মেঘভাঙা রৌদ্র পর্ব ৩

#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব- ৩
#লিখা: #Nilufar_Yasmin

বছর তিনেক আগের কথা, অন্যান্য দিনের মত সেদিনও কলেজ থেকে বাসায় ফিরছি। দিনটা মেঘলা ছিলো, তাই হঠাত করেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। এদিকে ছাতাও নিয়ে বের হইনি। কলেজ থেকে বাসা অনেকটা দূরে হওয়ায় রিকশা নিলাম না কারণ রিকশায় এতদূর গেলে নির্ঘাত ভিজে যাবো, আর অটোতে একা উঠতে বরাবরই আমি ভয় পাই। তারচেয়ে বাসে যাওয়ায় ভালো হবে।

অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে আছি, যদি বাস পাই; উঠে যাবো। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। এদিকে বৃষ্টির কারণে রাস্তায় দু’একটা রিকশা কিংবা অটো ছাড়া মানুষজন তেমন নেই বললেই চলে। কেমন যেন গা ছমছম ব্যাপার। কি করবো ভেবে পাইনা! নিজেকে যতটা সম্ভব বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি, যদিও বোরখা এবং হিজাবের অনেকটায় ভিজে গেছে। কিন্তু হাতে কলেজের ব্যাগ, ওইটাকে সামনের দিকে ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছি না ভেজানোর। সাধারণত আমি সময়ের ভিতরে বাসায় ফেরার চেষ্টা করি, কারণ দেরি হলে আম্মু চিন্তা করে। সময় গড়াচ্ছে, দুশ্চিন্তা ও বাড়ছে- এরই মধ্যে আবারও আকাশ ঘনকাল মেঘে ছেয়ে গেছে। রিকশা নিবো কিনা ভাবতেই একটা বাস সামনে এসে দাঁড়ালো, কিন্তু যা দেখলাম তাতে সীট পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ! প্যাসেঞ্জার উঠানামা শেষে দেখলাম বাস টা এগিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় বাসের হেল্পার ডাক দিলেন,

– ‘আপু গেলে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েন, আকাশের অবস্থা ভালো না। যেকোন সময় তুমুল বৃষ্টি নামবে।’

উনার কথায় অবস্থা বিপরীত দেখে উঠে পড়লাম। এদিকে উঠে দেখি বাসের ভেতরে সিট ফাঁকা নেই, তাছাড়া বৃষ্টির জন্য বাসে বেশ ভিড়। কি করবো ভাবতে পারছিনা। এত লোকজনের মাঝে দাঁড়িয়ে কিভাবে যাবো! একটা মেয়ের হয়তো এই জায়গাগুলোতেই পরাধীনতা। কারণ একটা ছেলে যেভাবে সবার মাঝে যাতায়াত করতে পারে একটা মেয়ে সেভাবে পারেনা। আর পারলেও তাকে হাজার রকমের সমস্যা ফেইস করতে হয়।

জড়সড় হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছি, যতটা সম্ভব সবার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছি। আল্লাহ কে ডাকছি যেন নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাতে পারি, এমন সময় সামনের সিটে বসে থাকা একটা ছেলে বললো-

– ‘আপনি চাইলে এইখানে বসতে পারেন’।

উনার পাশের সীট টা তখন ফাঁকা, ছেলের পাশে সীট, বসবো কিনা ইতস্তত বোধ করছি, এদিকে মহিলা সীটে জায়গা ফাঁকা নেই। ছেলেটি কি বুঝলো জানিনা- খানিকটা সরে গিয়ে বললো, বসুন। প্রথমে না করলেও উনার কথায় বসলাম। লোকাল বাস মাঝে মাঝে লোকজন বাড়ে কমে, আমি আড়ষ্টতা নিয়ে সীটের এক পাশে বসে আছি। এরইমধ্যে বাস বাসার কাছাকাছি এসে পড়লে, হেল্পার কে বলে বাসার সামনের বড় রাস্তাটায় নেমে যাই। বাড়ি ফেরার তাড়ায় তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে ছেলেটিকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে যাই।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় একটা অপরিচিত নং থেকে কল আসলে খানিকটা চমকে যাই! কার নং হতে পারে ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে যায়। কিন্তু কাটার পর আবারো রিং বাজে! এবার কিছু জড়তা নিয়ে কল টা রিসিভ করলে, ওপাশ থেকে একজন পুরুষ কন্ঠ সালাম দেয়! আমি সালামের উত্তর দিলে, উনি বলেন-

– আসলে আপনি আমাকে চিনবেন না। চেনার কথাও না। কিন্তু আপনার একটা জিনিস আমার কাছে থাকায় ফোন দিতে হলো।

– কিন্তু আপনি আমার নং জানলেন কিভাবে! অপরিচিত কেউ তো আমার নং জানেনা!

