#মুক্ত_পিঞ্জিরার_পাখি
#পর্বঃ৫
#Ipshita_Shikdar
লেক থেকে এসে দীর্ঘসময় ধরে গোসল করে বের হয়েই দেখে তার ফোনটা ভাইব্রেট করছে। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনটা সুইচ অফ করে রেখে দেয়। টাওয়াল জড়ানো দেহে আলনার সামনে যেতেই মুখে হাসি ফুটে উঠে। ভালোবাসার মানুষের সবকিছুই ভালো লাগে, তা তার ব্যবহার করা শার্টটাই হোক না কেন। সদ্য জলসিক্ত দেহে পোশাকটি জড়িয়ে নিয়ে বেডে ঝাপ দেয়।
আরিজের ব্যবহারকৃত পারফিউমের ঘ্রাণ পেতেই হুট করে মনে পড়ে যায় তাদের প্রেম নিবেদনের কথা। দিনটি ছিল তার নবীন বরণের।
যদিও প্রিয়ার ততোটা বাঙালিয়ানা সাজ পছন্দ না; কিন্তু দিনটির বিশেষত্বের জন্য লাল শাড়ির বদলে কালো নেটের শাড়ি, দুই হাত ভর্তি লাল চুড়ির বদলে কাফ ব্রেসলেট, নয়নযুগলে কাজলের জায়গায় ঠাই নিয়েছে আইলাইনার, কানে ঝুমকোর স্থানে কানের স্টাড, স্ট্রেইট চুলগুলো খোলা অবস্থায় রাখা। দেখতে অনেকটা প্রতিবেশি দেশের অভিনেত্রীর মতো লাগছে। ভার্সিটির অনেক ছেলেই মুগ্ধ চোখে দেখছে তাকে।
সে সেসবে ধ্যান না দিয়েই বান্ধুবীদের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত। তখনই এক পিচ্চি এসে বলে,
“আপা, আপনারে বড় ভাই ডাকসে।”
ভ্রু নাচিয়ে প্রিয়া জিজ্ঞেস করে,
“কোন বড় ভাই?”
“বড় ভাই বোঝেন না? সিনিয়র ভাই। কামে ডাকসে, হলরুমে যান।”
বলেই সাত বছরের বালক হেলেদুলে নিজের কাজে চলে গেল। প্রিয়া অবাক হয়ে ছোট বাচ্চার এমন এটিটিউড সয়ে নিল, তারপর নিজেও চলল হলরুমের দিকে। মনে মনে তার ভয় কাজ করছে।
“আমার করা কাজে কোনো ভুল হয়েছে নাকি! যদি র্যাগ করে…”
“ভাইয়া, আমি কি কোন ভুল করেছি? করলে আ’ম রেয়ালি রেয়ালি সরি। বিশ্বাস করেন ভাইয়া, মোটেও ইচ্ছাকৃত ছিল না।”
মাথা নত করে কথাগুলো একদমে বলছিল প্রিয়া। তাকে থামিয়ে দিয়ে আরিজ ধমক দিয়ে বলে উঠে,
“এই মেয়ে! একদম চুপ! ভাইয়া, ভাইয়া, করবা না একদম।”
নরম গলাতেই জিজ্ঞেস করে,
“ভাইয়া বলবো না তো কী বলবো, ভাইয়া?”
আরিজ একটানে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলে,
“প্রেমিক, দিওয়ানা, জামাই এগুলো।”
“মানে!”
