইনা? শেষ পর্যন্ত একেবারে জেল পর্যন্ত আসলে। আমি এমনটা না করলে কখনোই তোমাকে ওই বাড়িতে যেতে হতোনা ওই বাড়িতে না গেলে কখনোই এখানে আসতে হতোনা।” অরিন অবাক হয় তানভী কী তাহলে সব জানতো? অরিন হাতটা বাইরে বের করে তানভীর চোখ মুছে দিয়ে বলল”
_কাঁদছিস কেন কাঁদবি না। আমি এখানে তুই জানলি কেমনে?
তানভী কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল”
_এই দেখো আপু পত্রিকায় তোমার ছবি বেরিয়েছে তুমি নাকি খুনি, তুমি নাকি লইয়ার মাহফুজা চৌধুরীর মেয়েকে খুন করেছো। আপু আমি জানি তুমি এমন কিছু করবে না। দেখ আপু এখানে তাঁরা কী লিখেছে, সবাই নাকি স্বচোক্ষে দেখেছে তুমি মেরেছো। আপু তুমি পালিয়ে যাও প্লিজ। ওঁরা তোমাকে ফাঁসি দিয়ে দিবে আপু।
_হোক ফাঁসি এটাই চাই আমি চলে যা তুই। ” অরিনের কণ্ঠ ভেজা, একরাশ অভিমান জমা। তানভী বলল”
_তুমি দোষ না করে কেন ফাঁসিতে ঝুলবে আপু? দোষ ওঁদের তুমি কেন মরবে? আমি জানি তুমি এমনটা করনি।
_চলে যা তানভী এসবে নিজেকে জড়াবি না। সাংবাদিক কারো চোখে পড়লে খুনির বোন হিসাবে পরিচিত হয়ে যাবি।
_নিজের কথাটা একবার ভাবো আপু। কেন এতো মহৎ হতে হবে তোমায়? জানো আপু,,,,” তানভী কিছু বলতে যাবে তখনই এক দারোগা এসে বলল”
_এই মেয়ে তোমার পাঁচ মিনিট শেষ যাও।” তানভী মিনতির স্বরে বলল” আর দুই মিনিট প্লিজ চলে যাবো আমি।”
_আর এক মিনিটও দেওয়া যাবেনা যাও বের হও।”

তানভী ব্যাগ থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে বলল” পাঁচ মিনিট প্লিজ।” দারোগা চারদিকে তাকিয়ে টাকাটা হাতে নিয়ে চলে গেলো। অরিন ধমক দিয়ে বলল”
_তানভী তুই এই লোকটাকে টাকা দিয়েছিস? টাকা পেলি কই তুই?
_আপু রাগছো কেন তোমার জন্যই তো দিছি। “তানভী কেঁদে দিলো। অরিনেরও কান্না চলে আসলো। যতই হোক এক রক্ত বইছে তাদের দুজনের শরীরে। রক্তের টান তো থেকেই যাবে। এই রক্তের টানেই তো তানভী ছুটে এসেছে। অরিন হাত বাড়িয়ে তানভীর চোখের পানিটা মুছে বলল”
_মা কেমন আছে রে? আপু আর তানজু কেমন আছে?
_সবাই ভালো আছে। জানো আপু, বড় আপু তোমার বরকে বিয়ে করতে চায়। আম্মু বলছে যতই হোক বিবাহিত ছেলের কাছে কখনো বিয়ে দিবেনা। এ নিয়ে আম্মুর সাথে আপুর অনেক ঝগড়াও হয়, একবার দুদিন না খেয়ে ছিলো৷।
_অহ।” অরিনের বুকটা ধুক করে উঠে। তাঁর স্বামীর ভাগ যদি তন্দ্রা নিয়ে নেয়? ভাবতেই অরিনের বুকের ভারি পাথরের ঢিল পড়লো।

_আপু প্লিজ পালিয়ে যাও। ওঁরা তোমাকে মেরে দিবে আপু। ওদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলবেনা। এখানে থাকলে নিশ্চিত তোমাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে।

অরিন চোখ ভর্তি জল নিয়ে ঠোঁটে অদ্ভুত হাসির রেখা টেনে বলল” আমার আবার ফাঁসি। “একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল “তোর বয়ফ্রেন্ড কেমন আছে?
_ও আরেকটা রিলেশনশিপে জড়িয়েছে আপু।” বলেই তানভী মাথা নিচু করে ফেলল। অরিন অবাক হলনা। দেহের সম্পর্ক কতোদিন টিকে তা সে অনেক আগে থেকেই জানে। বুক ছিড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। দারোগা এসে তানভীকে বলল চলে যেতে। তানভী কাকুতি মিনতি করে কিছু সময় চাইলো কিন্তু পেলোনা। তানভী কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো।

