#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
২৬,,
আজ সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিলো তুলিকে পায়নি। সে এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। আবার ভার্সিটিতে গিয়েও অনিমাকে খুঁজে পায়নি। ও আসেনি আজকে। তিলো ফোন করেছিলো ওকে। ও বলেছে, আজকে আসবে না।
অরিক আর তিলোর সম্পর্কটা ভার্সিটিতে আগের মতোই। কেউ কারো প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আলাদা কোনো অনুভূতি এখানে প্রকাশ করে না। অরিক ওর সাথে আলাদা করে কথা বললেও সেটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে বলে। এখানে তারা নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় যথেষ্ট সচেতন।
তিলোর মনে হচ্ছে, আজকের পুরো দিনটাই ওর সাধারণভাবে চলেছে। অসাধারণ কোনোকিছু সামান্যতম ঘটেনি। জানার মধ্যে জানতে পেরেছে, অনিকেত খুব শীঘ্রই চলে যাচ্ছে। এদিকে তৌকিরের গোয়েন্দাগিরি সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। মীরার গোপন প্রেমিকের খোঁজ সে খুব শীঘ্রই পাবে। আহান আর রিয়া ফিরোজের ফ্ল্যাট ছেড়ে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠেছে। আহান টিউশনির সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। সাথে রিয়াও দুটো যোগাড় করে নিয়েছে। তবে ভাড়া বাড়িটা রিয়ার মনমতো না হওয়ায় ওর মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। রিয়া এমন বাড়িতে থাকতে একদমই অভ্যস্ত নয়। গত পরশু বলে, তারা ঝগড়াও বাঁধিয়েছে। মুখে কিছু বলেনি কেউই। তবে তাদের ভেতরকার প্রত্যক্ষ দূরত্বটুকু ওদের কারোরই চোখ এড়িয়ে যায়নি। গুঞ্জন উঠেছে, রিপার ছেলেরা, তাদের মায়ের জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করেছে। বাল্যবিধবা রিপার বয়স খুব বেশিও না। সাধারণত শহরের মেয়েদের এবয়সেই বিয়ে হয়। তার প্রথম স্বামী মারা গিয়েছে বলে তো সে তার সারাজীবন নষ্ট করতে পারে না। রিপাই বরং অরাজি। তবে তার তিন ছেলেও নাছোড়বান্দা। সাথে বউগুলো আর বাচ্চাগুলোও জুটেছে। পোতা পুতনি গুলো দাদীর বিয়ে দেওয়ার জন্য একপায়ে খাঁড়া। বয়স তাদের খুব বেশি না। বড়জনই সবে এগারোতে পড়েছে। তবে তারা অকালপক্ব। একটু বেশিই বোঝে।
তিলো তো পুরো কথা শুনে ওখানেই হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার যোগাড়। এজন্য না যে, রিপার বিয়ে ঠিক হচ্ছে। এজন্য যে, দাদীর বিয়ে নিয়ে নাতি নাতনিরা বেশি উত্তেজিত। এরপর রিপার বাচ্চাকাচ্চা হবে ওদের চাচা – ফুফু! অরিককেও ও এবিষয়ে বলেছে। তিলো নিজের ভেতর অদ্ভুত এই পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছে, ও অরিককে সবকথা বলে এখন। নিজের সমস্ত প্রকার অনুভূতি সে ভাগাভাগি করে নেয় অরিকের সাথে। অতিসাধারণ একটা ঘটনাও সে অরিককে বলে দেয়। এমন না যে ও উদ্দেশ্য নিয়েই বলে। ও কেবল বলে দেয় বিভিন্ন কথা প্রসঙ্গে। অরিকের সামনে নিজেকে একটা খোলা বইয়ের মতো মেলে ধরে। যে বইয়ের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল। কথাগুলো বলার পর, সেগুলো মনে পড়লে নিজের কপালই চাপড়ায়। সত্যিই! ও এতো তুচ্ছ বিষয়ও অরিককে বলেছে! কিন্তু যখন কথাগুলো বলে, তখন নিজেকে সামলাতে পারে না। মনে করে, এটাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ এই মূহুর্তে। এবং অবশ্যই অরিকের জানা উচিত। না জানলে বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাবে। অবচেতন উত্তেজনা গ্রাস করে ফেলে ওকে। অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে অরিক ওর জন্য।
আর অরিকও ওকে বাঁধা দেয়না। বরং সব কথাই আগ্রহ সহকারে শোনে। আর মাঝে মাঝে নিজেও কিছু অভিমত প্রদান করে।
দুপুরে খেতে বসে তিলো তুলির খোঁজ করতেই জানতে পারে, তুলি আজও বাইরে গিয়েছে। নাসীরা পারভীনকে বলে গিয়েছে। তিলোর মনে হয় না, তুলির কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে বলে। তবে কেন সে বারবার বাইরে যায়, এটা ওর কাছে রহস্য বলে মনে হয়।
তিলোর ঘরটার ঠিক সামনের ঘরটা তুষারের। আজকের দিনে তুষারের বাইরের টিউশন কম। আজকে ওর বাসায় টিচার আসে বেশি। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই ওর অঙ্কের শিক্ষক এসে হাজির। তিলো নিজের ঘরে বসে দুম দুম দুটো আওয়াজ শুনলো। তারপর বেত দিয়ে বাতাস চিড়ে ফেলে পিঠে পড়ে ‘চ’ বর্গীয় একধরনের শব্দ হতে শুনলো। তিলো নিশ্চিত তুষার মার খাচ্ছে। তুষার বেশি মার খায় ওর ঝিমুনির কারণে। এতো বড় হয়েও মার খায়। লজ্জাও করে না। প্রায়ই খায়। তবে আজকে ওকর মার খাওয়ার আওয়াজ শুনে তিলোর ভেতর আতঙ্ক বিরাজ করছে। তুষারের যে স্বভাব! নিজের ধৈর্য্যসীমার বাইরে চলে গেলে ও কোনো না কোনো অযুহাত দাঁড় করিয়ে তো মুক্তি পেতে চাইবেই এই পরিস্থিতি থেকে। আজ যদি, রাতের ঘটনা বলে তিলোকে ফাঁসিয়ে দেয়!! তাহলে কি বিশ্রী একটা ব্যাপার হবে!
তিলো দরজা ফাঁকা করে নিজের পূর্ণ মনোযোগ সেদিকে দিলো। ফ্যান বন্ধ করে ঘামছে এই গরমে। তারপরও ফ্যান ছাড়ছে না৷ প্রতিটা কথা ওর কানে আসা অতিব জরুরি।
নাসীরা পারভীন সামান্য নাস্তা নিয়ে ঢুকলেন তুষারের ঘরে। তখন ওর শিক্ষক ওকে দিলো একটা দাবড়। তুষার ঝাড়ি খেয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গিয়েছে। স্যার ওকে মারুক, বকুক সব নিজেদের মধ্যে থাকা পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে তা নাসীরা পারভীন বা আনিস সাহেবের কানে যাওয়া ওর জন্য বিশেষ ভীতির কারণ। ভীষণ ভয় পায় ও আনিস সাহেবকে পড়াশোনার বিষয়ে।
নাসীরা পারভীন ওর শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলেন না যে কেন ওকে দাবড়ানো হলো। তিনি নাস্তার ট্রে টা সামনে রেখে ওর স্যারকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-কি? কিছু পারছে না? শুনুন স্যার, আপনাকে আমি অনুমতি দিয়েছি, মারবেন ওকে। হাড্ডি আপনার, মাংস আমার। চামড়া ছিলে রোদে শুকাবেন।
তুষার ভীত চোখে একবার নাসীরা পারভীনের দিকে তাকালো। ওনার কঠিন দৃষ্টি দেখে চুপসে গিয়েছে সে। স্যার ইন্ধন পেয়ে আরো জোরে একটা দাবড় দিলো ওকে ঝিমানোর জন্য। তুষারের চোখে এবার পানি টলমল করছে। মায়ের সামনে এ অপমান ওর বড্ড গায়ে লাগছে। স্যার আরো কিছু বলার আগে তুষার নিজের রাগ ঝেড়ে বললো,
-আমি কি করবো? ওরা দুজন রাতভর প্রেম করে বেড়াবে আমাকে পাহারায় রেখে। সারারাত ঘুমাইনি। এখন ঘুম আসলে কি করবো আমি?
তিলোর কানে কথাটা যেতেই তিলোর মাথায় হাত! এতক্ষণ এটার ভয়ই পাচ্ছিলো। একদমই খেয়াল ছিলো না যে তুষারের স্যার এসে ওকে পড়াবে। তাহলে নিজে হাতে ঘি দিয়ে ব্ল্যাক কফি করে খাওয়াতো ওকে।
নাসীরা পারভীন সচকিত হয়ে বললেন,
-কারা রাতভর প্রেম করে তোকে পাহারায় বসিয়ে গিয়েছে?
