সে এক মনগড়া প্রেমকাব্য পর্ব -০২

#সে_এক_মনগড়া_প্রেমকাব্য
২য়_পর্ব
~মিহি

– “তুই কী আমার মেয়ে নাকি তোর বাবা আর তার দ্বিতীয় স্ত্রীর?”

– “মা!”

– “এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। পরিস্থিতি আমায় এত ধোকা দিয়েছে যে আমি জীবনে ছিঁটেফোটা বিশ্বাসটুকুও আর কাউকে করিনা। তুই বের হ আমার ঘর থেকে। আমি ঘুমাবো এখন।”

আমি আর কিছু বললাম না। মায়ের মানসিক অবস্থার এতটা অবনতি হয়েছে তা আমাদের জানানো হয়নি। আমার জন্মের পরপরই মায়ের মানসিক সমস্যা শুরু হয়। তীব্র মাথাব্যথা, শর্ট টাইম মেমোরি লসের মতো সমস্যাও হত। দাদামশাই বিষয়টা তখন আমলে নেননি। তখন সবার নজর ছিল আমার দিকে কিন্তু আমার গর্ভধারিণী মায়ের প্রতি কেউ নজর দেয়নি। বাবা? তিনি তো তখন ছিলেন অন্য নারীর বাহুডোরে, এখনো তাই আছেন। তার যে একটা মেয়ে আছে সে কথাও কী আর তার মনে পড়ে না? একটুও কষ্ট হয় না? দীর্ঘদিন একটা কুকুর পুষলে, তার প্রতিও তো মায়া জন্মে। সেখানে আমি তো একটা জলজ্যান্ত মানুষ, তার নিজের রক্ত। আমি কেন এত অনাদর পেলাম তার?

কলেজে যাওয়ার জন্য আমার যত আগ্রহ ছিল, তা অঙ্কুরিত হওয়ার পূর্বেই বিনষ্ট হলো। মা কিছুতেই আমায় কলেজ যেতে দিবেন না। আমি কলেজে গিয়ে কোন বিপদে পড়লে আমার বংশের লোকগুলো নাকি তার জীবন একেবারেই শেষ করে ফেলবে। কোনোভাবেই রাজি করানো গেল না তাকে। আমার ইচ্ছে অপূর্ণ থাকা নতুন নয় আমার কাছে। ছোট খালামণি আমার চেয়ে বয়সে ছয়-সাত বছরের বড় তবুও তিনি আমার সাথে সমবয়সীর মতোই মিশছেন। কলেজে না যেতে পারলেও তার থেকে মাঝেসাঝেই নতুন নতুন বিষয় শিখছি। দাদামশাইয়ের সাথে কথা হয়না আজ তিনদিন। রূপম ভাইয়ের যে কী অবস্থা তাও জানিনা। আমার ভাবতেও অবাক লাগে আমি কী করে রূপম ভাইকে মারার সাহস পেলাম? কই, আগে তো এমন সাহস ছিল না আমার। পরিস্থিতি কী আমায় ধীরে ধীরে শক্ত করে তুলছে?

___________________________________

বাড়িতে বেশ সাদাসিধে ভাবে কোনোকিছুর আয়োজন চলছে। বোধহয় কোন মেহমান আসবে। খালাকে জিজ্ঞাসা করা যায় কে আসতে চলেছে, এ বাড়িতে একমাত্র তিনিই আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেন। খালামণির ঘরে ঢুকে দেখি খালামণি সাজতে ব্যস্ত। লালপাড় সাদা শাড়ি, কানে ঝুমকো, চুলের খোপায় রজনীগন্ধা- শখের সাজ যাকে বলে। খালাকে কী কেউ দেখতে আসছে? দেখতে আসলে চুলে রজনীগন্ধা দেওয়ার কথা না, আবার দিতেও পারে। অদ্ভুত হেয়ালি লাগছে সবকিছু। খালামণির পাশে বসলাম।

– “এতসব আয়োজন কী জন্য, তিথি খালামণি?”

