#সে_এক_মনগড়া_প্রেমকাব্য
৩য়_পর্ব
~মিহি
ছেলেটা অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেজায় রাগ হলো আমার। দিব্যি গায়ের উপর এসে পড়লো অথচ মুখ থেকে সামান্য ‘স্যরি’ শব্দটুকু এখন অবধি বের হলো না। ইতর কোথাকার! কথাটা ভেবে ভ্রু কুঁচকাতেই অপর পাশ থেকে ছেলেটার গলা শুনলাম,”আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি। আসলে ওয়াশরুম খুঁজছিলাম, মেইবি পাশেই হবে।” আল্লাহ্! ছেলে মানুষের গলা এত মোলায়েম কেমনে হয়! ছেলেদের গলা হবে গম্ভীর, রুক্ষ্ম, রগচটা ধরনের কিন্তু এ ছেলের গলা তো পেঁজাতুলোর মেঘের মতো মোলায়েম।
– “ইটস ওকে। ওয়াশরুম বামদিকে, আপনি ডানদিকে এসেছেন।”
– “ওহ আচ্ছা। আমি আদিল রায়হান অভিক। ইউ ক্যান কল মি অভি।”
– “হোয়াই শুড আই কল ইউ?”
– “না মানে…”
– “ওয়াশরুমটা ঐদিকে, যান।”
অভি মাথা নেড়ে চলে গেল। আমি শাড়ির দিকে তাকালাম। নাহ! ঠিকই আছে কিন্তু কেন যেন নিচে যেতে ইচ্ছে করছিল না আমার। মায়ের ভয়ে নাকি অন্য কোনো কারণে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আবারো ঘরের কোণে এসেই বসলাম। পায়ের দিকে তাকাতেই খেয়াল হলো দাদামশাইয়ের দেওয়া পায়েলটা পায়ে নেই। তড়িৎ গতিতে আশেপাশে তাকালাম। ভালোমতো লক্ষ করতেই দেখলাম পায়েলটা দরজার কাছে পড়ে আছে। পা থেকে কখন খুলে পড়েছে সেদিকে আমার ধ্যানই যায়নি। দরজার কাছে গিয়ে পায়েলটা হাতে নিলাম। উপরে তাকাতেই দেখি অভি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
– “কী হলো? এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কী?”
– “না মানে..আপনি নিচে যাবেন না? আচ্ছা, আপনি তিথি ভাবীর কে হচ্ছেন?”
– “ভাগ্নী!”
– “সত্যিই? ভাবীর এতবড় ভাগ্নীও আছে?”
– “জ্বী আঙ্কেল।”
– “আঙ্কেল! আমায় দেখে তোমার আঙ্কেল মনে হয়?”
– “আপনি খালামণির হবু বরের বন্ধু অর্থাৎ আমার হবু খালুর বন্ধু। খালুর বন্ধুকে আঙ্কেলই তো ডাকে, তাই না?”
