সে_আমারঃ (আপডেট) পর্বঃ-৯

সে_আমারঃ (আপডেট)
পর্বঃ-৯
মোর্শেদা হাবিব!
**************
পৌষী ফজরের নামাজ পড়ে আজ আর ঘুমায়নি।মায়ের অসুস্থতার চিন্তা ওকে কাবু করে ফেলেছে।একটা মেজর অপারেশনের ধকল কি মা সামলাতে পারবে!
যদি তার কিছু হয়?
তাহলে পৌষী কার কাছে যাবে?
তার এই দুনিয়ায় আপন বলে কেউ থাকবেনা।
নানান বিচ্ছিন্ন ভাবনা পৌষীর মনটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।এরই মধ্যে সে
রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের জন্য পাতলা স্যুপ রান্না করে নিয়ে এলো।
সাহেদা শুয়েছিলেন।
পৌষী মা’য়ের পাশে বসে স্যুপের চামচটা তার মুখের সামনে তুলে ধরতেই সাহেদা কেঁদে ফেললেন!পৌষী চামচ নামিয়ে মা’য়ের দিকে অবাক হয়ে তাকালো!
-“ওকি মা,কাঁদছো কেন?”
সাহেদা কিছু না বলে শরীর কাঁপিয়ে নিরবে কেঁদেই চলেছেন!
পৌষী স্যুপটা রেখে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল-“কেন কাঁদছো তুমি,মা?……আমার কথা ভেবে ?”
সাহেদা মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন-“আমার কিছু হলে তুই কার কাছে থাকবি?”
পৌষী চুপ হয়ে গেলো!তারপর বললো-“আল্লাহ নিশ্চয়ই একটা না একটা ব্যবস্থা করবেন!”
-“আমি তো দেখতে পাচ্ছি,আল্লাহ আমার চিন্তা মোচনের একটা ভালো ব্যবস্থার পথ তৈরী করে দিয়েছেন।এখন তুই সেই পথে চলবি কিনা সেটাই আমার চিন্তা !”
পৌষী মায়ের দিকে চেয়ে রইল-“মানে?তুমি কিসের কথা বলছো তুমি মা?”
-“তোর বড়মামা সেদিন নিজে থেকে তোর বিয়ের কথা বললেন!”
বলে সাহেদা একটু থেমে একটু দম নিলেন।তারপর পৌষীর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন-“তিনি তোকে তার রাজের বউ করে নিতে চান!”
বলে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন।মেয়ের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
পৌষী একটু চমকে গেলো মায়ের কথা শুনে।
অবাক হয়ে বললো-“এসব তুমি কি বলছো মা?রাজ কোটিপতি বাবার একমাত্র ছেলে!ওরা আমাদের আশ্রয় দিয়ে অনেক বড় উপকার করেছে! বড় মামা হয়তো তোমাকে সান্তনা দেবার মতো কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে একথা বলেছেন।তাছাড়া রাজ শুনলেই বা কি ভাববে?সে কেন তার বাবার চাপে পড়ে আমাকে বিয়ে করবে?আর মামীও তো এটা মেনে নেবেন না!”
পৌষী এলোমেলো ভাবে কথাগুলো বলল।
সাহেদা পৌষীর মুখে হাত বুলিয়ে বললেন-“আর সবার কথা পরে,তুই নিজে রাজী কি না সেটা আগে বল্?তোর মামীকে তোর মামাই বোঝাবে।আর রাজের কথা বলছিস!ওর তো মানা করার কোনো কারনই নেই!”সাহেদার মুখে এতক্ষণে মৃদু হাসি দেখা গেলো!

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন



-“কেন,কোনো কারনই নেই….. কেন?তার নিজস্ব পছন্দ থাকতে পারেনা?”
সাহেদা কিছুক্ষণ ভেবে বললেন-“সে আসলে তোকে খুব….সাহেদা কথা শেষ করতে পারলেন না!
