তোলপাড় পর্ব ১১

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১১
____________________
অরূণী বের হয়ে যাওয়ার দশ মিনিট পরই রুদ্র বাসায় আসে।অরূণীর আচরণে কিরণ যে হতবাক হয়েছে তার রেশ যেন এখনো কাটেনি। রুদ্র রুমে এসে বলল, “যাবো না আজকে ভার্সিটি’তে।ঘুমে চোখ জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।লম্বা ঘুম দিবো।”
কিরণ হঠাৎ অদ্ভুত এক গলায় ডেকে ওঠল, “দোস্ত।”
কিরণের এমন কণ্ঠস্বর শুনে রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “কী হইলো তোর আবার?”
– “ওই মেয়ে একটু আগে বাসায় এসেছে তোর ফোন নম্বর নিতে।”
রুদ্র যেন ভুল কিছু শুনেছে।ঘাড় ঘুরিয়ে কিরণের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি?মানে?কি বললি?কোন মেয়ে?”
এক সাথে এতগুলো প্রশ্ন করে থামলো রুদ্র। কিরণ রেগে গিয়ে বলল, “কি বলছি শুনিস নাই?ওই মেয়ে আবার এসেছে।তোর ফোন নম্বরের জন্য।যে মেয়ে আরেকদিন এসেছিল।”
রুদ্র প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে বলল, “বাসায় এসেছে?”
– “ওইদিন তো দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলো।আজ একদম রুমে ঢুকে পড়েছে।খাটের ওপর বসেছে।”
রুদ্র ভারি গলায় বলল, “ফাজলামি করিস তুই আমার সাথে? একটা মেয়ে এসে রুমে ঢুকে যাবে?দুইটা ছেলে থাকে সেই রুমে মেয়ে মানুষ আসবে? আর দারোয়ান কাকা কি ছিলো না গেটে?
– “কিসের ফাজলামি? দারোয়ান কাকার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।এবার আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি রেস্টুরেন্টের সেই মেয়েই এই মেয়ে।”
রুদ্র এবার সিরিয়াস হয়ে বলল, “তুই বুঝলি কীভাবে এই মেয়ে সেই মেয়ে?”
– “ওই যে কাঁধ বরাবর চুল,শ্যামলা দেখতে।”
কিরণ একটু থেমে বলল, “তোর ওই সিম অফ বলে বাসায় এসেছে তোর খোঁজে।এটা তুই বুঝিস না? পাঁচ বছরের বাচ্চাও বুঝে এটা।”
রুদ্র কিছু বলার আগেই ওঁর ফোন বেজে ওঠে।ওপাশ থেকে তীব্র অভিমানী গলায় বলল, “এমন কেন আপনি?সিম’টা বদলে ফেললেন।”
রুদ্র তীব্র ভাবে চমকালো।কিরণের কথাই তাহলে সঠিক। রেস্টুরেন্টের এই মেয়েই সেই মেয়ে।এর মানে এই মেয়ে রেস্টুরেন্টের সেই ঘটনা ঘটার আগে থেকেই রুদ্র’কে ফলো করে।এসব ভাবনা চিন্তার মাঝে ওপাশ থেকে আবার বলল, “এত ভাব কীসের আপনার? সেফটিপিন দিয়ে পেট ফুটো করে ভাব বের করে দিবো।”
রুদ্র উত্তরে গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি আমাদের রুমে এসেছো?দুই’টা ছেলে থাকে সেই রুমে কোন সেন্সে এসেছিলা? বাড়াবাড়ির একটা লিমিট আছে!এমন নির্লজ্জ কেন তুমি?সমস্যা কি তোমার?”
এভাবে রুদ্র আগে কখনো কথা বলে নি।অরূণী থমকে গেল। নির্লজ্জ বলল রুদ্র? হঠাৎ যেন কি হয়ে গেল অরূণীর।চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। অরূণী’কে নিরুত্তর দেখে রুদ্র ধমকে বলল, “কি হলো কথা বলছো না কেন?লজ্জা না-কি নারীর অলংকার।তোমার ভিতর তো লজ্জার লেশ মাত্র নেই। হাসি-ঠাট্টা, ফাজলামি প্রতিদিন কেন?কমন সেন্স টুকু নেই?”
