বর্ষাই বোধহয় ইতিহাসের প্রথম মেয়ে, যে কিনা এক্স বয়ফ্রেন্ডের হলুদের অনুষ্ঠানে বিনা দাওয়াতে এসে ধুমছে নাচতাছে। তাও যেই সেই নাচ নয় একেবারে চমলোক্ক নাচ। বর্ষার এক্স বয়ফ্রেন্ড অনিক চোখ দুটো রসগোল্লা করে বর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের পলকও পরছে না। বর্ষা নাচের তালে তালে আড়চোখে অনিকের দিকে তাকাচ্ছে আর ঠোঁট চোখা করে চুমু দেখাচ্ছে। বেচারা অনিক বিস্ময়ে হতভম্ব। সে কখনও ভাবেনি বর্ষা এমন কিছু করবে। ধপ করে স্টেজের সোফায় বসতেই অনিকের বন্ধু রবিন ছুটে এসে বললো,
“দোস্ত ঐটা তোর গার্লফ্রেন্ড বর্ষা না?”
“হো দোস্ত, ওর তো এখানে এসে নাচার কথা নয়।যেখানে ওর বালিশ ভিজিয়ে সারা দুনিয়া এক করে কাঁদার কথা সেখানে ও আমার হলুদে এসে নাচতাছে। আমার মাথা ভনভন করে ঘুরতাছে। আমারে বাতাস কর রবিন।”
বর্ষা সাউন্ড বক্সের গান পাল্টে বেওয়াফা গান ছাড়লো। তারপর নাচের তালে তালে নিজেও গাইতে আরম্ভ করলো,
“বেওয়াফা, বেওয়াফা, বেওয়াফা হে তু!”
আঙুল ইশারা করে বেশ কয়েকবার অনিককে শাসাতেও ভুললো না বর্ষা। অনিক তা দেখে বড়সড় একটা ঢোক গিললো। এমনটা নয় যে অনিক বর্ষাকে ভয় পায়। তবে আজ ভিন্ন রকম বর্ষাকে দেখে সত্যি ভয় করছে তার। যে মেয়েকে একটা ধমক দিলে নাকের জল, চোখের জল এক করে ফেলতো। সে অনিককে ইশারায় শাসাচ্ছে। হঠাৎ করে যেনো বর্ষাকালের কালো আকাশের মতো বর্ষার রূপটা বদলে গেছে। এই রূপের সাথে অনিক পরিচিত নয়।
অনিক তড়িঘড়ি করে স্টেজ থেকে নেমে সটকে পরলো। সে এই মুহুর্তে বর্ষার মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না।হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হতে ঢেঢ় সময় বাকি। বোরিং সময় যাতে না কাটে তাই কাজিনরা মিলে নেচে পরিবেশ গরম করে রাখছিলো। সেখানেই হঠাৎ উদয় হয় বর্ষার। এসেই সেকি নাচ! সবার কাছে পরিচয় দিয়েছে অনিকের ফ্রেন্ড বলে। এতে কেউ আর কোন প্রশ্ন করেনি। হাতেগোনা অনিকের কয়েকটা বন্ধু ওকে চিনে। তারা দেখেও হতবাক। অনিকের কাছে যতটুকু শুনেছে তাতে বর্ষাকে অন্য পাঁচটা মেয়ের মত সাধারণ আর সহজ, সরল ধরে নিয়েছিলো। কিন্তু আজ যেনো অন্য রূপ দেখছে।
★
বন্ধুদের সাথে বাড়ির পেছন দিকে চিন্তিত মুখে বর্ষার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলো অনিক। ওর বন্ধু সাব্বির বললো,
“তুই না বললি বর্ষা কোন ভেজাল করবে না৷ তাহলে ও এখানে আসছে কেন?”
অনিকের আরেক বন্ধু পারভেজ বললো,
“তুই মেয়েটার সাথে কাজটা ঠিক করলি না। ও তোকে নিয়ে অনেক সিরিয়াস ছিলো। সেখানে তুই ওকে ঠকিয়ে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করছিস। এখন যদি মেয়েটা পুলিশ নিয়ে এসে ঝামেলা করে?”
