মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -২২

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী

ভোরে ঘুম ভাঙ্গলে নিজেকে সাদিফের বুকে ওর বলিষ্ঠ হাতের শক্ত বাঁধনে আবিষ্কার করে । তানিশা আলতোভাবে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ওর নড়াচড়ায় সাদিফের ঘুম ভেঙে যায়।
” কি হয়েছে বউ? হরিণ ছানার মত তিড়িংতিড়িং করছ কেন? আমাকে ঘুমাতে দাও। ” আবারও সেই কন্ঠের মাদকতায় তলিয়ে যায় তানিশা। যতবার সাদিফ ওকে ‘ বউ ‘ বলে ডাকে, ততবারই নিজেকে সদ্য বিবাহিতা কিশোরীর ন্যয় মনে হয়। এত আদর আদর কেন তার মুখের ‘ বউ ‘ ডাকটা! কেন সেই ডাকে নিজেকে সাদিফের মায়ায় আরো বেশি করে জড়িয়ে ফেলে! এই পুরুষের সান্নিধ্যে এক অসহনীয় যন্ত্রণাময় সুখ তা কি সে জানে? এক পরম আবেশে তানিশাও জড়িয়ে ধরে তার পরম আরাধ্য পুরুষকে।
সাদিফ ঘুমের মাঝেই বুঝতে পারল তার রমনীর হাতের বাঁধন। কোমল হাতের স্পর্শ পেতেই সাদিফের শরীরে খেলে যায় এক অসহনশীল যাতনা। সে আরও শক্ত বাঁধনে বেঁধে নেয় তার রমনীকে। পারলে বুকের খাঁচায় বন্দী করে রাখে।
তানিশাও চুপটি করে অনুভব করছে সেই শক্ত বাঁধনের মধুর সুখ। আজ এই ক্ষনে, এই আলতা রাঙ্গা ভোর সাক্ষী হতে চলেছে এক ভালোবাসার কাহনের। এক তৃষ্ণার্ত পুরুষের বহুদিনের তৃষ্ণা মেটাতে তার রমনী সদা তৎপর।

তানিশা রান্নাঘরে ব্যস্ত। ওকে সাহায্য করছে সাইরা ও তিয়াসা। শায়লা চৌধুরী বারবার নিষেধ করেছে তিয়াসাকে কাজ করতে কিন্তু তিয়াসা তার কোন নিষেধ শোনেনি। রান্না প্রায় শেষের দিকে তখনই উপর থেকে সাদিফের ডাক শুনতে পায় তানিশা। সাদিফ ওকে ননস্টপ ডেকেই চলেছে। তানিশা সাইরাকে দেখতে বলে উপরে আসে। সাদিফ ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শরীরে পারফিউম স্প্রে করছে।
” আমাকে ডাকলেন যে। ”
” টাই বেঁধে দাওতো বউ। ”
” এতদিন তো আপনিই বাঁধতেন! কিন্তু আজ কি হল! ”
সাদিফ কোমড় ধরে তানিশাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।
” বুঝলে বউ, ভেবে দেখলাম এখন থেকে বউ আমাকে টাই বেঁধে দিবে আর আমি তার কোমড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। এর চেয়ে সুখ আর কি হতে পারে। এই সুযোগে বউকে একটু কাছে পাওয়া যাবে। আর একটুআধটু আদরও করা যাবে। আমার ভাবনাটা খুব পারফেক্ট তাইনা। ” দুষ্টু হাসি সাদিফের ঠোঁটে।
” পারফেক্ট না কচু। আমার কাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে সে সুযোগ খোঁজে। নিন বাঁধা শেষ। এখন খেতে আসুন। ” তানিশার বুক টিপটিপ করছে। সাদিফের কাছে আসলেই ওর এমন হয়।
” কিছু না দিয়ে, না নিয়েই চলে যাবে! কিছুতো দাও। ” কোমড়ে জোরে চাপ পরতেই আৎকে উঠে তানিশা। বুঝতে পারে এই জেদী লোকটা এমনিতেই ছাড়বেনা।
