যে জীবন ফানুসের পর্ব -০৪

#যে_জীবন_ফানুসের
#পর্বঃ ৪
#রেহানা_পুতুল
আমি দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছি। যন্ত্রণার পাহাড় ভেঙ্গে চুরে পড়ছে মনজমিনের উপরে। নিমিষেই অন্তরটাকে গুড়ো গুড়ো করে দিচ্ছে যেন। মা আমাকে সাধ্যমতো শান্তনা দিয়ে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো।

মোবাইল আবার বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই বন্ধু রিমার গলা শুনতে পেলাম। রিমা আমার প্রাণের বন্ধু। যা আমার গোপন তাও রিমাকে না জানিয়ে থাকতে পারিনা। এই নিয়ে স্কুল কলেজ ভার্সিটিতে অন্য বন্ধুরা ক্ষেপাতো। ঈর্ষান্বিত হয়ে বলতো তোদের গলাগলি বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ড এর মতন।

হ্যালো ঝুমুর কিছু শুনেছিস?

ধরা গলায় বললাম হুম। মা ফোন দিলো এখন। তুই রাখ রিমা। আমার বেশ খারাপ লাগছে।

রিমা মনমরা কন্ঠে বলল, খারাপ লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আচ্ছা রাখি। তুই ভালো থাকার চেষ্টা কর প্লিজ।

দুই হাঁটু ভাঁজ করে একিস্থানে বসে আছি। পিছনে আবিদ এসে দাঁড়ালো। কি ব্যাপার ঝুমুর? আমি সেই কখন জাগলাম। ফোনে মায়ের সাথে কথা বললাম। আরো দু জায়গায় জরুরী আলাপ সারলাম। তোমার পাত্তা নেই।এতসময় এখানে কি করছ? ফ্রেস হয়েছো? বের হবানা ঘুরতে?

আমি নিচের দিকে মাথা ঝুঁকে বসে আছি। আবিদ আমার হাত ধরে টান দিলো। মুখপানে পলক চেয়েই ,
একি তুমি কান্না করেছ? চোখ ফোলা ফোলা লাগছে। এনি প্রবলেম? শেয়ার করো। উঠে আস প্লিজ।

এই এক সমস্যা। এলার্জি থাকার জন্য একটু কাঁদলেই দুচোখ ফুলে যায়। লাল হয়ে যায়। লুকানোর কোন সুযোগ নেই। অসহ্যকর।

আমি উঠে দাঁড়ালাম আস্তে করে। পা টেনে টেনে রুমে গেলাম। টেবিলের সাথে থাকা চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে বসলাম। টেবিলে মাথা এলিয়ে দিয়েছি নুইয়ে পড়া পুইঁয়ের লতার ন্যায়। আবিদ আলতো করে মাথার উপর হাত রাখলো। নিরবতা কোন সমাধান এনে দিতে পারেনা। মুখ খুলতে হবে। কথা বলতে হবে। বল কি হয়েছে?

আবিদের হাত শক্ত করে ধরলাম। ভেজা গলায় জানালাম, ফয়সাল বাইক এক্সিডেন্ট করেছে গতকাল সন্ধ্যায়। সিচুয়েশন নাকি খুব ক্রিটিকাল। এখন ঢাকায় পিজিতে নিয়ে আসতেছে এম্বুল্যান্সে করে।

মাই গড! এ কি ঘটে গেলো বলে আবিদ মোবাইল হাতে নিলো। হন্তদন্ত হয়ে তার কাছের কয়েকজনকে ফোন দিলো। ডিটেইলস জানলো। আমার দিকে চেয়ে বলল,তোমার মনের অবস্থা আমি রিয়েলাইজ করতে পারছি।
আসলে ব্যক্তিগতভাবে উনার সাথে আমার ও কোন দ্বন্দ্ব নেই। তাই আমারও খারাপ লাগছে। তুমি ঘুরতে বের হবা এখন?

