মোনালিসা পর্ব ৪

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪
মোনা ভীষণ পড়ুয়া স্বভাবের। গল্প, উপন্যাস পড়ার প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক। বাংলাদেশ থেকে আসার সময় ব্যাগে করে কয়েকটা উপন্যাসের বই নিয়ে এসেছিলো। আমেরিকা এসে সেগুলো আর পড়া হয়ে উঠছে না। একটা অস্বস্তি বোধ মোনা কে জেঁকে ধরেছে। এই বাসায় বসে উপন্যাস পড়াতে মন বসাতে পারেনা, খাপছাড়া মনে হয়। মোনার বার বার মনে হচ্ছে, লিলি বেগম কে বিপদে ফেলে দিয়েছে ওঁরা। ওঁদের জন্য লিলি আর হাবিব সাহেবের মাঝে ঝগড়া হচ্ছে।ব্যাপার’টা মোনা’কে পীড়া দিচ্ছে, কেমন যেন অপরাধ বোধ কাজ করছে।
মোনার বার বার মনে হতে লাগল সব পুরুষ মানুষরাই কি এমন? মোনার কলেজের একজন টিচার ছিলো। নাম ছিলো মুহিব‌। তাঁকে সবাই বউ পাগলা ডাকতো। মোনা অন্যদের কাছে শুনেছে মুহিব স্যার নাকি বউকে রেখে কোথায়ও এক কাপ চা ও খায়না। তাঁরা যে সদ্য বিবাহিত যুগল তাও কিন্তু না। মুহিব স্যারের বড় মেয়ে মোনার এক ব্যাচ জুনিয়র ছিলো। তাঁদের ভালোবাসা তো বদলে যায় নি! মুহিব স্যার তার মেয়েকে নিয়ে টিফিন টাইমে ক্যান্টিনে খেত, মোনা সব সময় দেখত উনি উনার মেয়েকে খাইয়ে দেয়। মেয়েটা একটু খেয়ে আর খেতে চাইতো না, মুহিব স্যার দুই-চার বছরের শিশু কে যেমন আহ্লাদ করে খাওয়ায় মেয়েকেও ওভাবে খাওয়াতে। মোনার বাবা কে দেখে মোনার মনে হতো পৃথিবীতে ভালোবাসার প্রচন্ড অভাব, আবার মুহিব স্যারকে দেখে মনে হলো পৃথিবীতে অফুরন্ত ভালোবাসা!
মোনার মা মোনায় প্রায়ই বলত,’পৃথিবীতে সব পুরুষরা খারাপ না মা, হয়ত তোর বা আমার সাথে খারাপ কিছু ঘটেছে। এজন্য সবার সাথে যে খারাপ কিছু ঘটবে এরকম কিন্তু না।” মায়ের এমন যুক্তিযথ কথা শুনে মা’কে খুব বুদ্ধিমান মনে হতো মোনার। কিন্তু আবার যখন দেখত হাজার রকমের অত্যাচার , অবিচার সহ্য করেও স্বামীর মায়ায় আবদ্ধ হয়ে থাকত তখন মা নামক মানুষটা কে খুব বোকা মনে হয়। মোনার মা বলত,’ পরিস্থিতি মানুষ কে বোকা বানিয়ে দেয়। মানুষ নিজের জায়গা থেকে অনেক কিছু চিন্তা করতে পারে, অনেক কিছু বলতে পারে। কিন্তু নিজে যখন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় তখন কিছুই পারেনা।” মায়ের সাথে যুক্তি, তর্ক কোন কিছুতেই পারত না মোনা
___
মোনা রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি উপন্যাসের বইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মোনার ইদানিং আরেক অসুখ হয়েছে। বই নিয়ে বসলেই হাজার রকমের চিন্তা এসে মাথায় ভর করে। তখন আর মোনার বইয়ের দিকে খেয়াল থাকে না, অন্যমনস্ক হয়ে ভাবনার জগতে ডুব।
-“আসব?”