রাহেলা ঘরে ঢুকে বলল-“পুষি আফা….বড়আম্মা আপনেরে ডাকে!”
পৌষী মা’কে ছেড়ে ওড়না প্যাঁচালো গায়ে তারপর স্যুপের বাটিটা হাতে নিয়ে বলল-“এটা ঠান্ডা হয়ে গেছে মা!আবার গরম করে আনতে হবে! ”
বলে সে বেরিয়ে গেলো!
ডাইনিং হলে আসতেই দেখলো রাজ পেপার পড়ছে।পৌষীকে দেখে রাজ একপলক তাকালো!
পৌষী চট কর মুখ নামিয়ে নিলো।সে অনুভব করলো ওর মুখটা হঠাৎই গরম হয়ে গেছে।অন্যান্য দিন তো তার এমনটা হয়না, আজ কেন হলো? নাকি একটু আগে শোনা মায়ের কথার প্রভাব এটা?
পৌষী অকারনেই ঘোমটা টেনে মুখ ঢাকলো! রাজ ততক্ষণে চোখ ফিরিয়ে পেপারে মনোযোগ দিয়েছে!
পৌষী মামীর ঘরে নক করল-“মামী, ডেকেছেন?”
মামী লেপের তলা থেকেই বললেন-“তোর বড় মামা আর রাজকে নাস্তা দিয়ে দে!”
-“জ্বী…মামী!”বলে পৌষী চলে আসতে নিলে মামী আবার ডাকলেন!
-“এ্যাই..শোন্..!তোর মায়ের কি অবস্থা….রে ?”বলে রানী পৌষীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন!
পৌষীটা বড় মায়াবতী! দেখলেই মায়া লাগে।রানী ওর জন্য ভালো ছেলে নিজ দায়িত্বেই দেখবেন!নিজের ছেলের বউ করে নিতে তার কোন আপত্তি ছিলোনা যদি সাহেদা অন্তত সামাজিক স্ট্যাটাসটুকু মেইনটেন করতে পারতো।তার একটা মাত্র ছেলে।লোকেই বা কি বলবে!মেয়ে পাওনি খুঁজে যে শেষ পর্যন্ত এক এতিম মেয়েকে ধরিয়ে দিয়েছো?তাছাড়া পৌষী সামাজিকতা বোঝেনা।ঘোমটা দিয়ে ঘরে বসে থাকে,তার ছেলের জীবন একেবারে একঘেয়ে হয়ে যাবে ওকে বিয়ে করলে!তারচে যে যার মিল মতো জীবনসঙ্গী নিয়ে ভালো থাকুক।রাজ আধুনিক ছেলে ওর জন্যে তেমন আধুনিকাই দরকার! আর পৌষী দ্বীনদার তাই ওর জন্য তিনি দ্বীনদারই খুঁজবেন।লোক লাগালে পাত্র ঠিকই পাওয়া যাবে!
রাণী যেন ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলেন।পৌষীর ডাকে ফিরে তাকালেন-
-“মা আগের মতোই আছে মামী!”
-“সে আসলে তোকে নিয়ে বড্ড বেশী ভাবে!আরে আমরা আছিনা?আচ্ছা…যা তুই ওদেরকে নাস্তা দে !” বলে লেপের ভিতর মুখ গুঁজলেন রানী।
পৌষী রান্নাঘরে এসে নাস্তা বের করে ওভেনে গরম করতে বসলো!
নানান চিন্তায় ভার হয়ে আছে মনটা।মামীর কথার ভঙ্গিতে মনে হলো তিনিও চান রাজের সাথেই ওর বিয়ে হোক!ওদিকে মা বলছেন বড় মামাও এটাই চান।
প্রশ্ন হলো রাজ কি চায়?সে যেমন উন্নাসিক ধরনের ছেলে তার তো পৌষীকে পছন্দ হবার কথা না!
আরে সে নিজে??