কথাটা বলে ওনার খেয়াল হলো, ওনি আসলে ওর স্যারের সামনে এ কথা বলছেন। বিষয়টা মাথায় আসতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। নিজের বেখেয়ালির মাশুল হিসাবে তুষারকে দু ঘা দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তিনি তা করলেন না।
এদিকে তুষারেরও খেয়াল হলো, ও আসলে কি বলে ফেলেছে! অরিক ওকে বারবার একথা কারো সামনে বলতে নিষেধ করেছিলো। তুষার নিজেও বিব্রতবোধ করছে একটু আগে খামখেয়ালিতে বলা কথাটার জন্য। অযুহাত খুঁজতে খুঁজতে সত্যিটাই বলে দিয়েছে। তুষার দ্রুত নিজেকে সামলে বললো,
-না। কারো না।
নাসীরা পারভীন আগের অপ্রস্তুত হয়ে পড়া আর তুষারের অস্বীকৃতি, সাথে সাথে ওর পড়াশোনা নিয়ে গাফিলতির কারনে সব রাগ নিয়ে ওর ফোনের উপর ফেললেন। টেবিলের তাকের উপর রাখা তুষারের স্মার্ট ফোনটা হাতে নিয়ে বললেন,
-এই ফোনটাই তো যতো নষ্টের গোড়া! সারারাত জেগে তুমি গেইম খেলো। কি মনে করো? আমি কিছু টের পাই না? তুষার, তুমি আমার পেটে জন্মেছো। সব বুঝি আমি। তুমি কতোটুকু ফাঁকা করে পা ফেলো সেটাও আমার মাপা। এখন থেকে নিয়ম করে একঘন্টা ফোন পাবে তুমি। বাকি সময় আমার কাছে থাকবে।
নাসীরা পারভীন শান্ত কন্ঠে তবে তিক্ততার সাথে কথাগুলো বলে ফোনটা হাতে নিয়ে চলে গেলেন। এমনই একটা সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি, ছেলের থেকে ফোনটা আলাদা করার। যন্ত্রণা একদম বিগড়ে দিয়েছে তুষারকে।
তুষারের স্যার সম্পূর্ণ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো। তুষার এদিকে প্রচন্ড হতাশ! যতো রাগ, সব গিয়ে শেষমেশ ওর অবলা, মাসুম ফোনটার উপরই পড়ে! তিলো, অরিকের পাশাপাশি স্যারের উপরও রাগ হচ্ছে ওর। কিন্তু কিছু বলার নেই। ফোনটা চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে, ওর শরীরের একটা অংশ কেটে নিয়ে গিয়েছেন নাসীরা পারভীন। ওর হৃদয় ছেঁড়া ধন। কান্না আটকাতে পারলোনা তুষার। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। গেইমের যে লেভেলে আছে সেখান থেকে দ্রুত পরের লেভেলে উঠতে না পারলে ও বন্ধুূদের থেকে পিছিয়ে পড়বে! ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে। ওদের প্রেম টিকাতে নিজের প্রেমিকাকে হারাতে হলো!!
তুষারকে কাঁদতে দেখে ওর স্যার আবার ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত হলেন।
তিলো সারাদিনে তুলির দেখা পায়নি। নাসীরা পারভীন ইশানকে সামলিয়েছেন। তিলোর নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। যখন তুলি নিজে থেকে বলতে চাইলো, ও শুনলো না। আর এখন সবটা শুনতে ও খুবই আগ্রহী। কিন্তু তুলির দেখা নেই।
বিকালে অনি ফোন করে ওকে হাঁটতে বের হতে বললো। এটা একসময় ওর আর অনির নিয়মিত কাজ ছিলো। তারা বিকালে একসাথে হাঁটতে বের হতো। গল্প করতো। চা খেতো। বাড়ি ফিরতো। একটা আলাদা পরিতৃপ্তি। নিজেদের ব্যস্ততায় এখন খুব বেশি সেটা হয়না। মাঝে মাঝে হয়।
তিলো আছরের নামায আদায় করে প্রস্তুত হয়ে বের হলো। রাস্তাটা মাথায় পৌঁছে তিলো দেখে অনি আগের থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
২৭,,
তিলোত্তমা অনিমার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েই নিজেকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-দেখ তো, আমাকে কি পিকিউলিয়ার কোনো জোকারের মতো লাগছে দেখতে?
অনি ভ্রু কুঁচকে ওকে পরখ করলো। কিন্তু কিছু বললো না। তিলো ওর এমন আচরণের সাথে একদমই পরিচিত নয়৷ অনি তো এমন সুযোগ পেলে ওকে ছেড়ে দেওয়ার মতো পাত্রী না। কিছু না কিছু বলে খেপিয়ে তুলবেই। তিলো আবার বললো,
-কি রে, বল।
অনি আগের মতো ভঙ্গিমা করেই বললো,
-কেন?
-দেখ, আমি ফ্রকের সাথে জিন্স আর তার সাথে জিতা পরেছি। কেমন যেন লাগছে নিজের কাছে?
অনি বেশ বিরক্ত হলো ওর কথায়। তবে সেটা চেপে রাখার বৃথা চেষ্টা করে বললো,
-তা পরেছিস কেন, এমন অদ্ভুত পোশাক?
-বৃষ্টি হচ্ছে তো প্রায়ই। রাস্তাঘাট কাঁদা কাঁদা। তাই জুতা পরেছি। একদম বেমানান। তাই না?
-না। ডায়াবেটিস ওয়ালা মহিলা আর মোটা মহিলারা হাঁটার সময় এমনই পরে।
তিলো আর কিছু বললো না। কিন্তু ওর নিজের কাছে নিজেকে অদ্ভুত লাগছে। মাথার ওড়নাটার কাঁধে লাগানো পিন খুলে চাদরের মতো ঢেকে নিলো নিজের পুরো শরীর। অনি কাঁধে ঝোলানো গোলাপি বর্ণের গুচ্চির ব্যাগটা থেকে একগাদা চকলেট বের করে তিলোর হাতে দিয়ে বললো,
-এগুলো ধর।
তিলো চকলেটগুলো হাতে নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। অনি ব্যাগ থেকে আরো অনেকগুলো বের করে ওর হাতে দিলো। সাথে আর কিছু জিনিস। তিলো এবার জিজ্ঞাসা করলো,
-আঙ্কেল এনেছেন?
-হুম।
-ইন্ডিয়া থেকে চকলেট কিনে শান্তি আছে। একই টাকায় অনেক বেশি পাওয়া যায়। এদেশে ঢুকলে তো দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে যায়।
-হুম।
তিলোর কন্ঠের প্রফুল্লতাও আজকে অনির অভিব্যক্তি বদলাতে পারছে না। আগে কথাগুলোয় ও তাল মেলাতো। আজকে একদমই চুপচাপ। তিলোও দমে গেলো ওর থেকে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে। চকলেট আর উপহারগুলো নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।
দুজনেই খানিকটা সময় নিরব থেকে হঠাতই অনি বললো,
-তোকে বুড়িদের মতো লাগছে দেখতে। ড্রইংরুমে হঠাৎ অতিথির আগমনে ভেতর থেকে যেভাবে পর্দা করে আসে মা চাচীরা, তেমন দেখাচ্ছে।
বলেই হেসে দিলো। তিলো একবার থমকে দাঁড়িয়ে বললো,
-আচ্ছা তো কিভাবে পড়বো বলতো।
অনি তিলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। এরপর নিজে হাতে ওর ওড়না ঠিক করে পড়িয়ে দিলো। তারপর আবারও হাঁটতে শুরু করলো। এই শহরের থেকে অপরদিকের উপশহরটাকে ভাগ করে রেখেছে যে নদীটা সেদিকের রাস্তা বেশ সুনশান। মানুষের যাতায়াত থাকা সত্ত্বেও নিরব হয়ে থাকে ভারী যানবাহন চলাচলের অভাবে। বিকালে ডায়াবেটিস এর রোগীরা বিশেষ করে এদিক থেকে ক্ষিপ্র গতিতে হাঁটাচলা করে।
নদীর পাড় থেকে উঁচু লোহার রেলিং দেওয়া। তিলো আর অনি বেশিরভাগ সময় এদিকটায় দাঁড়িয়েই কিছু ছবি তোলে। বিকালের সূর্যাস্তের, লঞ্চের, ঘোলা পানিতে বয়ে চলা কচুরিপানার।
আজ এসে ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অনির নিরবতা তিলোর সহ্য হচ্ছে না। তিলো ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বললো,
-ক্যামেরাটা কি ব্যাগে ভরে রাখার জন্যই কিনেছিস?
অনি উদাস ভঙ্গিতে বললো,
-আজকে আনিনি।
তিলো অবিশ্বাস্য চোখে ওর দিকে তাকালো।
-তুই! আর ক্যামেরা আনিসনি!! আনবিলিভএবল!! আজকে মেঘলা আকাশটা দেখ একবার।
অনি ওর কথার প্রত্যুত্তর করলোনা। তিলোও আর কথা বাড়ালো না। নিজের ফোনটা বের করে কিছু ছবি তুলতে আরম্ভ করলো। অনি ওর কাজের মাঝেই বললো,
-তিল, তোকে কিছু বলতে চাই আমি।
তিলো নিজের কাজেই মগ্ন থেকে বললো,
-তো বল। অনুমতি নেওয়ার কি আছে?