আজও সারাদিন গেলো দিহান একবারও আসেনি। অরিন ভেবেছিলো একবার হলেও দিহান আসবে, কিন্তু এলোনা। অরিনের চিন্তা হচ্ছে দিহান ঠিক আছে কিনা। হয়তো বাসার ঝামেলায় পড়ে আসতে পারিনি। হঠাৎ করে হয়তো অরিনের বিচার শুরু হবে। তারপর ফাঁসি। আচ্ছা অরিনের পক্ষে লড়বে কে? তানভী হয়তো ঠিকই বলেছে ওদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলবেনা। এখানে থাকলে সে মরে যাবে। সে মরে গেলে তো তাঁর বাচ্চাও মারা যাবে। বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো অরিনের। না এখানে থেকে তাঁর সন্তানকে সে মারবে না। কিন্তু এখান থেকে যাবেই বা কী করে?

অনেক্ষণ থেকে একটা দারগা এই মাথা হতে ওই মাথা হাঁটছে। হয়তো রাতের ডিউটি তাঁর। অরিন দারোগাকে কিঞ্চিৎ স্বরে ডাক দিলো।

_এই যে শোনোন।” দারোগা থাকাতেই অরিনের কলিজা ভয়ে কেঁপে ওঠে। লোকটাকে দেখে ডাকাত ডাকাত লাগছে। অরিন ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও বাইরে থেকে তা প্রকাশ করল না। আপাতত তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। তাঁর বাচ্চার জন্য হলেও তাকে পালাতে হবে। আঙুলে শাড়ীর আঁচল পেছাতে পেছাতে লাজুকবতীদের মতো মিটিমিটি হাসতে লাগলো। দারোগা ককর্শ গলায় বলল”
_কী হইছে ডাকলা কেন?
_আপনি না অনেক সুন্দর। “দারোগার মুখে হাসি ফুটে উঠলো,লজ্জার হাসি। অরিন আবারও বলল”
_আপনার মতো সুন্দর মানুষের সামনে বসে যদি চাঁদ দেখতে পারতাম আমি আমার জেলের জীবনটা স্বার্থক মনে করতাম। “লোকটা কপাল কুঁচকে তাকাল মনে হয় বুঝে গেছে অরিন যে ওকে কথার ফাঁদে ফেলতে চাইছে। লোকটা গম্ভীর মুখ করে চলে যেতে লাগলো অরিন বললো”
_আমি ভেবেছিলাম আপনার মনটা আপনার মতো সুন্দর তাই মনে আসা কথাটা বলে দিয়েছিলাম।” অরিনের কণ্ঠে মিথ্যে কান্না ছিলো যা দারোগাকে ফাসিয়ে দিলো। দারগা চারদিকে তাকিয়ে অরিনকে এসে বলল”
_বেশিক্ষণ কিন্তু চাঁদ দেখা যাবেনা।” বলেই তালা খুলে অরিনেকে বের করে পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসলো। বাইরে এসে অরিন অযথাই কাশতে লাগলো দারোগা ভিতু গলায় বললো”
_এই কাশতেছো কেনো? সবাই ঘুম থেকে উঠে যাবে।” অরিন আবারও কাশলো তারপর বললো”
_আমি কী করবো বলুন, আজ দুদিন ধরে চা কফি খাইনা। [একটু থেমে] আপনাদের বড় স্যার যেখানে বসেন ওখানে ফ্লাক্স আছে দেখলাম। একটু চা নিয়ে আসুন না প্লিজ।” দারগা নড়লো না অরিন বলল”
_ঠিক আছে ভেতরেই গিয়ে খাই চলুন। আমাকে যখন বিশ্বাস হচ্ছেনা এখানে থেকে কী হবে। কতো আশা নিয়ে এসেছিলাম আপনার কাঁধে মাথা রেখে চাঁদ দেখবো।” দারগার মনে লাড্ডু ফুটলো। মিটিমিটি হাসতে হাসতে চা আনতে চলে গেলো। অরিন এক সেকেন্ডও দেরি করলো না। পালাতে দৌড়ে দিলো। দেয়াল টপকাতে একটু কষ্ট হলো তাঁর। দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে পড়েনি সে যেভাবে বেয়ে উঠেছে ওইভাবেই নামলো। যে বাচ্চার জন্য এতোকিছু সে বাচ্চার যদি ক্ষতি হয়ে যায় সেই ভয়ে। দেয়ালের এপারে এসে নিজের সব জোর দিয়ে দৌড় দিলো সে। এই কালো জগত থেকে দূরে যাবে সে অনেক দূরে যেখানে থাকবেনা কোনো বেইমান ধোঁকাবাজের ছায়া।

চলবে……।
চলবে……।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here