হৃদয়ের একাংশ তুই পর্ব -০২

#হৃদয়ের_একাংশ_তুই
#Part_02
#Writer_NOVA

বর্ষা পৈশাচিক হাসি দিলো। কিন্তু বর্ষার রাগ কমছে না। তাই আরেকটা বারি দেওয়ার জন্য বাঁশ উচু করতেই কেউ ওর কোমড় পেচিয়ে পিছনে টেনে নিয়ে গেলো। কিন্তু এতে অনিকের শেষ রক্ষা হলো না। বর্ষা সরে যাওয়ার আগে অনেক জোরে আরেকটা বারি দিয়েই সরেছে। গগন বিদারক এক চিৎকারে অনিক অজ্ঞান হয়ে গেলো। ভেতরে এখনো সাউন্ড বক্সে জোরে গান বাজছে। গানের কারণে অনিকের গলার স্বর ভেতরে পৌঁছালো না।

রাগে ফুঁসছে বর্ষা। মানুষ প্রতিশোধ পরায়ণ হলে তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে যায়। কে ওকে কোমড় পেচিয়ে ধরছে তা দেখতে চোখ উঠলো। ওর বেস্টফ্রেন্ড হৃদয়। হৃদয়ের সাথেই বর্ষা এখানে এসেছে। হৃদয় চোখ বড় বড় করে অনিকের দিকে তাকিয়ে আছে। বর্ষা নিজেকে ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিলো। আঙুল উঠিয়ে শাসানো গলায় বললো,

‘কোন সাহসে কোমড় পেচিয়ে ধরছিস?’

‘সরি, দোস্ত! তোকে থামানোর আর কোন উপায় পাচ্ছিলাম না।তবু তো শেষ রক্ষা হলো না।বারিটা দিয়ে ফেললি।’

‘ওরে আমি জা’নে মে’রে ফেলবো।শা’লা, আমাকে মা বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে ফুপু বানাইবো তাতো হবে না।’

বর্ষা তেড়ে গেলে অনিকের দিকে। উঁচু গোড়ালির জুতা দিয়ে একটা লাথি বসালো পেটের কাছটায়। পায়ে একটা পারাও দিলো। হৃদয় টান মেরে সামনে নিয়ে এসে চেচিয়ে বললো,

‘পাগল হয়ে গেছিস? মারা যাবে তো।’

‘মরুক হারামজাদায়! আমাকে ঠকানোর শাস্তি ওর পেতে হবে।’

‘প্লিজ শান্ত হো বর্ষু। যা ডোজ দিছিস তাতেই বেচারা কপোকাত। আর মারিস না। চল এবার।’

‘ওরে খু’ন করবো আমি।’

বর্ষা অনিকের দিকে তাকিয়ে রাগে ফুলে ফেঁপে উঠছে।ওর ভেতর যেনো আজ অসুরের শক্তি ভর করছে। ঠিক ভুল কোন দিকে কান্ডজ্ঞান নেই। হুশ হারিয়ে প্রতিশোধ নিতে পাগল হয়ে গেছে। হৃদয় কান খাড়া করলো। মানুষ আসার শব্দ পাচ্ছে। এখন এই অবস্থায় অনিককে দেখে ওকে আর বর্ষাকে নিশ্চয়ই গণধোলাই দিবে। হৃদয় বর্ষাকে বললো,

‘মানুষ আসছে চল পালাই।’

‘ওকে না মেরে আমি কোথাও যাবো না।’

‘পাগলামি করিস না।’

বহু মানুষের পদদলিত শব্দ গাঢ় হচ্ছে। হৃদয় এক প্রকার বর্ষার হাত টেনে ধরেই ছুট লাগালো প্রধান সড়কের দিকে। পেছন থেকে রবিনের আওয়াজ পাওয়া গেলো।

‘ভাই, অনিককে তো আধমরা করে ফেলছে।ঐ যে, ঐ যে বর্ষা পালিয়ে যাচ্ছে। ওকে কেউ ধর।’