তানিশা এক হাত দিয়ে সাদিফের চোখ চেপে ধরে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয় ওর ঠোঁটে। মুহূর্তেই হাসিতে উদ্ভাসিত হয় সাদিফের মুখ। তৎক্ষনাৎ সে তানিশার ঠোঁট নিজের আয়ত্তে নেয়।

সাদিফ বেরিয়ে গেলে ওরা সবাই মিলে নাস্তা করে । এরপর দুপুরের রান্না সেরে তানিশা, সাইরা, তিয়াসা মিলে শপিংয়ে যায়। সাথে বাচ্চারাও আছে। সারাদিন শপিং, ঘুরাঘুরি শেষে বিকেলে বাসায় আসে।
সকাল থেকেই তানিশা লক্ষ্য করেছে শায়লা চৌধুরীর মন খারাপ হয়ে আছে। তানিশা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা ঘটনা কি। আবার বিকেলে শ্বশুরকে নাস্তা খাওয়াতে এসে দেখল তারও মন খারাপ। তানিশা একটু চিন্তায় পড়ে যায়।
সিদ্ধান্ত নেয় সাইরার সাথে কথা বলবে। তূর্ণাকে তিয়াসার কাছে রেখে ও সাইরার কাছে। সাইরা বাচ্চাদের নিয়ে বিছানায় বসে ল্যাপটপ দেখছে।
” সাইরা আসব? ”
” ভাবি, তুমি জিজ্ঞেস করছ, আসবে কি না! তুমি যখন খুশি আসতে পারো। ”
তানিশা বিছানায় বসে নিরোর চুল এলোমেলো করে দেয়। টুপ করে চুমু দেয় নোয়েলের গালে। এই বাচ্চাগুলো একটু বেশিই কিউট।
” সাইরা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। কিছু মনে করবেনা তো? ”
” তোমার কথায় কিছু মনে করার প্রশ্নই আসেনা।ভুল মানুষ বারবার করেনা। ”
” আজ বাবা-মা সকাল থেকেই মন খারাপ করে আছে কেন? আমি তাদের জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিনা। ”
সাইরা মলিন হেসে চোখের পানি মুছে।
” আজ ছোট ভাইয়ার জন্মদিন। বোঝোই তো বাবা-মা ‘ র মন। ”
ঝট করে তানিশার মনে পরে। এক সময় সাইফের জন্মদিন পালন করা হত।
” সাইফের কি হয়েছে আমাকে বলবে? তোমার ভাইয়াকে একদিন ওর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু সে কোন উত্তর দেয়নি। বরং আমার মনে হয়েছিল সাইফের নাম শুনেই সে রেগে গিয়েছিল। তারপর মা’কে সাহস করে সাইফের কথা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। ”
” ভাইয়া পড়াশোনার জন্য কানাডায় গিয়েছিল। তিন বছরের একটা কোর্স ছিল। সেখানে গিয়ে কিছুদিন আমাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছে। কিন্তু একটা সময় পর হঠাৎ করেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এখন কারও সাথেই যোগাযোগ নেই। আর একদিন ভাইয়া জানিয়ে দেয় সাইফের নাম এ বাড়িতে উচ্চারণ করা যাবেনা। মমও ভাইয়ার কথায় সায় দেয়। তারপর থেকে এভাবেই চলছে। আমি বুঝতে পারি কিছু একটা আছে কিন্তু মমকে জিজ্ঞেস করিনি পাছে তার যদি মন খারাপ হয়। ”
তানিশা বেশ অবাক হয় সাইফের কথা শুনে। আবার যে সাদিফ ভাই ছাড়া কিছুই বুঝতনা সেই সাইফের নাম নিতে বারন করেছে!

