মেঘের পরে মেঘ-২১-২২
“তুমি এসব কি বলছো সাবরিনা?এটা কোন ভাবেই সম্ভব না।আমাদের বাড়ির ভাড়াটিয়ার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে এটা কি করে সম্ভব, বলো তো?”
শফিক সাহেব রেগেই গেলেন স্ত্রীর কথা শুনে।
“কি সমস্যা এতে?মেয়ে টা সুন্দরী, ওর মা টাও তো কতো ভালো একজন মহিলা।”
“কতো ভালো জানা আছে,যে মহিলা স্বামীর সংসার করতে পারে না সে কতো ভালো বোঝা শেষ। ”
তাচ্ছিল্যের সাথে বললো শফিক।
“তুমি যা জানো না তা নিয়ে কথা বলো না।শায়েরী খুব ভালো একজন মহিলা। স্বামী যদি ওকে ফেলে অন্য কাউকে বিয়ে করে এতে ওর দোষ কোথায়?
আর কোন মেয়েই চাইবেনা সতীনের সংসার করতে।ও যে চলে এসেছে একদম ঠিক করেছে।”
“ভালো হলে কি আর স্বামী অন্য মহিলার কাছে যায়?হুহ্।”
“তুমি এতো রিয়েক্ট করছো কেন?ছেলে তো ওখানে সংসার করতে যাচ্ছে না।ওর মেয়ে আসবে এখানে।একটু গড়ে পিঠে নিলেই হবে।ছেলের যখন এতো পছন্দ, তুমি আর না করো না।”
“তুমি যাই বলো কোন কাজ হবে না।আমি কোন হাভাতে ঘরের মেয়ে কে আমার ছেলের বৌ হিসেবে মেনে নিতে পারবোনা।আর এটাই আমার শেষ কথা।যদি এরপরও কোন কথা আগায় তবে ঔ মহিলাকে আমি চুড়ান্ত অপমান করবো মনে রেখো।কতোবড় সাহস, আমার ছেলের পেছনে মেয়ে কে লেলিয়ে দেয়! তুমি তোমার ছেলেকে সামলাও, নয়তো এর পরিনাম ভালো হবে না একদমই।”
কথাগুলো বলতে বলতেই শফিক সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
______
দুদিন পরের কথা।শায়েরীর ঘরের সামনে সাবরিনা দাঁড়িয়ে আছেন।টোকা পরতেই শায়েরী দরজা খুলে দিলো।
“কেমন আছো শায়েরী?”
“আরে আপা আপনি? আসুন, আসুন,ভেতরে আসুন।”
সাবরিনা ধীরে সুস্থে ঘরে ঢুকলো।শায়েরীর উৎফুল্লতা ওনাকে স্পর্শ করছে না।ওদিকে শায়েরী বলেই চলেছে।
“কতোদিন পর দেখা বলুন তো?একই বাড়িতে থাকি অথচ কতোদিন হলো দেখা হয় না।”
সামনের একটি সোফায় সাবরিনা বসলো।বসলো শায়েরীও।
“আপা, আপনি একটু বসুন,আমি এক কাপ চা করে আনি।”
সাবরিনা বাঁধা দিলেন।
“তুমি বসো শায়েরী।আমি এখন চা খাবো না।তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। ”
“কি কথা আপা?বলুন না।”
“রুপসা কোথায়?”
“ও তো কলেজে।পরীক্ষা চলছে।কেন আপা?কোন সমস্যা? ”
“কিভাবে যে বলি?”
সাবরিনা ইতস্তত করতে লাগলেন।
“বলুন না আপা।একদম সংকোচ করবেন না।”
“বলি তাহলে?”