রবিন কলার ঝাড়া মেরে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“ঝামেলা করবে বললেই হলো? আমরা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো নাকি?”
অনিক এসবে মনোযোগ দিতে পারছে না। সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার আর বর্ষার সম্পর্কটা বেশি দিনের নয়। মাত্র তিন মাসের। প্রপোজ সে করলেও সম্পর্ক নিয়ে বেশি সিরিয়াস ছিলো বর্ষা। প্রথম প্রথম বর্ষাকে ভালো লাগলেও পরবর্তীতে তাকে আর ভালো লাগতো না অনিকের।তার মনে হতো মেয়েটা বড্ড ঠান্ডা স্বভাবের। অনিক রাগ করলে, জিদ করলে নিরবে সব মেনে নিতো, কিছু বললেই কেঁদে ফেলতো। এমন নিরামিষ মেয়েকে তার ভীষণ বিরক্ত লাগে। কথায় কথায় ছেঁদ কাঁদুনে মেয়ে তো আরো অপছন্দ। তাই মামার আনা প্রস্তাবে মানা করেনি। মেয়ের বাবা বিশাল বড়লোক। মেয়ের জামাইকে নগদ পাঁচ লাখ টাকা আর মোটরসাইকেল উপহার দিবে। খাঁটি বাংলায় যেটা যৌতুক। সাথে ঘরভর্তি ফার্নিচার, স্বর্ণ গয়না তো আছেই। এতো কিছুর লোভে পরে সে রাজী হয়ে যায়।
বর্ষাকে বিয়ে করে তার লাভ নেই। ওর বাবা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা।বেতন আর কত যে মেয়ের জামাইকে এমন অঢেল উপহার দিবে। তাই সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে নিশ্চিন্তে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। বর্ষাকে দাওয়াত করারো প্রয়োজন মনে করেনি। আর মনে মনে ভেবেছে বর্ষার মতো মেয়ে ওর কি আর করতে পারবে? কিন্তু অনিক এখন হিসাব মিলিয়ে দেখলো বেশ বড় একটা ভুল হয়ে গেছে। বর্ষাকে সে যা ভেবেছে, যেমন দেখেছে আসলে সে তেমন টাইপের মেয়ে নয়। আসলেই নয়!
★
বর্ষা অনিককে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পেছনে দিকে চলে এসেছে। অনিক ওকে দেখেই আৎকে উঠলো। মুখটা রাগে টকটকে হয়ে আছে বর্ষার। আশেপাশে কি জানি খুঁজলো। এক সময় ভাঙা ইটের টুকরো পেয়ে তা হাতে তুলে নিয়ে বিশ্রী সুরে কতগুলো খাস বাংলায় বকা দিয়ে বললো,
“শা’লা, আমার সাথে তিন মাস প্রেম করে এখন অন্য মেয়েকে বিয়ে করছিস? তবে রে ফুটার পো ফুটা!আজ তোর খবর আছে। দরকার পরলে তোকে মে’রে আমি জেলের ভাত খাবো। তাও তোকে আজকে মা’র’বোই মা’র’বো।”
বর্ষার মুখে গালি শুনেই অনিক তব্দা খেয়ে গেছে। বাকি কথা তার কান দিয়ে ঢুকেনি। কিছু বুঝে উঠার আগেই বর্ষা হাতের ইটের টুকরোটা সজোরে ছুঁড়ে মারলো অনিকের দিকে। অনিক লাফ দিয়ে সরে যাওয়ায় বেঁচে গেলো। অনিকের বন্ধুরা হই হই করে উঠলো। কিন্তু বর্ষার হুশ নেই। অনিকের শরীরে ইটের টুকরোটা লাগেনি বলে সে রাগে গজগজ করছে। পাশেই ডেকোরেশনের জন্য কতগুলো বাঁশ রাখা।সেখান থেকে একটা মোটা শক্তপোক্ত বাঁশ নিয়ে উঁচিয়ে ধরে বললো,
“আল্লাহর কসম অনিক, আজ যদি এই বাঁশ দিয়ে তোর মেইন পার্টে বারি না দিছি তাহলে আমার নাম বর্ষা নয়।”
অনিকের সাথে এবার বাকি বন্ধুগুলোও ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো। রবিন এগিয়ে এসে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলে তার আগে বর্ষা বাঁশ উঁচু করে শাসিয়ে বললো,
“আজ যেই শা’লা’র পু’তে আমার সামনে আসবে তার খবর আছে।জি’ন্দা দাফন দিবো। তোমরা পাইছো কি? আমারে ভুলো ভোলা দেখে মনে করছো আমারে নিয়া খেলবা আর আমি কিছু বলবো না। এমনটা তো হবে না। আজকে তোর খবর আছে অনিক্কা!”