দীর্ঘশ্বাস ফেললো পৌষী।ওর খুব ইচ্ছে ছিলো একজন দ্বীনদার স্বামী।কিন্তু এখন পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে এ বিয়েতে রাজী না হয়ে উপায় নেই।তবে রাজের প্রতি কৃতজ্ঞ সে।ওর মায়ের অসুস্থতার সময় রাজ যা করেছে তার ঋণ পৌষী শোধ করতে পারবেনা তাছাড়া সে নিজে যতই আধুনিক হোক না কেন,পৌষীকে সে এতটুকু বিব্রত করেনি বরং পৌষীর পর্দা মেনে চলাকে সে পূর্ণ সমর্থন যুগিয়েছে।নইলে সেদিন হাসপাতালে সে ইচ্ছে করলেই ও পাশের বেডটাতে ঘুমাতে পারতো।কিন্তু পৌষীর অস্বস্তির কথা ভেবেই সে এই শীতে সারাটা রাত বারান্দায় কাটিয়েছে!হোক মায়ের ভাইপো।তবু এ যুগে কে কার জন্য এতটা করে!”
নাস্তা বের করতে গিয়ে অন্য মনস্কতায় আঙ্গুলে ছ্যাঁকা লাগায় চমকে উঠলো পৌষী!
রাহেলাকে ডেকে ওকে দিয়ে সব নাস্তা টেবিলে পাঠালো! তারপর চা বসালো!এদের নাস্তা খাওয়া হলে মা’কে স্যুপ খাওয়াবে!
এরই মধ্যে বড়মামা ডাকলেন পৌষীকে।পৌষী রান্নাঘরের গেটে দাঁড়িয়ে বলল-
-“জ্বী,মামা?”
-“তুই নাস্তা খেয়েছিস?”
-“একটু পরে খাবো মামা!”বলে পৌষী অনিচ্ছাসত্ত্বেও আড়চোখে রাজকে একপলক দেখলো।
সে আজকে পত্রিকায় ডুবে আছে।কোনোদিকে মন নেই!ওর মনে হয় নাস্তা খাওয়া শেষ।পৌষী দ্রুতহাতে চা বানালো।রাহেলাকে হাত নেড়ে ডেকে ওর হাতে ওদের দুজনের চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে পৌষী ঘরে চলে এলো!”
সেদিনের সেই তর্ক বিতর্কের পর আমজাদ চৌধুরী আর রানীর সাথে এ ব্যপারে কথা বাড়াননি।তবে তাঁর স্থির সিদ্ধান্ত তিনি যে করেই হোক পৌষীকেই রাজের সাথে বিয়ে দেবেন।এতে রাজের জীবনটা নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচবে বলে তিনি মনে করেন।বরং এটা তো আরো ভালো হয়েছে রাজ পৌষীকে বিয়ে করতে স্বচ্ছন্দে রাজী হয়েছে।ওকে নতুন করে বোঝাতে হয়নি!
তিনি ভেবেছিলেন,আধুনিক ছেলে এরকম ধার্মিক মেয়ে পছন্দ করবেনা।কিন্তু নাহ্,রাজের রুচিটা তার মতোই উন্নত।তিনি আশা করেন,পৌষির সুশৃঙ্খল জীবনাচরণের প্রভাব রাজের উপর পড়বেই!
একটা সংসার সুন্দর হওয়ার মূল চাবিকাঠি থাকে নারীর আত্মত্যাগের উপর।আল্লাহ মেয়েদেরকে এমন বৈশিষ্ট্যে তৈরী করেছেন যে মেয়েরা যেখানে সংসার পাতবে সেখানে বটগাছের মতো শেকড় ছড়িয়ে চারপাশকে আঁকড়ে ধরবে! একজন সংসারী মেয়ে তার ভালোবাসার ডালপালা মেলে দেবে চারিদিকে যার উপর আশ্রয় করে সংসারের বাকি মানুষগুলো শান্তিতে থাকবে!সে নিজেই যদি হয় ছটফটে আর যুগের হাওয়ার সাথে উড়ে চলা মানুষ তাহলে সেই মেয়ে সংসারের হাল ধরবে কি করে।স্বামীকেই বা বাঁধবে কি দিয়ে?
