হৃদয়ের একাংশ তুই পর্ব -১৩

#হৃদয়ের_একাংশ_তুই
#Part_13
#Writer_NOVA

‘বর্ষা আমার কথাটা একবার শোন।’

হৃদয় বর্ষার সামনে এসে দুই হাত দিয়ে পথ আটকে বললো। কলেজ গেইট পার হতেই হৃদয়কে দেখেছে বর্ষা। দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাওয়ার সময় হৃদয় পথ আটকিয়ে দাঁড়ালো। বর্ষা হৃদয়ের মুখোমুখি হয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

‘কি শুনবো আর বল? কিছু শোনার কি বাকি রেখেছিস? ঘুরেফিরে তো সেই এক পেঁচাল পারবি। বন্ধুর গুণগান ছাড়া তো আর কিছু পারিস না।’

‘রাফি তোকে অনেক ভালোবাসে।’

বর্ষা রবি এডের মতো জ্বলে উঠলো আপন শক্তিতে। চোখ দুটো লাল করে বাজখাঁই গলায় চেচিয়ে বললো,

‘তোর বন্ধুর ভালোবাসাকে ঠোঙা বানিয়ে মুড়ি খেতে বল। আমার যারতার ভালোবাসার দরকার নেই।’

‘তুই ওকে অপমান করছিস।’

‘আমি অপমান করতে চাইছি না। বারবার তুই মনে করিয়ে অপমান করতে বাধ্য করছিস।’

‘ও আমার বেস্টফ্রেন্ড।’

‘আমার কিছু না।’

‘তুই কি শুরু করেছিস বল তো?’

‘আমি তো মোটেও শুরু করিনি হৃদ।তুই যা শুরু করছিস তার শেষ করছি।’

‘তুই আমাকে ভালোবাসিস?’

বর্ষা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। চোখ নামিয়ে ফেললো। চোখে তার হতাশার ছায়া। পূর্বের সেই তেজ নেই।নিজেকে মনে মনে শক্ত করলো সে। অনেক হয়েছে। আর নয়! এই দ্বিধা দ্বন্দ্বের খেলা আজ শেষ করবে। ক্ষীণ স্বরে প্রতিবাদ করে বললো,

‘আমি তোকে ভালোবাসি না হৃদ।’

হৃদয় জোর গলায় বললো,
‘মিথ্যে কথা!’

বর্ষা বারুদের মতো জ্বলে উঠলো। উত্তেজিত গলায় বেশ দাপট নিয়ে বললো,

‘হ্যাঁ, সত্যি বাসি না। যে বন্ধুর জন্য ভালোবাসার মানুষকে ছাড়তে পারে তাকে কেন ভালোবাসবো আমি? তুই বন্ধুত্বের জন্য ঠিক আছিস। কিন্তু ভালোবাসায় জিরো। এমন বন্ধু প্রত্যেক মানুষের হোক৷ কিন্তু এমন ভালোবাসার মানুষ কোন মেয়ের না হোক।’

হৃদয় আহত চোখে তাকালো। বর্ষা চোখ নামিয়ে ফেললো। তার হৃৎপিণ্ড বরাবর চিনচিন ব্যাথা করছে। কিন্তু নিত্যি নিত্যি এই যন্ত্রণা সহ্য করার থেকে একদিনে হোক। হৃদয় হাল ছাড়ার পাত্র নয়। আরেকবার চেষ্টা করার উদ্দেশ্যে বললো,

‘রাফির সাথে ঠিক করছিস না তুই।’

আবারো রাফির নাম শুনে বর্ষার সারা শরীর রাগে রি রি করে উঠলো। রাগে গজগজ করতে করতে বললো,

‘যাস্ট শাটআপ হৃদ।ওর নাম নিবি না আমার সামনে।’

‘কেনো?’

‘এক কথায় বারবার বলতে ভালো লাগে না। আমি ওকে সহ্য করতে পারি না। যাকে সহ্য করতে পারি না তাকে ভালোবাসবো কি করে? লিসেন! আমার লাইফ, আমার ডিসিশন। আমি কাকে ভালোবাসবো না বাসবো, কাকে রাখবো না রাখবো তা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। তুই এখানে রাফিকে ভালোবাসতে আমায় ফোর্স করতে পারিস না। বারবার একই ঘ্যানা পেঁচাল আর ভালো লাগে না।’

বর্ষা একটু থেমে কাঁদো কাঁদো সুরে বললো,
‘দোহাই লাগি হৃদ, আমাকে আমার মতো ছেড়ে দে।’

হৃদয় চমকে উঠে বললো,
‘আমি তোর ফ্রেন্ড বর্ষা।’

‘কোন মুখে নিজেকে তুই আমার ফ্রেন্ড বলে দাবি কারিস? লজ্জা করে না? তুই বন্ধুত্বটাকেও নষ্ট করে দিছিস। তুই আমাকে ভালোবাসতে না পারতি বন্ধুত্বটাকে রক্ষা করতি। তা করিসনি। রাফির জন্য জোর করে সেই বন্ধুত্বটাকেও গলা টিপে হ’ত্যা করেছিস।’

হৃদয় চেচিয়ে উঠলো,
‘বর্ষা!’