-আমি অরিক স্যারকে ভালোবাসি।
তিলো একমুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। কথাটা বুঝে উঠতে ওর মস্তিষ্ক কিছুটা সময় নিলো। যেন মর্স কোড বলা হয়েছে আর ও বিশ্লেষণ করে নিচ্ছে। বুঝতে পারতেই তিলো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো অনির দিকে। তিলো জানতো অনির অভ্যাস আছে ক্ষণে ক্ষণে ক্রাশ নামক ছোটখাটো আঘাত পাওয়ার। কিন্তু অরিকের বিষয়ে ও সংবেদনশীল হয়ে উঠবে তা ও বুঝতে পারেনি। অনি ছেলেদের সাথে প্রায়ই ফ্লাট করে বেড়ায়। তাই বলে সিরিয়াস হয়না কখনো।
তিলো কিছু সময় চুপ থেকে হঠাৎ করে যেন আটকে রাখা দম ফেলে জোরপূর্বক হেসে বললো,
-ভালো কথা।
তারপর আবারও নিজের কাজে মন দিলো। তবে তিলোর এই মূহুর্তে হাত কাঁপছে। ক্যামেরার ফোকাস ঠিক রাখতে পারছে না। অনি ওর থেকে আশানুরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আবারও বললো,
-তিল, আমি সিরিয়াস।
তিলো এবার ফোনটা ব্যাগে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-এই কথা বলতে তোর এতো আয়োজন! ফোনে বললেই হতো।
অনি ওর আচরণটা নিতে পারছে না। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-ন্যাকামি করবি না একদম।
-আজব তো! এখানে ন্যাকামির কি হলো?
-তুই কিছু কর।
অনি প্রায় কেঁদে দিয়েছে।
তিলো ওর থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
-এখানে আমি কি করতে পারি? সে ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে, তাই তুই ভালোবেসেছিস। আমার কি করার আছে এখানে?
অনি ওর থেকে চোখ সরিয়ে দুবার মাথা ঝাঁকিয়ে অদ্ভুত আচরণ করছে। এবার সবটা সহ্যসীমার বাইরে চলে গিয়েছে ওর। ও ভেবেছিলো তিলো সবকিছু বুঝতে পারার মতো ম্যাচিউর একটা মেয়ে। অনি নিশ্চিত, তিলো বুঝতে পারছে আসলে অনি ওকে কি করতে বলছে। এরপরও তিলো নিজের জন্য না বোঝার ভান করে চলেছে।
হঠাৎই অনি তিলোর দুইবাহু চেপে ধরলো। অনি তিলোর থেকে স্বাস্থ্যের দিক থেকে অধিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। পাশাপাশি দেড় ইঞ্চি বেশি লম্বা। তিলোকে দুইহাতে ধরতে অনির অসুবিধা বা বিব্রতবোধ কোনোকিছুই হলোনা।
তিলো নির্বিকার ভঙ্গিতে অনির দিকে তাকিয়ে আছে। অনি কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠলো,
-বুঝতে পারছিস না আমি তোকে কি করতে বলছি? বিয়েটা ভেঙে দে। করিস না এই বিয়ে।
ইতিমধ্যে রাস্তার উপর একটা দর্শনীয় দৃশ্যের উপস্থাপন হওয়ায় দর্শক জুটে যেতেও সময় লাগেনি। গাট্টা গাট্টা মহিলা, চিকন মহিলা, স্বাভাবিক মহিলারাই সিংহভাগ দর্শক। পুরুষের সংখ্যা কম। এরাস্তাটা মহিলাদের দখলে বলে ভদ্র পুরুষ এদিকটায় খুব কমই আসে।
তিলো একবার আড়চোখে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। অনি যে নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘোরের ভেতর আছে, সেটা বুঝতে পেরে ওকে খুব বেশি ঘাটালো না। ধীর হস্তে নিজের বাহুর থেকে ওর হাত নামিয়ে দিয়ে বললো,
-বিয়েটা দুপক্ষের সম্মতিতে হচ্ছে। অরিক রাজি বিয়েটা করতে। তাই কেবল আমি বলে ভেঙে দিলেই যে তুই ওকে বিয়ে করতে পারবি, এমন কোনো কথা নেই। দুনিয়ায় মেয়ের অভাব পড়েনি। আমার সাথে বিয়ে না হলেই যে তোর সাথে হবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। অন্য কারো সাথেও হতে পারে। তাছাড়া দুপক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে এদিককার পাল্লা ভারী। তুই আদ্রিয়ান আঙ্কেলকে বল অরিকের সাথে বা তার বাবার সাথে কথা বলতে। তারা রাজি হয়ে যদি আমার সাথে বিয়েটা ভেঙে দেয় তখন দেখা যাবে। পারিবারিক ভাবে ঠিক করা বিয়েতে পাত্র পাত্রী বদলে যেতেই পারে। পাশাপাশি এটা কেবল আমাদের উপর নির্ভর করে না। আরো একটা প্রজন্ম জড়িয়ে থাকে। তুই বলে দেখতে পারিস।
-তিল, একজন তাকে ভালোবাসে জানা সত্ত্বেও তুই অবলীলায় তার সঙ্গে সুখে সংসার করে যাবি?
অনি ভগ্ন ভেজা কন্ঠে কথাটা বললো। তিলোর নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে। ওর চোখ ছলছল করছে। এরপরও একপেশে হেসে বললো,
-অনি, একজন পাবলিক ফিগারকেও বহু মানুষ ভালোবাসে৷ তাই বলে কি তার সংসার হয়না কখনো বা অনেকগুলো সংসার হয়। নাকি তার বউ তাকে ছেড়ে চলে যায় এজন্য যে, না তাকে আরো কেউ ভালোবাসে?
-সেই ভালোবাসা আর এই ভালোবাসা এক না তিল। বোঝার চেষ্টা কর। তুই তো কেবল পরিবারের কথাতে রাজি হয়েছিস। ভালোবাসিস তাকে? নাহ্। কিন্তু আমি বাসি।
অনির কথাটা তিলোর হৃদপিণ্ডের একটা স্পন্দন হারিয়ে ফেলতে সক্ষম হলো। ও কি সত্যিই ভালোবাসে না? কথাটা আজও অজানা ওর কাছে। কিন্তু আজ অনি অরিককে ছাড়তে বলায়, ও মেনে নিতে পারছে না বিষয়টা কোনোভাবেই। স্বার্থপর করে তুলেছে মূহুর্তেই। অনির কথাটাকে অগ্রাহ্য করতে বা ওর অনুভূতিকে আঘাত করতে ওর একটু খারাপ লাগলেও ওর মন মস্তিষ্ক উভয়ে একই সাথে বলছে, এখন সে ভালো থাকতে চায়। সে চায় অরিকের সাথে সংসার করতে। এতে কেউ বাঁধা দিলেও সে উপেক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। তিলো আগের মতোই নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
-তোকে তো উপায় বললাম। কাজটা করে দেখ। আমার ভেতর অরিকের জন্য কি আছে, সেটা নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। তবে বলবো, অন্যের সিদ্ধান্তকে সম্মান দিতে শেখ।
অনি আহত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আবারও কিছু বলার আগে তিলো বললো,
-একান্তে কথাগুলো বলতে পারতিস। রাস্তার উপর এটা! এটা আসলে খুব বাজে একটা অভিজ্ঞতা।
তিলো আর দাঁড়ালো না। অনি কয়েকবার ওকে ডাকলো পেছন থেকে। তিলো ফিরে তাকালো না। রাস্তার কাঁদা মাটি বাঁচিয়েও ও চলছে না। গর্তে জমে থাকা ইটের খোয়া ধোয়া লাল পানিতে পা ডুবিয়ে কালো জুতাজোড়া একেবারে যাচ্ছেতাই দেখতে করে ফেলেছে। তিলোর চোখে পানি জমে ঘোলাটে দেখছে সামনের সবকিছু। অনি হতাশ হলেও ওর চলার ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পেরেছে, কথাগুলো তিলোর উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
২৮,,
বাড়ি ফেরার পর তিলো নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেলেও সে খোলেনি। এদিকে নাসীরা পারভীন, ওর সন্ধ্যাকালীন নাস্তা নিয়ে কয়েকবার দরজার সামনে গিয়ে ওকে ডেকেছে। ও শুধু বলেছে, আজকে ভালো লাগছে না কোনোকিছু। ওকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছে পাশাপাশি। নাসীরা পারভীন এরপরও ওকে ডাকলে শেষ পর্যায়ে ওর আচরণটা আজ আবারও খানিকটা রুক্ষ হয়ে উঠেছে। নাসীরা পারভীনের তীব্র বিশ্বাস, অরিকের সাথে ওর কিছু হয়েছে। আর সেই বিশ্বাসের জেরে অরিকের উপর রাগটাও বাড়ছে। বিয়ে হয়নি এখনও, তার মাঝেই তিলোকে কষ্ট দিতে শুরু করেছে সে!