“অবশ্যই।”
“আসলে হয়েছে কি,প্রলয় রুপসা কে ভীষণ পছন্দ করে।ওকে বিয়ে করতে চায়।আমারও কোন আপত্তি নেই।তুমি তো জানো আমি রুপসাকে ভীষণ পছন্দ করি।প্রলয় যখন ওর পছন্দের কথা জানালো আমি খুব খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু….. ”
“কিন্তু কি আপা?আমাকে বলুন।”
“সব শুনে প্রলয়ের বাবা খুব রেগে গিয়েছেন।তোমাকে যা নয় তাই বলেছেন।উনার ধারনা তুমি রুপসাকে প্রলয়ের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছো।”
এতটুকু শুনেই শায়েরীর কান ঝাঁঝাঁ করতে লাগলো।এই জীবনে অনেক কটুকথা ওকে শুনতে হয়েছে।তাই বলে এমন অপমানজনক কথা ওকে কেউ বলতে পারে তা ওর ধারণারও বাইরে ছিলো।
ও চুপ থেকে সাবরিনাকে বলার সুযোগ করে দিলো।
“তোমাকে খুব অপমান করতে চেয়েছিলো জানো।আমি অনেক কস্টে থামিয়েছি।প্রলয়কেও বুঝাতে পারছিনা।ওকে বললাম,তুমি এখন রুপসার বিয়ে দেবে না,কিন্তু ও শুনতে নারাজ।এদিকে ওর বাপকেও মানাতে পারছিনা।ওদের বাপ-ছেলের মাঝে পরে আমার অবস্থা বেহাল।এখন তুমিই পারো কিছু একটা উপায় করে প্রলয়কে ফেরাতে।
রুপসাকে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই।ও তো ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু আমার ছেলেকে তো আমি চিনি।ও না কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে।তুমি প্লিজ কিছু করো বোন।আমার সংসার বাঁচাও।”
শায়েরী এবার মুখ খুললো।
“আপা আপনি নিশ্চিতে থাকুন।আমি একটা ব্যবস্থা অবশ্যই করবো।আমার মেয়েকে আমি সম্মানের সাথে বড় করেছি,কোন অপমানের মধ্যে ওকে আমি ফেলবো না।তাছাড়া আমি এমনিতেও এখন ওর বিয়ে দিতাম না।আর কেউ না জানুক আপনি তো জানেন, ওকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। নিজে তো জীবনে অনেক কস্ট করেছি, আমার মেয়েও একই কস্ট করুক আমি তা কখনোই চাই না।”
“আমি সব জানি বোন।আর জানি বলেই তোমাকে কোন অসম্মানের মধ্যে ফেলতে চাই নি।”
দুঃখিত হয়েই কথা গুলো বললেন সাবরিনা।
শায়েরী ভেবেছিলে এ ব্যাপারটা একদমই প্রলয়ের এক তরফা।রুপসার কোন সম্পৃকততা নেই এখানে।কিন্তু ও যে কতো বড় ভুলে ছিলো তা আজ জানতে পেরেছে।
রুপসার কলেজ ব্যাগে একটা মোবাইল পেয়েছে শায়েরী।সেখানে একটাই নম্বর সেইভ করা।আর সেটা প্রলয়ের।মেয়ের মেসেজ পড়া ঠিক হবে না জেনেও ও কিছু মেসেজে চোখ বুলিয়েছে।
আর তাতেই জেনেছে ওদের পরবর্তী পরিকল্পনা।
প্রলয় রুপসাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছে।আর রুপসারও তাতে নিরব সম্মতি আছে।
মেঘের পরে মেঘ-২২
“তো কি খবর?আন্টি ডেকে পাঠিয়েছিল কেন?”
“নুর,আমি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি।আমি রুপসাকে নিয়ে পালাবো না।”
“কেন?এছাড়া সমাধান কি? ওর মা তো রাজিই হচ্ছে না।এদিকে তোর যাওয়ার সময়ও তো ঘনিয়ে এলো।”
“আমি চলে যাবো।কিন্তু পালাবো না।”
“হঠাৎ এ বদলাও কিসের জন্য? রুপসার মায়ের রিকুয়েস্ট করেছে বলে?”
“উনি রিকুয়েষ্ট করেছে এটা তোকে কে বললো?উনি কোন রিকুয়েষ্ট করেন নি।বরং চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে আমার দিকে।”
“কি চ্যালেঞ্জ?”
