হলুদ খাম, পর্ব:১১

0
365

#হলুদ_খাম
লেখিকাঃ #তানজীমা_ইসলাম

____________________[১১]_________________

তনু আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। ঝাপিয়ে পড়ল সায়নের প্রশস্ত বুকে। দু’হাতে সায়নের গলা জড়িয়ে ধরে ফোপাঁতে লাগলো। সায়ন একটা তৃপ্তির হাসি হেসে তনুর কপালে চুমু খেয়ে বলল,

” আস্তে ধর পেত্নী! তুই কি আমায় দম বন্ধ করে মারতে চাচ্ছিস!!

তনু ছাড়লো না। জড়িয়ে ধরা অবস্থায় ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল,

” আর আমি যে এত বছর ধরে দম বন্ধ হয়ে মরছি সে বেলায়!?

সায়ন আর কিছু বলল না। তনুর কান্নার বেগ বেড়েই চলেছে। কিন্ত সায়নের বুকে মুখ গুজে থাকায় শব্দটা সায়ন ব্যতীত কেউ শুনতে পাচ্ছে না। সায়ন ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশে ঝুলে থাকা রূপোলী চাঁদটার দিকে তাকালো।

আড়াই বছর আগে এমনই এক জ্যোৎস্না রাতে তনুকে নিজের নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো সায়ন। আজ এতো অপেক্ষার পর আবারও তনুর কাছেই ধরা দিয়েছে সে। ভালোবাসা থেকে পালিয়ে লাভ নেই। দিনশেষে ভালোবাসার কাছেই ফিরতে হয়। দেরিতে হলেও ফিরতে হয়।

_________________________________
|
|
|
|
|
ফোপাঁতে ফোপাঁতে তনু একসময় চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরপর শুধু নাক টানার মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে।
এখনও সায়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সে। যেন হাতের বাধন টা ঢিল হলেই সায়নকে আবারও হারিয়ে ফেলবে।

সায়ন বারবার ঘরের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে তারা এখানে। হাতে ফোন না থাকায় ঠিক কয়টা বাজে দেখতে পাচ্ছেনা। তবে তার সিক্সথ সেন্স বলছে অনেক রাত হয়ে গেছে।

এদিকে তনুও তাকে ছাড়ার নাম নিচ্ছেনা। হুট করে কেউ বারান্দায় চলে এলে শেষে হবে আরেক জ্বালা! সায়ন তনুর কানেকানে বলল,

” অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাবি চল।

” না আমি যাবো না।

” তো কি এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে রোম্যান্স করবি!?

তনু সাথেসাথেই সায়নকে ছেড়ে মুখ তুলে তাকালো। সায়নের চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলা করছে। তার ঠোঁটের কোণায় ফুটে ওঠা বাকা হাসিতে মারাত্মক লাগছে দেখতে।

সায়নের এই বাকা হাসিতেই তো বারবার ঘায়েল হয়ে যায় তনু। এই সুদর্শন মুখটা দেখলেই তার কেমন যেন ঘোর লেগে যায়।
তখন সে খুব করে চায়, সময়টা এখানেই থেমে যাক। কে জানে এই প্রেমময় মুহুর্ত আবার আসবে কি না!

তনুর ধ্যান ভাংলো নিজেকে শূন্যে ভাসতে দেখে! সায়ন তাকে কোলে তুলে নিয়েছে! তনু কিছু বলার আগেই সায়ন দ্রুত পায়ে তাকে নিয়ে ঘরে চলে এলো।
তনু কিছু বলতে গিয়েও বলল না। সায়ন সিড়ি বেয়ে উঠে তনুর ঘরের সামনে তনুকে নামিয়ে দিয়ে বলল,

” যা। ঘরে গিয়ে চুপচাপ ঘুমাবি।

তনু একবার ঘরের দরজায় তাকাচ্ছে আবার সায়নের দিকে তাকাচ্ছে। তনুর হাবভাব দেখে সায়ন কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

” কিরে! দাড়িয়ে আছিস কেন? এখন কি ঘরে নিয়ে বেডে শুইয়ে দেবো!!

প্রতিত্তোরে তনু শব্দ করে মুখ ভেংচি দিল। সায়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাপা স্বরে বলল,

” এটার পানিশমেন্ট তুই পাবি। এখন ভালোয় ভালোয় ঘরে যা। নয়তো এখানেই তোকে

বাকিটা বলার আগেই তনু টুপ করে সায়নের গালে চুমু একে দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে গেল। লজ্জায় ভয়ে তনুর সারা শরীরে কম্পন বয়ে চলেছে।

হাত দুটোও মৃদু কেপে উঠছে বারবার। তনু দু’হাতে মুখ ঢেকে বেডে শুয়ে পড়ল। কাল সায়নের সামনে কিভাবে যাবে ভাবতেই তনুর গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে থম মেরে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে সায়ন। তার শরীর মন সব আউলা ঝাউলা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগের সেই মধুময় দৃশ্য যতবার মনে পড়ছে ততবারই ভীষণ আকারে ঘামছে সে।
তনু এই প্রথম নিজে থেকে তাকে স্পর্শ করেছে! ভাবতেই আরেক দফা শিহরণ বয়ে গেল তার সারা শরীরে।