তিলো সেই সময় থেকে নিজের অবস্থান পর্যন্ত বদলায়নি। বিছানার উপর চিত হয়ে শুয়ে মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। যেন ঘূর্ণন সংখ্যা গুনছে খুব মনোযোগ দিয়ে। এটাই ওর একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিলোর চোখে একবার মনে হচ্ছে ফ্যানটা খানিকটা নিচে নেমে এসেছে। আবার মনে হচ্ছে, না ঠিকই আছে। ফ্যানের মাঝখানের লাল বিন্দুটা যেন ওকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর পর চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে চুলের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, কানের পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। সেই পানি মুছে ফেলার শক্তিটুকু বা ব্যস্ততা ওর মাঝে নেই। যেন হাত নাড়িয়ে এতোটুকু করতে ওর ভীষণ কষ্ট হবে।
তিলোর প্রশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে। আবারও সেই একই প্রকার অনুভূতি ওকে গ্রাস করে ফেললো যেমনটা সে অনুভব করেছিলো ফাহাদের বিয়ের সময়। তিলোর মনে পড়ছে গতবছর অনিমার সাথে কাটানো সেই রাতটার কথাগুলো।
সেদিন অনিমার ছোট ভাই আয়াশের জন্ম বার্ষিক ছিলো। আয়াশের অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পাশাপাশি একইসময়ে জন্মদিনটা হওয়ায় আদ্রিয়ান আঙ্কেল বড় করে একটা অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেন। মূলত আয়াশের সাফল্যের কথা আত্মীয় স্বজনদের জানানোই মুখ্য উদ্দেশ্য। অনির বন্ধু বলতে তখন তিলোই সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলো। বাকিদের থেকে ও অনেকটা দূরে সরে গিয়েছিলো অন্তর ওকে ধোঁকা দেওয়ার পর। অবশ্য অন্তরের কাছে থেকে ধোঁকাটা ও যেচে নিয়েছে। ও জানতো অন্তর একটা বখাটে ছেলে। স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাই ওর প্রধান কাজ। এরপরও ও অন্তরের ডাকে সাড়া দিয়েছে। এমন নয় যে অন্তর ওকে জোর করেছিলো। অনি স্বেচ্ছায় ওর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।
সেরাতে তিলোর খাওয়া শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়। তিলো আনিস সাহেবকে ফোন করে ওকে নিয়ে যেতে বলার আগেই অনি ওকে একপ্রকার জোর করে সেরাতে ওর সাথে থাকতে। সারারাত জেগে মুভি দেখবে আর গল্প করবে। তিলো প্রথমে ইতস্ততা করলেও নিজেও লোভটা সামলাতে পারেনি। ও রাজি হয়ে যায়।
রাতে অনির পোশাক পড়ে ওর রুমে ওর সাথেই থেকে যায়। অনি দরজা বন্ধ করে থ্রিলার মুভি দেখতে শুরু করে দুজনে। ‘নেইলপলিশ’ মুভিটা দেখছে আর সেটা নিয়ে আলোচনা করছে। ওরা এক একজন একে অপরের প্রতিক্রিয়া নিয়েও হাসাহাসি করছে। মুভিটার একপর্যায়ে অনি বললো,
-দেখ, এর থেকেও বোঝা যায়, ভীড় সিং নাটক করছে। সে চারু হয়ে গিয়েছে। একটা মেয়ে যতো সমস্যায়ই পড়ুক কিভাবে ও উকিলের শার্টের বোতাম ধরে টেনে রেখেছে?
তিলো চোখ জোড়া ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকালো। অনি ওর প্রতিক্রিয়া দেখে বললো,
-কি হলো? ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
তিলো উবু হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,
-তুই বলছিস একথা? ক্লাস সিক্সে থাকতে মেলায় ভুতের বাড়িতে ঢুকে সামনের সারির ছেলেদের কোলের উপর কে বসে পড়লো?
অনি তৎক্ষনাৎ উঠে বসে জিহ্বা কামড়ে বললো,
-জায়গা মতো ঘাই দিলি একেবারে। তোর কাছে থেকে কোনো কথা বলে সরার উপায় নেই।
-হ্যাঁ সেটাই।
বলে তিলোও হেসে দিলো। অনি হাসতে হাসতে বললো,
-এখনো মন খারাপ হলে ঘটনাটা মনে পড়লে হাসি পায়। তুই তো ছেলেটার পিঠে ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলি। আমি আর ফারিয়া একেবারে সামনের তিনটার কোলে। চোখ বুজে চিৎকার করছি। আর কামিনী নিজের জায়গায় বসে চিৎকার করছে। আমি ভাবছি, ভুতগুলো সেটা দেখার পরও কিভাবে ভয় দিচ্ছিলো নিজেরা না হেসে? আর জানিস, ওই ছেলেটাও সুযোগ নিয়েছিলো, আমার হাত ধরে রেখেছিলো।
তিলো এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
-তুমি সুযোগ দেবে আর সে নেবে না? এটা সম্ভব!
-তাই তো। অন্তর জানতো এটা। আসলে মানুষ যেখানে নিরাপদ মনে করে নিজেকে সেখানেই নিজেকে সপে দেয়। সেফটি ফার্স্ট। সেটা যেখান থেকে আসুক।
আরো কিছু সময় হাসাহাসির পর সিনেমা শেষ হলে অনি ফেসবুকে ঢুকে একটা ছেলের প্রোফাইল বের করে তিলোর হাতে ফোনটা দিয়ে বললো,
-তোর মনে আছে, দুমাস আগেও শফিক স্যারের ব্যাচে আমি পেছনে গিয়ে বসতাম।
তিলো ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললো,
-খেয়াল করিনি।
-হ্যাঁ বসতাম। এই ছেলেটা তার কারণ ছিলো। জানিস, একে আর তোকে নিয়ে আমি স্বপ্নও দেখেছি।
তিলো অবাক হয়ে বললো,
-তাই!!
-আমি ফারিয়াকে বলেছিও সেই স্বপ্নটা। আমি দেখেছি, আমি আর তুই একটা রেস্টরন্ট এ খেতে গিয়েছি। সেখানে ও ও ছিলো নিজের বন্ধুদের নিয়ে। আমার সাথে ওর চোখাচোখি হয়। কিন্তু তুই তখন ওকে দেখিসনি। খাওয়া শেষে বের হয়েছি। তুই আমি দুজনে দুদিকে চলে গিয়েছি। এরপর আমি আবারও কোনো একটা কারণে ফিরে এসেছি। আসলে স্বপ্ন বিধায় সবটা মনে নেই। আর সবকিছুর যুক্তিও হয়না। আমি তোকে খুঁজতে খুঁজতে ওই সেই নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। তখন দেখি, তুই আর ও একে অপরের অনেক কাছে। খুব কাছে। এরপরই আমার ঘুম ভেঙে যায়।
তিলোর অনির কথা শুনে শরীরে মৃদু কম্পন বয়ে গেলো। ও কোনো ছেলের এতো কাছে সজ্ঞানে। চিন্তা করেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। তারপর আবারও জোরে হেসে দিয়ে বললো,
-কোন লেভেলের স্বপ্ন তোর!! বাস্তবে ছ্যাঁকা খেয়ে এখন স্বপ্নেও খাওয়া শুরু করলি। তোর কি জীবনে কারো সাথে সম্পর্ক স্থায়ী হবে না? স্বপ্নেও ছ্যাঁকা। অন্তত স্বপ্নে তো সংসার করতে পারতিস।
তিলো প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছে হাসতে হাসতে। অনি নাক ফুলিয়ে বললো,
-ভাব একবার! তাও তোর থেকে! তোকে সবকিছু বলে দিই বলেই বোধহয় একটা ভয় কাজ করে।
তিলো হাসি থামিয়ে বললো,
-তারপরও এই নিয়ে ভেবে চলেছিস! লাইক সিরিয়াসলি!
-জানিস ও সত্যি আমাকে ছ্যাঁকা দিয়েছে। প্রোফাইল স্ক্রল কর। দেখ, রামিসার সাথে ওর কতোগুলো ছবি! বুঝলাম, ওর গার্লফ্রেন্ড রামিসা।
-তুই কি হতাশ?
-আরেহ্ নাহ্। ওকে তো শুধু চোখে লেগেছিলো। আর কিছু না।
-তাহলে এখন বাদ দে কথাগুলো। আরেকটা মুভি প্লে কর।
-ক্যাস্ট অ্যাওয়ে দেখবি? অস্কার পাওয়া ছবি।
-দেখেছি।
-তাহলে আর কি?
-দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস। টমাস হ্যারিসের উপন্যাস অবলম্বনে। এটাও অস্কার পাওয়া।
অনির সম্মতিতে তিলো প্লে করলো সিনেমাটা। সারারাত জেগে সকাল আটটার দিকে ঘুমিয়েছে ওরা।
তিলো প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো সেদিনের কথাগুলো। আজ আবারও মনে পড়লো। আজকের ঘটনাটা অনির স্বপ্নকে সত্যি করেছে। তিলো এই পর্যায়ে শব্দ করে কেঁদে দিলো। চোখে দেওয়া কাজল তো আরো আগেই লেপ্টে গিয়ে যা তা অবস্থা।
নাসীরা পারভীন অরিককে ফোন করে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দিলেন। অরিক ওনাকে বলেছে যে ও কিছু জানে না তিলোর কি হয়েছে সে ব্যাপারে। কিন্তু নাসীরা পারভীন সেটা শুনলেন না। ওনার ভাষ্যমতে এখন তিলোর ভালো থাকা বা কষ্ট পাওয়া যেকোনো বিষয় শুধু এবং শুধু অরিকের উপরই নির্ভর করছে। কেননা, তিনি আজ পর্যন্ত তিলোকে ওর বন্ধুদের দ্বারা কষ্ট পেতে কখনোই দেখেননি। অনেক ছোট থাকতে পেতো, যখন ও কিন্ডারগার্টেনে পড়তো। তখন ওর গায়ের রঙের জন্য অন্যান্য বাচ্চারা ওকে অবজ্ঞা করতো। তখন ও বাড়ি ফিরে কাঁদতো। তারা কেউই ওর বন্ধু ছিলো না। আর এখন তিলো বড় হয়েছে। ওকে এমন কোনো কথা বললে ও কষ্ট পাবে না। বরং অরিক কিছু বলেছে বলে ওনি নিশ্চিত। ওনি হুমকিও দিলেন এর শেষ দেখে ছাড়বেন। তিলোর সাথে মিটমাট করে নিতে না পারলে আর তিলো স্বেচ্ছায় খুশি মনে রাজি না হলে ওনি অরিককে মেয়ে দেবেন না। অরিক ওনার ফোন কেটে দেওয়ার পর হতভম্ব হয়ে কিছু সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। তিলোর কি হলো হঠাৎ সেটা ও অরিককেও বলেনি। অরিক এরপর একভাবে ওকে ফোন করে। কিন্তু ওর ফোন বন্ধ।
তিলো রাতে খাওয়ার সময় হতেই নিজে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে চলে আসে। ও রুম থেকে বের হয়েছে দেখে, আনিস সাহেব আর নাসীরা পারভীন দ্রুত এসে ওকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে তোলে। তিলো তাদের কারো কথার জবাব না দিয়ে বরং বিরক্তিসূচক কিছু কথা বলায় ওনারা দমে যান। তিলোকে ঘাটানো বন্ধ করে দেন। তিলো চুপচাপ খেয়ে আবারও নিজের রুমে ফিরে আসে। ও যতোই রাগ করে থাকুক বা মন খারাপ হোক, ও কোনোভাবেই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করতে পারে না। এটা ওর স্বকীয় একটা বৈশিষ্ট্য।
তুষার রাতে ঘুমানোর আগে একবার তিলোর রুমে আসে। তিলোর সাথে কথা বললেও তিলো খুব কমই প্রতুত্তর করে। তুষার নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ওর চোখ পড়লো তিলোর ব্যাগের দিকে। ভেতরে চকলেটগুলোকে উঁকি দিতে দেখে তুষার উত্তেজিত হয়ে ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে তিলোর উদ্দেশ্যে বললো,
-অনি আপু দিয়েছে আজকে এগুলো? তুই তো আমার ভাগটা দিলি না।
তিলোর কানে অনি নামটা যেতেই ও নিজের ভেতর রাগের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। ওর রক্ত ধারা রাতের ফাঁকা হাইওয়ে ছেড়ে উন্মাদ উগ্র অরণ্যের রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় একভাবে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিলো তুষারের হাতে থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-ওর জিনিস একদম ধরবি না।
তুষার অবাক চোখে তিলোর দিকে তাকালো। এরপর আবার বললো,
-আমাকে না দিয়ে একা খাবি সব? অনি আপুকে বলবো তোর কাছে আর কখনো দেবে না।
বলে আবারও তিলোর হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিতে যেতেই তিলো ওকে একটা ধাক্কা দিলো। তুষার আতর্কিত ঝোঁকটা সামলাতে না পেরে অনেকটা পিছনে সরে কার্বাটের সাথে ধাক্কা খেলো। তিলো চিৎকার করে বললো,
-একটা কথা কতোবার বলা লাগে তোকে? ছ্যাঁচড়ামি আমার একদমই ভালো লাগে না তুষার। একটা কথা একবার বললে শুনবি৷ এগুলো কিচ্ছু ধরবি না।
তুষার আঘাত পেয়েছে তিলোর আচরণে। আগে তিলো কখনো কিছু আনলে ওকে না দিয়ে খায়নি। আনার সাথে সাথে ওর ভাগটা বুঝিয়ে দিতো। এমন না যে ওকে এগুলো খেতেই হবে। কিন্তু তারপরও একটা আকর্ষণ!
আজকে ওর হঠাৎ পরিবর্তনটায় তুষারেরও অভিমান হয়েছে। কিছু না বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
তিলো ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। হাতে ধরা ব্যাগটার ভেতর চোখ যেতেই দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। সবকিছু কাল ও ফিরিয়ে দেবে অনিকে। আজকে ঘটনার আকস্মিকতায় বিষয়টা মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গিয়েছিলো।
তিলো ফোন অন করে রাখলো। রাতে অরিকের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। তিলো অনেকটা সময় ভেবে নিজেই ফোন করলো অরিককে। ওদের প্রণয় সম্পর্কটির পর এই প্রথম তিলো নিজে থেকে ফোন করলো অরিককে। যখন থেকে তিলো সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে তারপর।
অরিক ওর ফোনের অপেক্ষা করতে করতে সোফায় বসে ঝিমিয়ে পড়েছিলো। ধড়ফড়িয়ে উঠলো আওয়াজ কানে যেতেই। স্ক্রিনে তিলোর নাম দেখে ব্যস্ত হয়ে ফোনটা তুললো। তিলোকে কিছু বলতে না দিয়েই নিজের উদগ্রীবতা প্রকাশ করলো অরিক। তিলো ওর ব্যস্ততা বুঝতে পেরে হেসে দিলো। এতোক্ষণের মনখারাপ হঠাৎই ভালো হয়ে যেতে শুরু করেছে। অরিক একভাবে কিছু কথা বলে যখন তিলোর কোনো সাড়া পেলো না। অরিক থমকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-তিল! তুমি কি ঠিক আছো?
তিলো মৃদু হেসে বললো,
-হ্যাঁ। আমি ঠিক আছি। একদম ঠিক আছি।
-ছোটমা তখন ওভাবে কথা বলছিলেন কেন? তুমি কি করেছো? আমি কিছু করেছি কি?
তিলো থমকে গেলো কিছু মূহুর্তের জন্য। ওর সামান্য এতোটুকু প্রতিক্রিয়ায় ওদিকে এতোটা গড়িয়ে গিয়েছে সেটা ও আন্দাজ করতে পারেনি। তিলো স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,
-তুমি কিছুই করোনি। আর এমনিই। একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম তাই আরকি।
-দুশ্চিন্তা!! কি নিয়ে? দেখো, একদম টেনশন নিজের ভেতর চেপে রাখবে না। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।
তিলো বামহাতের সামান্য বর্ধিত নখগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
-এখন আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। একদম নেই। আমার চিন্তাগুলো সব বিদায় নিয়েছে। তুমি তো আছো।
অরিক ওর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে বললো,
-আমি থাকলে তোমার দুশ্চিন্তা বিদায় নিলো কি করে?
তিলো কন্ঠে উৎফুল্লতা এনে বললো,
-ম্যাজিক। এটা সম্পূর্ণ যাদু। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি অরিক।
-হ্যাঁ। তো?
-তো কিছু না। কাল দেখা করবে?
