হৃদয়ের একাংশ তুই পর্ব – শেষ

#হৃদয়ের_একাংশ_তুই
#Last_Part
#Writer_NOVA

বেশ কিছুদিন ধরে বর্ষাদের ফ্ল্যাটে গোছগাছ ভাব।গতকাল রাত থেকে তাড়াটা বেড়েছে। অবশেষে বর্ষার জেদের কাছে হার মেনেই নজরুল সাহেব বাসা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাসা ছেড়ে দিবো বললেই তো হয়ে যায় না। কত ঝামেলা, ভেজাল জড়িয়ে যায় তা বোঝাও মুশকিল। বর্ষার কাছে এই শহরটা বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। সে কিছুতেই এখানে থাকতে চায় না। এখানে থাকলেই তিনটা ছেলের থেকে একজনকে বাছাই করতে হবে তাকে। কিন্তু সে এখন নিজের জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে চায় না। অনেকদিন নিজেকে সময় দেওয়া হয়নি। মাস খানেক কেঁদেকেটে বাবা, ভাইকে রাজী করিয়েছে।

সূর্য তার লাল আভা ছড়িয়ে ধরণীতে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। নিচে গাড়ি এসে থেমেছে খানিক সময় আগে। জুনায়েদ, নজরুল সাহেব ধরাধরি করে আসবাবপত্র গাড়ি বোঝাই করতে ব্যস্ত। কাজে সাহায্য করতে, সাথে দালানের বাকি লোকেরাও আছে। রাস্তার দিকে তাকাতেই এক মাস আগের কথা মনে পরলো। আয়াজ গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করেছিলো। কিন্তু বর্ষা তা গ্রহণ করেনি। বরং মুখের ওপর বলেছিলো,

‘আপনি যেটাকে ভালোবাসা বলছেন মিস্টার আয়াজ খান, সেটা আসলে ভালোবাসা নয়। এটা মোহ। ভালোবাসা আর মোহের মধ্যকার পার্থক্য আমরা গুলিয়ে ফেলি। দুটো আলাদা জিনিস। কিন্তু আমরা এর পার্থক্য বুঝতে পারি না। খানিকের মোহকে ভালোবাসা ভেবে মরীচিকার পেছনে ছুটে বেড়াই। ভালোবাসা কোন সস্তা জিনিস নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও শুদ্ধতম অনুভূতির নাম ভালোবাসা। ভালোবাসা কখনো হুটহাট হয় না। হুটহাট যেটা হয় তা হলো মোহ। ভালোবাসা হয় ধীরেধীরে। মোহ যেমন হুটহাট হয়, তেমনি হুটহাট চলে যায়। আর ভালোবাসা সে তো আজীবন রয়ে যায়। আপনি মোহের পেছনে ছুটছেন। ভালোবাসতে হলে অপর পাশের মানুষটাকে জানতে হয় বুঝতে হয়। দু দিনের পরিচয়ে ধপ করে বলে দিলাম ভালোবাসি! আদোও কি এ ভালোবাসা? ভালোবাসা এতই সহজ? উত্তরগুলো খুজতে আরম্ভ করুন। আমার বিশ্বাস আপনি উত্তর পেয়ে যাবেন।’

কথাগুলো বলে বর্ষা সেদিন দাঁড়ায়নি। দৌড়ে চলে এসেছে। ঝুম বৃষ্টিতে আয়াজ ভিজতে ভিজতে বিষাদের চোখে বর্ষার বারান্দার দিকে তাকিয়ে ছিলো সারা বিকেল। কিন্তু বর্ষা আসেনি তাকে ফিরিয়েও নেয়নি। তারপর ছেলেটা যা জ্বরে পরেছিলো! অবস্থা অনেক খারাপ। বর্ষা সেই খবর পেয়েও দেখতে যায়নি। নিজে নিজেকে প্রশ্ন করে আজকাল। ‘এতো পাষাণ কবে হলি বর্ষা?’ উত্তর মিলে না।

‘চলে যাচ্ছো?’

