#হিংস্রতায়_ভালবাসা
#পর্ব_০২
#রীমা_শারমিন
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি।।মা,বাবা,দাদি,,ছোট বোন আর আমি এই পাঁচ জনের ছোট সুখী সংসার ছিল আমাদের।। বাবা খুব বড় পদের চাকরি না করলেও আমরা খুব ভালোই ছিলাম।টিউশনি করিয়ে নিজের পড়ার খরচ নিজেই জোগাড় করতাম সাথে বাবাকে টুকটাক হেল্প ও করতাম সংসারে। সবমিলিয়ে আমি আমার ছোট্ট দুনিয়ায় খুব সুখী ছিলাম।। কিন্তু সেই সুখ যে আমার জীবনে ক্ষনস্থায়ী সেটা আমার জানা ছিল না।
একদিন মা ফোন করে কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি আসতে বলল।বাসায় ফিরেই দেখলাম সবাই ভীষণ খুশি।
— মা,বাসায় কি কোন মেহমান আসবে নাকি এতো আয়োজন করছো যে?
— কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পাবি,তুই যাতো মা সুন্দর করে সেজেগুজে আয় তো!!
— আমি সাজবো কেন?
তখনই পাশ থেকে আমার ছোট বোন প্রিয়ু হাসতে শুরু করল।ওর মাথায় একটা গাট্টা দিতেই ও চেচিয়ে উঠল,,
— এখন যতখুশি মেরে রাখো আপু,,কয়দিন পরে তো আর সুযোগ পাবে না!!
— ওই সুযোগ পাবো না মানে, কোথায় যাবি তুই?
— হা হা হা,, আমি না তুমি যাবে!
— আমি কোথায় যাবো?
— কেন, শশুরবাড়ি হিহিহি!
— মারবো টেনে এক চড়! আমার বিয়েই হলো না আবার শশুড়বাড়ি।
— আজ তো তোমাকে দেখতে আসছে আপু,,ছেলে অনেক হ্যান্ডসাম। তোমার সাথে খুব মানাবে!!
— মানে কি? আমাকে না জানিয়েই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললে মা?
— দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যাবে পাগলি মেয়ে?এখন যাতো আমাকে কাজ করতে দে!
আর কোন কথা বাড়ালাম না,সত্যিই তো দেখতে আসলেই কি আর বিয়ে হয়ে যায়? আমার পছন্দ হতে হবে আগে তবেই!আলমারি থেকে মায়ের নীল শাড়িটা পড়ে, হালকা মেকাপ করলাম। সাথে হালকা লিপস্টিক আর হাতভর্তি কাচের চুড়ি পড়ে চোখে গাঢ় কাজল দিলাম!সিম্পল সাজ সবসময়ই আমার কাছে ভালো লাগে!!আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই তো প্রেমে পড়ে গেলাম হিহিহি।।
— বাহ আমার সতিনকে তো আজ খুব সুন্দর লাগছে!তোকে দেখে তো সে পলকই ফেলতে পারবে না!!
দাদি কানের নিচে একটু কাজল লাগিয়ে দিল।
— হয়েছে হয়েছে থামো তুমি বুড়ি,,আমাকে না জানিয়ে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ এখন আবার ঢং করতে এসেছো,হুহ!
— ছেলে দেখতে মাশাআল্লাহ,তোর পছন্দ হবে,, আর তুই অনেক সুখে থাকবি ছেলে অনেক বড় লোক।
— তবুও দাদি,শুধু বড়লোক হলেই হয় না তার সাথে সাথে মনটাও বড় হতে হয়।যদি ছেলে অহংকারি হয়, তখন?
— আচ্ছা আগে দেখি ছেলেকে, তারপর নাহয় এসব নিয়ে ভাবা যাবে!
এরমধ্যেই প্রিয়ু এসে বলল ছেলে চলে এসেছে।দাদি সেখানে চলে যেতেই প্রিয়ু এসে আমার পাশে বসল,,
— আপু জানিস ছেলে কে?
— কে?
— আহিল খান,কেএ গ্রুপের এমডি। শহরের সেরা ধনীদের মধ্যে একজন! আর দেখতেও অনেক হ্যান্ডসাম। আপু তুই রাজি হয়ে যা প্লিজ প্লিজ।
প্রিয়ুর কথা শুনে আমার মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরতে লাগলো। এত বড়লোক কিন্তু আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে কেন বিয়ে করতে চায়? সে চাইলে তো অনেক ধনী ফ্যামিলির মেয়েকে বিয়ে করতে পারে! ভাবনার মধ্যে পানি ঢেলে দিয়ে মা এসে টেনে নিয়ে গেল আমাকে ডাইনিং রুমে। মাথা নিচু করে বসে ছিলাম উপরে তাকাতেই আমার চোখ আটকে গেল আহিলকে দেখে।কারণ আহিল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।গলা খাকারি দিতেই চোখ নামিয়ে নিল।। আমি আহিলের সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাইলাম কেননা আমার তখনও সন্দেহ পুরোপুরি কাটেনি, আমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার কারণ কি? বাগানের কোনে দোলনার পাশে হাটতে হাটতে কথা বলছিলাম আহিলের সাথে।
— দেখুন আহিল সাহেব, আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি তাই আপনাকে সরাসরিই জিজ্ঞেস করছি।
— হ্যাঁ অবশ্যই,তুমি যা জানতে চাও জিজ্ঞেস করতে পারো।
— আমি শুনেছি আপনি অনেক বড়লোক,, ঢাকায় বেশ কয়েকটি বিজনেস রয়েছে আপনার, সো আপনি চাইলে,,
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আহিল বলল,,
— আমি চাইলে যেকোনো কোটিপতির মেয়েকে বিয়ে করতে পারি, তাইতো??
