মন ময়ূরী পর্ব -১১

#মন_ময়ূরী
#Tahmina_Akther

১১.

-আরে, খেয়া তুইও চল আমাদের সাথে। নিজের বরের হলুদে যাবি বোরকা পরে তাও মুরব্বি সেজে,ভেবে দেখ কতটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পাবি!

রুম্পার কথা শুনে আমি কিছুটা সাহস পেলাম। আসলেই,তো আমি যদি ওদের সাথে যাই তবে দেখতে পারবো,ওনার গায়ে হলুদে কয়টা হিরোইন এসেছে আর হাসিমুখে পিক তুলবে ফায়েজের সাথে।

যেই ভাবা সেই কাজ, দাদির কাছ থেকে বোরকা এনে দিলো রুম্পা। সবাই যখন সামনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে কার উঠেছে তখন আমি পেছনের গেইট দিয়ে বের হয়ে মেইন রোডের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকি। পরিকল্পনা মোতাবেক কার এসে আমাকে নিয়ে যায়।গাড়িতে উঠে বসতেই রুম্পা, কৌশিক, সুমি, রিয়াজের সে কি হু হু করা হাসি।

সে বাড়িতে পৌছানোর পর আমি আর কারো দিকে চোখ তুলে তাকায়নি, কারো সাথে কথা অব্দি বলিনি। যদি কেউ টের পেয়ে যায়!

এতকিছুর পরও কিনা নায়ক সাহেব আমাকে চিনতে পেরেছে! বলতে হবে ওনার চোখের দৃষ্টির প্রখর নয়তো তিনবারের সাক্ষাতে কেউ এতটা নিখুঁতভাবে কারো চোখের আকৃতি মনে রাখতে পারে!

**************

-খেয়া,আয়নায় তাকিয়ে দেখ। মাশাআল্লাহ, আজ তোর নায়ক সাহেব তোর ঝলসানো রুপের আগুনে দগ্ধ হবে।

রুম্পার ডাকে ভাবনার রাজ্য থেকে বের হয়ে আসে খেয়া। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ভের তাকিয়ে দেখে, আজ সত্যি তাকে বৌ বৌ লাগছে!

খেয়ার বিয়ের শাড়িটা পিংক কালারের,যাবতীয় অর্নামেন্টস ডায়মন্ডের ওয়াইট স্টোনের।নাকে জ্বলজ্বল করা নোজপিন সাক্ষ্য দিচ্ছে আজ সে অন্যকারো হতে যাচ্ছে, শুধুমাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা।

গতকাল, ফায়েজ চলে যাবার পর খেয়ার দাদিসহ ওর কাজিনরা বেশ হাসিহাসি করেছিল ওর হলুদ রাঙানো গাল দেখে। কারোই বুঝতে অসুবিধা হয়নি কে এই কাজটি করেছে।

খেয়া তো মনে মনে ভীষণ চটে গিয়েছিল ফায়েজের উপর। ফায়েজ শুধু খেয়ার সামনে ছিল না, নয়তো খেয়া ফায়েজকে যে কি করতো আল্লাহ জানে!

এমনসময়,শোনা গেলো বর এসেছে, বর এসেছে প্রতিধ্বনি। খেয়ার পাশে বসে থাকা রুম্পা, সুমি চলে যায়।

খেয়া তার মোবাইল বের করে গ্যালারিতে যেয়ে একটি ছবিতে টাচ করে,স্ক্রীণে ভেসে উঠে তাদের চার বন্ধুর দুষ্ট মিষ্ট হাসিমাখা মুখ। রিমি, নিধি, খেয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসছে, আর রওশান কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

খেয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। পরক্ষণেই, আধারে ছেয়ে গেলো খেয়ার চেহারায়।সেদিন গুলো বেশ ছিল!মাঝখান দিয়ে রওশানের কথায় এলোমেলো হয়ে গেলো তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

এতবার কল করা সত্বেও রিমি বা নিধি কেউ কল রিসিভ করেনি আর না এসেছে খেয়ার হলুদের অনুষ্ঠানে। আজ এমন একটা দিনেও কি ওর বন্ধুদের চোখের দেখাও দেখবে না, খেয়া!