সুরভীর কথায় হুশ ফিরে। চোখের পানি আড়াল করে মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে বললো,

‘হুম!’

‘খুব মিস করবো।’

বর্ষা সুরভিকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। সুরভির চোখেও পানি। দীর্ঘ দিন একসাথে থাকতে থাকতে মানুষগুলো আপন হয়ে গেছে। নাম না জানা মায়ায় পরে গেছে। বর্ষা দুই হাতে চোখ মুছে সুরভিকে বললো,

‘আমিও মিস করবো।’

‘ভুলে যেয়ো না।’

‘মোবাইল নাম্বার দিয়ে যাবোনি। কল করো।’

‘তোমরা চলে যাবে এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।’

বর্ষা নিজের জামাকাপড় গুছাতে গুছাতে বললো,
‘বিশ্বাস না হলেও করতে তো হবে।’

বৃষ্টি দৌড়ে দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে বললো,
‘পিপি তোমার হইছে?’

‘হ্যাঁ হয়ে আসছে। তুই যা।’

‘দাদাভাই ডাকছে।’

বৃষ্টি যেমন ঘূর্ণিঝড়ের মতো এসেছিলো তেমনি চলে গেলো। সুরভি চাপা শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো,

‘কোথায় যাচ্ছো?’

‘এখনো সঠিক বলতে পারছি না। আব্বু বললো ছোট ফুপির বাসায় রাত কাটাবে। তারপর আমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনি চলে যাবো। এরপর কোথায় যাবো জানি না।’

‘আঙ্কেল, ভাইয়ার চাকরির কি হবে?’

‘করবে!’

‘তোমরা চলে গেলে কিভাবে করবে?’

‘আব্বু আর ভাইয়া তো একেবারে যাচ্ছে না।তারা শুধু আমাদের পৌঁছে দিবে। এত জিনিসপত্র নিয়ে আমরা কি যেতে পারবো? এখন ট্রান্সফার হওয়া সম্ভব নয়। কয়েক মাস সময় লাগবে। তাদের অফিসের অদূরে একটা ছোট বাসা নিয়েছে। সেখানে দুজন থাকবে। পরে ট্রান্সফারের কাগজপত্র হয়ে গেলে আমাদের কাছে চলে যাবে।’

সুরভি বিষন্ন মনে বললো,
‘ওহ! তোমারা না গেলেও পারতে।’

‘এই যান্ত্রিক শহরটা আমার জন্য তিক্ততায় ঘিরে যাচ্ছে। আমি বুক ভরে শ্বাস নিতে পারি না। আমি এখান থেকে না গেলে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো।’

বর্ষা নিশ্চুপ হয়ে গেলো। সুরভি এক দৃষ্টিতে বর্ষার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার চেহারা শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালসিটে পরে গেছে। উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফ্যাকাশে রং ধারণ করেছে। আগের প্রাণোচ্ছলতা ভাব নেই। দৃষ্টি নিষ্প্রাণ।

‘বর্ষা তোমার হলো?’

হিজাব বাঁধতে বাঁধতে ঘরে ঢুকে বর্ষাকে জিজ্ঞেস করলো অনামিকা। বর্ষা দ্রুত বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

‘একটু সময় লাগবে ভাবী।’

অনামিকা, সুরভি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলো। একে অপরের থেকে মাফ চেয়ে নিচ্ছে। যদি মনের অজান্তে কোন ভুল করে থাকে সেজন্য। আবার দেখা হয় নাকি না হয় তার তো গ্যারান্টি নেই।

গাড়িতে ওঠার আগে পুরো দালানটাকে আরেকবার দেখে নিলো বর্ষা।এই নীড়ে আর ফেরা হবে না। প্রায় ৬ বছর এখানে থেকেছে। কেমন জানি মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলো। ভেতর থেকে ছিটকে কান্না আসছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমি যাবো না। প্রায় দালানের সবাই ওদের বিদায় জানাতে এসেছে। সুরভি ওড়না দিয়ে চোখ মুছছে। অনামিকা পাশের ফ্ল্যাটের এক ভাবীর সাথে কথা বলছে। মিনা বেগম সবার থেকে বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠে গেছে। সুরভি এগিয়ে এসে বর্ষাকে আলতো হাতে জড়িয়ে বললো,

‘নিজের খেয়াল রেখো।’

বর্ষা সুরভির পিঠে হাত রেখে বললো,
‘তুমিও!’