– “ওমা সে কী! তোকে কেউ জানায়নি, মীরু? আজ আমার বাগদান।”

– “ওহ।”

– “ওহ কী? যা তৈরি হ। তোর খালু কিন্তু বেশ মজার মানুষ, তার সাথে আলাপ করাবো তোকে। যা, সেজেগুজে তৈরি হ।”

– “আমি আজ অনুষ্ঠানে থাকলে নানুমণি কিংবা মায়ের ভালো লাগবে না। তার চেয়ে বরং আমি ঘরেই থাকি।”

– “অত পাকনামি কথা কই থেকে শিখছিস? আয় তো, আমি সাজিয়ে দিই তোকে।”

– “না, দরকার নেই। আমি পারবো।”

খালামণির ঘর থেকে বেরোতেই খেয়াল করলাম গাড়ির শব্দ। খালুর বাড়ির লোকজনরা বোধহয় এলেন। আমি যতদ্রুত সম্ভব ঘরে ঢুকলাম। যাই হয়ে যাক, আমি এ ঘর থেকে বের হবো না। খালামণিও তো আর অনুষ্ঠান ছেড়ে আমায় খুঁজতে আসবে না। আজ বাগদান অথচ কোনো মানুষজন নেই। কেবল দুই পরিবারের উপস্থিতিতেই অনুষ্ঠান নাকি? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জানালা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। নিচে দুটো গাড়ি দাঁড় করানো। ভালোভাবে তাকাতেই খেয়াল করলাম একটা ছেলে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে ফোনে কথা বলছে। একটু পরপর হাসছে। আমি কী ভেবে যে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম নিজেও বুঝলাম না। আচমকা চোখাচোখি হলো। ব্যস! বিপত্তি সেখানেই। চোরের ন্যায় জানালা থেকে আস্তে করে সরে গেলাম। ছেলেটা কী খালামণির হবু বর? নাকি অন্যকেউ?

________________________

তিথির মনটা আজ বেশ ভালো। অবশেষে দীর্ঘ দু’বছরের সম্পর্কটা আজ পূর্ণতা পাচ্ছে। সমবয়সী হওয়ায় এ সম্পর্ক না মানার হাজারটা কারণ ছিল। তবুও সে রাফসানকে পেয়েছে। ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়ার অনুভূতিটা সে কিছুতেই ব্যক্ত করতে পারছে না। এ অনুভূতি ব্যক্ত করার ক্ষমতাটুকুও তার নেই। ঠোঁটের ঐ সামান্য প্রসারিত হাসি কিংবা রাফসানের জন্য শখের সাজ ঐ অনুভূতিকে ব্যক্ত করতে পারেনা। অনুভূতিটা একান্তই তিথির মনে বন্দি।

– “কোন খেয়ালে মত্ত আমার বউ? তখন থেকে ডাকছি, সে তো শুনছেই না।”

– “আজ আমি অনেক খুশি, রাফসান। আমি তোকে বলে বোঝাতে পারবোনা আমি কতটা খুশি।”

– “বিয়ের পর অত্যাচার করে বুঝায়ে দিস কত্ত খুশি!”

– “তা তো করবোই।”

কথাটা বলেই মুখ টিপে হাসে তিথি। রাফসান সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

রাফসানের মা-বাবা তিথির মা এবং বোনের সাথে গল্প করছে। এদিকে রাফসান-তিথি ফিসফিস করে কথা বলে চলেছে। হঠাৎ রাফসান আশেপাশে তাকিয়ে বলে উঠলো, “অভি কই? ছেলেটা হারালো নাকি?” রাফসানের কথায় তিথি হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো, “অভি আর হারানো? দেখ বাইরে গিয়ে, তাকে সসম্মানে ভেতরে না আনায় হয়তো তিনি বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন।”

রাফসান হাসতে হাসতে অভিকে আনতে বাইরে গেল। তিথি আশেপাশে তাকাতেই খেয়াল হলো মীরা এখনো আসেনি। তৈরি হতে এতক্ষণ তো লাগার কথা না। তিথি মীরার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

