#যে_জীবন_ফানুসের
#পর্ব– ৩
লেখনীতে #রেহানা_পুতুল
ভ্রুকুচঁকে আবিদ হেসে ফেললো। বলল, আমি আবিদ ভাই হয়ে গেলাম? ওকে ফাইন। এখানে মশা কুটকুট করে কামড়াচ্ছে। রুমে আসো। সকালে ত চলেই যাবে। কিছু কথা ছিলো আমার।
আমি তবুও চেয়ার ছাড়ছিনা। খোলা বারান্দায় মশা আমাকেও ধরেছে। আবিদ আমার হাত ধরে টেনে তুললো। কোলে করে নিতে হবে নাকি ঝুমুর?
তার এই রসালো বাক্যটি আমার কাছে অসহ্য ঠেকলো। হাত ছাড়িয়ে হনহন পায়ে হেঁটে গিয়ে বেডে বসলাম।
পিছন দিক দিয়ে সেও এসে আমার পাশে বসল। আমি সরে যেতেই জোরে এক ধমক দিলো।
তোমার এসব আর নেয়া যাচ্ছেনা। ফাজলামো অনেক হচ্ছে। খুব জ্বালাচ্ছ দুদিন ধরে। মানুষ বন্ধুর সাথেও আরো মাখামাখি করে চলে। আর তুমিতো আমার বিয়ে করা বউ।
বউ শব্দটা শুনেই আমার মাঝে প্রবল উত্তেজনা কাজ করলো । ক্রোধান্বিত হয়ে, আমি কারো বউনা। তুমি স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় বিয়ে করেছ। স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি না হলে সে বিয়ে বৈধ নয়। সো আমি ঝুমুর না তোমার বউ না ফয়সালের। আজ রাতেই সুইসাইড করবো।
হোয়াট! বলে আমার গালে সজোরে চড় বসিয়ে দিলো আবিদ।
আমি ব্যাথায় গাল চেপে ধরলাম। দিশেহারা হয়ে আবিদের পায়ে লাথি মারলাম।
আবিদ আর আমাকে কিছুই বললনা। অবোধ শিশুর মতো চুপচাপ বাকি বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো। দুচোখের পানি ছেড়ে দিলো নিরবে।
আমি নিজের ব্যথা ভুলে স্তব্দ হয়ে গেলাম আবিদের নিরব অশ্রুপাত দেখে। যতই হোক বর্তমানে আমি ওর কাছেই আছি বিয়ে করা বউ হিসেবে। হোক না চুক্তির বিয়ে। হোক না নামকাওয়াস্তে। হোক না সমাজ দেখানো। তবুও। সে আমার সিনিয়র।
শুরু থেকেই আমার প্রতি তার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, কেয়ারিং এর তিল পরিমাণ ঘাটতি নেই। আর আমি অবুঝের মত শুধু যন্ত্রণাই দিয়ে যাচ্ছি। কতটা আগলে রাখছে আমাকে মুরগীর ছানার মতো।
আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। তার হাত চেপে ধরে সর্যি আবিদ খুব স্যরি। আসলে আমার লাইফের সবকিছু এত বাজেভাবে এলোমেলো হয়ে গেলো। তাই মাথা ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
আবিদ উঠে বসলো এবার। তার মুখের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে আমার কথায় বেশ সন্তুষ্ট হলো সে। সারামুখে ভালোলাগার রেশ এনে বলল,
ঝুমুর…
আমি মুখের মলিনতা দূর করে চোখ তুলে চাইলাম আবিদের দিকে।
ঝুমুর নামটা ঝুমুরের মতই সুন্দর। তোমার কথা শুনে সত্যি মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। সেই ঢাকা থেকে যে মুখে তালা দিয়েছো। এই এখন সেই তালা খুললে। কোন কথাই বলনি। একজনকে হাতের কাছে না পেয়ে সেই ঝাল উঠাচ্ছ আমার উপর দিয়ে।
তুমি কি যেন বলতে চাইলে আবিদ?
ওহ হ্যাঁ। শুন ঝুমুর। তুমি শিলার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। সেই সুবাদে আগে থেকেই তোমার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। তোমাকে বিয়ে করতে আমি খুবি অনিচ্ছুক ছিলাম। ইচ্ছা থাকার মতো বিষয় এটা? না আমি এ টাইপের? খুব সংকোচ ও কাজ করছিলো। ফয়সাল ভাই পারেনি শুধু আমার পায়ে ধরে ফেলে।
আমরা মানুষেরা কারো সিচুয়েশন না বুঝে দূর থেকে ভুল আর নিন্দার ঢিল ছুঁড়ি। আমাকে পরোক্ষভাবে শিলাও সাপোর্ট করেছে। শিলার হৃদয়তরী নোঙর ফেলেছে অন্যঘাটে বিয়ের আগেই। এটা আমি কমবেশি টের ও পেয়েছি। শিলাকে আমার দিকে ফেরাতে পারিনি বহু চেষ্টা করেও। প্রেম এমনি। আসলে তাদেরই উচিত হয়নি শিলাকে জোর করে আমার টাকা আছে দেখে বিয়ে দেওয়া আমার কাছে। ভাগ্যিস কোন বেবি হয়নি আমাদের। শিলাও নিতে চায়নি। কেন চায়নি এখন তা কাচের মতই স্বচ্ছ।
আবিদের কথার মাঝে আমি জানতে চাইলাম, শিলার জন্য তোমার মাঝে কোন খারাপ লাগা কাজ করছেনা আবিদ?