‘আমাদের কি আর দেখা হবে না বর্ষা?’

‘ইন শা আল্লাহ।’

‘তাই যেনো হয়।’

‘শুনো সুরভি, তোমাকে যে বলেছি আমরা ফেনি যাচ্ছি তা কিন্তু কাউকে বলবে না।কেউ জানে না আমরা কোথায় যাচ্ছি। তোমায় বিশ্বাস করে বলেছি। বিশ্বাস ভেঙো না।’

‘তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। একটা কাকপক্ষীও তোমাদের কথা জানবে না।’

জুনায়েদ পেছন থেকে বিরক্তির সুরে তাড়া দিয়ে বললো,

‘অনামিকা, বর্ষা গাড়িতে উঠ।’

নজরুল সাহেব গলা উচিয়ে বললো,
‘কই রে বর্ষা? এবার আয় মা।’

বর্ষা সুরভির দিকে তাকিয়ে ছোট করে বললো,
‘আসছি।’

রিকশায় উঠার আগে বাসার দারোয়ানের সাথে দেখা করলো বর্ষা। সবার অগোচরে তিনটা চিঠির খাম তার হাতে তুলে দিয়ে বললো,

‘এগুলো পৌঁছে দিবেন। আমার বিশ্বাস তারা আমার খোঁজে এখানে আসবে। তখন না হয় দিয়ে দিবেন।’

দারোয়ানকে সবকিছু সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলো। বর্ষা রিকশায় উঠতেই তা ছেড়ে দিলো। পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখলো সবাই ওদের হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে। বাসস্ট্যান্ড অব্দি রিকশায় যাবে। তারপর বাসে করে তার ফুপির বাসায়। জুনায়েদ আসবাবপত্রের গাড়িতে।বর্ষার পাশে অনামিকা। অনামিকার কেলে বৃষ্টি। বৃষ্টি আজ চুপচাপ, মনমরা হয়ে বসে আছে। বারবার চোখ মুছে পেছনে তাকাচ্ছে। অনামিকার মুখটা থমথমে। সবার মন ভার।

বাসে ওঠার আগে সিম দুটো মোবাইল থেকে বের করে দুই ভাগ করে ভেঙে ফেললো। পাশের ড্রেনে ছুঁড়ে ফেলে ধীর গতিতে বাসে উঠলো। জানালার পাশে বসে সিটে গা এলিয়ে দিলো। প্রথম দুই সিটে অনামিকা, বর্ষা। পরের দুই সিটে নজরুল সাহেব, মিনা বেগম। বৃষ্টি তার দাদাভাই এর কোলে। মিনিট দশকের মধ্যে বাস ছেড়ে দিলো। জানালার ধারে দুই হাত গুঁজে প্রিয় শহরটাকে বিদায় জানাতে লাগলো বর্ষা।

বন্ধুদের সাথে বান্দারবন ঘুরতে গিয়েছিলো আয়াজ। সেখানে নেটওয়ার্ক অনেক বাজে। ফিরে এসে যতবার বর্ষাকে কল করেছে ততবারই সুইচ অফ বলেছে। বর্ষাকে কলে না পেয়ে ওর অবস্থা খারাপ। আজ তাই ছুটে চলে এসেছে বর্ষাদের বাসার সামনে। দারোয়ানের রুমের সামনে দাঁড়াতেই ভেতরে আরো দুটো ছেলের দেখা মিললো।

ছুটি নিয়ে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি গিয়েছিল হৃদয়। সাথে রাফিও। ওদের বাসা একি গ্রামে। সবাই চলে যাওয়ায় বর্ষা সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে।হৃদয়, রাফি দারোয়ানের কাছে বর্ষার কথা জিজ্ঞেস করতেই ওদের নিয়ে রুমে চলে এলো। হৃদয়, রাফির মাথায় কিছু ঢুকছে না। মোবাইল নাম্বার, কলেজ, কোচিং কোথাও বাদ রাখেনি বর্ষাকে খুঁজতে। হঠাৎ করে জলজ্যান্ত মানুষ উধাও হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বর্ষার বাসায় চলে এলো।

‘আসতে পারি?’