অরূণীর বুকে কষ্টের মহাতরঙ্গ বয়ে যেতে লাগলো।কান্নার বেগে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কান্না চাপিয়ে ধরে আসা গলায় বলল, “স্যরি।”
– “প্রতিদিন এক বিষয় নিয়ে হাসি-তামাশা করলে সেটা এক সময় তীব্র বিরক্তকর পর্যায় গিয়ে ঠেকে। সেটা কি তুমি বুঝো?”
চাপিয়ে রাখা কান্না আপন নিয়মে আত্মপ্রকাশ করলো অরূণীর গলায়।
– “আমি কোনো ফাজলামি করি নি। একটা ছেলে যদি একটা মেয়েকে ভালোবাসতে পারে,একটা মেয়ে কেন পারবে না?”
– “অদ্ভুত! কাঁদছো কেন তুমি? ভালোবাসার কি বুঝো তুমি?”
অরূণীর কান্না যেন আরো বেড়ে গেল। রুদ্রের কথা গুলো প্রচণ্ড পীড়া দিচ্ছে। শুধু আস্তে করে অরূণী বলল, “আপনি আমার সাথে এমন আচরণ কেন করছেন?আগে তো এমন আচরণ করতেন না।কষ্ট হচ্ছে আমার।”
রুদ্র কঠিন স্বরে বলল, “কান্না থামাও বলছি। প্রতিদিন ভালো আচরণ করি বলেই তো তুমি লাই পেয়ে যাচ্ছো।”
– “একটু লাই দিলে কি হয়?”
এ পর্যায়ে রুদ্র নির্বাক হয়ে গেল। এতসব বলার পরেও কোনো পরিবর্তন হলো না? রুদ্র বলল, “পাগলামি করো না।তুমি ছোট মানুষ। এগুলো তোমার বয়সের দোষ।ফোন রাখো।আর কখনো ফোন দিবে না।”
অরূণী কান্না থামিয়ে জোর গলায় বলল, “রাখবো না ফোন। আমি ছোট না, আমি কলেজে পড়ি। আমার আঠারো বছর হয়ে গেলে। আমার এক ফ্রেন্ডের বাচ্চাও আছে।”
রুদ্র এবার পুরোপুরি হতাশ।কাকে কি বলল এতক্ষণ?এত সব কঠিন কথা বলে ফয়দা হলো কি? রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলল, “এত খারাপ আচরণ করলাম।তাও গায়ে মাখলে না?”
– “আপনি বকবেন আবার আপনিই তো ভালোবাসবেন‌‌।মন খারাপ কেন করবো?”
– “তুমি তো দেখছি এবনরমাল।”
অরূণী রুদ্রের কথা উপেক্ষা করে বলল, “আমার সাথে আর কখনো খারাপ আচরণ করবেন না। আমি ব্যথা পাই।”
– “ব্যথা পাও? মানুষ খারাপ আচরণে কষ্ট পায়।আর তুমি ব্যথা পাও?এসব অদ্ভুত কথা কোথায় পাও তুমি?”
অরূণী বিষণ্ণ গলায় বলল, “জানি না কোথায় পাই।আপনি আমায় নির্লজ্জ বললেন। বিশ্বাস করুন জীবনে এত কষ্ট আমি পাই নি কখনো।খুব কষ্ট পেয়েছি।”
রুদ্র বেশ নরম গলায় বলল, “তাহলে তোমার দুঃখের সাথে পরিচয়ই হয়নি।”
অরূণী কিছু বলল না। রুদ্র আবার বলল, “এই মেয়ে শুনো,টাকার দরকার নেই আমার।টাকা লাগবে না। আর কখনো ফোন দিবে না,বাসায় আসবে না।খুব বেশি খারাপ আচরণ করবো নেক্সট টাইম যদি বাসায় আসো কিংবা ফোন দেও।”
অরূণী মরিয়া হয়ে ওঠে বলল, “ফোন না দিলে কথা বলব কীভাবে আপনার সাথে?আপনার সাথে কথা না হলে আমার ছটফটানি লাগে।”
রুদ্র ধমক দিয়ে ওঠল।বলল, “কি বলতেছি এতক্ষণ ধরে।বুঝতে পারছো না তুমি?তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি বিরক্ত হই?ছোট মানুষ তুমি,বড় হও।এসব পাগলামি রাখো।”
রুদ্র এই টুকু বলে ফোন’টা কেটে বন্ধ করে রাখলো। রুদ্র ফোন’টা বিছানার দিকে ছুঁড়ে ফেলে বিড়বিড় করতে লাগলো। কিরণ বলল, “কি বলেছে মেয়ে’টা?কি হয়েছে?”
