মোনালিসা পর্ব ২৬

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৬
মাঝরাত তখন। মোনা ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ মোনা ধড়পরিয়ে উঠে বসে। বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে।‌ ভয়ে মোনা আড়ষ্ট হয়ে আছে। হাত-পা নাড়াতেও ভয় করছে। মোনার পুরো শরীর ঘেমে একাকার। তীব্র একটা ভয় যেন মোনা’কে জড়িয়ে রেখেছে। খাট থেকে নেমে লাইট জ্বালানোর সাহস টুকু হারিয়ে ফেলেছে। হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে। মোনার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে যেন। মোনা সাহস সঞ্চয় করে, খাট থেকে নেমে লাইট জ্বালালো। টেবিলের উপর রাখা এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো। ভয়ে গলা শুকিয়ে মোনা তৃষ্ণার্ত হয়ে গেছে। মোনা ইমরুল চৌধুরী’কে স্বপ্নে দেখেছে। যেভাবে ছুরিঘাতে খুন হয়েছে, ঠিক সেই চেহেরা দেখেছে। গলা বরাবর ছুরির যে ভয়ঙ্কর আঘাত’টা ছিলো সেটাও স্পষ্ট দেখেছে মোনা। মোনার শ্বাস ভয়ে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোনার মনে হচ্ছে ও আশেপাশে তাকালেই দেখবে ইমরুল চৌধুরীর লাশ। মোনা তীক্ষ্ণ চাপা আর্তনাদ করে ওঠে। ইমরুল চৌধুরীর ক্ষত-বিক্ষত লাশ’টা মোনার গলা টিপে ধরেছে। মোনার মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন না, মোনার বাস্তবে দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। মোনা থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফ্লোরে বসে পড়লো। ভয়ে মোনার শরীর অবশ হয়ে আসছে। উদভ্রান্তের মত হয়ে যায় মোনা।মোনা কাঁপা কাঁপা হাতে লিলি বেগমের ফোনে ডায়েল করে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর লিলি বেগম কল রিসিভ করল। এত রাতে মোনা কল দিয়েছে দেখে কিছু’টা আতংকিত হয়। ঘুম জড়ানো চোখে ফোন রিসিভ করল। মোনা তীক্ষ্ণকন্ঠে আর্তনাদের মত বলল,
-“খালা আমায় মেরে ফেলবে,খালা তুমি তাড়াতাড়ি আসো। যেভাবে পারো আসো।”
মোনার গলার আওয়াজ’টা জোরালো না। প্রচন্ড ভীতি মোনায় আড়ষ্ট করে রেখেছে, মোনার গলায় আস্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে যেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙার ফলে লিলি বেগমের মস্তিষ্ক জড়াগ্রস্থ হয়ে রইল যেন। বুঝে উঠতে সময় লাগলো কিছু’টা। সে সময় টুকু পার হওয়ার পর লিলি বেগম দিশেহারা হয়ে গেলো। বিধ্বস্ত গলায় বলল,
-“মোনা কি হয়েছে তোর?কি বলছিস?কে মারবে তোকে?”
মোনা আর কিছু বলতে পারলো না।ভয়ে ভিতর থেকে কথা বের হচ্ছে না। লিলি বেগম প্রচণ্ড ভাবে আঁতকে উঠল, অস্থির হয়ে উঠে। মোনার নম্বরে বার বার ডায়েল করছে, ওপাশ থেকে কল রিসিভ হচ্ছে না।লিলি বেগম দ্রুত বিছানা ছাড়ে, মুহূর্তে’ই মনের ভিতর নানান শঙ্কা জাগে। কেউ মোনার বাসায় গিয়ে মোনা’কে মেরে ফেলছে? লিলি বেগম কিছু ভাবতে পারছে না , চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে যেন।প্রবল ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কোন উপায় না পেয়ে প্রিয়মের রুমে যায়। আতঙ্কগ্রস্ত গলায় প্রিয়ম’কে ডেকে তুলে। এভাবে ঘুম ভাঙানোর ফলে প্রিয়ম হতবিহ্বল হয়ে যায়।‌‌‌‌‌‌‌‌‌ ঘুম ঘুম চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় লিলি বেগমের দিকে। লিলি বেগম শঙ্কিত গলায় বলল,
-“মোনার যেন কি সমস্যা হয়েছে, আমায় একটু ওঁর বাসায় দিয়ে আয়।”
প্রিয়ম চমকে গিয়ে অনার্গল ভাবে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে মোনার?লিলি বেগম উত্তর দিচ্ছে না। চেহারায় স্পষ্ট ভীতি, শঙ্কা, আতঙ্কের ছাপ। পথ যেন ফুরায় না।প্রিয়ম অধৈর্য হয়ে বলল,
-“কি হয়েছে তা তো বলবে?”