আয়াজ অনুমতি চাইতেই দারোয়ান, হৃদয়, রাফি একসাথে তাকালো। দারোয়ান জিজ্ঞেস করলো,

‘কে আপনি?’

‘আমি আয়াজ। বর্ষার কি হয়েছে?’

অচেনা এক ছেলের মুখে বর্ষার নাম শুনে হৃদয় রাফি একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। দারোয়ান অনুমতি দিয়ে বললো,

‘ভেতরে আসুন। আপনাদের তিনজনের জন্য চিঠি আছে।’

তিনজন চমকে উঠে সমস্বরে বললো,
‘চিঠি! কিসের চিঠি?’

দারোয়ান রঙচটা ট্রাংক থেকে তিনটা খাম বের করে তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘বর্ষা এগুলো আপনাদের জন্য রেখে গেছে।চিঠির ওপর হৃদয়, রাফি, আয়াজ নাম লেখা আছে। যার যারটা সে নিয়ে নিন।’

হৃদয় জিজ্ঞেস করলো,
‘বর্ষা কোথায়?’

দারোয়ান শান্ত কন্ঠে বললো,
‘চলে গেছে।’

তার শান্ত কন্ঠের উত্তর তিনজনের মাথায় বাজ পরলো। রাফি চোখ দুটো কপালে তুলে বললো,

‘চলে গেছে মানে?’

দারোয়ান ম্লান হেসে বললো,
‘হ্যাঁ, চলে গেছে।’

আয়াজ উৎকন্ঠিত গলায় বললো,
‘কোথায়?’

‘আমি জানি না। আমি কেন আমাদের দালানের কেউ জানে না। ওরা আরো দুই দিন আগে বাসা ছেড়ে দিছে। কোথায় গেছে কাউকে বলে নাই।’

তিনজন স্তব্ধ। আয়াজ হাতের খামের দিকে তাকালো। ঐ ছেলে দুটো কে তা ওর জানার আগ্রহ নেই। হৃদয় নির্বাক ভঙ্গিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। এতবড় শর্কড নিউজ শুনে ওর মাথা হ্যাং করছে। রাফি মূর্তির ন্যায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে। তার মাথায় কিছু খেলছে না। তবে তার মন বলছে তার অগোচরে অনেক বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। কিন্তু তা সে জানে না। আয়াজ খামটা ছিঁড়ে ফেললো। ভেতরে সাদা কাগজে বেশ কিছু কথা লেখা। আয়াজ পড়তে আরম্ভ করলো।

আয়াজ,
ভালোবাসা কোন সাধারণ অনুভূতি নয়। এটা পৃথিবীর
মধ্যে থাকা স্বর্গীয় অনুভূতি। আমাদের ধরণীটা টিকে আছেই তো এই ভালোবাসা নামক বস্তুটার কারণে। আপনি যেই পাগলামি গুলো করেছেন তাতে অন্য কেউ হলে নির্ঘাত পটে যেতো। কিন্তু আমি পারলাম না। আঘাতে আঘাতে আমি নিষ্ঠুর হয়ে গেছি। তাই আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র অনুভূতি জন্মায়নি। আমায় মাফ করবেন। আমার পক্ষে এভাবে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না। আমি মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছিলাম। এতগুলো অপশন থেকে যেকোনো একজনকে আমি মেনে নিতে চাইনি। তাহলে যে অপর দুজনের সাথে অন্যায় করা হবে। নিজেকে গুছিয়ে নিয়েন। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করেন না। আমি যেখানে থাকবো ভালো থাকবো।