আনমনে এইসব কথা ভাবতে গিয়ে দুচোখ ভরে উঠে খেয়ার। চোখের জল গড়িয়ে পড়তেই কেউ এসে খেয়ার চোখের জল মুছিয়ে দেয়।

খেয়া ঝট করে মাথা উচু করে দেখে রিমি ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কান্নারত অবস্থায় রিমিকে জড়িয়ে ধরে খেয়া। রিমি খেয়াকে জরিয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

-আরে এত কান্না করলে তোর মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। ফায়েজ চৌধুরীর স্ত্রীকে ঘেটে যাওয়া মেকআপে দেখলে মিডিয়ার লোক ক্যামেরা ফেলে ভূত বলে চিৎকার দিয়ে পালিয়ে যাবে।

রিমির কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় খেয়া। রিমি খেয়ার চোখের পানি ট্যিসু দিয়ে আলতোভাবে মুছে দিয়ে বলে,

-তোর উপর কেন যেন, ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার আর নিধির। কিন্তু, রওশানের কথায় আমাদের রাগ গলে যায়। আসলেই তো এতে তোর কোনো দোষ নেই। গতকাল,আসতে পারিনি তাই আমরা দুঃখিত।

-আমরা বলতে নিধি আর রওশান এসেছে?

রিমি মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়, ততক্ষণে খেয়ার ঘরে ধীরপায়ে প্রবেশ করে নিধি আর রওশান। নিধি এসে খেয়াকে দুহাতে জরিয়ে ধরে। খেয়া নিধিকে ছেড়ে দিয়ে রওশানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, রওশান তখনো মাথা নিচু করে রেখেছে। খেয়া অভিমানী কন্ঠে বলে,

-তোকে না আমি বলেছি, তুই আমার বিয়েতে আসবি না, এমনকি আমার বাবা দাওয়াত দিলেও তুই আসবি না। তবে এসেছিস কেন?

খেয়ার কথায় এই প্রথম রওশান মাথা তুলে তাকায়,খেয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-তোকে বৌ সাজে কেমন দেখাবে, এই ভেবে ভীষণ লোভ হচ্ছিল। লোভ সামলাতে না পেরে চলে এসেছি। দেখ খেয়া তুই আমার না হলি তাই বলে তোকে বৌ সাজে দেখতে পারবো না এটা বলিস না।তাছাড়া, তুই তো জানিস বিয়ের খাবার
আমার অনেক ফেবারিট।যেহেতু, আমার বন্ধুর বিয়ে তাহলে দাওয়াতের কি প্রয়োজন!

খেয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রওশানের দিকে।রওশান যতই হাসিমুখে করে কথা বলুক তার চোখের কোণে জমে থাকা পানি তো আড়াল করতে পারছে না।

খেয়া রওশানের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

-তুই যদি আমার বিয়েতে এসে কাঁদিস তবে আমি ভাববো, তোর চোখের এক একটা জলের ফোঁটা আমায় অভিশাপ দিচ্ছে।

-খেয়া,তোকে আমার করে চাওয়ার যোগ্যতা নেই তাই বলে আমি তোকে না পাওয়ার বেদনায় দুচোখের অশ্রু বিসর্জন দিতে পারবো না!আমার চোখ থেকে নির্গত জলকে তুই অভিশাপ বলছিস!

খেয়া মাথা নিচু করে রেখেছে, রিমি নিধি এগিয়ে এসে খেয়ার কাঁধে হাত রাখলো। রওশান ফের বলে উঠে,

-কিন্তু, আমার বসন্তী যেহেতু বলেছে তাহলে আমি আর একফোঁটা চোখের জল ফেলবো না, প্রমিজ। আমিও চাই তুই সুখে থাক।তোর একটা সুখের সংসার হোক৷ তোকে অনেক ভালোবাসে এমন মানুষ তোর পাশে থাকুক,তোর সংসার ভালোবাসায় টুইটুম্বর হোক। হোক না সে মানুষটা আমি বা অন্যকেউ। তবুও, আমার বসন্তী সুখে থাক।