টর্চের আলো ওদের বরাবর পরলো। হৃদয় আর বর্ষা এবার প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। কোনভাবে ধরা পরলে আজ শেষ।

সিএনজির ভেতর বসতেই ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিলো। হৃদয় বর্ষা দুজনেই হাঁপাচ্ছে। আরেকটু দেরী হলে আজ দু’পায়ে ভর দিয়ে বাড়ি যেতে হতো না। সিএনজি নিয়ে তারা দু’জনে এসেছিলো। হৃদয় সামনের শিকে মাথা হেলিয়ে দিলো। বর্ষা বুকে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হৃদয় নাক ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,

‘তোকে কি করতে পাঠিয়ে ছিলাম, আর তুই কি করে এলি?’

‘যা করেছি ঠিক করেছি।’

বর্ষার তেজি স্বরের একপটে জবাব হৃদয়ের পছন্দ হলো না। মাথা উঠিয়ে পাশের শিকের দরজায় মৃদু শব্দ করে ঘুষি বসালো। ফের বর্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তোকে একা পাঠানোটাই ভুল হইছে আমার।’

‘মাথা ঠিক ছিলো না আমার। ওকে দেখে এতো রাগ উঠেছিলো যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না।’

‘আমি আরেকটু দেরী করলে তো ছেলেটাকে মেরেই ফেলতি।’

‘ওর মরাই উচিত ছিলো।’

বর্ষা জোর গলায় বললো। হৃদয় সরু চোখে ওর দিকে তাকালো। বর্ষা মিনমিনে গলায় বললো,

‘আমি সম্পর্কে জড়াতে চাই নি। টানা দুই মাস আমার পিছনে ঘুরে এক প্রকার ব্লাক মেইল করে রাজী করিয়েছে। যেই আমি দূর্বল হতে শুরু করছি সেই আমাকে ঠকিয়ে আরেক মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলো।’

‘একদম ঠিক হয়েছে। তোদের মেয়েদের পছন্দই ঐ ওমন প্লে-বয় টাইপের ছেলে। ভালো ছেলে তো তোদের চোখে পরবেই না।’

হৃদয়ের চাপা গর্জন শোনা গেলো। বর্ষা কথা বাড়ালো না। সিটে গা এলিয়ে দিলো। সিএনজি এয়ালা হৃদয়কে প্রশ্ন করলো,

‘মামা, কোন রোড দিয়া যামু। ডাইন নাকি বাম?’

‘ডানের রোডে চলেন। ঐখান দিয়ে তাড়াতাড়ি হবে।’

রাতের নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে পৃথিবীকে। সিএনজির শো শো শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ ভেসে আসছে না। মাঝে মাঝে বড় বড় ট্রাক পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাসের সাথে সাথে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। হৃদয়ের কাঁধে মাথা রেখে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে বর্ষা। সাথে একটু সময় পরপর হৃদয়ের শার্টে সর্দি মুছছে। হৃদয় নির্বাক ভঙ্গিতে বসে আছে। অথচ বর্ষার জায়গায় অন্য কেউ হলে এই অব্দি ঠাটিয়ে কয়টা যে থাপ্পড় খেতো তার হিসেব নেই। হুটহাট মেয়েটার কান্ডে হৃদয় যেমন অবাক হয় তেমনি রাগও হয়। একটু আগের বর্ষার সাথে এখনকার বর্ষার বিস্তর ফারাক। সিএনজি ওয়ালা হাঁক ছেড়ে বললো,

‘মামা, আফায় কান্দে কেন?’

হৃদয় বর্ষার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ওর জামাই মরছে।’

তারপর বর্ষাকে বিশাল এক ধমক দিয়ে বললো,
‘ঐ চুপ করবি? মরা কান্না শুরু করছিস কেন?’

বর্ষা নাক টেনে বললো,
‘অনিক আমার সাথে কেন এমন করলো বল? আমি তো সব ছেড়ে ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। আর ও আমায় ধোকা দিলো।আমি ওকে মারতাম না বিশ্বাস কর।ও আমায় কেন ধোকা দিলো?’