বলে চমকে যেয়ে মাথা উঠিয়ে উপরে তাকাতেই চোখজোড়া আটকে যায় বিড়ালচোখ দুটোর দিকে।
“মানে যা ভাবছো তাই। আই লাভ ইউ, প্রিয়। তুমিই আজ থেকে আরিজের প্রিয়তমা।”
সেদিন কোন এক ঘোরেই ডুবে গিয়েছিল প্রিয়া, যেই ঘোর থেকে তার পৃথিবীতে থাকতে হয়তো বের হওয়া সম্ভব নয়।
এসব ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে। খাণিক বাদেই এত ঝড় বয়ে যাওয়া শরীর আর ক্লান্তি সইতে না পেরে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।
১৪।
পক্ষী কিছুটা শান্ত হতেই তার হুশ আসে সে কী কী বলে ফেলেছে। মনে মনে নিজের করা কাজের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বেশ ভীতি কাজ করছে তার।
“যদি সে আমায় বাড়ি থেকে বের করে দেয়! না, আমির ভাই আছে তো পারবে না। আর আমি যা বলেছি ঠিকই তো বলেছি। কিন্তু তারপরও যদি…”
এসব অহেতুক ভাবনা মাথায় নিয়েই মাথা ভার হয়ে যাচ্ছে তার। এর উপর আবার পানির তৃষ্ণা নিবারণও হয়নি। এবার হয়তো এত চাপে জ্ঞান হারিয়েই শান্ত হবে সে।
এসবের মধ্যেই আরিজ ব্যালকনি থেকে বের হয়ে দেখে শ্যামাঙ্গা কন্যাটি সোফায় ‘দ’ আকারে বসে একহাতে পেট চেপে ধরে আছে তো আরেক হাতে মাথা, চোখজোড়া বন্ধ; দেখাই বোঝা যাচ্ছে বেশ চিন্তিন ও দুঃখিত সে। গতকাল পক্ষীকে তেমন দেখা হয়ন, অবশ্য তেমন ইচ্ছেও ছিল না তার। কিন্তু আজ কেন যেন পক্ষীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চাচ্ছে বেহায়া চোখজোড়া, যেন এক ঘোরে চলে যাচ্ছে। যেই ঘোর শুধুমাত্রই সামনে বসে থাকা নারীকে নবরূপে আবিষ্কার করতে চাচ্ছে।
নারীটির গায়ের রঙ ঠিক শ্যামাও বলা যায় না, আবার উজ্জ্বল শ্যামাও না। ভ্রুজোড়ায় কখনো কৃত্রিমতার ছোঁয়া পড়েনি বোঝায় যাচ্ছে, তবে এমনিতেই বেশ রূপায়িত। অধরসুধা খাণিকটা খয়েরীর ছোঁয়া গোলাপির মাঝে। নাকটা বাঁশির মতো নাহলেও চেহারার সাথে বেশ মানিয়েছে। চোখজোড়াকে বিশ্লেষণ করতে যাবে তখনই পক্ষী চোখজোড়া খুলে তার দিকে তাকায়।
এবার যেন সে সত্যিই ঘোরে চলে যায়। কাজল রাঙানো ডাগরডাগর চোখজোড়ার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে ডান চোখের কোণঘেঁষা গোল গর্তাকার দাগটি, সম্ভবত পক্স বা বসন্তের রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন এটি।
আনমনেই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,
“ডাগর ডাগর আঁখির পাশে ছোট্ট একখান দাগ
সাজিয়ে রাখা মেয়েটি যে বড্ড মায়াবতী।”
এদিকের পক্ষীর বড় অস্বস্তিবোধ হচ্ছে লোকটির এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে। যতোই হোক স্বামী, অপরিচিতর সাথে অপ্রিয় এবং ঘৃণিতও বটে সে। কয়েক মুহূর্ত হয়ে গেলেও তার দৃষ্টি না সরলে পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতা কাটাতে সে মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে। সাথে সাথেই আরিজের ঘোর ভেঙে যাওয়ায় সেও দৃষ্টি নত করে ফেলে।