– “তা ডাকে কিন্তু খালুর বন্ধু ইয়াং এণ্ড হ্যান্ডসাম হলে তাকে ভাইয়া ডাকতে হয়, নাহলে ঘোর পাপ লাগে।”
– “আসছে রে কোথাকার কোন পাগল! যান তো আপনি।”
অভি ছেলেটা বড্ড একরোখা। আমার কথার কোন প্রভাবই পড়লো না তার উপর। তিনি দিব্যি আমার হাত ধরে টেনে নিচে নিয়ে গেলেন আমায়। খালামণি আমায় আসতে দেখে বেজায় খুশি হলেও নানুমণি আর মায়ের মুখ তখন বিবর্ণ। এর কারণ দুইটা। প্রথমত, অভি আমার হাত ধরে নিচে নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয়ত, আমি মায়ের শাড়ি পড়ার স্পর্ধা দেখিয়েছি। মায়ের অগ্নিচক্ষু বলে দিচ্ছে আজ হয়তো কোন একটা ঝামেলা হবেই। আমার উপর মায়ের এত রাগ শুধুই কি মানসিক সমস্যার জন্য? নাকি মানসিক সমস্যার আড়ালে অন্য কোন কারণ আছে? প্রত্যেকটা মুহূর্তে আমি একটা করে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি আমি যেসব প্রশ্নের উত্তর দুই রকমের হয়, ইতিবাচক আর নেতিবাচক কিন্তু সত্যি কোনটা তা স্বচক্ষে অনুধাবন না করা অবধি বুঝে ফেলা সম্ভব না।
_________________________________
রাফসান তিথির অনামিকা আঙুলে আংটি পড়িয়ে দিল। আশেপাশের মৃদু হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো ঘর। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল তিথি। রাফসান হাসছে। সমবয়সী প্রেমের সম্পর্কে লজ্জা জিনিসটার সাক্ষাৎ খুব একটা হয় না। সারাক্ষণ তুই-তুকারি, মুখের উপর কথা, কোনকিছু ব্যক্তিগত রাখার প্রয়োজনহীনতা সম্পর্কটাকে অনেকটা আন্তরিক করে তোলে। আমরা বন্ধুদের সাথে যেভাবে কথা বলি, সেক্ষেত্রে লজ্জা বিষয়টার আগমন সচরাচর প্রত্যাশার বাইরে।
– “ভাবী, শোনেন।”
– “আরে অভি সাহেব যে! অবশেষে আপনার দর্শন হলো তাহলে। শালা বড়লোক হয়ে গেছিস না? তোকে কি বরণডালা দিয়ে বরণ করে ঘরে তোলা লাগবে?”
– “ইশস রে! ঐসব বাদ। একটা কাজ করে দে।”
– “কী কাজ?”
– “তোর ভাগ্নীর নম্বরটা দে।”
– “অভি! তুই সিরিয়াস? মেয়েদের পাত্তা না দেওয়া অআদিল রায়হান অভিক কিনা আমার কাছে একটা মেয়ের নম্বর চাচ্ছে?”
– “দেখ! তেমন কিছু না, আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা ডিপ্রেশড। আমার সাথে কথা বললে ওর ভালো লাগবে।”
– “মীরা ফোন ইউজ করেনা।”
– “এটা কোনো কথা!”
– “তুই চিন্তা করিস না। ওর সাথে কথা বলার ব্যবস্থা আমি করে দিবনি তোকে। তুই আপাতত মীরার দিকে এত তাকাস না, আপা দেখলে কিন্তু বাড়িতে ঝামেলা হবে।”
অভি চুপ করে এককোণে দাঁড়িয়ে রইল। পরিবারের অন্য সদস্যরা গল্পগুজবে ব্যস্ত। অভি এখনো একদৃষ্টিতে মীরার দিকে তাকিয়ে। মানবমন বলে কথা! যা নিষেধ করা হবে, তা সে অবশ্যই করবে।
_________________________
“এই লোক আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে কী জন্য? অদ্ভুত তো! ওরে ছাগল, চোখ সরা!” মনে মনে কথাগুলো বলতে বলতে অন্যদিকে তাকালাম। “এখনো কী তাকিয়ে আছে আমার দিকে? তাকাবো একবার? হুশস না! তাকালে কী না কী ভাবে! ধূর! দেখিই না একবার।” খুব সতর্কতার সাথে অভির দিকে তাকালাম। অভির চোখে চোখ পড়ল। বেহায়া ছেলে! চোখ সরানো তো দূর, উল্টো চোখ টিপ মারলো। না, এসব বাড়তে দেওয়া যাবে না। এখান থেকে কোনোমতো সরতে হবে। সবাই গল্পে ব্যস্ত। এই সুযোগে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। পিছন ফিরে আর অভির দিকে তাকানো হয়নি।
কালো মলাটের ডায়েরিটা এখনো বিছানার পাশেই পড়ে। এটা কী নানুভাইয়ের ডায়েরি নাকি? কৌতূহলী দৃষ্টিতে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা খুললাম। গোটা গোটা অক্ষরে বড় করে নাম লেখা,”শঙ্খিনী”। শঙ্খিনী আবার কার নাম? এ বাড়িতে শঙ্খিনী নামে কে ছিল? খালামণির নাম তিথি, মায়ের নাম উষা, নানুমণির নাম তাহেরা। তাহলে শঙ্খিনী কী কারো ছদ্মনাম?