আমার দুহাত চেপে ধরলো আবিদ। একটুও নাহ ঝুমুর। কারণ যার কাছে আমার অস্তিত্বই বিলীন ছিলো। সেখানে খারাপ লাগার প্রশ্নই আসেনা। আর মানুষের একদিক শূন্য হয়ে গেলে তা পূরণ করার জন্য প্রকৃতি উদার হস্তে একটা বিহিত করেই ছাড়ে। কেননা প্রকৃতি শুন্যস্থান পছন্দ করেনা। এজন্যই প্রকৃতি এত নির্মল, সজীব মায়াময়।
তোমার অফিসে সমস্যা হবেনা?
নাহ। আমি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছি মায়ের অসুস্থতার কথা বলে।
মিথ্যা বললা?
এটা মহৎ মিথ্যা ঝুমুর। মিথ্যা নয়।
আবিদের কথায় বেলুন ফোটার মতোই ধুম করে মুখ দিয়ে হাসি বেরিয়ে এলো। বললাম। হইছে। যাহা লাউ তাহাই কদু।
আবিদ ও হেসে ফেলল। আমি সহজ হচ্ছি এ ধারনায় তাকে প্রফুল্ল দেখা যাচ্ছে।
সে বলল দেখ ঝুমুর তুমি আমি দুজনেই পরিস্থিতির শিকার। এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য না তুমি দায়ী না আমিই দায়ী। ঝুমুর এক কাজ করি আমরা। বন্ধু হতেতো দোষ নেই। তুমিতো চলেই যাবে। যাওয়াই হয়তো উচিত। তোমার ফাস্ট লাভ। ফাস্ট ফিলিংস। ফাস্ট টাচ। ফাস্ট রোমান্টিসিজম। ফাস্ট বাসর।
আমি ক্ষেপে গেলাম। খুন করে ফেলব আবিদ। গরম তেলে জল ঢালতে এসোনা।
ওরেব্বাহ! খুব লাগলো বুঝি। খুন কি আর করবে সখী। খুন যে হয়েই গেছি আমি সখা। ফয়সাল যেগুলোর জন্য ফিরে পেতে চায়। সেই একি কারণ আমার মাঝেও কি সৃষ্টি হয়নি এই তিনমাসে? আমি পুরুষ। তবে নেহাৎ ভদ্র পুরুষ। নইলে…
আমি বিব্রতবোধ করছি দেখে কথার বাঁক ঘুরিয়ে ফেলল আবিদ।
ঝুমুর তুমি যখন যেতে চাইবে। তখনি যেতে পারবে। আমার মনটা খোলা আকাশের মতই। ইচ্ছে মতেই অবাধে দু ডানা মেলে উড়তে পারো। সিলেটে দেখার মতো মনোরম স্থান একাধিক রয়েছে। চাইলে আমি তোমাকে এসব স্থানে নিয়ে যেতে পারি দেখার জন্য। চলে গেলেতো চলেই গেলে।
আবিদের কথা শুনে মনের ভিতরে অফুরন্ত ভালোলাগা উঁকি দিল ভোরের উদীয়মান সূর্যের ন্যায়। সিলেট আমার পছন্দের একটি জেলা। একমাত্র এই সিলেট জেলার লোকাল ভাষাটাই আমি বেশ এনজয় করি। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিলো সিলেট ঘুরতে আসবো।
ফয়সালসহ আসার কথা প্রায় চুড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু আসলাম ঠিকই। ঘুরবো ঠিকই। কিন্তু ফয়সাল নয় অন্য কারো সাথে। ভাগ্যই যেন কিছু মানুষের জীবন নিয়ে হাসিঠাট্টা করে বড় সুখবোধ করে।
আমি বরাবরই ভ্রমণবিলাসী। সিলেট এসে দর্শনীয় জায়গাগুলো না দেখে চলে গেলে মনটা উচাটন করবে খুব। এই লোভ সংবরণ করা অসম্ভব আমার পক্ষে।
কি ব্যাপার ঝুমুর। আনমনে হয়ে গেলে মনে হয়। ঘুরতে যাবে? না কালই চলে যাবে?