রুমে এসে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় সাদিফের সাথে কথা বলবে।
সাদিফ আসলে প্রাত্যহিক কাজ সেরে তিয়াসার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। এরপর রুমে আসে। তূর্ণা ওর কোলেই ঘুমিয়ে ছিল। মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে সেও শুয়েছে তখন তানিশা রুমে আসে।
সাদিফের পাশে আধশোয়া হয়ে মাথা রাখে তার বুকে। সাদিফও ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখে।
” একটা কথা ছিল। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে একটুও রা*গ করতে পারবেননা, বিরক্ত
হবেননা। হাসিমুখে আমার কথা শুনে তবেই উত্তর দিবেন। ”
” বাব্বাহ! এত শর্ত! বলে ফেল তোমার কথা। ”
” না আগে প্রমিজ করেন। তাছাড়া বলবনা। ”
” প্রমিজ করার পরও যদি রে*গে যাই? ”
” তাহলে বুঝব আমাকে ভালোবাসেননি। ”
” এই চুপ, আমার ভালোবাসা নিয়ে কোন কথা নয়। আমার ভালোবাসা এত ঠুনকো নয় বুঝেছ। প্রমিজ করছি রা*গ করবনা। এই রা*গ*ই আমাদের দূরত্বের কারন ছিল। আমি সেই দূরত্ব আর চাইনা। এর থেকে মৃ*ত্যু*ও সহজ আমার কাছে। ”
তানিশা কেঁপে উঠে সাদিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সাদিফের মুখে মৃ*ত্যু*র কথা শুনে ওর শরীর কাঁপছে। সাদিফও তানিশার অবস্থা বুঝতে পেরে হাতের বাঁধন শক্ত করে।
” বউ, তুমি এভাবে কাঁপলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করব কেমন করে! তখন কিন্তু তোমার কথা শোনার অবস্থায় থাকবনা। এখন ঝটপট বলে ফেল কি বলবে। ”
তানিশা একটু ধাতস্থ হয়ে সাদিফের পাশে বসে। ওর দুই হাতের মুঠোয় সাদিফের ডানহাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
” সাইফের কি হয়েছে? ও দেশে আসেনা কেন? আপনাদের সাথে যোগাযোগ নেই কেন? ”
মুহুর্তেই তানিশা লক্ষ্য করল ওর হাতের মধ্যে থাকা সাদিফের হাত শক্ত হয়ে গেছে। সাদিফের মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারে ওর চোখমুখে রা*গে*র ছটা।
তানিশা এবার ভয় পায়। সে জানে সাদিফের রা*গ সম্পর্কে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সাদিফ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।
” তোমার এসব শুনতেই হবে? এসব না শুনলেই নয়। ”
তানিশার বুকে কষ্ট জমাট বাঁধে। সে কি এই বাড়ির কেউ নয়! তাকে কেন বলা যাবেনা সাইফের খুব! নিতান্তই তার প্রয়োজনিয়তা আছে বলেই এখানে জায়গা হয়েছে! তূর্ণার পাশে নিজের বালিশ ঠিক করে শুয়ে পরে।
” আচ্ছা আমি আর শুনতে চাইবনা। এবার আপনি শুয়ে পরেন। অনেক রাত হয়েছে। কাল কিন্তু অফিস আছে। ”
সাদিফ চুপচাপ কিছুক্ষণ তানিশার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তানিশা চোখ বন্ধ করেছে। সাদিফ বেশ বুঝতে পারছে তানিশার খারাপ লেগেছে। কিন্তু বোকা মেয়ে ওকে বুঝতে দিতে চায়না। কিন্তু সাদিফও নিরুপায়। সাইফ যা করেছে তাতে নিজের ভাই বলে পরিচয় দিতে ঘৃণা হয়। সাদিফ তানিশার কোমড়ে হাত রেখে ওকে নিজের দিকে চাপিয়ে নেয়। তানিশা চোখ খুলে দেখে ও সাদিফের খুব কাছে।
” বারান্দায় এসো। ”
” কেন! ঘুমাবেন না! ”