হৃদয়ের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।মেয়ে মানুষ এতো ঢং, অভিনয় কিভাবে করতে পারে? এদের মন বোঝা আসলেই কঠিন কাজ। নিজে মেরে এখন নিজে কান্না করছে। রাগী স্বরে হৃদয় বললো,

‘চপ, একদম ন্যাকামি করবি না। ঢং এর ক্ষেত্রে আসলেই তোরা মেয়েরা সেরা। ছেলেটারে তো মেরে ফেলছিলি। আর এখন ঢং করে মাছের মায়ের পুত্রশোক দেখাতে হবে না।’

হঠাৎ আবহাওয়া বদলের মতো বর্ষাও বদলে গেলো। চোখ মুছে ফুসলে উঠে বললো,

‘আমি যা করছি ঠিক করছি। আমার এতে কোন আফসোস নেই। বেইমানদের শাস্তি এভাবেই হওয়া উচিত।’

সিএনজি এসে থামলো বর্ষা যে দালানে থাকে তার সামনে। হৃদয়ের থেকে বিদায় নিয়ে সে গেইটের সামনে দাঁড়ালো। সিএনজি ঘুরিয়ে হৃদয় তার গন্তব্য চললো।বর্ষা গেইটের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গেটের দারোয়ান তাকে দেখলে তার বাবার কাছে বিচার দিবে।ভেতরে ঢুকতে হলে মাথা খাটাতে হবে। গেইট বেশি উঁচু নয়। সেটাকে টপকে অনায়াসে যেতে পারবে সে।দারোয়ানকে দেখা যাচ্ছে না।কিছু সময় পরপর পান খাওয়ার অভ্যাস আছে দারোয়ানের। পান আনতে ঘরের দিকে গেছে। ধীরে ধীরে গেইট টপকে নিচে নামলো বর্ষা। নিচে নামার সাথে সাথে ধপ করে পরে গেলো।শব্দ শুনে দারোয়ান চেচিয়ে উঠলো,

‘কে কে ঐহানে?’

বর্ষা দেয়ালের আড়ালে গিয়ে দেয়ালের সাথে মিশে রইলো। দারোয়ান পান মুখে নিয়ে টর্চ হাতে বের হয়ে এদিক ওদিক খুঁজে আবার গেইটের দিকে চলে গেলো। পা টিপে টিপে কেচি গেইটের দিকে গিয়ে যতটা আস্তে পারে সেভাবে তালা খুললো। চাবি সে আগেই জোগাড় করে রেখেছিলো। ভেতরে ঢুকে তালা লাগিয়ে দোতালায় ছুট লাগালো।

নব ঘুরাতেই কেচৎ শব্দে বাসার দরজা খুলে গেলো। চোখ খিঁচে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। হঠাৎ কানে টান পরতেই বর্ষা চমকে গেলো। বাসার সবার তো পরে পরে ঘুমানোর কথা। পায়েসের সাথে হাই ডোজের ঘুমের ঔষধ মিশিয়েছে সে। তাহলে জেগে আছে কে?

‘কোথায় গিয়েছিলে ননদী?’

একমাত্র ভাবী অনামিকার কন্ঠ পেয়ে ভয়টা কমে এলো বর্ষার। অনামিকার দিকে ঘুরে হে হে করে হাসি দিয়ে বললো,

‘সব বলবো তোমায়। আগে কান ছাড়ো।’

অনামিকা কান ছেড়ে দুই হাত গুঁজে দাঁড়ালো। তারপর তীক্ষ্ণ নজরে বললো,

‘আমিও তো বলি ননদী আমাকে পায়েস বানাতে এতো জোর করছে কেন? আমাকে দিয়ে পায়েস বানিয়ে আমার অগোচরে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে সবাইকে খাইয়ে দিলে?’

বর্ষা অসহায় মুখে বললো,
‘তুমি ধরে ফেলছো?’