বর্ষা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে হাত দুটো জোর করে বললো,

‘তুই তোর মতো থাক। আমাকে আমার মতো ভালো থাকতে দে। আজকে থেকে তোর পথ আলাদা আমার পথ আলাদা। তোর বিষয়ে আমি নাক গোলাবো না। দয়া করে আমার বিষয়ে তুই মাথা ঘামাস না।রাফির জন্য আর ওকালতি করিস না। ওর বিষয় নিয়ে জোর করতে করিস না। মনে রাখিস, আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করার মূল কারণ তুই। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা আবারো বলছি।তোর মতো বন্ধু সব মানুষের হোক৷ কিন্তু এমন ভালোবাসার মানুষ কোন মেয়ের না হোক।ভালো থাকিস।’

হৃদয় কিছু বলার আগে বর্ষা মুখ ঝামটা মেরে এগিয়ে গেলো। হৃদয় করুণ দৃষ্টিতে বর্ষার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। চোখ দুটো পানিতে টইটুম্বুর। বন্ধুত্ব রক্ষা করতে সে ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে ফেললো। তার কানে এখনো একটা কথা বাজছে, “তোর মতো বন্ধু সব মানুষের হোক৷ কিন্তু এমন ভালোবাসার মানুষ কোন মেয়ের না হোক।”

বর্ষা ধীরপায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো প্রচুর জ্বলছে। কিন্তু পানি পরছে না। হার্টবিট দ্রুত উঠানামা করছে। বুকের ভেতর নাম না জানা এক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কেমন দমবন্ধ, রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি! এর থেকে মুক্তি আদোও মিলবে কি?

একঘেয়ে, বিরক্ত সুরে মোবাইল রিংটোন বাজছে। বর্ষা চোখ বুজেই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললো। মাথাব্যথা উঠছে। চোখটা সবেমাত্র লেগে এসেছে তার মধ্যে কল। মেজাজ পুরো বিগড়ে গেছে। উঠে বসলো। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে মাথা নিচু করে রাখলো। মোবাইল বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে আবার বেজে উঠলো। বর্ষা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে খাইয়া ফালামু লুক দিলো। হাতের কাছে থাকলে নির্ঘাত আছাড় মারতো।ভাগ্যিস মোবাইলটা টেবিলের ওপর মাল্টিপ্লাগে চার্জে দেওয়া। অনিচ্ছা সত্বেও উঠে গেলো। আননোন নাম্বার! ভ্রু কুঁচকে কল রিসিভ করে সালাম দিলো। অপরপাশ থেকে কেউ একজন শান্ত কন্ঠে খুব সুন্দর করে ডাকলো,

‘বর্ষা!’

বর্ষা দ্বিগুণ ভ্রু কুঁচকে মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকালো। নাম্বার সে চিনে না। কিন্তু কন্ঠ চেনাচেনা মনে হচ্ছে। ইতস্তত ভঙ্গিতে বর্ষা বললো,

‘হ্যাঁ, কে?’

‘আমি আয়াজ।’

বর্ষা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মোবাইলের স্কিনে তাকালো। মনে হলো স্কিনে নয় স্বয়ং আয়াজকে দেখলো। হতভম্ব গলায় বললো,

‘আমার মোবাইল নাম্বার কোথায় পেলেন?’

‘বলা যাবে না। সিক্রেট!’

‘বলুন বলছি।’

‘একটু বারান্দায় আসতে পারবে। তোমাকে অনেকদিন দেখি না।’

বর্ষা চমকে উঠলো,
‘মানে?’

‘মানে ক্লিয়ার হয়ে যাবে। যদি তুমি বারান্দায় আসো।’

বর্ষা দ্রুত বারান্দার দরজা খুলে এদিক সেদিক তাকালো। রাস্তার দিকে তাকাতেই আয়াজ এক হাত নাড়ালো। বর্ষা নির্বাক! এই ছেলে ওর বাসার ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার কোথায় পেলো?

‘আপনি আমার বাসা চিনলেন কিভাবে?’

আয়াজ দুষ্টুমির সুরে বললো,
‘ওমা সেদিন না ঠিকানা দিলে। এর মধ্যে ভুলে গেলে?’

বর্ষা দেখলো আয়াজ মুখ টিপে হাসলো। মুখে সিরিয়াস ভঙ্গি বজায় রেখে বর্ষা বললো,

‘আমি মজা করার মুডে নেই।’

‘একটু নিচে আসতে পারবে?’