নাহ্…রাণীর স্ট্যাটাসের ভুত ওর ঘাড় থেকে নামাতে হবে।
রানী নিজের একমাত্র ছেলেকে দিয়ে সমাজে নিজের ঠাটবাট জাহির করবে আর তিনি চান তার একমাত্র ছেলের বউ হবে একজন আদর্শ স্ত্রী,আদর্শ মা।যে একইসাথে তার স্বামী-সংসার-সন্তান এবং অন্য সবকিছু সততার সাথে সামলাবে।আর সেটা একজন ধীরস্থির ধার্মিক মনস্ক মেয়ের পক্ষেই সম্ভব।পৌষী ঠিক তেমনি একটা মেয়ে।আমজাদ চৌধুরী প্রয়োজনে ঝুঁকি নিতে রাজী আছেন কিন্তু একমাত্র ছেলে র জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে রাজী নন।

কয়েক দিন পরের কথা!
ইরা একাই মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে !রানী তো বেশ অবাক এবং খুশিও।কিন্তু ইরার মুখে তেমন হাসি ছিলোনা!
রানী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন!
-“কি হয়েছে মামনি? কোনো সমস্যা?”
ইরা পুরো ব্যপারটা পরিস্কার করে না বললেও যা বললো তাতে বোঝা গেলো যে
ইরার স্বামী নাকি কিছুদিন পর কানাডা যাবে!সাথে ইরাকেও নিয়ে যাবে।
রানী শুনে তো মহাখুশি হলেন…!
-“এটাতো খুবই ভালো কথা রে…।স্বামীর সাথে ইউরোপ,আমেরিকা ঘুরে বেড়াবি! আর আমি সবাইকে বড় মুখ করে বলবো যে আমার মেয়ে স্বামীর সাথে কানাডা বেড়াতে গেছে!”
কিন্তু ইরা কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে বললো-“দুর থেকে সব চোখে দেখা যায়না মা!”
-“বুঝলাম না!তোর যেতে সমস্যাটা কি?”
-“,সমস্যা কিছু না!তোমাকে শুধু এটাই বলতে এসেছি যে তুমি আমার সাথে যাবে।কেনাকাটার নাম দিয়ে হোক বা অন্যকিছু বলে হোক তোমাকে নিয়ে যেতে চাই আমি…!মোট কথা ওর সাথে একা যাবোনা!”
ইরা অস্বস্তিতে মায়ের দিকে ভালোভাবে তাকাতে পারছেনা!
রানী ওর মুখ তুলে ধরে বললেন-“ঠিক করে বল তো কি হয়েছে?”
ইরার চোখের কোণে এক বিন্দু পানি দেখা গেলো!-“আমি সব বলতে পারবোনা মা,শুধু অনুরোধ তুমি আমার সাথে চলো!তুমি সাথে থাকলে ও বুঝে শুনে চলবে,আমার সাথে যা খুশি করতে পারবেনা!”
-“কি বলছিস এসব?স্বামীর সাথে থাকবি এতে সমস্যার কি হলো?”
-“বললাম তো এখন এসব বলতে পারবোনা।তুমি আমার সাথে যাবে কিনা বলো?”
-“দেখি রাতে তোর বাবা আসুক! তোর বাবাও তো জানতে চাইবে!কি বলবো?”
-“যা ইচ্ছে হয় বলো শুধু তুমি আমার সাথে চলো,মীরাকেও নিয়ে নাও।নীরার প্রাকটিক্যাল চলছে…ও থাক্!আর আমি যে তোমাকে বলে আমাদের সাথে নিচ্ছি একথা ওকে বলোনা!ও জানুক,তুমি নিজের প্রয়োজনেই যাচ্ছো!”
-“কি জানি বাবা…… তোর কথার আগামাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা!তা কতদিনের জন্য যেতে হবে?”
-“পনের বিশ দিন হতে পারে আবার মাসখানেকও লাগতে পারে।ওর ব্যবসার কাজের অবস্থা বুঝে!”