_________________________

সেলফে অনেকগুলো বই আছে। খুব সম্ভবত এসব নানাভাইয়ের। নানাভাই আমার জন্মের আগেই মারা যান তবে আমি তার সম্পর্কে বেশ কিছু কথা শুনেছি। তিনি নাকি প্রচুর বই পড়তেন। তার সেলফে ইসলামিক বই, বিভিন্ন বিখ্যাত লেখকের বিখ্যাত বইসমূহ, আবার বেশকিছু বিদেশী বইও রয়েছে। সেদিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই চোখ পড়লো কালো মলাটের একটা মোটা ডায়েরির উপর। আগ্রহবশত হাতে তুলে নিতেই কারো পায়ের আওয়াজ পেলাম। খালামণি কি উপর আসছে নাকি? সর্বনাশ!
তাড়াহুড়ো করে বইটা একপাশে রেখে বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম, অসুস্থতার ভান করার প্রচেষ্টা আর কী! খালামণি দরজা খুললেন। চাদরের নিচ থেকে দরজার ক্যাচক্যাচ শব্দটা দিব্যি পেলাম। খালামণি ধীরে ধীরে এসে আমার পাশে বসলেন। আমি ভাবলাম একটু ডেকে বোধহয় চলে যাবেন। তা আর হলো না। খালামণি তৎক্ষণাৎ উঠে আলমারি থেকে কিছু বের করলেন। আবারো পেলাম ক্যাচক্যাচ শব্দটা। এ বাড়ির সব জিনিস বেশ পুরনো তবুও নানুমণি কেন যেন এসব পাল্টান না।

– “তোর নাটক করার এনার্জি শেষ হয়ে থাকলে উঠে এই শাড়িটা পড়।”

– “ক..কিসের নাটক?”

– “আপনার আম্মিজান আমাকে আপনার চরিত্র সম্পর্কে অবগত করেছেন। ঐ বাড়ি ছেড়ে আসার পর থেকে উঠতে-বসতে তোর নাম জপ করে। তুই যে অনুষ্ঠান এড়ানোর জন্য অসুস্থতার ভান করিস এটাও বলেছে আমায়।”

– “মা আমার কথা বলে তোমাদের?”

– “সারাদিনই! রেডি হ, তাড়াতাড়ি। আমি গেলাম। দশ মিনিটের মধ্যে নিচে আসবি।”

খালামণির পায়ের শব্দ পেলাম, চলে গেল বোধহয়। চাদর সরাতেই লক্ষ করলাম পাশে পড়ে থাকা খয়েরী বর্ণের শাড়ির দিকে। এটা তো মায়ের শাড়ি। এটা আমি পড়লে মা রাগ করবে না তো?

মায়ের শাড়ি পড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। সযত্নে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখলাম। মায়ের শাড়ি আমায় বেশ মানিয়েছে। সাজসজ্জার উপর থেকে আমার রুচি বহু আগেই উঠে গেছে। দাদামশাই সবসময় আমাকে পরিপাটি আর সাধারণ থাকতেই শিখিয়েছেন। হাতমুখ ধুয়ে এসে শাড়িটা পড়লাম। যে আমার এখন বিয়ের পরপরই নতুন নতুন শাড়ি-গহনার ভারে নুইয়ে পড়ার কথা, সেই আমি কিনা নিজ গ্রাম ছেড়ে এখানে এসে আছি। আমার বিয়ে ভেঙেছে মা কি জানে? আদৌ আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার খবরটাও কি এ বাড়ি অবধি পৌঁছেছে?

শাড়ির কুচি সামলে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোলাম। দরজা খুলতেই অপর পাশ থেকে কেউ হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকলো। আচমকা আগমনে ধাক্কা নিশ্চিত! হালকা রকমের একটা ধাক্কা খেয়ে ছেলেটা কয়েক কদম পিছালো। আমি চোখ তুললাম। আরে! এ তো সেই ছেলেটা যাকে দেখে তখন আমি সরে গিয়েছিলাম। এ এখানে কী করছে?

চলবে…

[অনুগ্রহপূর্বক ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here