‘সরি, সম্ভব না।দয়া করে আপনি চলে যান।’

‘কেনো?’

‘কেউ দেখলে আব্বু,ভাইয়ার কাছে বিচার দিবে।’

‘তুমি নিচে এলেই আমি চলে যাবো।’

‘মাফ করবেন।’

‘তাহলে আমিও যাবো না।’

‘বসে থাকুন তাহলে।’

‘দরকার পরলে তাই করবো।’

‘আশ্চর্য, আপনি জেদ করছেন কেন?’

‘জেদের দেখছো কি? সবে তো শুরু।’

‘যত্তসব ঢং।’

বর্ষা কল কেটে দিলো। রাস্তায় আয়াজের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ভেতরে ঢুকে গেলো। ঠাস করে বারান্দার দরজা আটকে ভেতরে চলে গেলো।

হুট করে আবহাওয়া বদলে গেলো। সারা আকাশ কালো হয়ে গেছে। গুড়ুম গুড়ুম করে মেঘ ডাকছে।কিছু খন আগের মিষ্টি রোদের বিকেল এখন ঘন আঁধারে ঢেকে গেছে। শো শো গতিতে বাতাস বইছে। ঠান্ডা বাতাসের সাথে ধুলাবালি উড়ছে। অনামিকা রান্নাঘর থেকে বর্ষাকে বললো,

‘বর্ষা ছাদ থেকে একটু জামা-কাপড় গিয়ে নিয়ে আসবে? ঢল নামবে। আকাশের কি অবস্থা দেখছো?’

বর্ষা চেয়ার বসে আনমনে কিছু ভাবছিলো। অনামিকার কথায় তার ধ্যান ভাঙে। সে উঠতে উঠতে বললো,

‘আচ্ছা যাচ্ছি।’

সিঁড়ি বেয়ে ছাদের উঠতেই বর্ষার কাঁপুনি উঠে গেলো। ঠান্ডা বাতাসে সারা শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এতো বাতাস দাড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই বুঝি উড়িয়ে নিয়ে গেলো। বৃষ্টির জামাটা দড়ি থেকে নিতে গিয়ে বাতাসে উড়ে গেলো। সেটা সামনের একটা রডের সাথে আটকে থাকায় রক্ষা। নয়তো কোথায় উড়ে চলে যেতো বর্ষা জানতোও না। জামাটা আনার সময় রাস্তার দিকে চোখ পরতেই বর্ষা আৎকে উঠলো। আয়াজ এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে তো আয়াজের কথা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো। রাগত্ব স্বরে বিরবির করে বললো,

‘এমন পাগলামি করছে কেনো?’

জামাকাপড় গুলো বসার রুমে রেখে দৌড়ে বেরুতে নিলে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো,

‘কোথাও যাও পিপি?’

বর্ষা এক নজর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আসছি।’

দেরী করলো না। দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেলো। বাতাসে ওড়না, জামা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ধুলোবালিতে তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। সবাই ছোটাছুটি করছে। যার যার কাজে সে ব্যস্ত।আয়াজ রাস্তার পাশের টং দোকানে বেঞ্চে বসে ছিলো। বর্ষাকে দেখে দাড়িয়ে গেলো। চোখ মুখে বিজয়ের হাসি। বর্ষা এদিক সেদিক তাকিয়ে সাবধান হয়ে নিলো। পরিচিত কেউ নেই। দুই হাত বুকের কাছে গুজে দাঁড়ালো। আয়াজ বাঁকা হেসে বললো,

‘আমি জানতাম তুমি আসবে।’

বর্ষা ওর কথায় উত্তর দিলো না। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করলো,

‘এমন পাগলামি করছেন কেনো?’

আয়াজ এগিয়ে এলো। বর্ষার হাত দুটো ধরে হাঁটু মুড়ে বসে পরলো। বর্ষা ভড়কে গেলো। আশেপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। আয়াজের এমন কান্ডে সে ভয় পেয়ে গেছে। হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করলেও আয়াজ ছাড়লো না।

‘এটা কোন ধরণের অসভ্যতামী?’

বর্ষা বললো। আয়াজ কিছু না বলে পকেট থেকে দুটো বড় চকলেট আর চার/পাঁচটা গোলাপ বের করলো। পকেটে রাখার কারণে গোলাপ চেপ্টা হয়ে গেছে। সেগুলো বর্ষার দিকে বাড়িয়ে বললো,

‘আই লাভ ইউ বর্ষা।’

বর্ষা চোখ দুটো রসগোল্লা বানিয়ে আয়াজের দিকে তাকালো।ধীরে ধীরে সেই বড় চোখ রাগে লাল হয়ে গেলো। ঝাটকা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

‘ভালোবাসার মায়রে বাপ।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here