মেঘভাঙা রৌদ্র পর্ব ৪

#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব- ৪
#লিখা:#Nilufar_Yasmin

সেদিন বাসায় ফিরে রাতে যখন পড়ার টেবিলে বসেছি, ও ফোন দিয়েছে-

– নীলা,
– জ্বি-
– একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি-
– কি কথা!
– আপনি হাসলে কিন্তু আপনাকে অদ্ভুৎ সুন্দর দেখায়!
– কিভাবে বুঝলেন! আপনি তো আমাকে দেখেননি!
– হুম্মম তা দেখিনি, তবে চোখ তো দেখেছি; আর তাতেই মনে হয়েছে।
– চোখ দেখে বুঝি বুঝা যায়? এই প্রথম শুনলাম!
– অন্য কেউ বুঝে না বলে যে আমিও বুঝবো না তাতো নয়! আপনি হয়তো জানেন না- মানুষ যখন হাসে তখন তার পুরো লাবণ্য তার চোখের মাঝে ফুটে উঠে।
– ধুরো কি যে বলেন! এটা হয় নাকি আবার!
– বাঙ্গালীর এই এক সমস্যা….
– কি রকম?
– এই যে সত্যি বললেও ভাবে মিথ্যে বলছি…!
– হুম বুঝলাম, কিন্তু যা সত্যি নয় তা যদি কেউ বলে, তখন কেমন লাগে?
– সত্যি নয় কে বলেছে?
– কে আবার; আমি। কারণ, কাউকে পুরোটা না জেনে, না দেখে বলতে নেই। হতে তো পারে আমার চোখের সাথে মুখের সাদৃশ্য নেই?
– তা পারে, তবে এইক্ষেত্রে হয়তো আমিই ঠিক- হয়তো আছে।
– আপনার সাথে কথায় পারবোনা। তার চেয়ে এখন ফোন রাখি।

বলেই আমি ফোন টা কেটে দিলাম। কারণ, কথা বলার সময় একটা জিনিস বেশ বুঝছিলাম, ও যখন কথা বলছিলো- মনের ভিতর অদ্ভুৎ এক ভালোলাগা কাজ করছিলো, যেটা কে হয়তো আর কিছুক্ষণ কথা বললে দমিয়ে রাখা সম্ভব হতোনা। আমার যে বরাবরই প্রকাশ করতে ভয়। আমি চাইনা ও আমাকে বুঝে ফেলুক।

সময় গড়িয়ে যায়, দেখা না হলেও প্রায় অয়ন ফোন করতো। বিশেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সারাদিনের রাজ্যের যত গল্প কাহিনি ওর আমাকে বলাই চায়। বেশিরভাগ সময় আমি চুপচাপ শুনতাম। যদিও মুখে কোনদিন বলা হয়নি যে আমরা একজন অন্যজনের কেউ হই তবুও মনে মনে বুঝতাম হয়তো বন্ধু কিংবা বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু! নইলে হয়তো এতটা আন্তরিক ভাবে কথা বলা সম্ভব হতোনা।

আর এইভাবেই দু’জনের অজান্তে কখন যে একটা অদৃশ্য বন্ধন গড়ে উঠলো, টের ই পেলাম না! বুঝলাম তখন, যখন ওর প্রতিটা কথা, হাসির শব্দ, ফান ছেলেমানুষি, কিংবা দুষ্টুমি সবকিছুই আমার ভালো লাগতে শুরু করলো!