-“আচ্ছা,ঠিক আছে…!”রানী মাথা নাড়লেন।
ইরা বেশীক্ষন থাকলো না।
শপিংয়ের কথা বলে বেরিয়েছিলো সে !
সেই সুযোগে মায়ের সাথে এসে কথাগুলো বলে বিদায় নিলো!
রাতে আমজাদ চৌধুরী ফিরলে রানী তাকে সব কথা জানালেন।আমজাদ চৌধুরী রানীকে ওদের সাথে যাবার পরামর্শই দিলেন।
পরের সপ্তাহেই রানী বড় মেয়ের সাথে কানাডা চলে গেলেন।
যাবার সময় পৌষীর হাত ধরে বললেন-“জানি,তোর উপর চাপ পড়ে যাবে।কারন সাহেদা তো অসুস্থ। তবু বাড়ীতে সবদিকে একটু খেয়াল রাখিস মা।আমি না আসা পর্যন্ত কোনো কাজের লোককে ছুটি দিবিনা।তাহলে তুই হাবুডুবু খাবি।সব কাজ ওরাই করবে তুই কেবল দেখিয়ে দিবি…কেমন?”
রানী জানেন পৌষী পূর্ণ সততার সাথে দায়িত্ব পালন করবে।এদিক দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত নইলে হুটহাট এদিক সেদিক তার যাওয়া মুশকিল হয়ে যেতো।
তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এবার দেশে ফিরে ওকে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ীতেই রাখবেন।ওদের হেড অফিসের ম্যানেজার ছেলেটাও ভালো।অল্প বয়স।ওকে প্রয়োজনে বাড়ীর পেছনে কোয়ার্টার বানিয়ে দেয়া হবে।এতে পৌষীরও ঠাঁই হবে সাহেদারও দুঃশ্চিন্তা কমবে আর তিনিও হাতের কাছে বিশ্বস্ত লোক পাবেন।পৌষীকেও তার হারাতে হলোনা!সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে রানী নিজের মনেই খুশি হয়ে উঠলেন!
সাহেদার অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।আজ সকাল থেকেই বলছেন যে,বুকের উপর নাকি প্রচন্ড চাপ অনুভব করছেন তিনি।
আমজাদ চৌধুরী অফিসে বসেই ফোন পেয়ে রাজকে নির্দেশ দিলেন,দ্রুত সাহেদাকে এ্যাপোলোতে নিয়ে ভর্তি করাতে।
তিনি কাজ সেরে সোজা ওখানে আসবেন।
এদিকে পৌষীর হিমশিম খাওয়ার দশা।একদিকে মায়ের অসুস্থতা অপর দিকে বাড়ীতে মামী নেই,সবকিছু দেখাশোনা করার দায়িত্ব ওর একার ওপর।
কোনদিকে যাবে সে?
এরিমধ্যে পৌষী যথাসাধ্য কাজ গুছিয়ে নিরাকে বুঝিয়ে দিলো।তারপর সাবুমিয়া আর রাহেলাকে বলে ও হাসপাতালে চলে এলো!
ইমারজেন্সীতে সাহেদার কিছু টেষ্ট করানো হলো!তার হার্টে কয়েকটা ব্লক ধরা পড়েছে।ইমিডিয়েট অপারেশন করানো লাগবে।ওপেন হার্ট সার্জারী করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ডাক্তাররা!
পৌষী শুনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
সে যতটুকু জানে এই অপারেশন করালে অনেকেই মারা যায়।
অপারেশনের ধকলটা সবাই নিতে পারেনা!
আমজাদ পৌষীকে ডেকে মাথায় হাত রেখে বললেন-“শোনরে মা!হায়াত মওত আল্লাহর হাতে! তোর মা’কে অপারেশন না করালেও ঝুঁকি না করালে ঝুঁকি তারচে বেশী।তাই অপারেশন করানোটাই ঠিক হবে।আমি কেবল একটা কথাই তোকে বলতে চাচ্ছি যে,তোর মা’কে তুই মনের দিক থেকে হালকা করে অপারেশন টেবিলে পাঠা।এটা তার জন্যেও ভালো হবে!”বলে আমজাদ পৌষীর দিকে উত্তরের আশায় চেয়ে রইলেন!