______________________________
|
|
|
|
|
বেডে শুয়ে তনু এপাশ ওপাশ করতে করতে একপর্যায়ে উঠে বসল। কিছুতেই ঘুম আসছেনা তার। ফোন হাতে নিয়ে দেখল রাত দুইটা বাজে।
এক ঘন্টাও হয়নি সায়ন তাকে রেখে গেছে। অথচ মনে হচ্ছে যেন কত সময় পেরিয়ে গেছে। হয়তো কিছুক্ষণ পরই দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসবে।

মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মাঝেমধ্যে এমন মনে হয় যে, রাত শেষ হতে চলেছে, এখনই আকাশ পরিষ্কার হয়ে সূর্য উঁকি দেবে পুব আকাশে। তনুরও এখন তাই মনে হচ্ছে। ফোনের টাইম দেখেও বিশ্বাস হচ্ছেনা এখন মাত্র দুইটা বাজে।

সেইসাথে তার ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাথার মধ্যে এলোমেলো প্রশ্নেরা বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলেছে। তনু অনেক কষ্টে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে ভাবতে লাগল,

” সায়ন ভাইয়া বলেছে সে জানে না আমাদের বিচ্ছেদের মূল কারণ কি ছিলো।

” আবার মায়ের কাছে জবাব চাইছে, আমাদের কেন আলাদা করে দিলে।

” আমাদের আলাদা হওয়ার সাথে মায়ের কি সম্পর্ক?

” আর যদি থাকে, তাহলে তো মা সব জানে!

শোয়া থেকে উঠে বসল তনু। পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে গেছে। হাতড়ে পাতড়ে বেডের নিচে রাখা পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিল। দরদর করে ঘাম ছুটছে তার। মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। জানতে হবে আসলে কি হয়েছিলো। আর সায়নও বা কেন তাকে মিথ্যে বলে ব্রেকাপ করেছিলো।

তনু পানির বোতলটা দু’হাতে ধরে চোখ জোড়া বুজে ফেলল। বেডে হেলান দিয়ে বসে অতীতের পাতায় চোখ বুলাতে লাগল,

” সেই রাতে সায়নের বলা দুটি ঐন্দ্রজালিক শব্দের মাধ্যমে ভালবাসা নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো সায়ন আর তনু। দুটি মনের অপ্রকাশিত অনুভূতি গুলো সেদিন প্রণয়ে পরিণত হয়েছিলো।
তনুর নিজস্ব ফোন না থাকায় মন চাইলেই সায়নের মাদক মিশ্রিত কন্ঠঃ সে শুনতে পেতো না।
তবে সায়ন হুটহাট তার প্রেয়সীকে দেখতে চলে আসতো।
তাদের প্রেমটা আবদ্ধ হয়েছিলো সেই হলুদ খাম আর কুরচি ফুলের মাঝেই।
প্রতিবার হলুদ খামের সাথে সায়ন এক গুচ্ছ কুরচি ফুল তনুকে পাঠাতো।
তনু সেই ফুল গুলো পড়ার টেবিলের ওপর সজত্নে সাজিয়ে রাখতো আর মন দিয়ে পড়াশোনা করতো। কিন্ত দিনদিন এমন অবস্থা হল যে, সায়নের চিঠি না পেলে পড়ায় তার মন বসতো না।
নব্বই দশকের প্রেমিকাদের মতো তনুও প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকতো, কখন আসবে তার সেই হলুদ খাম! যদিও সেটার আসার কোনো নির্দিষ্ট ঠিকঠিকানা ছিলো না।
কখনো কখনো এক সপ্তাহ বা এক মাস পরেও চিঠি আসতো। তবে তিন মাস কখনো পেরোতো না।
এর কারণ অবশ্য সায়ন নিজেই তনুকে বলেছিলো, “প্রেমিকার থেকে তিনমাসের বেশিদিন দূরে থাকতে নেই”। এটা নাকি প্রেমের নীতিতে মস্ত বড়ো অপরাধ!
কথাটা আদৌ কেউ বলেছিলো নাকি কে জানে।
তা নিয়ে তনু কখনো মাথা ঘামায়নি। কারণ, সায়নের বলা কথা মানেই তার কাছে তিন সত্যির সমান।
তাই হয়তো সায়নের মিথ্যে অযুহাতও সেদিন তার কাছে সত্যি মনে হয়েছিল!
সেদিন ছিলো রাইসার বৌভাত। সায়নের পাঞ্জাবীর সাথে মিলিয়ে গাঢ় বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছিলো তনু। তাদের সম্পর্কের বয়স তখন দেড় বছর চলছে।
কিন্ত ফ্যামিলির কেউ জানতো না শুধু স্নেহা বাদে। কেউ সন্দেহ করবে ভেবে সায়ন তনুর থেকে বেশ দূরত্ব রেখে অনুষ্ঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো।
এদিকে রাইসার পাশে বসে ছবি তোলার সময় তনুর হটাৎ মনে হল, কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্ত ব্যাপারটা তেমন একটা পাত্তা দিলো না সে। রাইসার পাশ থেকে উঠে আসার সময় একটা ছেলের সাথে ধাক্কা লাগে তার। ছেলেটা সাথেসাথে বলে উঠল,

” স্যরি মিস! আপনার লাগেনি তো!?