শেষের বাক্যটি আবিদ নরম স্বরে একটু ইতস্তত হয়েই বলছিল।

আমি উদাস ক্লান্ত গলায় বললাম। নাহ।

আবিদ নিচে গিয়ে নাস্তা আনলো। চিকেন পরোটা বুটের ডাল সালাদ সহ। খেতে ইচ্ছে করছেনা। আবিদের ধমকাধমকিতে একটা পরোটা খেলাম জোর করে ঔষধ খাওয়ার মতো। কি করবো আমি গলা দিয়ে খাবার নামছেনা।

আবিদের ও সারামুখজুড়ে বিষন্নতার ছাপ। যতটুকু তাকে দেখেছি আর জেনেছি। তার হৃদয়টা মানবিকতা আর ঔদার্যতায় গড়া। সে ঢাকায় তার কাছের দুজন বন্ধুকে ফোন করে পিজি হাসপাতালে যেতে বলল ফয়সালের জন্য দৌড়ঝাঁপ করার জন্য। বিষয়টা আমার বেশ ভালো লাগলো। সমস্ত বিভেদ ভুলে হলেও একজন মানুষের বিপদের সময় এগিয়ে যাওয়াই মানুষের কাজ। এটাই মনুষ্যত্ব। এটাই মানব ধর্ম।

ফয়সালের সান্নিধ্যে কাটানো মুহুর্তগুলো চোখের সামনে ভেসে চলছে শরতের নীল মেঘের ন্যায়। কেনইবা ও আমার জীবনে এলো। কেনইবা তাকে ভালোবাসলাম হৃদয় ছিঁড়েপুড়ে। কেনইবা এমন ভুল বোঝাবুঝি হলো। কেনইবা সে আমাকে তার জীবন থেকে তাড়িয়ে দিলো দূর বহুদূরে । কেনইবা ভুল বুঝতে পেরে ফিরে পাওয়ার জন্য উম্মাদ হয়ে গেলো।
তার এই উম্মাদনা দেখেই প্রেমের প্রপোজাল রিফিউজড করতে পারিনি আজ হতে ছয় বছর আগে। আহ ফয়সাল! বুকটা কেমন হাহাকার করছে। গুমরে গুমরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।

জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষ যতই ভুল করুক। ছেড়ে যাক। তবুও কখনো কখনো তারজন্য সফট কর্ণার কাজ করে। এই আবেগ,অনুভূতির কাছে প্রতিটি মানুষ পরাজিত, পরাভূত ব্যর্থ সৈনিকের মতো।

চেয়ারে আর বসে থাকতে পারছিনা। নিস্তেজ শরীরটাকে নিয়ে পড়ে আছি বিছানায়। আবিদ কি প্রয়োজনে যেন বের হয়ে গিয়েছে রুম থেকে। প্রচন্ড মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। এ এক ব্যারাম। কাঁদলে মাথাও ব্যথা করে। আমার সারা শরীরে ও মনে সমস্যার অন্ত নেই।

বেশ কিছু সময় পরে আবার ফোন বেজে উঠলো। আননোন নাম্বার। রিসিভ করলাম। দূর্বল স্বরে জিজ্ঞেস করলাম হ্যালো.. কে?

মা আমি। আমি ফয়সালের মা। তোমাকে ফয়সাল একটু দেখতে চায় ভিডিও কলে। ছোট বাচ্চার মতো করে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ফয়সালের মা আমাকে অনুরোধ করলেন ।

মৃত্যুপথগামী সন্তানের জন্য একজন অসহায় মায়ের বিলাপ আমার হৃদয়ে আছড়ে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো করে।
একজন মা তার সন্তানদের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। খোদার দেয়া নেয়ামত। কারো কারো চোখে হয়তো মন্দ। কিন্তু সন্তানদের নিকট নয় কখনো।
ঠিক তেমনি সন্তান ও অন্যের কাছে নিন্দনীয় হতে পারে। দুশমন হতে পারে। কিন্তু মায়ের কাছে স্রস্টার নিকট থেকে পাওয়া অনন্য উপহার। যে উপহার মা প্রতিটিমুহুর্তে যত্ন করে রাখে। যেন এতটকুও নষ্ট না হয়। সেই মা কেমন করে বাঁচবে সন্তানের এমন অবর্ননীয় যন্ত্রণা দেখলে।