কিন্তু এরপর ই আমার খেয়াল হলো- যা হচ্ছে হয়তো ঠিক হচ্ছেনা। কারণ, এইভাবে কথা বলতে বলতে যদি বেশি হয়ে দূর্বল হয়ে পড়ি তাতে কারর জন্যই ভালো হবেনা। কারণ, আমার ফ্যামিলি কনজার্ভেটিভ তারা যদি এই সম্পর্ক না চায়, আমি কখনই তাদের ইচ্ছের বাইরে কিছু করতে পারবোনা। তাছাড়া আব্বু মারা যাবার পর আম্মু অনেক কষ্টে আমাকে মানুষ করছে। আমি কোনভাবেই চাইনা, আম্মু কষ্ট পাক। আর এটাও তো ঠিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা, বিয়ের আগের এই সম্পর্ককে কখনই স্বীকৃত দেয় না। তাই সবদিক ভেবে ঠিক করলাম, নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ঠিক হবে। কারণ, এখনো সময় আছে, নিজেকে শুধরে নেবার। কিন্তু এরবেশি আগালে হয়তো তখন সম্ভব হবে না। আর হলেও সেটা কষ্টের হবে, যেটা আমি চাইনা। আর আমি এড়িয়ে চললে অয়ন ও একসময় ঠিক ভুলে যাবে।

সেদিনের পর আমি কথা বলা কমিয়ে দেই। অয়ন ফোন দিলে এটা সেটা বলে এড়িয়ে যাই। কিন্তু বুঝতে পারি ও কষ্ট পাচ্ছে। আমিও যে একেবারেই পাচ্ছিনা তা নয়। তবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত রাখি।

এর কয়দিন পরে কলেজে ঢুকতে যাবো, পেছন থেকে কেউ ডাকে, চেনা কন্ঠ, পিছনে ফিরতেই অয়ন!

– আপনি এইখানে?!
– হ্যাঁ, আসতে হলো-
– কোন দরকারে এসেছেন?
– হুম্মম, দরকারেই, আপনার সাথে দরকার।
– আমার সাথে!
– হুম্ম, আমার কিছু জানার আছে, বলার ও আছে, আর সেটা দেখা না করলে সম্ভব হতোনা।
– ওহ!
– রাগ করলেন?
– নাহ বলুন কি বলতে চান।
– তার আগে একটু বসি কোথাও। এইভাবে অনেকেই তাকাচ্ছে, এটা খারাপ দেখায়।
-আচ্ছা, ক্যানটিনে চলুন, তবে বেশি সময় হবেনা, আমার ক্লাস শুরুর বেশি সময় নেই।
– ঠিক আছে, বেশি সময় নিবো না।

ক্যানটিনে বসার পর দুইজনেই চুপচাপ বসে আছি, এ অবস্থায় অয়ন-ই প্রথমে বলে উঠে-

– কি হইছে বলুন-
– মানে!
– আপনি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?
– কই?
– আপনি জানেন না?
– দেখুন, সব সময় যে ফ্রি থাকি তা তো নয়, সামনে মিড টার্ম, পরীক্ষা সেই নিয়ে ব্যস্ত। তাই এড়িয়ে যাচ্ছি এটা ঠিক নয়।
– দেখুন, আমাকে বুঝাবেন না। আমি বুঝি।

আমি এ-র কোন উত্তর দিতে পারিনা। নিচের দিকে মুখ করে নেই-

– নীলা, আমি কিছু জিজ্ঞাসা করছি।
– দেখুন আমি যখন ছোট আব্বু মারা যান, তখন থেকে আম্মু আমাকে একায় মামাদের আশ্রয়ে থেকে মানুষ করেছে। আমি চাইনা আমার আম্মু কোন কারণে কষ্ট পান। উনি কোন ভাবে যদি বুঝেন আমি আপনার সাথে লুকিয়ে কথা বলি, বা এটা পাঁচ কান হয় মামা কিংবা আম্মু কষ্ট পাবে। আমি চাইনা সেটা হোক। ভবিষ্যতে র কথা ভেবেই…
– ভবিষ্যতের কথা ভেবেই, নিজেকে আড়াল করতে চাইছেন তাইতো? কিন্তু একটা প্রশ্ন করি, আপনি কি আমার সাথে কথা না বলে ভালো আছেন?
– সেটা নিয়ে ভাবছিনা। আমার কাছে পরিবার আগে।
– কিন্তু কথা বললে ক্ষতিটা কি!
– না বললেই বা ক্ষতিটা কি?
– ক্ষতি আছে, কারণ…
– কি কারণ?
– আপনি বুঝেন না?
– নাহ, আর বুঝতে চাইও না। আপনার আর কিছু বলার আছে? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, ক্লাসে যাবো।
– হুম্ম, ঠিক আছে, রাতে ফোন দিলে রিসিভ করবেন, অন্তত আজকের দিনটা? প্লিজ..
– ভেবে দেখবো।

সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পর বুকের ভেতর তোলপাড় করা শুরু করলো। একটায় ভয়, অয়ন ফোন দিয়ে কি বলবে! কিন্তু রাত ১১ টা পার হলেও ও ফোন করেনা। আমি পড়ায় মন দেই, যদিও মন বসছেনা তবুও। ১২ টার পর পড়া শেষ করে ঘুমাতে যাবো অমনি অয়নের ফোন!

– নিশ্চয়ই পড়া শেষ?
– হ্যাঁ,
– এইজন্যই এতক্ষণ ফোন দেইনি নইলে তো বলবেন আমি আপনার পড়ার ডিস্টার্ব করছি।
– হুম্ম বুঝলাম। তো নিজের বুঝি পড়াশোনা নেই?
– আরেহ, আমার আবার পড়া লাগে নাকি!
– মানে?
– আমি এমনিতেই পাস করে যাবো; চিন্তা নেই।
– নাহ চিন্তা করিনিতো, বললাম আর কি।
– নীলা,
– হুম্মম,
– আপনি কি জানেন? আমি আপনাকে কতটা পছন্দ করি?

আমি উত্তর না দিয়ে চুপ থাকি।

– নীলা, আমি একটা কথা বলেছি।
– হ্যাঁ শুনলাম তো।
– আপনার কিছু বলার নেই?
– নাহ নেই। কারণ বলতে গেলে যে সাহস লাগে ওইটা আমার নেই। বলেছি না? আমার ফ্যমিলি খুব কনজার্ভেটিভ? আমাদের ফ্যামিলির মেয়েরা নিজেদের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। পরিবার যা বলে, যা করে সেটাই চুড়ান্ত।
– সেই জন্যই তো আপনাকে আমার ভাল লেগেছে। সত্যি বলতে জীবন সঙ্গী হিসাবে এমন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েই আমার পছন্দ। আপনি শুধু আপনার মতামত টা দিন। বাকিটা আমি আপনার পরিবারের সাথে বলে নিবো।
– কি বলবেন!
– বলবো যে, আপনাদের মেয়েকে আমার খুব পছন্দ। আর ছেলে হিসাবে আমি অতটা খারাপ নই, সুতরাং উনাদের অপছন্দ হবেনা।
– এটা একটু বেশি ভাবা হয়ে গেলোনা?
– মানে?
– হ্যাঁ, যাকে বলে ওভার কনফিডেন্স?
– আমি বলছিনা আমি খুব আহা মরি কিছু৷ তবে একেবারেই যে অকরমুন্য তাও তো নই, তাই এটুকু বিশ্বাস নিজের উপরে আছে, আমি শুধু আপনার মতামত টুকু জানতে চাই। তারপর সময় মত ঠিক আপনার পরিবারে আমার পরিবার যাবে।
– আচ্ছা ভেবে জানাবো।
– আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকবো,
– অতটা অপেক্ষা করবেন না…
– কেন!
– সব সময় সব অপেক্ষার পরিনতি ভালো হবে তাও তো নয়, যাইহোক, এখন রাখছি।

বলেই আমি ফোন কেটে ফোনের সুইচ অফ করে দেই। কারণ আমি চাইনা অয়ন যখন তখন ফোন দিয়ে আমাকে বিব্রত করুক।

কিন্তু এরপর কিভাবে যেন ও বাসার ল্যান্ডলাইনের নং জেনে যায়!