‘হ্যাঁ, এর জন্য আমি খাইনি। তারপর যখন তোমায় চুপিচুপি বাসা থেকে বের হতে দেখলাম তখনই মনে হলো ঘাপলা আছে।’

‘তুমি পায়েস খাওনি?’

বর্ষা প্রায় চেচিয়ে বললো। অনামিকা মুচকি হেসে বললো,

‘না, এবার বলো কাহিনি কি?’

‘পরে সব বলবো ভাবি। প্রমিস! এখন শরীর কুলচ্ছে না।’

দুপুরে তপ্ত রোদে হেঁটে চলছে বর্ষা। বাসা থেকে কলেজের কথা বলে বেড়ুলেও সে এখন যাবে হৃদয়ের কাছে। তার দ্বিতীয় মিশন কমপ্লিট করা এখনো বাকি। গতকাল রাতে ভাবীকে ইনিয়েবিনিয়ে কিছু একটা বুঝিয়ে শান্ত করেছিলো। ভাগ্যিস সেখানে অনামিকা ছিলো। অন্য কেউ হলে পিঠের ছাল তুলতো। ক্যাফের সামনে এসে হাফ ছাড়লো। ‘সান এন্ড সাইন ক্যাফে’ বড় করে লেখাটা টানানো।বিশাল বড় ক্যাফে। দুই তালা পুরোটাই ক্যাফের অধীনে। কাচের দরোজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। হৃদয় এই ক্যাফেতে ওয়েটারের কাজ করে।

ক্লাশ ওয়ান থেকে হৃদয়ের সাথে ওর বন্ধুত্ব। বর্ষা এবার বিবিএ অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। কিন্তু হৃদয় জেএসসি পাশের পর পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। দারিদ্র্যেতার জন্য নয়। মারামারিতে সে বেশ পটু।প্রচুর রাগী আর জিদ্দি ছেলে। তবে রাগের সময় বর্ষা ছাড়া ওকে কেউ মানাতে পারে না। কারণে অকারণে তার রাগ নাকের ডোগায় থাকে। সেই রাগ মারামারি অব্দি চলে যায়। ক্লাশ নাইনে উঠার পর মারামারির কারণে স্কুল হেড টিচার টিসি দিয়ে দিয়েছিলো। জিদ করে সে অন্য স্কুলে ভর্তি হয়নি। পড়াশোনাও আর হয়নি।

বর্ষাকে দেখে সাকিব নামের ছেলেটা বলে উঠলো,
‘আফা,হৃদয় ভাইয়ের কাছে আইছেন?’

বর্ষা মাথা দুলালো। সাকিব বললো,
‘আপনে বসেন আমি ভাইরে ডাইকা নিয়া আসি।’

সাকিব ভৌ দৌড় দিলো।বর্ষা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক চোখ বুলালো।দুপুর হওয়ায় ক্যাফেতে মানুষ খুব কম। দূর টেবিলে এক জোড়া কাপল দেখা যাচ্ছে। তারা একে অপরের হাত ধরে নিচুস্বরে কথা বলছে। বর্ষা চোখ সরিয়ে নিলো।অন্যের ব্যক্তিগত জিনিস দেখতে নেই।কয়েক মিনিট পর হৃদয়কে নিয়ে সাকিব ফিরলো।হৃদয় বর্ষাকে উদ্দেশ্য করে সাকিবকে বললো,

‘সাকিব, তোর আফারে দুইটা চেয়ার দে।’

সাকিব আশেপাশে তাকিয়ে সন্দেহ চোখে বললো,
‘মানুষ একজন, দুইটা চেয়ার কেন?’

হৃদয় মুখ টিপে হেসে বললো,
‘হাতির বাচ্চায় মুটকি আছে। একটা চেয়ারে বসলে চেয়ার ভেঙে যাবে। তারপর আমার জরিমানা দিতে হবে।তাছাড়া ওর শরীর একটায় আঁটবো না।

বর্ষা চোখ রাঙিয়ে তাকালো। সাকিব হো হো করে হেসে উঠলো। হঠাৎ……

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here