অরিকও তিলোত্তমার হঠাৎ প্রস্তাবিত প্রকল্পে নিজের ভেতর খুশির আমেজ অনুভব করলো। ও সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলো।
-কোথায় করতে চাও? বলো।
-তোমার ফ্ল্যাটেই।
অরিক তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না ওর কথায়। ও কেবল সম্মতি দিলো।
তিলো পূর্ণ আত্মতৃপ্তির সাথে ফোন কেটে দিলো। ও নিশ্চিত, ও বিশ্বাস করে, যে যাই বলুক বা যেই আসার চেষ্টা করুক অরিকের জীবনে। অরিক ওকে ছাড়বে না। তিলোর এখন নিজেকেই বোকা মনে হচ্ছে। আগেই অরিকের সাথে কথা বললে ওকে এতোক্ষণ মনোকষ্টে ভুগতে হতোনা। অরিকের কন্ঠে ওর জন্য বিশেষ কিছু আছে। যেটা ওর অশান্ত মনটাকে শান্ত করার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে।
#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
২৯,,
তিলোর আজকে ভার্সিটিতে না যাওয়া নিয়ে কেউই কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এমনকি অরিকও ওকে ফোন করে কোনো কঠিন কথা শোনায়নি। তিলোর অরিকের সবকিছু খুব ভালো লাগলেও এই পোস্টার বয় এর পড়াশোনা নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি তিলোর ভালো লাগে না।
একসময় তিলোর মাঝে জ্ঞানী মানুষের আশেপাশে আসলেও ভীতি কাজ করতো। মোটামুটি কলেজ শেষে যারা ভার্সিটিতে উঠেছে, তাদেরই মনে হতো বিরাট জ্ঞানী। ওদের আশেপাশে থাকাও বিপদজনক। কখন কি জিজ্ঞাসা করে ওকে একেবারে অপ্রস্তুত করে ফেলে! এখন তো নিজেই ভার্সিটিতে পড়ে। এরপরও প্রফেসরদের ও ঠিক নিতে পারে না। দেখলেই অবচেতন আতঙ্ক গ্রাস করে।
হালিম সাহেব বাড়িতে আসলেও তিলো অনেক কমই সামনে যেতো। ফাহাদের দাদু ছিলেন ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিলোর মনে পড়ে না কখনো ও ওনার সামনে গিয়েছে বলে। অবশ্য ওনি দেশে এসে মাত্র দুবারই ওদের বাড়িতে এসেছিলেন। তাও তিলোর দাদুবাড়িতে। ওদিকে ফাহাদের বাবাও একজন অধ্যাপক। তিলোকে দেখলেই শাশুড়ী, শাশুড়ী সম্বোধন করে বেশ আহ্লাদ দিতেন। এরপরও তিলো কখনোই ওনার সাথে খুব হাসিখুশিভাবে কথা বলতে পারতোনা। তিনি কথা বলতে বলতে একগাদা জ্ঞানদান শুরু করতেন। এটাই তিলোর ভয়ের কারণ ছিলো।
তিলো খেয়াল করেছে, যে যেটা অপছন্দ করে সেটাই তার কপালে এসে জুটে যায়। তিলোর সেই দশাই হয়েছে। ওর সাথে যে সারাজীবন থাকবে বলে ও আশা করছে, সেই একজন অতিজ্ঞানী ব্যক্তি।
তিলো বিকালের দিকে অরিকের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সাথে করে অনির গতকালকে দেওয়া চকলেট আর উপঢৌকনগুলোও নিয়ে এসেছে। ফেরার পথে ওর বাড়িতে দিয়ে যাবে।
আজ আবারও সেদিনের সেই ছেলেটার সাথে তিলোর দেখা। তিলো ঘটনাটাকে কাকতালীয় বলবে নাকি ছেলেটা সবসময়ই ওঠানামার মধ্যে থাকে সেটা বুঝতে পারছে না। তিলোকে ভবনের বড় গেটটা দিয়ে ঢুকতে দেখেই সেই ছেলেটা মুখে চওড়া হাসি টেনে সালাম দিলো। তিলোও ছোট করে তার উত্তর দিলো।
ছেলেটা এগিয়ে এসে বললো,
-বললেন না তো আপনি এখানে নতুন কিনা?
তিলো বিব্রতবোধ করছে ছেলেটার কথায়। যদি ও বলে ও অরিকের সাথে দেখা করতে আসে তবে কথার হাত পা গজাতে সময় লাগবে না। ব্যাচেলর একটা ছেলের কাছে ও কেন আসে? প্রশ্নটা নিশ্চয়ই এই লোকের মাথায় উদয় হবে। তিলোর চোখে মুখে অপ্রস্তুতভাবটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছেলেটা ওর মুখভঙ্গি দেখে মিটমিট করে হাসছে। তিলো বিষয়টা খেয়াল করে কোনো উত্তর না দিয়েই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো। শ্যাম বর্ণের বলিষ্ঠ দেহের ছেলেটা পেছন থেকে বলে উঠলো,
-আমি কিন্তু জানি আপনি অরিক ভাইয়ার কাছে আসেন।
তিলো এবার খুব বেশি বিরক্ত হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। যখন জানেই তখন জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন কোথায়?
তিলো অরিকের ফ্ল্যাটের দরজায় বেল বাজানোর সাথে সাথে দরজা খুলে দিলো অরিক। যেন প্রস্তুত ছিলো খোলার জন্য। তিলোকে দেখেই হাসিমুখে সালাম দিলো। তিলো তার জবাব দিয়ে ভেতরে ঢুকে সোফায় বসলো।
তিলো দ্বিতীয়বারের মতো অরিকের বাসায় আসায় অরিকের মাঝে ব্যস্ততা দেখা দিলো। সে তিলোকে যেকোনোভাবে হোক তার জন্য একটা তৃপ্তিকর পরিবেশ এনে দিতে ব্যস্ত। সে কি দুপুরে খেয়েছে? এখন কিছু খাবে? এসিটা কি রুমটা একটু বেশিই ঠান্ডা করে ফেলেছে? সে কি বসে আরাম পাচ্ছে? আসার সময় সমস্যা হয়নি কোনো? কখন আসবে সময়টা কেন বললো না, তাহলে ও নিজে গিয়ে ওকে নিয়ে আসতো?
বিভিন্ন প্রশ্নের বাণে বিদ্ধ করে ফেলছে তিলোকে প্রথম কয়েক মূহুর্তের জন্য। অরিকের আচরণ অতিব্যস্ত ছোট পাখির মতো। তিলো ওর আচরণে হেসে দিলো। ধীরে ধীরে সে একটু বেশিই সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে। তিলোর পাশে বসে স্বাভাবিকভাবে সে কথা বলতে পারছে না। তিলোর মনে হচ্ছে, অরিকের ব্যস্ততা কৃত্রিম। সে তিলোর চোখের সামনে থেকে পালাতে চায় কোনো কারণে। সেই অর্থে অরিক যখন কফি বানিয়ে আনার প্রস্তাব পেশ করলো, তিলো নিষেধ করলোনা।
অরিক রান্নাঘরে যেতেই তিলো চিৎকার করে বললো,
-তোমার কাজের মেয়েটাকে কি ছুটি দিয়েছো তুমি?
অরিক রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে বললো,
-কেন?
তিলো সেন্টার টেবিলের দিকে ইশারা করে বললো,
-আজকে তোমাকে অগোছালো মনে হচ্ছে।
অরিক মৃদু হেসে বললো,
-নাহ্। কিন্তু আমি কেবল অতীত চর্চা করছিলাম। হাতে কোনো কাজ না থাকায় বিরক্ত লাগছিলো।
-ওহ্। তা আমি কি সাহায্য করবো?
অরিক উত্তেজিত ভঙ্গিমায় বললো,
-কোনো প্রয়োজন নেই। আমি পারবো।
তিলো আর কিছু না বলে সোফায় শরীর ঠেকিয়ে ফোনে চোখ রাখলো। কিন্তু এরপরও ও শান্তি পাচ্ছে না। সেন্টার টেবিলের উপর ফাইলগুলো অগোছালো করে রাখার কারণ তিলো আন্দাজ করতে পারছে। অরিকের মতো সচেতন ছেলে এমন কাজ করবে না কখনো যে, ও ব্যক্তিগত কোনোকিছুকে অপর জনের আকর্ষণের জন্য ফেলে রাখবে। ও চায় তিলো সেগুলো হাতে তুলে নিক এবং পড়ুক।
তিলো করলোও সেটা। অরিকের উদ্দেশ্য সফল করা ওর উদ্দেশ্য নয়। বরং নিজেই কৌতুহলী।
সবচেয়ে উপরের খুলে রাখা ফাইলটা হাতে নিতেই, প্রথম দিক দেখেই বুঝতে পারলো কোনোকিছুর নমুনা মাত্র। মেডিকেল ফাইল আছে। সাথে আছে প্রেসক্রিপশনের কপি। কিছু নোট। লেখাগুলোর আসলে কোনো অর্থ নেই। সব আজেবাজে কথায় ভরপুর। তিলো তবুও পড়তে শুরু করলো —
আমি কেবল কামড়াচ্ছি। চুলকাতে চুলকাতে আমি বিরক্ত। এখন কামড়ে জায়গাটুকু তুলে ফেলতে ইচ্ছা করছে। সে বলেছে, চুলকানো ভালো। কিন্তু আমি সহ্য করতে পারছি না।
আমার ন্যাপি বদলে দেওয়া নার্সগুলো কোন জাতের? জানতে পেরেছো তুমি? ওদের পূর্বপুরুষগুলো কি বিষ্ঠা পরিষ্কারকারী নাকি ইঁদুর পাকরাওকারী?
তুমি জানো, মিস ব্রিটনির অবৈধ বাচ্চাটার বাবা আসলে ওর আপন ভাই ই?
প্রিয় ডাক্তার কমা পরের লাইন……। এই তুমি কমা দিয়েছো তো? বিরামচিহ্ন খুবই বড় বিষয়। না হলে ঠিকানা হয়ে যাবে, গুলি ও বারুদের কারখানা ড ড নং কলিকাতা।
মিনাকে বলবে, গাছগুলোর যত্ন নিতে।
ঐ সাদা কাপড় পড়া লোকগুলো পটি সাফ করে। ওরা কি তোমার আত্মীয়?
চলো আমরা যাই গা।
সাদা পোশাক পরিহিত লোকগুলোকে আমার পাশে ঘুরতে মানা করবে?