পৌষী বোকার মতো মামার দিকে তাকালো!
-“মামা,আপনি কি বলছেন,আমি ঠিক…!’
-“তোর মা তোকে বলেছে কিনা জানিনা!আমি চাই তোর মা তোকে একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে দেখে যাক।আমরা তো আশাকরি সে সেরে উঠবে।কিন্তু সে তো মনের মধ্যে প্রচন্ড চাপ পুষে রেখেছে! তার একটাই চিন্তা যে তার কিছু হলে তোর কি হবে!মা হিসেবে এই ভাবনাটা আসা খুবই স্বাভাবিক।তাই আমি চাই সাহেদার অপারেশনের আগেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে…… তুই কি বলিস?”
পৌষী এতক্ষণে ওর মামার কথাটার মর্ম ধরতে পারলো।
মা ও সেদিন ওর বিয়ে নিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
এখন পৌষীর কাছে নিজের ভালোলাগা-মন্দলাগার চেয়ে মায়ের স্বস্তিটাই বেশী জরুরী।
পৌষি মৃদু স্বরে বলল-“আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে মামা!আমি নিজে থেকে কিছুই ভাবতে পারছিনা!”
আমজাদ পৌষীর মাথায় আবার হাত রেখে বললেন-“গুড…সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারাটা অনেক বড় একটা যোগ্যতা। তোর মাকে আগামী পরশু অপারেশন টেবিলে তোলা হবে।আগামীকাল থেকে ওকে ফুল অবজার্ভেশনে রাখা হবে তখন ডাক্তার হয়তো রুগীর কাছে সবাইকে ভিড়তে দেবেনা!তাই আমি যা করার আজই করতে চাই!তোর মা’কে নিয়ে আজ বাসায় চলে যাবো আমরা! রাতেই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করবো!আগামী কাল তোর মা নিজের মেয়ে মেয়ের জামাই নিয়ে নিশ্চিন্তমনে অপারেশনের প্রস্ততি নেবে।কি…ঠিক আছে?”
পৌষীর বুকের বাতাস থেমে গেলো!
এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে? এভাবে হুট করে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে কখনো ভাবেনি পৌষী।
মামা ওর দিকে তাকিয়ে বললেন-“কি রে ,কিছু বলবি রে মা?”
-“মামী বা রাজ ওদের মতামতটা..?”
-“রাজের সাথে আমার কথা হয়েছে।ওর কোনো সমস্যা নেই!আর বাকি রইলো তোর মামী? সে ফিরলে তাকে বুঝিয়ে বলবো!এটা নিয়ে আমি এতোটা আপসেট না! বরং তুই নিজে রাজী কিনা সেটা বল্! তোর হয়তো মনে হতে পারে আমি তোকে চাপ দিয়ে….!”
-“না…মামা!আপনি আমাদের জন্য যা করেছেন তার ঋণ…!”
পৌষীর কথা থামিয়ে দিলেন মামা!
-“এসব কথা বলিসনা তো ।তোরা আমার ঘাড়ে পড়িসনি বরং তোরা আমার দায়িত্ব।তোদের প্রতি দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে না পারলে আমাকে আল্লাহর কাছে জবাব দিহী করতে হবে।তবে তোর কাছে আমার কেবল একটাই চাওয়া….”!
পৌষী মুখ তুলে তাকালো!
-“আমার ছেলেটাকে ভালো রাখিস!ওকে জীবনের মূল্য বুঝতে শেখাস।ও যেন ধর্মকে আর দশজনের মতো পোশাকি না বানিয়ে ফেলে।
পৌষী মুখ নামিয়ে রাখলো।সে বুঝতে পারছে ওকে কঠিন একটা দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে।এটা গ্রহন করা ছাড়া এ মুহূর্তে ওর আর কোনো উপায়ও নেই!