লিলি বেগম মন্থর গলায় বলল,
-“জানি না,আগে চল।”
কলিং বেলের শব্দে মোনা প্রাণ ফিরে পায়। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে লিলি বেগমের গায়ে ঢলে পড়ে। নিশান নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে। চারদিক শুনশান। লিলি বেগম কিছুই বুঝে উঠে পারছে না। এ মুহূর্তে লিলি বেগম আর কিছু ভাবছে না, শুধু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মোনা ভালো আছে এই ভেবে। মোনার শরীর শীতল হয়ে গেছে যেন। প্রিয়ম কি হয়েছে কিছুই বুঝতে না পেরে মোনার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এখন কিছু জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া যাবে না,তাই কিছুই জিজ্ঞেস করল না। মোনার নিস্তেজ শরীর’টা লিলি বেগমের বুকে লেপ্টে আছে। লিলি বেগম অস্থির গলায় অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“মোনা কে মারবে তোকে?আমি এসেছি। ভয় পাস না।”
প্রিয়ম লিলি বেগমের পাশে বসে। চারদিকে তাকায়। চারদিকের পরিবেশ খুব স্বাভাবিক। প্রিয়ম লিলি বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মোনা বাজে কোন স্বপ্ন দেখেছে হয়ত। ভয় পেয়েছে ভীষণ। চারদিকের পরিবেশ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।”
লিলি বেগম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মোনার দিকে। মোনা নিস্তেজ, ক্ষীণ গলায় বলল,
-“খালা আমায় মেরে ফেলবে। আমার গলা টিপে ধরেছে। আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এসেছে। কি বিভৎস চেহেরা। নিশান’কে
ও মেরে ফেলবে। প্রতিশোধ নিবে।”
মোনার কথা শুনে ভাঁজ পড়ে লিলি বেগমের কপালে। মোনার কথা বুঝতে পারলো না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বুঝতে পারলো মোনা খারাপ কোন স্বপ্ন দেখেছে। স্বপ্ন দেখে কেউ এত ভয় পায়?লিলি বেগমের কাছে অযৌক্তিক লাগলো। মোনা’কে যতটুকু চিনে তাতে কোন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেও এত’টা ভয় পাওয়ার কথা না। প্রিয়ম হতাশ ভঙ্গিতে তাকালো লিলি বেগমের দিকে। বলল,
-“বুঝতে পেরেছো ও স্বপ্ন দেখেছে?”
মোনার নিস্তেজ হয়ে যাওয়া শরীর’টা খাটে শুইয়ে দিলো। লিলি বেগম প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল। অবচেতন মনে নানান আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। প্রিয়ম’কে বলল,
-“মোনা জব শেষে রাতে বাসায় ফিরে।মোনা খুব স্ট্রং, সাহসী মেয়ে। স্বপ্ন দেখে ও এত ভয় পাবে?”
লিলি বেগম পাশের রুমের দিকে পা বাড়ায়।পানির জগ আনার জন্য। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আসা মোনার মুখের দিকে তাকালো প্রিয়ম। চোখ গুলো বন্ধ, ভয়ের রেশ যেন এখনো কাটে নি। প্রিয়মের ইচ্ছে হলো মোনার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ানোর। কি হবে না হবে ,এসব না ভেবে প্রিয়ম মোনার মুখের দিকে ঝুঁকে কপালে চুমু খায়। মোনা হয়ত সজাগ নয়ত সজাগ না।
লিলি বেগম পানি নিয়ে আসে।লিলি বেগম আসার আগেই প্রিয়ম দূরত্ব রেখে বসেছে মোনার পাশে। লিলি বেগম আহত গলায় বলল,
-“এত রাতে কি পাগলামি করল মেয়ে’টা দেখলি?কত ভয় পেয়েছি।”
লিলি বেগম মোনার পাশে শুয়ে পড়ল।প্রিয়ম পাশের রুমে গিয়ে শুইলো। প্রিয়ম মনে মনে পুলকিত হচ্ছে। কত কাছ থেকে দেখেছে মোনা’কে। কপালে চুমু খেয়েছে। প্রিয়ম কত মেয়ের ঠোঁটে চুমু খেয়েছে কখনো এমন অনুভূতি হয়নি। হৃৎপিণ্ড শীতল হওয়ার মত অনুভূতি। সামন্য কপালে চুমু খাওয়ার মাঝে এত সুখ নিমজ্জিত?