— exactly!
— আমি আমার জন্য বউ নিতে চাই, আমার লাইফ পার্টনার চাই।ম্যাটার করে না সে কোটিপতির মেয়ে নাকি সাধারণ ঘরের মেয়ে!!আমি তোমাকে আজ থেকে সাতদিন আগে তোমার কলেজের সামনে দেখেছি আর সেদিনই ঠিক করে নিয়েছি স্ত্রী হিসেবে আমার তোমাকেই চাই।।ছয়দিন লেগেছে তোমার ঠিকানা খুজে পেতে আর সাতদিনের দিন আমি তোমার সামনে।। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি প্রানো আর সারাজীবন ভালবাসতে চাই।বিলিভ মি,,আমি তোমাকে এতো ভালবাসবো যে,তোমার আর কারো ভালবাসার প্রয়োজন হবে না!!
সেদিন আহিলের কথা আমার কাছে মাদকের মতো মনে হয়েছিল, নেশা হয়ে গেছিল আমার।। আমি ফেরাতে পারিনি ওনাকে।।
সবাই রাজি থাকলেও বাবা রাজি ছিল না। বাবার মনেও একই সন্দেহ ছিল আমার মতো।তাই বাবা তখনই ওনাকে মানা করে দিয়েছিলেন কিন্তু ওনার এই ইনোসেন্ট মুখ আর কথার জালে বাবাও ফেসে গিয়েছিল।। কথা শেষ করে বাসার মধ্যে যেতেই বাবা সামনে দাঁড়ায়।
— দেখুন আহিল সাহেব,,আমি মধ্যবিত্ত এক বাবা আর আপনার সাথে আমাদের অনেক তফাৎ।
— বাবা,প্রথমত আমাকে তুমি করে বলবেন প্লিজ আমাকে আপনার একটা ছেলে মনে করবেন। আমার মা বাবা কেউ নেই,, আমি এখানে এসেই আপনাদেরকে আমার মা-বাবা হিসেবে ধরে নিয়েছি।। বাবা আর ছেলের মধ্যে কি অর্থ সম্পদ কখনো তফাৎ সৃষ্টি করতে পারে বলুন??
আহিলের এমন কথায় আমার বাবা আর না করতে পারেনি সেদিন।। বাবাও বশীভূত হয়ে পড়েছিল।। খুব সাদামাটা ভাবেই আমার আর আহিলের বিয়েটা হয়ে যায়।।আহিল নিজের হাতে আমাকে বরন করে এই ঘরে নিয়ে এসেছিল। আহিলের ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালের রুপ আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।কাউকে বললে হয়তো বিশ্বাসও করবে না কারণ সবার সামনে যে ওর অন্য একটা রুপ আছে।। বিয়ের তিনমাসে আমি প্রতিটা মুহুর্তে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। এই বিশাল বাড়িতে আমি আর আহিল ছাড়া কেউ নেই। কথা বলার মতোও একজন মানুষ নেই যার সাথে কথা বলে একাকিত্ব দূর করা যাবে।। প্রথম প্রথম আহিল বলতো আমাদের মাঝে ডিস্টার্ব সৃষ্টি করবে তাই ল্যান্ডফোনের বা আমার ফোনের কোন দরকার নাই।। কিছুদিন পরে সব ব্যবস্থা করবে। এমনকি সেজন্য কাজের লোকও রাখেনি আমাদের প্রাইভেসির জন্য।। তখন এসব কিছুর মধ্যে ভালবাসা খুঁজে পেলেও এখন আমি বুঝতে পারি এসব আসলে আমাকে সবার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্যই করেছে।। মা-বাবার সাথে কথা হয়না অনেকদিন, আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই আমার।। কেমন আছে সবাই??
আহিলের বলা সেই কথাটার মানে এখন বুঝতে পারছি,,”তোমার আর কারো ভালবাসার প্রয়োজন হবে না”!!কিন্তু আমি তো এমন ভালবাসা চাই নি!!
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বেলা গড়িয়ে গেছে টেরই পাইনি।। কলিংবেলের আওয়াজে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলাম।খুড়িয়ে খুড়িয়ে দরজার কাছে গেলাম।। দরজা খুলতেই দেখলাম আহিল দাড়িয়ে আছে।। হাতে কিছু খাবারের প্যাকেট।।কিন্তু চেহারায় রাগের ছাপ স্পষ্ট।
— প্রানো তুমি এখনো খাবার খাওনি কেন?
— আ আমি আসলে..
— তুমি আসলে কি, আমি সকালবেলা উঠে তোমার জন্য নাস্তা রেডি করে রেখে গেলাম কিন্তু তুমি না খেয়ে বসে ছিলে।আমার কথার কোন দাম নেই তোমার কাছে?
— স সরি!
— শাটআপ প্রানো,,কথায় কথায় এভাবে কাদার কি আছে?আমার জন্য এক কাপ কফি নিয়ে এসো যাও।
— এখন কফি?
— যেটা বলেছি সেটা করো,উল্টো প্রশ্ন করতে বলিনি তোমাকে।
— আচ্ছা আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
কফি এনে দেখলাম আহিল ওয়াশরুমে। কফিটা রেখে আমি ডাইনিং টেবিলের কাছে গেলাম খাবার সার্ভ করার জন্য।খাবার সার্ভ করার কিছুক্ষণ পরেই ঘর থেকে কিছু ভাঙার আওয়াজ এলো।তড়িঘড়ি করে রুমে যেতেই দেখলাম চায়ের কাপটা ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে আর আহিল অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।।
চলবে…….
ধন্যবাদ।