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
আরিজের মতো মানুষের মুখে এমন কথা শুনে বেশ অবাক হয় পক্ষী। এতদিনের আচার-ব্যবহারে যা বুঝেছে; তার মাঝে অন্যতম হলো লোকটির সুপিরিয়োরিটি কমপ্লেক্স আছে। সে নিজেকেই সবসময় সঠিক ও শ্রেষ্ঠ ভাবে, তাছাড়া কোনো কিছু করার জন্য কারো অনুমতি নেওয়ারও দরকার মনে করে না।
এসব ভাবনা পিছনে ফেলেই শীতল গলায় উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ, বলেন।”
আরিজ স্বাভাবিক ও শান্ত গলায় বলতে শুরু করে,
“আই নো, যা হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্রও তোমার দোষ নেই। আমার মন ও মস্তিষ্ক তোমাকেই দোষী ভাবে, কারণ তুমি চাইলে সে সময় অনেক কিছু করেই বিয়ে আটকাতে পারতে। বাসা থেকে পালাতে পারতে, সুইসাইডের হুমকি এন্ড মেনি মোর…”
কথাগুলো বলে মেয়েটার দিকে একদফা তাকাতেই চোখে পড়ে বাঁকা হাসি, তবে এ হাসি কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। বরং, বেশ তাচ্ছিল্য মাখা। নিচু গলায় বলল,
“পরিস্থিতিটায় আমি ছিলাম, আপনি না।”
গোপণে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বলল,
” দূর থেকে অনেক পরিকল্পনাই চিন্তা করে ফেলা যায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কিন্তু তা কতোটা কার্যকর তা শুধুই ঐ পরিস্থিতির মাঝে আটকে পড়া ব্যক্তিটিই জানে।”
“আমি জানি তোমার নিজস্ব বাধ্যবাধকতা ছিল, কিন্তু তারপরও…”
তাকে থামিয়ে মৃদু গলায় বলল,
“ইট’স ওকে, আমি কোনো জবাবদিহি আপনাকে দিতে বলিনি। কারণ যেই অঘটনকে মানুষ এক্সিডেন্ট বলে, তার দোষী আমার মন ও মস্তিষ্ক কেন যেন আপনাকেই মানে। বড্ড বেশি অপ্রিয় আপনি, হয়তো ঠিক যতোটা আমি আপনার কাছে।”
আনমনেই আরিজ ভেবে উঠে,
“আসলেই কি অপ্রিয়? অবশ্য প্রিয় কেউও তো নয়।”
নিজের ভাবনায় নিজেই বিস্মিত হয়। নিজেকে সামলে আলতো হেসে বলে,
“ইট’স গুড ফর বোথ অফ আস। এত সময়ের মিসবিহেভের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমি আমার প্রিয়কে অনেক বেশি চাই, বুঝলে? ওকে ঘরে আনার সঠিক সময় হলেই তোমাকে তালাক দিয়ে দিব। তুমি ততদিন মানে ছয়-সাত মাস শান্তিতে থাকো আমাদের বাড়িতে, একদম মেহমানের মতো। সময় হলে তোমাকে পিঞ্জিরা খুলে মুক্ত করে দিব।”
যদিও পক্ষীর কথাটায় খুব একটা যায়-আসার কথা না, তবুও বেশ গায়েই লাগলো তার। কেমন একটা শ্বাস আটকে যাওয়া অনুভূতি। আপন মনেই ভেবে উঠে সে,
“কবুলের মায়া এতোই গভীর! তবুও আমি আটকে যেতে চাই না এই মায়ার বদ্ধ পিঞ্জিরার পাখি হয়ে।”
“এই যে ম্যাম, কী এত ভাবছো?”
আরিজের ডাকে তার ভাবনার সুতো কাটে। সৌজন্যতা রক্ষার্থে জোরপূর্বক হেসে বলে,
“না, তেমন কিছু না।”
“আরেকটা কথা, যেহেতু কিছুদিন হলেও একসাথে আছি তাই খুব ক্লোজ বন্ধু নাহলেও রুমমেট টাইপ বন্ধু হয়েও থাকা যায় কী বলো!”