মোনা তাকায় দরজার দিকে প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়নে। গায়ে শার্ট, গেঞ্জি নেই।‌ প্রিয়মের হাইট প্রায় ছয়’ফিট হবে। এমন তাগড়া একটা যুবক শুধু একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়া। মানুষকে বডি দেখিয়ে বেড়ায়! মোনার কাছে একদম বিশ্রী লাগে। প্রিয়মের দিকে তাকাতেই লজ্জা লাগে।মোনা চুপ থাকে কিছুক্ষণ।অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আসুন।”
প্রিয়ম এসে খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসলো। রুমের এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিশান কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“কি ইয়াং ম্যান, কি খবর?”
নিশান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রুমে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা, মোনা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। প্রিয়মের উপস্থিতি’তে বিরক্ত হচ্ছে।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ নীরবতা বিলীন করে প্রিয়ম বলে,
-“বাংলাদেশের সব মানুষ কি তোমার মত বোরিং পাবলিক? এভাবে রুমের কোণে বসে থাকে?”
প্রিয়মের তিরস্কার মূলক কথা মোনার অসহ্য লাগে। এঁরা সব সময় বাংলাদেশ, বাংলাদেশ করবে। বাংলাদেশ নিয়ে খুব এলার্জি! মোনা রাগ সংযত করে ঠান্ডা গলায় বলল,
-“কথায় কথায় বাংলাদেশ , বাংলাদেশ করেন কেন বলেন তো? আর আমি এখানে কাউকে চিনি, কোন জায়গা চিনি না, ভাষা বুঝি না। চিনি শুধু এই রুমটা তাই রুমে থাকি।”
প্রিয়মের মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে মোনার কথায় মজা পেয়েছে। হাসতে হাসতে বলল,
-“রেগে কথা বললে তোমার নাক কাঁপে।”
মোনার আবারো রাগ হলো। মোনা জানে রাগ করলে ওর নাক কাঁপে। একথা অনেকেই বলে। কিন্তু এই বিষয়টা মোনার ভালোলাগে না‌।
প্রিয়ম নড়েচড়ে বসে বলল,
-“এনিওয়ে। কাম টু দ্যা পয়েন্ট। আম্মু তোমায় নিয়ে বের হতে বলল। তুমি নাকি বাসায় বসে বোর হচ্ছো।”
মোনা যেন খানিকটা অবাক গেলো। গম্ভীর মুখে বলল,
-“কখন বলেছি আমি বোর হচ্ছি?কোথায়ও বের হবো না আমি।”
মোনা মুখ গম্ভীর করে তাকায় প্রিয়মের দিকে। অস্ফুট স্বরে বলে,
-“অসহ্য”
মোনা কে চুপ থাকতে দেখে প্রিয়ম বলে,
-“দ্রুত রেডি হও। দশ মিনিট টাইম দিলাম।”
-” বলছি তো যাবো না।”
-“কোলে করে তুলে নিয়ে যাবো। দ্রুত রেডি হও।”
-“আশ্চর্য আমি কি একবারো বলেছি আমি যাবো?”
মোনার কোন কথা না শুনেই রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো প্রিয়ম। মোনার শরীর রাগে গিজগিজ করছে। প্রিয়মের সাথে বাইরে বের হওয়া প্রশ্নেই আসে না। হাবিব সাহেব দেখলে বিনা মেঘে বজ্রপাত শুরু হবে। মোনা উপন্যাসের বইটা আবার হাতে নিলো।
-“মোনা এখনো রেডি হোস নি?”
লিলির কথায় মোনা বই থেকে মুখ তুলে তাকায়। স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
-“খালা আমি তো যাবো না।”
লিলি বেগম ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে মোনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে।কয়েক মুহূর্ত পর বলে,
-“কেন গেলে কি হবে?”