– “তোর কথাই ঠিক।সেই মেয়েই এই মেয়ে।”
কিরণের ধারণা সঠিক হওয়া উৎফুল্ল হয়ে বলল, “দেখছিস তো এবার?আমার অনুমান ভুল হয় না।”
রুদ্র বলল, “রাখ তো অনুমান। মেয়ে’টা কান্না-কাটি করে অস্থির।কি পাগলের পাগলামি তে পড়লাম।মাথায় সমস্যা না-কি কে জানে?”
কিরণ অবাক গলায় বলল, “কাঁদছে মানে?এই তুই কি ওঁর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস?”
রুদ্র রুক্ষ গলায় বলল, “প্রতিদিন এসব ভালো লাগে?খারাপ ব্যবহার করবো না তো মাথায় নিয়ে নাচবো?ভালো কথা বললে গায়ে মাখে না।রুম পর্যন্ত এসে পড়ে!”
কিরণ যেন বিরক্ত হলো রুদ্রের ওপর।বলল, “রুদ্র এটা তুই কি করলি?খারাপ আচরণ কেন করেছিস?”
– “আমি বিরক্ত একদম। প্রতিদিন এমন ফাজলামি ভালো লাগে?”
– “তুই এটা’কে ফাজলামি ভাবছিস?মেয়ে’টা তোকে সত্যি ভালোবেসে।খুব বেশি চঞ্চল মেয়ে’টা।আর তুই জিজ্ঞেস করিস নি তোকে কবে থেকে ফলো করছে? ওঁর ঠিকানা?কীসে পড়ে?”
– “আরে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি বলে নি। প্রতিদিন কী জিজ্ঞেস করব? মাথায় কমন সেন্স থাকলে আর ফোন দিবে না।”
কিরণ’কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুদ্র গোসলখানায় ঢুকে পড়লো।কিরণ সরু চোখে তাকিয়ে আছে। রুদ্র গোসলখানা থেকে বের হওয়ার আগেই কিরণ ভার্সিটি’তে চলে গেল।এসব নিয়ে আর কথা হলো না রুদ্রের সাথে।
______________
ফোন রেখে অরূণী বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে রইলো। রুদ্রের বলা কথা গুলো আবার ভাবছে।অরূণীর কান্না পাচ্ছে আবার। এর ভিতর সেলিনা আহমেদ অরূণীর রুমে আসে।অরূণী চোখে মুখের অবস্থা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। সেলিনা আহমেদ এসেই বলল, “তুই কলেজে না গিয়ে চলে আসলি কেন?”
– “শরীর খারাপ লাগছিলো।”
সেলিনা আহমেদ অরূণীর কপালে হাত দিয়ে বলল, “কই জ্বর টর তো আসে নি।কি হয়েছে?”
অরূণীর এখন কথা বলতে একদম ইচ্ছে করছে না। তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলল, “মাথা ব্যথা করছিলো খুব। ওষুধ খেয়েছি। কমে যাবে আস্তে আস্তে।যাও এখান থেকে। কথা বলো না।”
সেলিনা আহমেদ কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেল। রুদ্রের বলা কথা গুলো অরূণীর কানে বাজছে শুধু। ফোন’টাও কেটে বন্ধ করে রেখেছে রুদ্র।একটু ভালো করে কথা বলেও যদি ফোন রাখতো তাহলে অরূণী ওসব খারাপ আচরণের কথা ভুলে যেত।এমন কাঠখোট্টা কেন রুদ্র? নির্লজ্জ বলতেও ছাড়লো না।
কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও অরূণী ফোন দিলো না আর।বাস স্ট্যান্ডেও যায় না এখন।কারো সাথে তেমন কথাও বলে না।
টানা পনেরো দিন ধরে এক পড়া পড়িয়ে চলেছে পিয়াস।পিয়াস বেশ বিরক্ত। ষোল দিনের মাথায় অরূণী’কে পড়াতে আসা বন্ধ করে দিলো। সেলিনা আহমেদ রেগেমেগে বলল, “আমি বুঝি না ভেবেছিস?তুই ইচ্ছে করে তাড়িয়েছিস ছেলে’টা কে। কত মেধাবী স্টুডেন্ট। আর তুই পড়া বুঝিস না?”