ইতি
~~~বর্ষা

আয়াজ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চিঠি পড়ে সে কি রিয়েকশন দিবে তাও ভুলে গেছে। রাফি একবার আয়াজের দিকে তাকিয়ে নিজের চিঠির খাম ছিড়লো।

রাফি,
প্রথমেই বলবো হৃদয়ের খেয়াল রাখবেন। আমার ও আপনার কথা ছাড়া হৃদয় যে কারো কথা শুনে না তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। ও ভেঙে পরলে গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনার। ইচ্ছে করছে অনেক কথা বলতে। কিন্তু আমি হৃদয়কে কথা দিয়েছি কখনও তা বলবো না। তাই বলতে পারলাম না। আমার আশা বাদ দিয়েন। আমি কখনো আপনার হবো না।

ইতি
~~~বর্ষা

রাফি চমকে উঠলো। বর্ষা কিসের কথা বললো? হৃদয়ের পাশে বসে হৃদয়কে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘বর্ষা আমার থেকে কি লুকিয়েছে? কিসের কথা দিয়েছে তোকে?’

হৃদয় উত্তর দিলো না। নিষ্পলক চোখে একবার রাফির দিকে তাকিয়ে চিঠির খামটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো। বিরবির করে পড়তে আরম্ভ করলো।

হৃদয়,
আমি চলে যাচ্ছি। তোকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। এতোটা দূরে যে তুই উপলব্ধি করতে পারবি না। আমি কোথায় তা তোর ধারণারও বাইরে। এই চিঠি যখন তুই পাবি তখন আমি বহুদূরে। তোর প্রতি কোন রাগ নেই আমার। তোর দিক দিয়ে তুই ঠিক ছিলি। ক’জন পারে বন্ধুত্বের জন্য নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে? আই রিয়েলি রেসপেক্ট ইউ। তবে, তোর বন্ধুর গল্পে তুই হিরো। কিন্তু আমার গল্প! জিরো। আরেকটা অনুরোধ! আমাকে খুঁজিস না। পাবি না। যে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু যে নিজ থেকে হারিয়ে যেতে বাধ্য হয় তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।নিজের খেয়াল রাখিস। একদম মারামারি করবি না।

ইতি তোর
— বর্ষা

হৃদয় ধপ করে হাঁটু ভেঙে বসে পরলো। বুকের ভেতরটা খালি খালি লাগছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে। চিৎকার করে কান্না করতে গিয়েও থেমে গেলো। মিনমিন গলায় বললো,

‘আমি তোকে পেয়েও হারিয়েছি। সমস্যা নাই বন্ধুত্ব তো ধরে রাখতে পারছি। বাস্তবে আর পেলাম কই? তুই না হয় আমার কল্পনাতেই থাকলি।আর তোকে না হয় আমি দূর থেকে ভালোবেসে যাব।আমার জীবনে হাজার মেয়ে এলেও এই হৃদয়ের একাংশ তুই থাকবি বর্ষা।’

আয়াজ এক নজরে হৃদয়ের দিকে তাকালো। একবার মনে মনে ভাবলো বর্ষা ওর কি হয় তা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিলো।কিছু ভালো লাগছে না। চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রাফি নিস্তব্ধ হয়ে চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের বৈদ্যুতিক খুটিতে বসে একটা কাক একঘেয়ে সুরে কা কা করে ডাকছে। সেই ডাকে স্তব্ধ পরিবেশটাকে চিঁড়ে ফেলছে। তিনটা যুবক ভাঙা মনে অদূরে তাকিয়ে আছে। ধূ ধূ মরুভূমির মতো তাদের মন আজ শুষ্ক। কাঁদতেও ভুলে গিয়েছে তারা।

নিয়তির কি অদ্ভুত খেলা! কেউ চেয়ে পইলো না।কেউ পেয়েও রাখলো না। আর কেউ যে কি চাইলো তা নিজেই বুঝলো না।

সমাপ্ত

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here