আমি প্রার্থনা করি এই মাকে করুণা করে হলেও স্রস্টা যেন তার সন্তানকে কেড়ে না নেয়। উনাকে শান্তনা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, আপনি উনার সামনে এভাবে কাঁদবেন না। আমি ভিডিও কল দিচ্ছি আবিদ আসলেই। সে বাইরে গিয়েছে। এখন আমার ফোনে নেট কানেকশন নেই।

আবিদকে ফোন দিয়ে জানালাম। সে দ্রুত ছুটে এলো। অভিযোগের সুরে বলল, কত বললাম এমবি কিনে দিই। না দিলেইনা। দরকার নাই। দেখলে দরকার কারে কয় এবার?

দাঁড়াও হোয়াটসঅ্যাপে ফয়সাল ভাইয়ের ফোনে ভিডিও কল দিচ্ছি বলে ট্রাই করতে লাগলো। একটু পরেই ফোন রিসিভ হলো। তার এক ভাবি মোবাইলের স্পিকার অন করে ফয়সালের মুখের সামনে ধরলো। জানালো ফোন হাতে ধরে রাখার মতো অবস্থা নেই তার। আবিদ আমাকে স্পেস দিয়ে বারান্দায় চলে গেলো।

ফয়সাল আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে । দুচোখের কোন গড়িয়ে ভারী অশ্রুপাত নির্গত হচ্ছে। যে অশ্রুর ভাষা কেবল আমিই অনুধাবন করতে পারছি।

বললাম, ফয়সাল পথচলায় তুমি ছিলে আমার আপনের চেয়েও আপন। আমার ভুলত্রুটিগুলো মাফ করে দিও একজন মানুষ হিসেবে। বলে ফোনের এপাশে আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। ফয়সাল অবোধ শিশুর মতো অস্পষ্ট ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে আমার কাছে ক্ষমা চাইলো সবকিছুর জন্য।

আমি ফোঁপানো মোটা গলায় বললাম, আমার আর কোন অভিযোগ নেই তোমার উপর। আল্লাহ চাইলে তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। ফয়সাল আবিদকে ডাকতে বলল, আমি রুমে বসেই জোরে আবিদ বলে ডাক দিলাম। আবিদ এলো।

মোবাইল হাতে নিয়ে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে নমনীয়ভাবে বলল,
ভাই আমরা সবাই আপনার পাশে আছি। আপনি ভালো হয়ে যাবেন। ফয়সাল শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে, আবিদ ঝুমুরকে আগলে রেখো সবসময়। এই বলে চুপ হয়ে গেলো। তার ভাবি বলল। রাখেন। খুব কষ্ট হচ্ছে ফয়সাল ভাইয়ের।

ছোটভাই রাশেল ফোন দিলো।
ঝুমুপু মায়ের কাছে এ টু জেড বিস্তারিত শুনেছি শুরু থেকেই। তুমি বেশী আফসেট হয়ে যেওনা। ফয়সাল এখন মরনের পথে তাই আর কিছুই বলার নাই এ বিষয়ে তোমাকে। নয়তো টাকার জন্য তুমি আবার তার কাছে বিয়ে বসতে রাজী হয়েছো। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। ঘৃণিত একটা কাজ বলে মনে হয়েছে।গ্রামে আমাদের জমি আছে একটা। সেটা বিক্রি করেই বাবা টাকা পরিশোধ করতে পারতো। জানি এ একটুকরো জমিই আমাদের শেষ সম্পদ ও সম্বল।