অরূণী সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়, “না বুঝি না।”
সাহেদ আহমেদ আর সূর্য বরাবরের মত হতাশ।সাহেদ আহমেদ চেঁচিয়ে বাসা মাথায় তুলেছে এই নিয়ে।অরূণী চুপচাপ রুমে বসে রইলো। কয়েকদিন সূর্যের সামনে পড়লো না।
রুদ্র’কে ফোন দেয় না প্রায় পনেরো দিন ধরে। মাঝে মাঝে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে অরূণী। রুদ্র একবার ফোন দিলে কি হতো? রুদ্র শুধু বিরক্তই হয়েছে?আর কিছু না? অরূণী ভাবলো রুদ্রের টাকা’টা ফিরিয়ে দিতে হবে।এখন আর লুকোচুরি খেলে কী লাভ। হঠাৎ একদিন রুদ্রের কাছ ফোন দিলো অরূণী। রুদ্রের ওপর তীব্র অভিমান অরূণীর‌। এই অভিমানের কথা রুদ্র জানবে না কখনো। অনেকদিন পর ফোন দিয়ে অরূণীর কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। আগের মত চঞ্চল গলায় কিছুই বলল না। রুদ্র ফোন তুললেই বলল, “অকারণে ফোন দিই নি। খারাপ আচরণ করবেন না প্লীজ।”
রুদ্র হেসে বলল, “অনেক পরিবর্তন দেখছি।এটা ভালো।না খারাপ আচরণ করব না।বলো।”
– “মিস করেন নি আমায়?”
রুদ্র উত্তর দেওয়ার আগে আগেই অরূণী আবার বলল, “দুঃখিত। অবান্তর প্রশ্ন করে ফেললাম। আপনার টাকা’টা ফেরত দিতে চাচ্ছি।বাসায় দিয়ে যাবো?”
রুদ্র বেশ অবাক হয়ে বলল, “আমার সামনে আসবে?চড় দিই যদি?”
– “ইচ্ছে হলে দিয়েন চড়।বাসায় গিয়ে দিয়ে আসলে সমস্যা হবে?”
– “টাকা’টা আমার লাগবে না।”
– “স্যরি আমি সবকিছুর জন্য।তবে সত্যি আপনায় আমি ভালোবেসেছি। আর দুই হাজার টাকা আমার একদিনের হাত খরচও না। আপনার টাকা ফেরত দিবো না,এটা কোন কথা?”
– “বাহ! ধনীর দুলালি দেখছি।”
রুদ্র টাকা ফেরত নিতে চায় নি।কেন চায় নি নিজেও জানে না।শেষ পর্যন্ত ফেরত নিতে স্বীকার হলো।অরূণী ওঁর কলেজের সামনে আসতে বলল রুদ্র কে। রুদ্রও রাজি হলো। অরূণী ফোন রাখার কথা বললে রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম’টা?”
– “নাম’টা না হয় না জানাই থাক।”
রুদ্র হেসে বলল, “আচ্ছা।আর শুনো তুমি সব সময় চঞ্চলই থেকো।এভাবে একটুও ভালো লাগছে না তোমায়। সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি স্যরি।”
রুদ্রের এই কথা টুকুতে অরূণীর মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল যেন। প্রত্যুত্তর করলো না অরূণী। রুদ্র আবার বলল, “কলেজের নাম আবার ভুল বলো নি তো?”
– “না।”
অরূণী আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিলো।
(চলবে)
~রিচেক করি নি ভুল গুলো একটু বুঝে নিয়েন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here