– নং টা আপনার পার্স ব্যাগের ভিতরে ছিলো।

– আমার পার্স ব্যাগ! কি বলছেন? আমার পার্স তো আমার ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতরেই আছে।

– উঁহু ভাল করে দেখুন, আপনার ব্যাগে নেই। বাসের সীটে ছেড়ে গেছেন।

– কি বলছেন!

– হ্যাঁ,

– ওহ! তাহলে হেল্পার কে টাকা দেয়ার পর হয়তো তাড়াহুড়োয় ব্যাগে ঢোকাতে ভুলে গেছি।

– হ্যাঁ ওইটা আপনার সীটেই ছিলো, আপনি নেমে যাওয়ার পর আমার চোখে পড়ে- কিন্তু ততক্ষণে বাস ছেড়ে গেছে। তাই অগত্যা আমাকেই নিয়ে আসতে হয়েছে। কারণ অন্য কেউ যদি আপনাকে ফেরত না দেয়।

– ইশ আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো। সত্যি ওইটা আমার জন্য অনেক মূল্যবান।

– হুম্মম পথেঘাটে এইভাবে মুল্যবান জিনিসপত্র যদি ভুলে ফেলে যান তাহলে তো মুসকিল! কারণ সব সময় যে আমার মত কারর হাতে পড়বে তাও তো না!

– দুঃখিত। সত্যি বলতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল আর আম্মু চিন্তা করবে ভেবেই- তাড়াহুড়োয় নেমে পড়েছিলাম।

– চিন্তা করবেন না- আপনার ব্যাগে আমি হাত দিতাম না, শুধুমাত্র আপনার ঠিকানা জানার জন্যই দিতে হয়েছে। তবুও ভাগ্য ভাল যে আপনার নং টা ছিলো নইলে মুস্কিল হতো।

– আসলে নং রাখিনা, একদিন একটা দরকারে রেখেছিলাম, কপাল ভাল যে রেখেছিলাম!

– জ্বি- আপাতত আপনার কপাল ভালই, তো বলুন কোথায় পৌঁছাইতে হবে।

– কলেজে দিলেই ভালো হয়, আমি কাল সকালে কলেজ যাবো, আপনি যদি একটু কষ্ট করে সেখানেই আসেন..তো ভাল হয়।

– জিনিস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি যখন দিয়েছি যেতে তো হবেই। যাইহোক- কলেজের নাম টা বলুন।

আমি কলেজের ঠিকানা দিয়ে ফোন কেটে দিলাম,

পরেরদিন সকালে কলেজ যাওয়ার পর উনি আমার নং এ ফোন দেন, আমি কলেজের ক্যানটিনে আসতে বলে অপেক্ষা করতে থাকি, এমন সময় উনি এসেই বলেন-

– বসবো?

আমি কিছুটা চমকে যাই-

– হ্যাঁ শিওর, দাঁড়িয়ে কেন; বসুন প্লিজ। তাছাড়া আপনার জন্যই তো বসে আছি।

উনি সামনের চেয়ার টা টেনে বসতে বসতে বললেন –

– আপনার কলেজ টা আগে থেকেই চিনতাম। তবে কখনো আসা হয়নি। কিন্তু আপনার বাসা থেকে কলেজ টা বেশ খানিকটা দূর, এতদুরে ভর্তি হলেন কেন! চাইলে তো বাসার কাছাকাছি হতে পারতেন!

– আসলে এই কলেজের পড়ার মান ভালো যেটা আমাদের কলেজে নেই। তাছাড়া এই কলেজের টিচার মামার বন্ধু, উনিই বলেছিলেন মামাকে, সেইজন্যই আর কি।

– ওহ আচ্ছা, কথা হচ্ছে- এরপর একটু সামলে চলবেন। নইলে দেখবেন, একদিন নিজেই হারিয়ে বসে আছেন।

– হারিয়ে গেলে সমস্যা কি?

– মানে?

– না মানে এখনো সমাজ টা তো পুরোটা বখে যায়নি, কিছু ভালো লোক আছে, এই যে, এই সুযোগে তেমন ই একজনকে দেখার সুযোগ হলো!

– এটা কিন্তু ভুল।

– কোনটা?

– এই যে আমি ভালো..

– তা নয়তো কি?

– শুধুমাত্র একটা ব্যাপারে ভালো খারাপ বিচার হয়না।

– তবুও টুকরো টুকরো গুণ গুলো জমা হয়েই একদিন পাহাড় তৈরি হয় বুঝেছেন?

– আচ্ছা বুঝলাম, তো- আজ তাহলে উঠি। আমার একটু তাড়া আছে।

– তা কি করে হয়! এতদূর থেকে এসে উপকার করলেন, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যান।

– উঁহু আজকে সম্ভব না।

– কেন! বেশি সময় নিবোনা, মাত্র এক কাপ চা, ও-ই দুই মিনিটেই হয়ে যাবে।

– না না- আজকে না বরং অন্য একদিন খাবো।

– সে না হয় বুঝলাম- কিন্তু আপনাকে পাবো কিভাবে! তারজন্য কি আবারো পার্স হারাতে হবে?