“বলেছে বিদেশ গেলে নাকি আমার রুপসার প্রতি আগ্রহ কমে যাবে।আমি যেন বিদেশ চলে যাই,বিদেশে গিয়ে চার বছর থাকার পরও যদি মনে হয় আমার রুপসাকে চাই, অর্থাৎ আমার রুপসার প্রতি ভালোবাসা একই পর্যায়ে থাকে তবে উনি রাজি থাকবেন।কিন্তু এর জন্য আমাকে চার বছর অপেক্ষা করতে হবে।এর মধ্যে যদি আমার বা রুপসার মনের কোন পরিবর্তন না হয় তবে এ বিয়ে উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দিবেন।আর উনার ধারনা আমি এতে ঢাহা ফেল করবো।”
“এতো মহা ঝামেলা।”
“অবশ্য আমি এতে উনার কোন দোষ দেখছি না।জীবনে অনেক কস্ট করেছেন।একা একা মেয়ে কে মানুষ করেছেন,তাই উনি অবশ্যই চাইবেন যাতে উনার মেয়ের লাইফটা সিকিউর হয়।উনি রুপসাকে সাবলম্বী করে বিয়ে দিতে চান।”
“তো কি করবি এখন?রুপসাকে বলেছিস এ কথা,?”
“কোন কথা?”
“এই যে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিস।আর তুই ওর মায়ের চ্যালেঞ্জ এক্সসেপ্ট করেছিস।”
“না জানাতে পারিনি।ও আগের পরিকল্পনা টুকুই জানে।ওর কাছে এখন মোবাইল নেই।”
“এখন যদি ও এসে বসে থাকে আর তোকে না পায়?”
“পাবে না কেন?আমি তো ওখানেই অপেক্ষা করবো।শুধু ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠাবো।”
“দেখ।যেটা ভালো হয় কর।”
“রাখি তাহলে।”
বলে লাইনটা কেটে দিলো প্রলয়।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। কতো পরিকল্পনা ছিল অথচ কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সব পাল্টে গেছে।কিন্তু এতে কোন আফসোস নেই প্রলয়ের।বরং একটা ভুল করা থেকে বেঁচে গিয়ে ভালো লাগছে।চোখের সামনে শায়েরী আন্টির কান্নামাখা মুখ টা এখনো চোখে ভাসছে।
নিজেই নিজের মনে রুপসাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“চার বছর কেনো?আমি তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি রুপসা।”
______
ভোর চারটা।সবকিছু আগেই গুছিয়ে নিয়েছে রুপসা।এখন শুধু বেরিয়ে যাওয়ার পালা।প্রলয় গেটের বাইরে ওর জন্য অপেক্ষা করবে।কিছুদুর হাঁটলেই অপেক্ষাকৃত সিএনজি তে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।সেই মতোই সবকিছু পরিকল্পনা করা আছে।
এখন শুধু বেরুনোর পালা।শায়েরী ঘুমিয়ে আছে। রুপসা একবার মায়ের দিকে তাকালো।খুব কস্ট হচ্ছে মা কে ছেড়ে যেতে।কিন্তু প্রলয়কে ছেড়ে বেঁচে থাকাও অসম্ভব। ইস্ যদি মা রাজি হতো,তাহলে আর এই কাজটা করতে হতো না।
নিজের অজান্তেই চোখের পানি বাঁধ ভেঙেছে।
মায়ের দিকে আর তাকালো না রুপসা।ধীর পায়ে হেঁটে রুমের বাইরে আসলে।দরজা খোলার জন্য হাত দিতেই থেমে গেলো রুপসা।
“রুপসা,পালিয়ে যাচ্ছো?”
শায়েরী পেছনে দাঁড়িয়ে। কখন উঠে এসে দাঁড়িয়েছে রুপসা জানে না।ওর হাত কাঁপতে শুরু করলো।কোন রকমে পিছু ফিরলো,
“মা,আমি…..”