সাহেদার মনে হলো তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন।পৌষীকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না তার।পৌষীর মনে হলো সে তার মা’ কে এতো খুশি কখনো দেখেনি।সবচে বেশী খুশি নিরা।সে দুজন বান্ধবী জুটিয়ে একা একাই বিকেলের মধ্যে শপিং করে আনলো।পৌষী দ্বিধাজড়িত কন্ঠে বলল-“এতোটা দরকার ছিলোনা নীরা।ঘরোয়াভাবেই তো সব হচ্ছে!বাইরের কেউ তো আসছেনা!”
-“না আসুক! আমার দুজন বান্ধবী আর ভাইয়ার দুতিনজন ঘনিষ্ট বন্ধুবান্ধব থাকছে তোমাদের বিয়েতে …! আব্বুর হয়ত দুএকজন থাকতে পারে!তাতে কি?আমার একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে।যখন ফাংশান হবে তখন দেখা যাবে।কিন্তু বিয়ে তো বিয়েই!একটা বিয়ের শাড়ী থাকবেনা এটা একটা কথা হলো?তাই আমি মোটামুটি সব নিয়ে এসেছি।আব্বুই টাকা দিয়েছে আর তোমার ফিয়ন্সে কালার বলে দিয়েছে।
রাজ কালার বলে দিয়েছে শুনে পৌষী লজ্জায় আরক্ত হয়ে মুখ নামিয়ে নিলো।এই ছেলে দেখি বিয়ের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
পৌষী নিরার আনা শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোট জুতা কসমেটিকস,চুড়ি সব চুপচাপ দেখলো কিন্তু কোনো মন্তব্য করলোনা।এমনিতেই
পৌষীরর বুক ধুকধুক করছে, ঐদিকে রাজ কি ভাবছে কে জানে!”
রাজ দীর্ঘক্ষণ সিজদায় পড়ে ছিলো।এতো আন্তরিকভাবে সিজদা ও শেষ কবে দিয়েছে ও বলতে পারবেনা।
মাথা তুললে দেখা গেলো ওর চোখের কোন ভেজা।
বাবা যখন ওকে রাতেই বিয়ের খবরটা জানালেন তখন মনে হয়েছিলো ওর হ্রৎপিন্ডটা থেমে গেছে।
দুআ কবুলের আনন্দ ও হাড়েমাংসে টের পাচ্ছে।আল্লাহ ওর দুআ শুনেছেন।
আজ তার দুআ রঙীন হয়ে বাস্তবায়ন হতে চলেছে!রাজ তার মনের কথা কাউকে বলে বোঝাতে পারবেনা।ঐ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেনা ওর মনে কি পরিমাণ উথালপাতাল চলছে!

রাত আটটার মধ্যেই কাজী সাহেব এসে পড়লেন।দুচারজন অতিথি যারা ছিলেন তারাও খুব উৎসাহের সাথে ড্রইংরুমে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন।
অবশেষে কোনো রকম বাগাড়ম্বর ছাড়াই সাদামাটাভাবে বিয়েটা পড়ানো হয়ে গেলো।আমজাদ চৌধুরী নিজে মেয়ের ওয়ালী হয়ে কন্যা সম্প্রদান করলেন নিজেরই ছেলের হাতে!
আজ সকাল থেকে সারাদিনেও পৌষীকে একবারের জন্যেও দেখতে পায়নি রাজ।সে সারাদিনই রাজের চোখ বাঁচিয়ে চলাফেরা করছিলো!