ওরা তোমায় অপহরণ করেছিলো। তাই না? খুব মেরেছে? তোমায় কি বেঁধে রেখেছিলো? তারা কালো পোশাকধারী ছিলো। তাই না?
এই তুমি অরিক না? আমার ছেলের বন্ধু। তাই তো?
ওরা কি তোমার বিড়াল? ওরা ছেলে না মেয়ে?
আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। তোমাকে, আমাকে আর নিভ্রানকে।
এখন পা-লা-ও।
হ্যালো! তোমার সাথে পরিচিত হয়ে কি যে ভালো লাগছে!
রাজু আসামাত্র আমরা পালাবো। আমার পটির পাত্রটা সাথে নিয়ে এসো। গু’ টা রেখে যাবে।
আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার আশেপাশে অনেক মানুষ। শুধু নিয়াজ নেই। সে কি রাগ করেছে?
ওঠো!!!
আমি বাইরে যাচ্ছি। আমি হারিয়ে গিয়েছি বলে ওরা তোমাকে আটকে রাখবে। কি মারটা যে খাবা তুমি!
এটা লজ্জাজনক যে তুমি বলে বেড়াও তুমি অরিক। আসলে তুমি নও। তাই না? নিভ্রানও নিজেকে নিভ্রান বলে। আসলে সে নয়।
বৃষ্টি হচ্ছে নাকি রোদ উঠেছে।
সবকটা ছাগলের জন্য কি ওদের ওষুধ আছে?
সব চেক করে নাও আর আমরা যাই গা।
তুমি কি খেয়াল করেছো, হাই তোলার সময় মানুষগুলোকে ভেড়ার মতো দেখায়?
কখনো কখনো ওরা তোমাকে ডিসকাউন্ট অফার আর এটা খুবই ফালতু একটা ব্যাপার।
কি ভীষণ যুদ্ধ লেগেছে আমার আর মশাগুলোর মধ্যে।
সে চলে যাচ্ছে। এরপর আর কেউ। তারপর আর কেউ।
আমার টাকা কই?
এটা আমার যন্ত্র।
তিলো পড়তে পড়তে শেষ পাতার আগের পাতায় এসে থমকে গেলো। তিলোর মনে হচ্ছে এখানে অনেক কিছুই বর্জ্যের সাথে ইতিমধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর সেখানে এই লেখাগুলো নতুন করে সংযোজন করা হয়েছে। সেখানে গোটা গোটা করে খানিকটা লেখা —
ভালোবাসা সম্পূর্ণ অনুভূতির একটা বিষয়। এটাও একটা ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রের মতো। বা হয়তো জীবনের কোনো খেলা। খেলায় হার জিত থেকে থাকে। আবার ভাগ্যের উপর চলতে পারে। তবে বেশিরভাগ সময় সূচনা পর্বের পরের অংশটুকু নিজের হাতে থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। জীবনটা ছোটো। এই ছোট জীবনে কিছুটা স্বার্থপর হওয়াটা দোষের কিছু না। নিজেকে ভালো রাখতে স্বার্থপর হতে হয়। অপরপক্ষকে ভালো রাখতে স্বার্থপর হতে হয়। অপরপক্ষের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতেও স্বার্থপর হতে হয়। ভেবে দেখো, তুমি যদি অপরপক্ষকে ভালোবেসেই থাকো, তবে তাকে ভালো রাখতে জানতে হয়। সে কিভাবে ভালো থাকতে পারে বা কার সাথে ভালো থাকতে পারে। ছোট জীবনটায় আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকো। পাল্লা কোনদিকে ভারী?
তিলো মৃদু হাসলো লেখাটা পড়ে।
অরিক ইতিমধ্যে কফি তৈরি করে ফিরে এসেছে। তিলোর দিকে মগটা বাড়িয়ে দিতেই তিলো সেটা গ্রহণ করলো। অরিক ওর পাশের সোফাটায় বসলো।
তিলো একবার অরিকের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ওর কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। এটুকু করেই নাজেহাল দশা। তিলো টেবিলের উপর থেকে টিস্যু বক্সটা অরিকের দিকে এগিয়ে দিলো। অরিক সেখান থেকে টিস্যু নিয়ে কপাল মুছতে মুছতে বললো,
-খেয়ে বলো কেমন হয়েছে?
তিলো কফি খাওয়ার আগে ফাইলটা হাতে রেখেই বললো,
-সপ্তাহ জুড়ে স্টেনোগ্রাফির কাজও করো নাকি?
অরিক একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বললো,
-আরেহ্ নাহ্। এমনিই একটা করেছিলাম।
-কার এটা?
-নিভ্রানের বড় মা, শাপলা আন্টির।
-বড় মা?
তিলো ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো।
অরিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
-হ্যাঁ। নিভ্রানের বাবা নিয়াজ আঙ্কেল ভালোবেসে একজন বয়স্ক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। ওনার কোনো সন্তান না হওয়ার কারণে ওনি নিজেই নিজের স্বামীকে আরেকটা বিয়ে দেন। নিভ্রান ওর দুই মা আর এক বাবার একমাত্র ছেলে। ওনার মৃত্যুর পূর্ববর্তী কিছুদিন।
-ওনি সি ও পি ডি তে আক্রান্ত ছিলেন। তাই না?
অরিক তিলোর এই বুঝে ফেলার ক্ষমতাটাকে একটু বেশিই পছন্দ করে। মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিলো স্মিত হাসলো নিজের ধারণা ঠিক প্রমাণিত হওয়ায়।
ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারী ডিজিস (সি ও পি ডি) এমন একটা ব্যাধি যেটা নিষ্পাপ অভিজাত বৃদ্ধ দাদী নানীদেরকে দিয়ে বেশ্যাখানার মালকিনদের মতো আচরণ করাতে পারে আবার বিশপদের মুখ থেকে গালিগালাজ করাতে পারে মাতালদের মতো। সমস্ত সংস্কার ভুলিয়ে দিতে পারে।
মাঝে মাঝে তাদের আচরণ হয়ে ওঠে শিকারপ্রবণ, আক্রমণাত্মক।
-কিন্তু তার স্টেনোগ্রাফার হিসাবে নিযুক্ত হলে কেন হঠাৎ?
অরিক সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বললো,
-নিভ্রানের ধারণা ছিলো, শাপলা আন্টি এমন কিছু জানে যেটা ও জানে না। মরণকালে নষ্ট মাথার বদৌলতে কিছু বলে দিলে, সেটা ও জানতে চায়। আমি আর মাঝে মাঝে ও নিজেও কাজটা করতো।
তিলো ভ্রু কুঁচকে বললো,
-গোপন কিছু? শেষ পর্যন্ত পেয়েছিলে?
-নাহ্। নিভ্রানের ধারণা, ও শাপলা আন্টিরই গর্ভের সন্তান। ওর মাঝে বেশির গুণই তার। কিন্তু আশেপাশের সবাই বলে ও আসলে নিয়াজ আঙ্কেলের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। আসলে নিভ্রান খুব বেশি ভালোবাসতো ওনাকে। এটা হলে হয়তো খুশিই হতো। তবে জানো, নিয়াজ আঙ্কেল সত্যিই শাপলা আন্টির জানাযায় ছিলেন না? এমনকি কবরস্থানেও যাননি।
-কেন?
-জানি নাহ্।
-তিনি কি শেষের এই নোটটার কথাও বলেছেন?
তিলো অরিককে সেটা দেখিয়ে বললো। অরিক হঠাৎই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে নোটটা দেখে। অরিক প্রত্যুত্তর করলো না৷ তিলো মৃদু হেসে একচুমুক কফি খেয়ে বললো,
-অনিকে কেমন লাগে তোমার? সে নিঃসন্দেহে রাজকন্যা।
অরিক হতাশ দৃষ্টিতে তিলোর দিকে তাকালো। তিলো সে দৃষ্টির দিকে এক মূহুর্ত তাকিয়ে সেটা উপেক্ষা করে সামনে তাকালো।
তিলো ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললো,
-তিনি আসলে অসাধারণ মহিলা ছিলেন বলে মনে হচ্ছে। নিজের মাথায় গন্ডগোল হওয়া সত্ত্বেও খুব বেশি খারাপের দিকে সেটা যায়নি।
আবার অরিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
-নাকি খারাপটুকু ফেলে দেওয়া হয়েছে?
অরিক এই প্রশ্নেরও জবাব দিলো না। তিলো হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-কফিটা চমৎকার ছিলো। আমি আসছি।
অরিক এবার আর চুপ করে থাকতে পারলোনা। শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
-আমাকে কোনো কিছু পরিষ্কার করে কেন বলো না তুমি? আমি তোমাকে স্পষ্টভাষী বলে জানতাম।
তিলো থেমে দাঁড়িয়ে বললো,
-আমার মনে হয়েছে, আমাদের আজকের মতো বলার কিছু নেই।
অরিক উঠে দাঁড়িয়ে তিলোর সামনে দাঁড়ালো। ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
-তোমার থেকে স্পষ্ট ভাষায় একটা উত্তর জানতে চাই। তুমি কি এখনো আগের সিদ্ধান্তে অটল। নাকি বদলেছো?