তনু পড়ে যাওয়ার আগেই নিজেকে সামলে নিল। কেন যেন মনে হচ্ছে ছেলেটা ইচ্ছে করেই তাকে ধাক্কা দিয়েছে। কিন্ত তার অপরাধীর মতো কাচুমাচু করা ফেইস দেখে ভাবল, হয়তো এক্সিডেন্টলি হয়ে গেছে। তনু ভদ্রতার খাতিরে বলল,

” না। আমি ঠিক আছি।

বলেই তনু দ্রুত পায়ে স্টেজ থেকে নেমে এলো। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে হয়তো আরও কিছু বলতো। তনু মনেমনে হেসে বলল,

” কিছু বলে যে লাভ নেই ভাই। আ’ম অলরেডি ইন লাভ উইথ মাই হলুদ খাম।

স্টেজ থেকে নেমে সায়নকে খুজে বেড়াচ্ছে তনু। খুজতে খুজতে পেয়েও গেলো। কিন্ত যএভাবে পেলো তা দেখে সাথেসাথেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সায়ন দুটো মেয়ের সাথে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর হাসছে। মেয়ে গুলো কথা বলছে কম হাসছে বেশি।

সায়নও যে এতো কি কথা বলছে কে জানে। অন্য কোনো দিকে হুস নেই তার! মেয়ে গুলো সায়নের দিক ফিরে থাকায় তাদেরকে দেখতে পাচ্ছেনা তনু। কি ভেবে রেগেমেগে এগিয়ে গেলো সেদিকে। তনু কাছাকাছি আসতেই সায়নের দৃষ্টি গেলো তার দিকে। তনু চোখ পাকিয়ে বলল,

” স্যরি ইনটেরাপ্ট করছি। মি. সায়ন! আমার সাথে ওদিকে চলুন তো। আপনার সাথে কথা আছে!!

তনুর এমন রূপ দেখে সায়ন কিছুটা ভড়কে গেল। তার উপর তনু তার নাম ধরে ডাকছে! মি. সায়ন!! তনু তাড়া লাগিয়ে বলল,

” কি হল চলুন! নাকি এদেরকেও সাথে নিয়ে যাবেন!?

এবার পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে সায়ন। তনু এই মেয়েগুলোকে দেখে জেলাস ফিল করছে! সায়ন বিড়বিড়িয়ে বলল,

” বাচ্চাকাচ্চার সঙ্গে প্রেম করলে যা হয়!

সায়ন কথাটা আস্তে বললেও তনু স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। সাথেসাথে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো তনু। রাগে গজগজ করতে করতে সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, সায়ন খপ করে তার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো।

তনুর রাগ নামছেনা। তার ইচ্ছে করছে সায়নের হাতে জোরে একটা কামড় দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে। সায়ন সেসব উপেক্ষা করে বলল,

” মিট মাই লাভ, তনু।

চকিতে সায়নের দিকে তাকালো তনু। মেয়ে দুটো হেসে বলল, ” তো ওকে আমরা কি বলে ডাকবো!? তনু ভাবি? নাকি বাচ্চা ভাবি!?

তনু আরেক দফা অবাক হল। মেয়ে গুলো তাকে ভাবি ডাকছে! সে কি ঠিক শুনেছে নাকি তার চোখের সাথেসাথে কানটাও গেছে!! সায়ন তাকে আরেকটু নিজের সাথে চেপে ধরে বলল,

” যখন ও ভাবি হবে, তখন কি আর বাচ্চা থাকবে নাকি!? তখন ভাবি ডাকবি।

তনু আবারও সায়নের দিকে তাকালো। তার চোখে একরাশ বিস্ময়! সায়ন তার বিস্ময় কাটাতে বলল,

” এই যে বড় আপুদের দেখছিস, এরা যমজ বোন আর আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড।

তনু এবার বেশ লজ্জায় পড়ে গেছে। মেয়ে গুলোকে সে কি না কি ভেবেছিলো। এখন নিজের ওপরই ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। মেয়ে গুলো কি ভাবছে কে জানে। এরমধ্যেই মেয়ে দুটোর একজন বলল,

” আচ্ছা ভাবি! তুমি এবার কোন ক্লাসে পড়ো!?

তনু হালকা গাল ফুলিয়ে বলল, ” এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।

|
|
|
|
|
[চলবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here