আমি ক্ষেপে গেলাম রাসেলের উপরে। হড়হড় করে বললাম,তোর কি মনে হয় ফয়সালের কাছে ফিরে যাওয়া কেবলমাত্র ওই পাঁচ লক্ষ টাকার জন্যই? এখানে কোন ভালোবাসা কাজ করেনি?
তুইতো শুধু আজ একটা, কাল একটা, পরশু আরেকটার পিছনে টইটই করে ঘুরেছিস বুনোহাঁসের মতো। জীবনে কাউকে একান্ত করে ভালোবাসিসনি। তাই এটার গুরুত্ব তোর কাছে না থাকাটাই স্বাভাবিক। ফোন রাখ।

তোমাকে ফোন দেয়াটাই আমার ভুল হয়েছে বলে ফোন লাইন কেটে দিলো রাসেল।

রাসেলের সাথে এত রূঢ় আচরণ না করলেও পারতে। বলল আবিদ।

শুনে বললাম,মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশী দেখাতে এসোনা।

আবিদ বাধ্য ছাত্রের মত আচ্ছা বলে চুপ হয়ে গেলো।

একটু পর নরমসুরে আবিদকে বললাম,
ইয়ে…মানে…

কিইই বল?

আচ্ছা এখন কি ঢাকায় যাওয়া সম্ভব ?

আবিদ চকিতে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। জানালো সিলেট থেকে ঢাকার দুরত্ব সড়ক পথে প্রায় ২৪৩ কিলোমিটার। সো বুঝতেই পারছ নিকট জেলা নয়। তবুও সম্ভব তুমি চাইলে। সেদিনের মতো রিজার্ভ কার ভাড়া নিব।

মাইন্ড করোনা ঝুমুর। অহেতুক মামুলি বিষয়কে ইস্যু করে ফয়সাল ভাই তোমাকে ছেড়ে দিলো। অথচ তারপরেও তোমার হৃদয়ে তার স্থান কত বিশাল। কত গভীর। সিরিয়াসলি?
ফাস্ট লাভ বলে।

আর আমি অমানুষের বাচ্চা এত করেও তোমার কাছে আছি থার্ড পারসনের মতো। আমার জীবনটাই আজ বড় দূর্ভাগার জীবন।

একরাশ অভিমান আর অনুযোগের সুরে কথাগুলো বলল আবিদ। আমি বিচলিত হয়ে গেলাম তার এমন কথা শুনে।
এরপর চনচন গলায় বলল, তুমি তোমার সব নিয়ে রেডি হও ঝুমুর। আমি হোটেল ছেড়ে দিচ্ছি আর গাড়ি ঠিক করে আসতেছি এনি হাউ। আমি আমার আগের লাইফে ফিরে যাব। আর তুমি তোমার মত করে যা ইচ্ছে যেভাবে ইচ্ছে চলিও।

আবিদ ছটপট করে বেরিয়ে গেলো। আমি কি করবো বা কি করা উচিত কিছুই বুঝতেছিনা। তবুও সবকিছু গুছিয়ে নিলাম ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
আধা ঘন্টা পর আবিদ ফিরে এলো। হোটেলের রুম থেকে আমরা বেরিয়ে গেলাম। রিসিপশনে টাকা দিয়ে চাবি বুঝিয়ে দিলো।

গাড়ি ছুটে চলছে দূর্বার গতিতে। জীবন সত্যিই ফানুসের মত। উড়ে যেতে যেতে কত স্থান বদল হয়। আমি অপরাধী চোখে আবিদের হাতের উপর হাত রাখলাম।
আবিদের মায়াবী শ্যামলা মুখখানি কালো মেঘের বর্ণ ধারণ করে আছে। আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। কিন্তু সে চাহনিতে কোন তেজ নেই। অস্থিরতা নেই। রাগ নেই। উত্তেজনা নেই। অভিযোগ নেই।

আছে শুধু স্থিরতা, ধৈর্য, খাঁ খাঁ শূন্যতা, পেয়েও হারানোর বেদনা, গুমোট অভিমান আর দীর্ঘ অপেক্ষা।

চলবে…৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here