“হুম, তা করা যায়।”
১৫।
আকাশটা প্রায় অন্ধকার হলেও লাল আভা কিছুটা দেখা যাচ্ছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লালবর্ণের চায়ে ঠোঁট ডুবায়, গোলমরিচের ঝাঁঝটা গলায় লাগতেই শরীরটা সতেজ হয়ে উঠে।
কিছু একটা ভেবে ফোনটা সুইচ অন করতেই দেখতে পায় মায়ের ত্রিশের অধিক মিসড কল। এক সুদীর্ঘশ্বাস ফেলে সে, এই নিঃশ্বাসের মর্ম শুধু সেই প্রেমিকাই বুঝে যে প্রতিনিয়ত পরিবারের সাথে লড়ে শুধুমাত্র প্রেমিককে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় দেওয়ার জন্য।
কল ব্যাক করে ফোন স্পিকারে রাখে, রিংটোনের আওয়াজ সারা ঘরময় আলোড়িত হতে থাকে।
একা এক ফ্লাটে থাকে সে, তাই বিষয়টা অস্বাভাবিক কিছু নয়; আগে অবশ্য পক্ষী থাকতো সাথে। পক্ষী তার ছোট চাচার মেয়ে। তার দাদুর বাড়িতে মানে দেওয়ান বাড়িতে যদি আসলাম দেওয়ান ছাড়া আর কেউ পক্ষীর সাথে একটু হলেও ভালো আচারণ করে তা হলো প্রিয়া। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর তো বাচ্চা মেয়েটির গলায় ত্রিশ বছরের এক লোকের সংসারের দায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিল গোটা পরিবার, ভাগ্যের দোষে সে সময়ে আসলাম দেওয়ানও ছিল না। সুযোগ বুঝে মেয়েকে নিজের কাছে তথা ঢাকা পালিয়ে আনায় পড়াটা চালিয়ে যেতে পেরেছে।
নিজের অহেতুক ভাবনার মাঝেই মার গলা ভেসে আসে ফোন থেকে।
“হ্যালো! প্রিয়ু, শুনছিস…?”
“হুম, মা।”
প্রিয়ার মা আঞ্জুমান বেশ রেগে বলেন,
“তোর কি বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না! বিয়ের আসর থেকে ড্রাইভারের সাথে ঢাকা চলে গেছিস, একবার বলে যাবি তো!”
“সরি মা, ভিপি ম্যাম কল করেছিল তাই আর কী! বাদ দাও, আম ঠিক আছি।”
অতঃপর আঞ্জুমান বেশ খুশিমনেই বলেন
“শোন তোর জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড আর চেহেরা সবদিক দিয়েই মাশা আল্লাহ!”
শান্ত গলাতেই প্রিয়া বিপরীতে মা বলে,
“মা, তুমি তো জানোই তাহলে কেন…”
আঞ্জুমান শেখের রাগের অগ্নিকুণ্ড এবার যেন ফেটে পড়ার উপক্রম।
“তুই কি আমাদের শান্তি দিবি না। সময় নিতে নিতে যে আধবুড়ি হয়ে যাচ্ছিস খবর আছে? টাউনের লোকজন আমাদের আড়ালে হাসাহাসি কানাঘুষা করে যে তোর নাকি কোথাও অবৈধ সম্পর্ক আছে কিংবা চরিত্রে সমস্যা… তোর বাবা লজ্জায় বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। কী যে এমন পাপ করেছি আগে যে আল্লাহ এমন মেয়ের মুখ দেখালো! যার কাছে বাপ-মা মরলেও কিছু না!”
অতঃপর কলটা ডিসকানেক্ট করে দেওয়ার নোটিফিকেশন টোন শুনতে পেল প্রিয়া। এত পেরেশানিতেও মুখে আলতো হাসি ফুটে উঠলো প্রিয়ার। বিড়বিড় করে বলল,
“দেখেছিস তো পক্ষী, এই প্রেমে ডুবে কত নাকানিচুবানি আর কত অসহ্য কষ্ট ও অপমান সহ্য করেছি। আজকের নয় এই অপেক্ষা, চারটা বছরে এমন কতশত ঝড় পেরিয়ে নিজের ভালোবাসাকে আগলে রেখেছি। যেই মা কোনোদিন জোর গলায় কথা বলেনি তার মাইর, যেই বাবা কোনোদিন মা ছাড়া কথা বলেনি তার তিরস্কার সবই সয়েছি। এত কষ্টের ভালোবাসা অন্যকাউকে দেওয়ার মতো নয়। বরং, একান্তই নিজের করে রাখার মতো।”
চলবে…
সবাই রেসপন্স করুন, নাহলে লিখতে ভালো লাগে না।