মোনা উত্তর দিলো না। বইয়ের দিকে অকারণেই তাকিয়ে থাকে। লিলি বেগম নিশানের দিকে তাকিয়ে মোনার উদ্দেশ্য বলল,
-“নিশান ওভাবে শুয়ে আছে কেন?জ্বর আসছে নাকি?”
মোনা নিশানের দিকে তাকায়। কপালে হাত দেয়। আস্তে করে বলে,
-“এই টুকু সময়ের ভিতর ঘুমিয়ে গেলো! না,না জ্বর আসেনি।”
লিলি বেগম কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যায়।এর ভিতর প্রিয়ম চলে আসে রেডি হয়ে। মোনা কে তখন যে অবস্থায় দেখে গেছে ,সে অবস্থায়ই বসে আছে। প্রিয়ম হুট করে মোনার হাত ধরে হেঁচকা টান দেয়। মোনা খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। বলল,
-“রেডি হতে হবেনা,যে অবস্থায় আছো সে অবস্থায় চলো।”
প্রিয়ম মোনা কে হাত ধরে টানতে টানতে রুমের বাইরে নিয়ে আসে। লিলি পিছনে পিছনে আসছে।
-“আরে প্রিয়ম কি করছিস? মেয়েটা হাতে ব্যাথা পাচ্ছে তো।”
মোনা পিছনে তাকিয়ে বলল,
-“খালা নিশান।”
-“নিশান তো ঘুমাচ্ছে । ওকে নিয়ে যাবি কিভাবে?”
মোনা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। বাসার সামনে রাখা কালো রঙের কার টা তে উঠায় মোনা কে। প্রিয়ম গাড়িতে উঠে মোনার হাত ছেড়ে দেয়। মোনা দেখে হাতটা লাল হয়ে ফুলে আছে। মোনার গায়ের রং ফর্সা হওয়ার কারনে মনে হচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। মোনা ব্যাথাতুর মুখে হাতে ফুঁ দিচ্ছে। প্রিয়ম ধমক দিয়ে বলে,
-“সিট বেল্ট বাঁধো। তোমায় বললাম রেডি হতে আর তুমি-__” ভালো ভাবে বললে গায়ে লাগে না কথা।”
মোনার নাক মুখ কুঁচকে আছে। চোখে জল টলমল করছে। যেন এক্ষুনি গড়িয়ে পড়বে। প্রিয়ম আবার বলে,
-“কাঁদবা তো কোলে নিয়া গাড়ি থেকে আছাড় মেরে ফেলে দিবো।”
চোখের কোণে জমালো জল টুকু মুছে ফেলল মোনা।এই বাসার সব মানুষ গুলো বাড়াবাড়ি টাইপের। রাস্তায় জ্যাম নেই, হাউকাউ নেই। মাঝে মাঝে দুই একটা কথার শব্দ পাওয়া যায়। প্রিয়ম একটা ক্যাফটেরিয়ার সামনে গাড়ি থামায়। মোনা কে গাড়ি থেকে নামতে বলে। মোনা বলে,
-“এখানে কি?”
-“নামো! এখানকার কফি চমৎকার।”
মোনা গাড়ি থেকে নামে। নির্জন রাস্তাঘাট। রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া, বাইরের রোদ’টা একটু তীব্র। দুই জন মুখোমুখি বসলো। কফির কাউন্টারে গিয়ে প্রিয়ম দুইটা কফির অর্ডার দিলো।কফির কাপে চিন্তিত মুখে চুমুক দিলো মোনা। নিশানের জন্য চিন্তা হচ্ছে।
-“নিশানের চিন্তা করছো?আম্মু আছে তো বাসায়।”
মোনা আশ্চর্য হয়ে গেলো। বলল,
-“আপনি বুঝলেন কিভাবে?”
-“এছাড়া আর তোমার চিন্তা করার কারণ নেই তো।”
মোনা হাসলো। হঠাৎ প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে মোনার চোখ আটকে যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়মের চোখের দিকে তাকিয়ে মোনার দৃষ্টি আটকে যায়। প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
-“কি হলো?এভাবে তাকিয়ে কি দেখছো?”