” উহু, আজ বউয়ের সাথে জোছনা বিলাস করব। ” সাদিফ উঠে একটানে তানিশাকেো টেনে তুলে নিয়ে যায় বারান্দায়। বারান্দার এককোনায় বিছানা পেতেছে তানিশা। মাঝে মাঝে এখানে বস। সাদিফ তানিশা পাশাপাশি বসা। কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করে দুজনের মাঝে। তানিশাকে এক হাত দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় সাদিফ। তানিশা নির্বাক চেয়ে থাকে সাদিফের দিকে।
” সাইফ অনেক বড় অন্যায় করেছে, বউ। ভুলের ক্ষমা হয়, কিন্তু অন্যায়ের কোন ক্ষমা নেই। অন্যায়ের জন্য হয় শুধু শা*স্তি। ” তানিশা একটু অবাকই হয়। ও ভেবেছিল সাদিফ এ বিষয় নিয়ে কথা বলবেনা। সাদিফ আপনমনে বলে চলেছে,
” সাইফ কানাডার একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। তিন বছরের কোর্স ছিল। ও যাওয়ার সময় বাবা ওর একাউন্টে অনেক টাকা দিয়েছিল যাতে সেখানে যেয়ে ওর কোন কষ্ট করতে না হয়। আমিও দিয়েছিলাম বাবার সমপরিমাণ টাকা। চেয়েছিলাম ভাই উচ্চডিগ্রি নিয়ে দেশে এসে বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। প্রথম প্রথম সব ঠিতই ছিল। কিন্তু একসময় সে একটা মেয়ের সাথে জড়িয়ে যায়। মেয়েটার পেশা ছিল ছেলেদের ফাঁসানো। আর তার মা ছিল একসময়কার প*তি*তা। আমি এসবের কিছুই জানতামনা। বাবার অসুস্থতার সময় যখন লক্ষ্য করলাম এই বিপদেও ও যোগাযোগ করছেনা তখন খটকা লাগল। মমকে জিজ্ঞেস করলে, সে ইতস্তত করে বলে, সাইফ খুব একটা যোগাযোগ করেনা। তখন শিওর হলাম কিছু একটা হয়েছে। কিছুদিন পর অফিসের কাজের নাম করে কানাডা গেলাম। বাসায় অবশ্য জানালাম সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। কানাডায় যেয়ে প্রথমে যোগাযোগ করলাম বাবার বন্ধু আসাদ আলম চাচ্চুর সাথে। তিনি আমাকে সাইফের ব্যাপারে সব জানালেন। এরপর আমি গেলাম ওর ভার্সিটিতে সেখানে গিয়ে দেখলাম ও ভর্তি হয়েছে ঠিকই কিন্তু ক্লাসে অনিয়মিত। ওর ফ্ল্যাটের আশেপাশের মানুষের থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম সত্যিই এক মেয়ের সাথে রিলেশনে আছে। ” সাদিফ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তানিশা অবাক হয়ে শুনছে।
” তারপর সেই মেয়ের ও তার মায়ের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানলাম আসাদ চাচ্চুর কথাই সত্যি। এরপর গেলাম ওর ফ্ল্যাটে। নক করতেই এক মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়। আমি মেয়েটার সাথে কথা না বলে সেখান থেকেই ডাক দিলাম সাইফকে। সাইফ দরজায় আমাকে দেখে ভয় পায়। আমি সবকিছু জানতে চাইলে মেয়েটিকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়। অবশ্য এটা সত্যি ওরা বিয়ে করেছিল। আমি যতদূর খোঁজ নিয়ে জেনেছে এই মেয়ে সংসার করবেনা। কিন্তু সাইফ সেকথা অনেকে বোঝানোর পরও বুঝলনা। সে সব ছাড়বে শুধু সেই মেয়েটাকে ছাড়া। আমার সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছে সেদিন। জানিয়ে দেয় দেশে আর কখনোই আসবেনা। সেখানেই স্ত্রীকে নিয়ে সংসার সাজাবে। তবে এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম ও নেশা ধরেছে। তাই ওকে বোঝানো না বোঝানো সমান। আমি দেশে ফিরলাম। কয়েকমাস পরে আসাদ চাচ্চু জানায় সাইফ সেখান থেকে অন্য জায়গায় চলে গেছে। তিনি জানেননা ও কোথায় গেছে। এরপর আমিও ওর খোঁজ রাখিনি। ” তানিশা কিছু না বলে সাদিফের কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ থাকে। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে কেউ বলতে পারেনা। রাতজাগা পাখির ডাকে দুজনের নিরবতা ভঙ্গ হয়।