কিন্তু আজ কন্যা সম্প্রদানের এই মুহূর্তে মেরুন বেনারসী পড়া পৌষীকে সে আশাই করেনি!রাজের স্ট্রোক হবার যোগাড়।বুকের ভেতর অজস্র দমকল যেন একসাথে ঘন্টা বাজাচ্ছে।
পৌষী মুখ নিচু করে রেখেছে।রাজের চোখে ওকে অপরূপ দেখাচ্ছে।
সাহেদা হুইল চেয়ারে বসে ওদের দুজনের হাত মিলিয়ে দিলেন!রাজ সে হাত আঁকড়ে ধরলো।পৌষীর হাতগুলো উষ্ণ মনে হলো রাজের কাছে!
বিয়ে পর্ব শেষে সাহেদাকে ঘরে শুইয়ে দেয়া হলো!আগত অতিথিদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য একটা রেষ্টুরেন্টে বলে রাখা হয়েছিলো।সেখান থেকে প্রচুর খাবার দাবার আসলে তারাই খাবার সার্ভ করলো!
বিদায় নেবার আগে ফিন রাজের পিঠে চাপড় মারলো-“অবশেষে রাজকন্যা জয় করলি তাহলে? এবার রাজকন্যার মনটা জয় করা বাকি! ”
রাজ মুচকি হাসলো -“হ্যাঁ…..! আলহামদুলিল্লাহ!”
সাহেদার রুমে মায়ের পাশেই চুপ করে বসে আছে পৌষী।সাহেদা ওকে প্রাণভরে দেখছেন।তার মিষ্টি মেয়েটা আজ স্বামীর অধীনে চলে গেলো।আহ্,আল্লাহ তাকে এতো বড় সুখ দিলেন।তার দরবারে কোটিবার শুকরিয়া।হঠাৎ তার রাণীর কথা মনে পড়লে ভয় লাগে,সে ফিরে এসব শুনলে কি বলবে কে জানে?”
এমন সময় রাহেলা হাসিমুখে উঁকি দিলো।
-“আফা…ও থুক্কু ভাবী আমনেরে বড়সাবে ডাকছে!”
পৌষী ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালে ওর হাতের চুড়িগুলো টুংটাং শব্দে ঝংকার তুলল!
-“মা…মামা ডাকছেন শুনে আসি!”
সাহেদা মাথা নাড়লেন।
ডাইনিং স্পেশে আসতেই আমজাদ চৌধুরী বললেন-“কি রে মা…নাকি বৌ মা বলবো? হা হা হা…. খিদে লেগেছে যে খেতে দিবিনা?”
পৌষী মুচকি হেসে প্লেট ধুয়ে মামার সামনে দিয়ে খাবার দাবার গুলো বেড়ে দিতে লাগলে মামা ওকে থামালেন!
-“রাজকে নিয়ে তুইও খেয়ে নে!যা ওকে ডেকে নিয়ে আয়!”
পৌষী এবার বিপদেই পড়লো!ওর পা গুলো মনে হলো কেউ যেন চেপে ধরে রেখেছে।বেশ ভারী মনে হচ্ছে ওগুলো!
ধীরে ধীরে পা বাড়ালো পৌষী!
রাজের ঘরের বারান্দার সামনে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো!কি ভাবে ডাকবে ওকে..!
পৌষীর যে ভীষণ লজ্জা লাগছে।
তখনি পেছন থেকে রাজ বলে উঠল-
-“আসসালামু আলাইকুম..!”
পৌষী চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার ওড়নাটা টেনে লম্বা করার চেষ্টা করলো!রাজ হেঁটে পৌষীর কাছে এসে দাঁড়ালো!পৌষী মাটির দিকে চেয়ে আছে।রাজ মৃদু স্বরে বলল-“কি…আমাকেই খুঁজছিলে?”
পৌষীর কানে রাজের তুমি ডাকটা বড় আপন মনে হলো!মৃদু স্বরে বলল-“মামা খেতে ডাকছে !”
-“তুমি ডাকবেনা?”
পৌষী মুখ নামিয়ে বলল-“খাবেন,চলুন!”
-“একটা অনুরোধ ছিলো,রাখবে?”
-“জ্বী…বলুন!”
-“আমার দিকে তাকাও…….বলছি!”
পৌষীর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল।
চলবে……!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here