-বদলালে বলে দিতাম।
অরিক যেন এতোক্ষণের আটকে রাখা দম হঠাৎ করে ফেললো। চোখজোড়া ইতিমধ্যে লাল হয়ে এসেছে ওর। ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বললো,
-তুমি ধারণা করতে পারো না, গতকাল থেকে আমি কোন পরিস্থিতিতে ছিলাম।
তিলো ওকে চমকে দিয়ে ওর দাড়িতে নিজের লম্বা সেলেন্ডার আঙুল গুলো ভরে দিয়ে বললো,
-তোমার জানা প্রয়োজন, আমি নিজেকে বড্ড বেশি ভালোবাসি। আমাকে অন্যরা অবজ্ঞা করে যতোটুকু ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে তার অধিক নিজেকে ভালোবেসে সেই অভাব পূরণ করি। আমি ভালো থাকতে চাই অরিক। আর আমাকে যে ভালোবাসে, তাকে ভালো থাকতে দেখাটাও আমার ভালো থাকার একটা অংশ। আমি জানি, সে আর কারো সাথে সুখী হবে না। নিজের পাশাপাশি তাকপ ভালো রাখতেও আমি সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবোনা।
অরিক তিলোর থেকে ইন্ধন পেয়ে নিজের ভেতরকার সংকোচবোধের দেয়ালটাও টপকে গেলো। হঠাৎ করেই তিলোর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সে। খুব কাছে, যতোটা বর্ণনা করেছিলো অনিমা তার স্বপ্নের। অরিকের নিশ্বাস এখন তিলোর মুখে আছড়ে পড়ছে। অরিক স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-একটা স্বীকারোক্তি দেই।
তিলো একপেশে হেসে বললো,
-আমি বোধহয় জানি সেটা। শাপলা আন্টি নামে কারো অস্তিত্ব নেই।
অরিক চোখ সামান্য বুজে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো। তারপর আবারও ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-কিছুটা ঠিক। তবে পুরোটা না। শাপলা আন্টি ছিলেন। সবটাই হয়েছে। শুধু স্টেনোগ্রাফার আমি ছিলাম না। তবে তুমি বুঝলে কিভাবে?
-স্টেনোগ্রাফিতে শেষ অংশটুকু অতোটা যত্ন নিয়ে লেখার কোনো উপায় নেই। তাছাড়া সেই রোগাক্রান্ত ব্যক্তি গুছিয়ে অতোটা বলতে পারবে না কখনো। কিন্তু শুরুটা ছলনা দিয়ে কেন করলে?
অরিক কন্ঠে অপরাধবোধ এনে বললো,
-আমি ভয় পেয়েছিলাম তিল। খুব ভয় পেয়েছিলাম। তোমার আজকে হঠাৎ দেখা করাটা নিয়ে। অনির থেকে সবটা শুনে ভেবেছিলাম তুমি আমাকে এই গোলকধাঁধায় ফেলে চলে যাবে। আমি পথ হারিয়ে ফেলার ভয় পেয়েছি। কথাগুলো তুমি শুরুই করছিলে না। আমি জানতে চাইছিলাম তোমার উত্তর। তোমার সিদ্ধান্ত। কথাগুলো শুরু করতেই শেষটুকু লিখেছি। সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে পারছিলাম না।
-যদি এই ছলনার জন্য এখন সিদ্ধান্ত পাল্টাই?
-সেটা করো না দয়া করে। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। ক্ষমা চাইছি।
-এটা আমার সিদ্ধান্ত। কি করবে তুমি?
-ভেবে দেখিনি এখনো। আসলে ভাবার সাহস পাইনি।
একটু থেমে চোয়াল শক্ত করে বললো,
-ফ্ল্যাটটা আমার। সম্পূর্ণ ফাঁকা। এমন সিদ্ধান্ত নিলে আমি কি তোমার সাথে এমন কিছুই করতে পারিনা, যাতে তোমার আমাকে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না?
অরিকের কথায় তিলো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। অরিক ওর আচরণে অবাক হয়নি। বরং এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলো সে। তিলো কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললো,
-তোমার হুজুগের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্তটা কখনোই তুমি সফল করতে না। বিশ্বাস করি আমি তোমাকে। তাই তো তোমার ফ্ল্যাটেই এসেছি।
তিলো থেমে গিয়ে প্রকাশভঙ্গীমায় গাম্ভীর্যতা এনে বললো,
-প্রতিটা সম্পর্কের বলো আর যে কোনো কিছুরই বলো না কেন, সবকিছুর একটা সীমা থাকে। সেই সীমার ভেতর সবই সুন্দর। সম্পর্কের সৌন্দর্য তার সীমার মাঝে থাকে। আমি জানি, তুমি আমাদের ভেতর হতে চলা সম্পর্কের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল আর তার সৌন্দর্য রক্ষায়ও সচেষ্ট। এমন কিছু তুমি কখনো করবে না, যাতে আমাদের সম্পর্কটাকে আমরা দুজনেই ঘৃণা করতে শুরু করি। অরিক বিশ্বাস করো, তুমি যদি সত্যিই এমন কিছু করতে, আমি কখনোই তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হতাম না। সীমা লঙ্ঘন করে তিক্ততা আনার কোনো মানে হয়না।
অরিক অবাক কন্ঠে বললো,
-এতটা বিশ্বাস করো আমাকে?
তিলো মুচকি হেসে বললো,
-হ্যাঁ। আর এটাও বিশ্বাস করি যে, তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে।
অনেকটা সময় দুজনের মাঝে নিরবতা বিরাজ করলো। তিলো এরপর বললো,
-আমিও একটা স্বীকারোক্তি দেই? আমি আসলে আজকে তোমাকে একটা কিছু শেখাতে এসেছিলাম। আমার শেখানো কথা তুমি বলবে। তোমাকে নিষেধ করতাম, যে কোনো পরিস্থিতিতে তুমি কোনোমতেই অনিকে মেনে নেবে না। অনির বাবা তোমাকে বললেও তুমি শুনবে না, যেকোনো পরিস্থিতি হয়ে যাক না কেন।
অরিক তিলোর কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে বললো,
-আমি কি তাহলে নিজেকে বোকা বলবো? নাকি অনিকে?
-দুজনেই।
-আসলেই। তুমি যতোটা বুঝতে পারো, আমি ততটা তোমাকে বুঝি না। আর এদিকে তুমি দু’পক্ষই নিজের হাতে রাখছো।
তিলো পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যতোটা সম্ভব উঁচু হয়ে অরিকের কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
-আসলে তুমি যেভাবে আমাকে দেখো আমি তেমন নই। তুমি মনে করো, তুমি আমাকে তোমার ভালোবাসায় বাঁধবে। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, অনেক আগেই তুমি আমার মায়ার জালে ফেঁসে গিয়েছো। আর এখন আমি তোমাকে মুক্তি দেবো না। এটা কেবল তুমি নও যে, হতে যাওয়া সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চাও। এটা আমি নিজেও যে, সম্পর্কটার যত্ন নিতে চাই। শাপলা আন্টির মতো তোমায় আর কারো সাথে বিয়ে দেবো না আমি। তাতে আমার যতো অক্ষমতাই থাকুক না কেন।
অরিক ঠোঁট কামড়ে হেসে দিলো তিলোত্তমার কথা শুনে। ও এটা আশা করেনি একদমই। অপ্রত্যাশিত খুশিতে অরিকের হৃদয় পুলকিত। তিলো ওর থেকে সরে দাঁড়িয়ে ওকে রেখে চলে যেতে নিতেই অরিক আবারও বললো,
-এতো পেঁচিয়ে কথা না বলে কেন স্পষ্টভাষায় বলে দাও না?
-এরপরও স্পষ্ট ভাষায় বলার অপেক্ষা থাকে? এতোটা বললাম। সারসংক্ষেপ সেই তিনটা শব্দ নিজে থেকে বুঝে নাও।
অরিক আর কথা না বাড়িয়ে তিলোকে দাঁড়াতে বলে ভেতর থেকে একটা ব্যাগ এনে তিলোর হাতে দিয়ে বললো,
-তুষারকেও ভাগ দিও।
তিলো সেটা খুলে দেখলো ভেতরে অনেকগুলো চকলেট। তিলো অরিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ভালোই ঘুষ খায় দেখি।
-It costs me a lot to keep him quite. অনির দেওয়া চকলেটগুলো ওকে দাওনি বলে আমাকে নালিশ করেছে। কেন দাওনি আর কেন কালকে এতো অদ্ভুত আচরণ করছিলে ভাবতেই মনে হয়েছে, অনিই তোমাকে কিছু বলেছে। ওকে আমি কল করেছিলাম।
তিলো এরপর ওর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলো অনির বাড়িতে। অরিক নিজেই ওকে বাড়ি ফিরিয়ে দেবে বললেও তিলো রাজি হয়নি। অনির বাড়ির দরজায় ব্যাগটা রেখে বেল বাজিয়ে ফিরে আসে তিলো।
#চলবে
#চলবে
#চলবে
#চলবে