” বউ কি আমাকে সারারাত বারান্দায় রাখার প্ল্যান করেছে! নাকি তাদের রোমান্স আশেপাশের মানুষদের দেখার সুযোগ করে দিবে! ” সাদিফের কথা শুনে চমকে উঠে তানিশা।
” ছিহ্ নির্লজ্জ পুরুষ। ”
” হুম, নির্লজ্জ শুধু তোমারই জন্য। তারাতারি রুমে চল, রাত পেরিয়ে যাচ্ছে। আমার আবার অল্পতে মন ভরেনা। ” তানিশা পারলে লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়। এই লোক এতটা নির্লজ্জ হতে পারে ওর ধারনায়ই ছিলনা। তানিশার ভাবনার মাঝেই ওকে কোলে তুলে নেয় সাদিফ।

পরদিন সাদিফ অফিসে গেলে শায়লা চৌধুরীকে বলে তানিশা বাইরে বের হয়। আজ ও একাই এসেছে। তিয়াসা তূর্ণাকে নিয়ে বাসায় আছে।
একটা বিশাল বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তানিশা। গন্তব্য বিল্ডিংয়ের অষ্টম তলা। ধীরে ধীরে প্রবেশ করে মূল ভবনে। লিফটে চড়ে চাপ দেয় বাটনে।
কাঁচে ঘেরা দেয়ালের ওপাশে বড় ডেস্কে ল্যাপটপের দিকে গভীর মনযোগে তাকিয়ে আছে রাতুল। তানিশা সিকিউরিটির থেকে জেনে নিয়েছে রাতুল কোথায় বসে। দরজার সামনে বসে থাকা পিয়নকে বলে, সে রাতুলের সাথে দেখা করতে চায়। পিয়ন রাতুলের থেকে অনুমতি নিয়ে তানিশাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়।
তানিশা ভালো করে লক্ষ্য করে রাতুলকে। খুব সুদর্শন যুবক সে। হলুদ ফর্সা গায়ের রং, ঘন ভ্রু জোড়া, মাথায় ঝাঁকড়া চুলের সমাহার। পুরুষ্টু বাদামী ঠোঁট। এই সুদর্শন চেহারায় চোখের নিচে কালি বেমানান। মনে হচ্ছে অনেক রাত ঠিকমত ঘুমায়না।
রাতুলও চেয়ে আছে তানিশার দিকে। সে কখনোই এই মেয়েটিকে দেখেনি।
” আমি তানিশা। সাদিফ চৌধুরীর স্ত্রী, সাইরার বড় ভাবি। ” তানিশাই প্রথমে কথা বলে।
রাতুল চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায়।
” বসুন ভাবি। ”
” আমরা কি বাইরে কোথাও বসতে পারি? কিছু কথা ছিল আপনার সাথে। অফিসে বসে কথা বলতে আমার ভালো লাগবেনা। ”
” ঠিক আছে, আপনি আমাকে দশ মিনিট সময় দিন। ” রাতুল বেরিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর এসে তানিশাকে নিয়ে রাস্তার ওপাশে থাকা রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে যায়।

একটা টেবিলে সামনাসামনি বসে আছে রাতুল, তানিশা। তানিশা ওর সাথে কেন দেখা করতে এসেছে, রাতুল কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে।
এদিকে তানিশা তার কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে।
” একজন পুরুষের জীবনে স্ত্রী-সন্তানের মূল্য কতটুকু তা কি আপনি জানেন? একজন মানুষ কখন সম্পন্ন হয় এর উত্তর আপনার জানা আছে? ” রাতুল নিশ্চুপ। সে বেশ বুঝতে পারছে সামনে আর কি কি প্রশ্ন অপেক্ষা করছে।
” একজন মানুষ সম্পন্ন হয় তার জীবনে বৈধ ভালোবাসার মানুষের আগমনে। আর বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনই হচ্ছে বৈধ ভালোবাসা। একজন পুরুষ যেমন তার বাবা-মা’র অবলম্বন ঠিক তেমনি সেই পুরুষই তার স্ত্রীর আশ্রয়স্থল। আর সেই পুরুষ যখন কালের পরিক্রমায় বাবা হয় তখন সে সন্তানের কাছে বট গাছের ন্যায়।