সিলেট ঘোরা শেষ করে তবেই চলে যাব। মুখ নামিয়ে উত্তর দিলাম।
এইতো গুড গার্ল। গুড ডিসিশন নিয়েছো। আমাকে বন্ধু ভাবো। দেখবে আর আড়ষ্টতা কাজ করছেনা তোমার মাঝে। না এতেও আপত্তি তোমার? আমি বুঝিনা। যখন তোমার ননদের হাজব্যান্ড ছিলাম। তখন কিন্তু তুমি আরো ইজি হয়ে আমার সামনে আসতে। মিশতে। হাস্যোজ্জ্বল মুখেই সারাক্ষণ খুনসুটি করতে আমার সাথে। এখন শুধু জোঁকের মতো কুঁচকে কুঁচকে থাক। কারণ টা কি খোলাসা করবে ঝুমুর?
আমি প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বললাম,কাল ঘুরতে নিয়ে যাবে? আর সিলেটে মনে হয় তুমি আরো এসেছ?
শুরুতেই বলছি তুমি যা চাইবে ঠিক তাই হবে। কারো মনের উপর আমি জোর খাটাইনা সাঁড়াশির মতই। দেখনা শিলাকে ফিরিয়ে আনার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। হুম কালই নিয়ে যাব তোমাকে। অফিসের কাজে সিলেট আমার প্রতি মাসেই আসতে হয়। প্রায় এই হোটেলেই উঠি এদিকে আসলে।
ফয়সাল জানবেনা তুমি আমাকে নিয়ে সিলেট আসছ?
একদম নাহ। এজন্যই তো সিলেটে আসা আপাতত।
আচ্ছা শিলার সাথে তোমার ডিভোর্স হওয়া দরকার নাহ? যেহেতু ফিরিয়ে আনবেনা।
হাহাহাঃ করে আবিদ প্রানখোলা হাসি ছড়িয়ে দিলো। শিলা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে নিশ্চিত। আমার দিতে হবেনা।
ওহ আচ্ছা। তাহলে তুমি বিয়ে করবেনা?
অবশ্যই করবো। তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে তা নব্বই দিনের মধ্যে কার্যকর হলে তারপর করবো আস্তে ধীরে। এত তাড়া নেই। বিন্দাস হয়ে হাওয়া খাব পাক্কা একবছর। হোহোহোঃ। চাইলে সে একবছর আমার সফর সঙ্গী হতে পারো।
একদমে বললাম। নো নীড। জীবন নিয়ে তামাসা অনেক হয়েছে। আমার নতুন চাকরি। আলতাফ সচিব আমার কাকা হয়। বাবা উনাকে বলে ছুটি নিয়ে দিয়েছে। সামনের সপ্তাহ থেকে অফিসে যেতে হবে।
আর আমাকে ডিভোর্স দেয়ার প্রয়োজন নেই। কারন কাজী অফিসে বিয়ে পড়ানোর সময় সবাই মিথ্যে বলছে যে তুমি ডিভোর্সড। বাট সত্যিটা তো আমরা জানি। সুতরাং আমাদের বিয়েটা ধর্মীয়মতে ও আইননুসারে সম্পন্ন হয়নি।
আমার কথা শুনে আবিদ বেশ চিন্তিত হয়ে বলল, ওহ তাইতো। আমি এতটা জানতাম না। আর সব আসলে সব এত তাড়াহুড়ো করে হয়েছে জানার সুযোগ ও হয়নি।
আচ্ছা, তোমার অফিস বের করতে কতক্ষণ ফয়সাল ভাইয়ের। ঝামেলা করবেনা?
আমি তার স্ত্রী নই এখন। নারী হয়রানির মামলা দিয়ে দিব ঝামেলা করলে।
তার মেসেজ কতটা বিধ্বংসী দেখলে? বোঝাই যায় বুকের পাঁজরে তোমার জন্য উথাল-পাতাল মধু মধু প্রেম।
রাগে চুল ছিঁড়তে মন চায় তোমার কথা শুনলে। ঘোড়ার ডিমের প্রেম। হুহ। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাবো। ক্লান্ত লাগছে।
দুজন দুই বেডে ঘুমিয়ে পড়লাম। এই কয়দিনে আবিদকে দেখেছি । অবলোকন করেছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায় আবিদকে। নিঃশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম কাঁথামুড়ি দিয়ে।
পাখি ডাকা ভোরে ঘুম ছুটে গেল। আবিদ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি আড়মোড়া ভেঙে বারান্দায় গিয়ে বাইরে চোখ মেললাম। কিছুই ভালোলাগছেনা। চারপাশকে ভীষণ পানসে আর নিরানন্দ লাগছে। নিজের মনের ভুবনে রঙ না থাকলে বাইরের সব রঙকেও বিবর্ণ ধূসর মনে হয়।
ফোন আসার শব্দ হতেই রুমে গিয়ে ফোন রিসিভ করলাম। মায়ের ফোন।হ্যালো মা..বলতেই,
যা শুনলাম তাতে আমি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে বসে পড়লাম।
চলবে…৩