রুওশান কথাটি বলে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো খেয়ার সম্মুখে। খেয়ার কপালে ছড়িয়ে থাকা বেবি হেয়ারগুলো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়ে রওশান বলে,

-আজ শেষবারের মতো তোর ওই চুলে হাত দেয়ার আমার অধিকার আছে। আর কিছু সময় পর তুই একান্তই ফায়েজের।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে।খেয়া এখন শরিয়ত মোতাবেক ফায়েজ চৌধুরীর স্ত্রী।

বিয়ের আগ অব্দি বর কনে একে অপরকে দেখেনি। বিয়েে যেহেতু সম্পুর্ন হয়েছে এবার বর কনের একে অপরকে দেখার পালা।

ফায়েজ তখন ফুলে দিয়ে সাজানো স্টেইজে বসে আছে রাজকীয় চেয়ারে। স্টেজকে ঘিরে আছে শ’খানেক ক্যামেরা।বরের ছবি হাজার খানেক ছবি ক্লিক করতে পারলেও কনের ছবি এখন অব্দি তোলা হয়নি।

উপস্থিত সকল মেহমান,সাংবাদিক, নায়ক-নায়িকা, ডিরেক্টর এবং খেয়ার বাবার আমন্ত্রণে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ আরও অনেক রাজনীতিবিদরা।

ফায়েজ হাসিমুখে আগত সকল মেহমানদের সাথে কথা বলছে এবং অগনিত ছবি তুলে তুলে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। এতকিছুর পরও ফায়েজের মনে খোঁচখোঁচ করছে খেয়াকে দেখার জন্য, তার নবগত স্ত্রীকে দেখার জন্য।

কাটাকাটা কথা বলা মেয়েটা, যার কথা শুনে ফায়েজের হৃদয়ে শান্তি নয় বরং আগুন জ্বলে উঠতো, সে মেয়ে আজ তার স্ত্রী।

আপনমনে,কথাগুলো বলে যখন ফায়েজ আনমনা তখনি আগমন ঘটে খেয়ার।

নববধূর আগমনে পুরো হল জুড়ে হৈ হৈ রব। ক্যামেরা অনবরত ক্লিক, ফ্ল্যাশের আলো যেন মূহুর্তে খেয়াকে অপ্রস্তুত করে ফেললো।

খেয়ার মনের ভাব বুঝতে পেরে রিমি আর নিধি এসে খেয়ার দুহাত ধরে এগিয়ে গেলো স্টেইজের দিকে। ফায়েজ খেয়াকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো, রিমি খেয়ার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

-দুলাভাই, এসে তোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিবে। তুই উনার হাতে হাত রাখবি ব্যস বাকিটা উনি সামলে নিবে। এটাই বিয়ের মূল আকর্ষন, বর তার কনের হাত ধরে স্টেইজে নিয়ে আসবে আর শোন ভয় পাবি না।

খেয়া রিমির কথা শুনলো কি না কে জানে! কিন্তু,
ঘোমটার আড়াল থেকে একটি হাত দেখতে পেলো, এই হাত ফায়েজের, যা খেয়ার জন্য বাড়িয়ে রেখেছে।

কাঁপাকাঁপা হাতে ফায়েজের হাতে নিজের হাত সমর্পন করলো খেয়া। ফায়েজ আলতোভাবে খেয়ার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে স্টেইজে তুললো খেয়াকে।

মূহুর্তের মাঝে সকল ক্যামেরার ক্লিক এন্ড ফ্যাশে মুখরিত পুরো হল।

সকলের সামনে যখন হাসিমুখে পোজ দিয়ে ছবি তুলছে ফায়েজ তখন খেয়ার কথা শুনে ফায়েজের মুখ মূহুর্তের মাঝে চুপসে গিয়েছে। পরমূর্হতে, নিজের মুখে হাসি ঝুলিয়ে খেয়াকে বলে,

-ছবি তো তুলতেই হবে,নায়কের বৌ হয়েছো বলে কেউ এত ছবি তুলছে না তোমার। এখনকার ওয়েডিংয়ে এগুলো পানিভাত।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here