বাশ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বন্ধুদেরকে ভয় দেখিয়ে অনিকের পেছনে ছুট লাগালো বর্ষা। ওর বন্ধুরা যে যার মতো পড়িমরি করে পালিয়েছে। বর্ষার যে রণমুর্তি আজ তারা দেখেছে তাতে তাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ। এমনটা নয় তারা বর্ষার সাথে পারবে না। কিন্তু বর্ষার যে রূপ দেখছে তাতে যদি দু-একটা শরীরে বারি দেয় তাহলে সপ্তাহ খানেক বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না। যদিও এগুলো নিছক কল্পনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।তবুও তারা বর্ষাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। ওদের মনের মধ্যে ভয়টা এমনভাবে জেঁকে বসছে যে না পালিয়ে উপায় নেই। অনিক জোরে চেচিয়ে করুন সুরে বললো,
” হারামিগুলা বন্ধুত্বের এই পরিচয় দিলি।”
দৌড়ে সামনের মাঠে চলে গেলো অনিক। পিছনে পিছনে বর্ষা। হঠাৎ জুতার সাথে বেজে মুখ থুবড়ে পরে গেলো অনিক। নিজেকে পিছন দিকে হিঁচড়ে নিয়ে অনুরোধের সুরে বর্ষাকে বললো,
“আমাকে ছেড়ে দাও বর্ষা। আমার কোন দোষ নেই।হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমি তোমার সাথে অভিনয় করেছি কিন্তু আমি সত্যি তোমায় ভালোবাসি।”
বর্ষা হুংকার দিয়ে বললো,
“এসব মিথ্যে ছেলেভুলানো কথায় বর্ষা গলছে না। বোকাসোকা সেজে ছিলাম বলে তুমি আমায় ঠকাবে তাতো হবে না। কি ভেবেছো আমি তোমাকে এভাবেই ছেড়ে দিবো? ভালো ছিলাম ভালো লাগেনি। যখন আমি খুঁটি ধরে গর্তের ভেতর লুকিয়ে ছিলাম প্রেম করবো না বলে। তখন তো আমাকে টেনেহিঁচড়ে বের করছিস।আর এখন আমাকে কাঁদিয়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে তুই সুখে থাকবি। তাতো হতে দিবো না আমি। আজ তোমার অভিনয়ের পার্ট ঘুচাবো আমি। বড় অভিনেতা হয়ে গেছো তুমি না?”
সর্বশক্তি দিয়ে অনিকের পায়ে একটা বারি দিলো বর্ষা।যাতে অনিক পালাতে না পারে। অনিক ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। জোর লাগিয়ে রানের কাছটায় আরেকটা বারি বসালো।এতেই অনিক কুপোকাত।এক বিশাল আত্ম চিৎকার দিয়ে মাটিতে কুজো হয়ে মুড়িয়ে গেলো।ব্যাথায় সে চোখ মেলতে পারছে না।বর্ষা পৈশাচিক হাসি দিলো। কিন্তু বর্ষার রাগ কমছে না। তাই আরেকটা বারি দেওয়ার জন্য বাঁশ উচু করতেই কেউ ওর কোমড় পেচিয়ে……..
#চলবে
#হৃদয়ের_একাংশ_তুই
#Part_01
#Writer_NOVA