– হা হা হা- না না তার দরকার হবেনা। আপনি শুধু একবার ডাকবেন, দেখবেন চলে আসবো। তাছাড়া আমার ভার্সিটি তো এইখান থেকে বেশি দূর না। ধরে নেন না আরও একদিন দেখা করার সুযোগ টুকু করে রাখলাম?

– জ্বি! ঠিক বুঝলাম না।

– নাহ কিছুনা। বলছি আজকে উঠি। আমার ফোন নং তো রইলো ই। কখনো দরকার হলে বলবেন, এইটুকু বন্ধু ভাবতেই পারেন। আর যাইহোক আপনার ক্ষতির কারণ হবোনা।

– সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু এত কথায় আপনার নামটায় তো জানা হলোনা!

– বলার সুযোগ হলো কই! আমি অয়ন, এবার ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল ইয়ারে আছি।

– ওহ, আচ্ছা,

– আপনার ডাক নাম নীলা তাই তো? ফোন নং এ নাম লিখা ছিল।

– জ্বি- নীহারিকা নীলিমা, সবাই নীলা বলেই ডাকে।

– মিষ্টি নাম। আচ্ছা, মিস নীলা আজ তবে আসি।

– জ্বি-

ও যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই আমি বললাম-

– মি. অয়ন-

– হ্যাঁ…! কিছু বলবেন?

– আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, এতটা উপকার করার জন্য.. সত্যিই সেদিন আপনি না হয়ে অন্য কেউ হলে….

– থাক- আর কৃতজ্ঞতা দেখাতে হবেনা। মানুষ হিসাবে একটুকু আমার ডিউটি। আচ্ছা, আসি, ভাল থাকবেন।

বলেই ও গটগট করে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি অনেকক্ষণ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম, তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঠোঁটের কোণে কখন যে হাসি ফুটে উঠেছে বুঝিনি!

এরপর বেশ কিছুদিন চলে যায়। অয়ন নাম টা প্রায় ভুলতেই বসেছি। হঠাত একদিন পড়ার টেবিলে বসে আছি- দেখি একটা ফোন আসে আমার ফোনে।

– বাব্বাহ! এইভাবে ভুলে গেলেন!
– জ্বি!
– হ্যাঁ এখন নিশ্চয়ই নাম টাও ভুলে গেছেন?

আমি ততক্ষণে বুঝে যাই- এই অয়ন। আসলে খেয়ালে ছিলোনা তা নয়, তবে কি ভাববে, ভেবেই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি। ও আমার উপরকার করেছে। এটুকুই তো পরিচয়ের সূত্র তারজন্য কাউকে বারবার ফোন দেয়া, খবর নেয়াটা সমীচীন দেখায় না, অবশ্যই সেটা দৃষ্টি কটু। যাই হোক, সেটা কে গোপন করে বললাম-

– দেখুন, ভুলে গেছি বললে ভুল হবে, আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই আর কি…কিন্তু আপনিও তো খবর নেননি!

– তাই বুঝি? আজ তবে কে আগে খবর নিলো?

আমি খানিকটা লজ্জ্যা পেয়ে যাই। চুপ করে আছি দেখে ও আবারো বলে-

– শুনেন, আপনার ঋণ শোধের সময় হয়েছে-

– মানে!

– আরেহ বুঝলেন না? সেদিনের সেই চা যে ডিউ রয়েছে সেটার কথায় বলছি, আগামীকাল কলেজ আসছেন তো?

– হ্যাঁ তাতো যাবই।

– তাহলেই হবে, শুনুন, আমি আগামীকাল একটা কাজে ওইদিকে যাবো ভাবছি আপনার সাথে দেখা করবো, কি বলেন, অসুবিধা হবে?

আমি নরমালি কারর সাথে এইভাবে দেখা করা খাওয়াদাওয়া করিনা। কিন্তু ওর টা কিভাবে না করি, না বললে হয়তো ভাব্বে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, আর কি দরকার! তাই কিছুটা ভেবে বললাম-

– আচ্ছা আসুন, কাল আমার প্রথম পিরিয়ড ১০ টার পরে শুরু, আপনি ৯ টার দিকে আসুন।

– কিন্তু আপনার অসুবিধা হলে কিন্তু দরকার নেই।

– এমা, না না, এটা কি কথা, অসুবিধা আবার কেন! আপনি আসুন, অসুবিধা নেই।

তারপর ওর সাথে দেখা হবার পর সত্যি সত্যিই আমরা দুইজন কলেজ ক্যানটিনে চা খাই। কিন্তু কেন জানিনা, ও বারবার আমার দিকে আড়চোখে দেখছিলো, আমি লজ্জ্যায় অন্যদিকে মুখ করে নিচ্ছিলাম। কথা এবং আপ্যায়ন শেষে ও চলে গেলো, সেদিন বাসায় ফিরে রাতে যখন পড়ার টেবিলে বসেছি, ও ফোন দিয়েছে-

– নীলা,
– জ্বি-
– একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি-
– কি কথা!

#চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here