পরেরদিন রাত ১২ টার পর ল্যান্ডলাইনে ফোন বাজতেই আমি দৌড়ে যাই; কারণ, ড্রইংরুমের পাশের রুমটা আমার, তাই সবার আগে আমিই শুনতে পেয়েছি। যদিও অত রাতে কারর ই জেগে থাকার কথা নয়। তাই জরুরী ফোন ভেবে ধরতেই দেখি অয়ন!

– নীলা আমি অয়ন, প্লিজ ফোন টা রাখবেন না। আমি ২ মিনিটেই রেখে দিবো।
– কিন্তু আপনি এই নং পেলেন কিভাবে?
– পেয়েছি,
– কিভাবে সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি,
– আপনি একদিন ফোন দিয়েছিলেন এই নং থেকে, আমি সেইভ রেখেছিলাম।
– ওহ বুঝলাম। কিন্তু এতরাতে ফোন দেয়াটা কি ঠিক? বিশেষ করে বাড়ির ল্যান্ড লাইনে? আমি না ধরে যদি অন্য কেউ ধরতো?
– সরি, কি করতাম আপনার নং অফ দেখাচ্ছিলো তাই দিতে বাধ্য হলাম, তার জন্য আগাম সরি।
– তবুও এটা ঠিক হয়নি। ভাগ্যিস আমিই ধরেছি।
– অন্য কেউ ধরলে কেটে দিতাম, এতটা নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই যাইহোক, আমি আমার উত্তর টুকু জানতে চাই।
– যদি বলি আমি চাইনা এই সম্পর্ক?
– যদি নয়, আমি ক্লিয়ারেন্স চাই।
– আমি জানিনা… প্লিজ আমি আপাতত এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইনা।

বলেই আমি ফোন রেখে দেই। ফোন মুখের উপরে রেখে দেওয়ায় হয়তো অয়ন আমাকে অনেককিছু ভাবছে। তবুও আমি নিরুপায়।

কিন্তু এরপর অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটলো, প্রায় এক সপ্তাহ অয়নের সাথে কথা হয়না। কিন্তু অয়নের চিন্তা মন থেকে এক সেকেন্ডের জন্যেও যাইনি। মনের ভিতরে কোথাও যেন একটা খচখচানি হতেই থাকে। অথচ আমি চাইনা সেটা হোক। কিন্তু মন যদি অবাধ্য হতে চায়, আমার কি সাধ্যি তাকে ফেরাতে পারি! কিন্তু এরপর আরো বেশিই আশ্চর্য হইলাম যখন ও আমার সাথে আর কোন রকম যোগাযোগের চেষ্টা করলো না। অথচ আমি চাইছিলাম ও আমার সাথে কথা বলুক, আমার খবর নিক, আমি কেমন আছি জানতে চাক। কিন্তু না তার কিছুই হলোনা। হয়তো আমার ই দেয়া বারবার আঘাতে ও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। নেয়াটাই স্বাভাবিক, দোষ ও দেয়া যায়না। কিন্তু তাই বলে এইভাবে ভুলে যাবে! এই ভালোবাসে আমাকে! এই জন্যই হয়তো বলে, চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়। যেই দেখলো আমি আড়াল হয়েছি অমনি ভালোবাসা হারিয়ে গেলো! আমি না হয় মায়ের কথা, পরিবারের কথা, কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনের কথা ভেবে ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছি, তাই বলে ও আমাকে ভুলে যাবে! ঠিক আছে, তবে তাই হোউক, আমিও ওর কাছে আগে যাবো না, যদি আসার হয় ওকেই আসতে হবে…!

অয়নের সাথে প্রায় পনেরো দিন হতে চললো দেখা বা কথা নেই। ওর ইউনিভার্সিটি আমার কলেজ থেকে খুব বেশি দূর নয়। অন্য সময় হলে ও কলেজে আসতো দেখা করতে। এসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে হাটছি। হঠাত একজন ছেলে পিছু ফিরে ডাকলো-

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here