রাত আর খুব বেশি বাকি নেই। লিলি বেগম নামাজের জন্য উঠে। মোনার গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বলে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।এখনো যেন ভয় কাটে’নি।‌ লিলি বেগম মোনার নাম ধরে ডাকছে। কোন সাড়া নেই। লিলি বেগম চমকে যায়। মোনা অচেতন হয়ে আছে। লিলি বেগমের বুকের ভিতর ধ্বক করে হয়ে। স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে ভেবে লিলি বেগম অত’টা ভাবেনি রাতে। কিন্তু এখন মোনার অবস্থা খুব খারাপ মনে হচ্ছে। কি হয়েছে রাতে মোনার সাথে?লিলি বেগম কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। রাতের ন্যায় হন্তদন্ত হয়ে প্রিয়ম’কে ডেকে তুলল। মোনার অবস্থা দেখে প্রিয়মও বিগড়ে যায়। কি হয়েছে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। স্বপ্ন দেখে কেউ এত ভয় পায়? প্রিয়ম মোনা’কে পাঁজাকোলে নিয়ে এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। গাড়ি’তে উঠালো, হসপিটালে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। মোনার নিস্তেজ হওয়া শরীর’টা মোমের পুতুলের ন্যায়। লিলি বেগম দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে। প্রিয়মের মুখ’টাও রক্তশূন্য হয়ে আছে যেন।
দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা ধরে অচেতন হয়ে আছে মোনা। জ্বরের তাপমাত্রা যেনো ক্রমশ বাড়ছে। নিশান বিধ্বস্ত মুখে লিলি বেগমের পাশে বসে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বার বার নিশানের চোখ ভিজে যাচ্ছে। মোনাই একমাত্র আশ্রয়স্থল, একমাত্র ভরসা নিশানের।
মোনার হুঁশ ফিতরে সময় লাগলো বেশ। জ্বর ধীরে ধীরে কমে আসছে। লিলি বেগম বার বার অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করছে,
-“কি হয়েছিল তোর?কি স্বপ্ন দেখেছিস মোনা?”
মোনা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কোন জবাব দিলো না।মোনা’কে বাসায় নেওয়া হলো। প্রিয়ম বার বার লিলি বেগম’কে বলেছিল,
-“আমাদের বাসায় নিয়ে চলো।”
মোনা এই গুরুত্বর অবস্থায়ও তীব্র প্রতিবাদ করলো। লিলি বেগমের বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে মোনার এত বিমুখতা লিলি বেগম’কে ভাবায় মাঝে মাঝে।
মোনা দিনের বেলায়ও যেন ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। বার বার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলে ওঠে,
-“খালা, আমি চোখের উপর শুধু বাবার বিভৎস মুখ দেখি। আমায় বোধ হয় মেরে ফেলবে।”
লিলি বেগম এখন মোনার পাশেই থাকতে হয় সারাক্ষন।লিলি বেগম ভাবে ইমরুল চৌধুরীর খুন হওয়া লাশ দেখে মোনা ভয় পেয়েছিল, সেই ভয় নতুন করে নাড়া দিয়েছে। ভার্সিটি, জব ওসব কিছুই যেন মনে নেই মোনার। মোনা নিস্তেজ অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকে। লিলি বেগম চোখের আড়াল হলেই মোনা চিৎকার দিয়ে উঠে শুধু। মোনা উদভ্রান্তের মত হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোন খেয়াল নেই ওঁর।
কয়েকদিন হয়ে গেলো মোনার অবস্থার তেমন উন্নতি হলো না। প্রিয়ম রাতে বাসায় থাকলেও, দিনে কয়েকবার আসে মোনার বাসায়। মোনার পাশে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মোনার দিকে। কোন রাগ,জিদ, তেজ কিছুই নেই মোনার। মোনার এই অবস্থা প্রিয়ম’কে পীড়া দিচ্ছে ভীষণ ভাবে। হঠাৎ মোনার এই অবস্থা প্রিয়ম মানতে পারছে না। প্রিয়মের বুকের ভিতর ভারী হয়ে আসে বার বার। বুকে সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হয়, বুক চিঁড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
লিলি বেগম ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লো। কিছু সময়ের ব্যবধানে কেমন হয়ে গেলো মোনা। প্রিয়ম বলল,
-“আম্মু মোনার চিকিৎসার জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট দরকার, মোনা মানসিক ভাবে বিপর্যয়গ্রস্থ হয়ে পড়েছে।”
প্রিয়ম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“আচ্ছা খালু খুন হয়েছিল কিভাবে?”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here