মোনা বিস্ময় ভরা গলায় বলল,
-“ওহ মাই গড! আপনার চোখের মনি নীল। এটা কি কৃত্রিম?”
-“কৃত্রিম হতে যাবে কেন?তুমি এতদিন দেখো নি।”
-“না তো।”
-“তুমি হয়ত আমার দিকে ভালো করে তাকাও ই নি।”
মোনা মনে মনে ভাবলো তাইতো। কখনো ভালো ভাবে তাকায় নি। মোনা অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়মের চোখের দিকে। প্রিয়ম বলে,
-“কি নীল মনি দেখে প্রেমে পড়ে গেলে?”
মোনা বলল,
-“ছিঃ, নীল চোখের মানুষ মুভিতে দেখতাম। বাস্তবে দেখলাম তাই অবাক হলাম।”
প্রিয়ম কফি এক কাপ খাওয়া শেষ করে আরেক কাপ অর্ডার করলো। মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমার জন্য আরেক কাপ অর্ডার করবো?”
-“উঁহু।”
প্রিয়ম ডেকে ইংরেজি তে বলল,
-“এক কাপ দেন‌ শুধু।আমেরিকানো নয় ক্যাপাচিনো।”
মোনা একটু একটু করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। অপজিট টেবিল থেকে এক আমেরিকান মেয়ে প্রিয়ম কে হায় জানালো। মেয়েটা কে দেখে প্রিয়ম উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। দুইজন দুইজনকে কে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা শর্ট একটা স্কার্ট আর ছোট খাটো একটা টপস পড়া। এভাবে কফিশপে জড়াজড়ি, মোনার অস্বস্তি লাগছে। উৎফুল্লতা হ্রাস পাওয়ার পর প্রিয়ম মোনা কে দেখিয়ে বলল,
-“মাই কাজিন।”
মেয়েটা হাত নেড়ে হায় বলল। মোনাও উত্তরে একটু হেসে হ্যালো বলল। তাঁরা দুই জন ব্যস্ত হয়ে গেলো। প্রিয়ম যেন ভুলেই গেছে ওর সাথে কেউ একজন এসেছে। মেয়েটা অনার্গল ইংরেজি বলে যাচ্ছে, সাথে প্রিয়মও। মোনা যে ইংরেজি বুঝেনা তাও না। কিন্তু ওরা এত দ্রুত ইংরেজি বলে আর এমনভাবে উচ্চারণ করে মোনার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। মোনা যা বুঝতে পারল তা হলো প্রিয়ম কেন কাল ক্লাবে যায়নি, কাল খুব উল্লাস হয়েছে, মাস্তি হয়েছে। প্রিয়ম মোনার প্রতি সম্পূর্ণ অমনযোগী হয়ে গেলো। মোনার চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর উপায় রইলো না।
কিছুক্ষণ পর ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হলো। মোনা কে বলল,
-“আমি ওর সাথে বের হবো। তোমায় ট্যাক্সি ডেকে দিচ্ছি।”
মোনা প্রচন্ড বিরক্ত হলো। অপমান বোধ করলো। এভাবে জোর করে এনে, এখন অনাদৃত ভাবে বাসায় ফিরে যাচ্ছে। এমন অদ্ভুত আচরণে মোনা খানিকটা অবাক হলো, মনক্ষুণ্ণও হলো। ট্যাক্সি করে বাসায় এসে দেখে হাবিব সাহেব বাসায়।মোনা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রিয়মের সাথে আসলে এখন কি রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো?এই মুহূর্তে মোনার মনে হচ্ছে তা হয়েছে ভালোই হয়েছে।
.
বিঃদ্রঃ নাইচ,নেক্সট এসব কমেন্ট থেকে দূরে থাকুন। পারলে দুই লাইনে ভালোমন্দ বলে যান। আপনাদের মতামত, আলোচনা-সমালোচনা লেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করবে। এটা বুঝতে হবে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here