আর কোন কথা বলতে পারলো না রুপসা।
“আমি জানি তুমি প্রলয়ের সাথে পালানোর জন্য বেরিয়ে যাচ্ছিলে।থামলে কেন যাও।কি ভেবেছো আমি থামাবো তোমায়?থামাবো না।যাও।”
“মা।”
কাতর কন্ঠে ডেকে উঠলো রুপসা।
“কি?বলো?কি বলতে চাও তুমি?এই পর্যায়ে এসে কি বলার থাকতে তোমার?আর আমিই বা কি শুনতে পারি?তবুও বলি।তোমার কাছ থেকে এ ব্যবহারটা আমি একদমই আশা করিনি রুপসা।দুনিয়ার সব ছেড়ে আমি তোমার দিকে চেয়ে বেঁচেছিলাম।তোমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার যখন তোমার অস্তিত্ব জানতে পেরেছিলাম,তখন অনেকেই এবরসনের কথা বলেছিল।আমি রাজি হইনি।কতো কস্ট করেছি কিন্তু তোমাকে কাছ ছাড়া করিনি। তোমার ভালোর কথা ভেবে কোন কস্ট কে কস্ট মনে করিনি।আর আজ তুমিই কি না সবচেয়ে বড় আঘাতটা আমায় করলে।”
রুপসা এগিয়ে এলো।মাকে ছুঁয়ে দিয়ে কাতর গলায় বললো,
“মা মা মা।শোন মা।একটু শোন।”
“কি শুনবো?এই কাজটা করার আগে একবার আমার কথা ভাবলে না?কি করে পারলে রুপসা?”
“আমি সরি মা।খুব সরি।কিন্তু কি করবো?প্রলয়কে যে আমি অনেক ভালোবাসি মা।তুমি রাজি হচ্ছিলে না ওদিকে ও চলে যাবে।আমি কি করবো মা?ওকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো?”
“আমি রাজি না সেটা শুনলে।কেন রাজি না সেটা কি একবারও জিজ্ঞেস করেছিলে?করোনি।”
আরে তুমি কি জানো,প্রলয়ের বাবা কি বলেছে তোমার আমার নামে?জানো না।নুন্যতম সম্মানবোধ থাকলে কোন মানুষই এ বিয়েতে রাজি হবে না।”
রুপসা থামলো।চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো,
“কি বলেছে উনি?”
“আমি নাকি তোমাকে উনার ছেলের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছি।উনার অর্থ সম্পদ দেখে নাকি আমি লোভে পরেছি।”
“কি বলছো এসব?”
খুব বেশি অবাক হয় রুপসা।এই যদি আসল কথা হয় প্রলয় ওকে কিছু জানালো না কেন?
“কিন্তু প্রলয় যে বললো, তুমি রাজি না।”
“আমি যা জানিয়েছি ও তাই বলেছে।ও এ ব্যাপারটা জানে না।আমি চাই নি বাপ ছেলের মধ্যে কোন সমস্যা হোক।”
“মা আমি সরি।আমি বুঝতে পারিনি।আমায় মাফ করে দাও মা।”
মাকে জড়িয়ে ধরলো রুপসা।একমুহূর্তেই যেন ও কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এসেছে।কাঁদতে কাঁদতে শায়েরীর কাঁধ ভিজিয়ে দিতে লাগলো রুপসা।
“তে এখন তো বুঝতে পেরেছো।এখন কি করবে?প্রলয় নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে?”
চোখের পানি মুছে নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আমি যাবো মা।কিন্তু একটু বিশ্বাস রাখো।আমি যাবো ফিরে আসার জন্য।রুপসাকে পেতে হলে ওকে ওর বাপকে নিয়ে আসতে হবে। ওর বাবা নিজে যেচে যেদিন আমাকে ঘরের বৌ করতে আসবে সেদিনই ওর সাথে আমার বিয়ে হবে।এরজন্য যদি সারাজীবন অপেক্ষা করতে হয়,তো করবো।”
শায়েরী মৃদু হাসলো।আলো আঁধারীতে সে হাসি দেখা গেলো না।কিন্তু জোড়ালো কন্ঠ শোনা গেলো,
“যাও।কথা বলে আসো।”
চলবে…….
মুনিরা মেহজাবিন