প্রথম পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পরের পৃষ্ঠায় গেলাম। পরের পৃষ্ঠায় অনিপুণ হাতে কিছু লাইন লেখা,
“প্রথম অনুভূতি, প্রথম পরিচয়, প্রথমবার চোখাচোখি। অপ্রস্তুত মুহূর্তগলোও কী এত সুন্দর, পরিকল্পিত হওয়া সম্ভব?”
এটুকু পড়তেই দরজায় কারো টোকা দেওয়ার শব্দ পেলাম। অভি! এ আবারো এসেছে। অভি কিছু না বলেই বিছানার এক কোণে এসে বসলো।
– “আচ্ছা মীরাবাঈ, তুমি এত উদাস থাকো কেন?”
– “মীরাবাঈ কী? ভালোভাবে নাম নিবেন নয়তো নিবেন না।”
– “নিতে পারি, একটা শর্ত আছে।”
– “কী?”
– “আমায় নাম ধরে ডাকতে হবে।”
– “আপনার কী মাথা খারাপ? আপনি আমার চেয়ে কমপক্ষে ছয় বছরের বড় হবেন, আপনার নাম ধরে ডাকতে যাবো কোন দুঃখে?”
– “কেন? ডাকলে ক্ষতি কী?”
– “আপনার সমস্যাটা কী বলুন তো! আমায় একা ছাড়বেন, প্লিজ?”
– “এ শহরের কিছুই তো চেনো না। চলো ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”
– “যেতে চাইছি?”
– “না ক..কিন্তু ..ত.. তুমি কোন কলেজে যেন এডমিশন নিছো?”
– “শাহ সুলতান।”
– “পড়াশোনা তো হচ্ছে না বাসায় বসে। আমি কিন্তু সাহায্য করতে পারি।”
এই মুহূর্তে আমার এত পরিমাণ রাগ হচ্ছে বলার মতো না। তার উপর এই লোকের বকবক থামেই না। সে নিজের মতো বকবক করেই চলেছে। আমি যে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তা যেন সে দেখেও দেখছে না। আচমকা বলে উঠলো, “তোমাদের ছাদটা ঘুরে দেখাও তো।”
আমি কিছু বলার আগেই খালামণি এলো সেখানে। অভির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো, সে ইশারার ভাষা আমার বোধগম্য হলো না।
__________________________
– “তোকে মানা করছিলাম না মীরার আশেপাশে থাকতে? তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ওর জীবনটা নষ্ট করিস না প্লিজ। ও মাত্র কয়েকদিন এখানে আছে। তুই প্লিজ ওর কাছে যাস না। মেয়েটা এমনিতেই ছোট থেকে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করছে। তোর ভালোবাসা পেয়েও যদি হারিয়ে ফেলে, তাহলে সে যন্ত্রণা মীরা সহ্য করতে পারবেনা রে।”
– “তুই কী আমাকে কখনো দেখেছিস এমন কিছু করতে যা তোর খারাপ লেগেছে? বা আমার চরিত্রে দোষ আছে?”
– “আমি কি সেটা বলছি?”
– “শোন তিথি, তুই তোর ভালোবাসাকে পাইছিস। আমি তোর ভাগ্নীকে এখনো ভালোবাসিনি, তার প্রতি আমার একটা সফট কর্ণার আছে, এটুকুই। এত সিরিয়াস হোস না।”
– “ভালোবাসা হতে সময় লাগে না।”
অভি কিছু বললো না। সে জানে এখন তিথিকে বোঝানো কোনোভাবেই সম্ভব না। তিথিকে এড়িয়ে রাফসানকে খুঁজতে লাগলো সে। আপাতত রাফসানকে বলে এখান থেকে চলে যেতে চায় সে। মীরার প্রতি আর আবেগ বাড়িয়ে কাজ নেই, চোখের আড়াল হলেই আবেগ কর্পূরের ন্যায় উবে যেতে সময় লাগবে না।
চলবে…