আপনি পিতামাতার উত্তম অবলম্বন হয়েছেন ঠিকই কিন্তু একজন স্ত্রীর নিকট আশ্রয়স্থল, সন্তানদের নিকট বট গাছের ছায়া হয়ে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। এক্ষেত্রে আপনি একজন ব্যর্থ স্বামী একজন ব্যর্থ পিতা। স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কের সাথে বাবা-মা’র নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক কেন গুলিয়ে ফেলেন! স্ত্রীর আসনে যেমন বাবা-মা বসতে পারেনা ঠিক তেমনি বাবা-মা’র জায়গা স্ত্রীর জন্য নয়। এই সম্পর্কগুলোও যেমন আলাদা তেমনি তাদের ভালোবাসার ক্ষেত্রও আলাদা। আপনি যতদিন মায়ের সম্পর্কের সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক গুলিয়ে ফেলবেন ঠিক ততদিনই আপনাকে চোরাবালিতে আটকে থাকতে হবে। সাইরা আপনাকে যতটা ভালোবাসে তাকে ততটা ভালো কেন বাসতে পারেননা! ওর ভালোবাসায় কোন ত্রুটি আমি দেখিনি। সাইরা যেভাবে বেড়ে উঠেছে যেমন লাইফ লিড করেছে সেই মেয়ের আমূল পরিবর্তন দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। সেই সাইরা যে কাউকে এত ভালোবাসতে পারে এটা অভাবনীয়। আজ যদি সে আগের সাইরা থাকত তবে আপনি কিছুতেই তাকে অবহেলা করতে পারতেননা। কিংবা আপনার মা’ও ওকে অপমান করার আগে দুইবার ভাবত। সে যাইহোক আমি চাইনা সাইরা এমন কোন সিদ্ধান্ত নিক যাতে আপনার সারা জীবন পস্তাতে হয়। পারবেন তো আজীবন ওদের না দেখে থাকতে? আমি চাইনা ও আমার মত সবার থেকে দূরে যাক। এর কষ্ট যেমন আমি ভোগ করেছি তেমনই করেছে সাদিফও। সাদিফ ওর সন্তানের মুখ না দেখেই সন্তানের জন্য ব্যকুল ছিল কিন্তু আপনি তো ওদের দেখেছেন তবুও কি একটুও ব্যকুলতা ওদের জন্য নেই! সম্পর্কের মূল্য দিতে শিখুন, তখন দেখবেন আপনার থেকে সুখী আর কেউই নেই। ” একনাগাড়ে কথা বলে তানিশা। রাতুলও মাথা নিচু করে আছে। এত সহজভাবে কঠিন কথাগুলো কেউ ওকে এই প্রথমবার বলল।
সামনে থাকা কফি জুড়িয়ে গেছে সেই কখন।
” আমি চেষ্টা করছি সম্পর্কটাকে ঠিক করার। যদিও জানিনা সাইরার মনোভাব কেমন। আমিও চাই সন্তানদের নিয়ে বাঁচার মত বাঁচতে। ওদের জন্য ব্যাকুলতা আমারও আছে। ”
” স্ত্রীর কোন ভুল থাকলে আপনি তাকে শোধরাবার চেষ্টা করুন। আপনার মা এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারেনা বা আপনি তাকে বলতে পারেননা। মনে রাখবেন আপনারা একে অপরের পরিপূরক। স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখার দ্বায়িত্ব আপনার। সাইরা অন্যায় করলে আপনি ওকে শাসন যেমন করবেন তেমনি ওকে ভালোবাসার দ্বায়িত্বও আপনার। তবে যে সাইরাকে এখন আমি দেখছি তার পক্ষে অন্যায় কিছু করা অসম্ভব। পারলে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করবেন। দাম্পত্যের স্বচ্ছ প্রতিবিম্বে দাঁড়িয়ে যাচাই করবেন কে ভুল, কে সঠিক। আমি এখন উঠছি। আশা করি সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন। ” টেবিলের উপর কফির বিল সাথে টিপস রাখতেই রাতুল মানা করে দেয়। তানিশা হেসে বলে, ” যেদিন স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে আসবেন, সেদিন আমাকে ডাকবেন। আর সেদিন বিলটা কিন্তু আপনাকেই দিতে হবে। ”
তানিশার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রাতুল ভাবে কত আত্মবিশ্বাস মেয়েটার মাঝে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here