#হৃদয়ের_একাংশ_তুই
#Part_07
#Writer_NOVA
‘কেমন আছেন মিস বুলবুলি?’
আয়াজের কথা শুনে বর্ষা খুকখুক করে কেশে উঠলো। অনামিকা একবার আয়াজের দিকে তাকায় আরেকবার বর্ষার দিকে। কারো মতিগতি ঠাওর করতে পারছে না। ছিমছাম গঠনের ছেলেটাকে আগে কখনও সে দেখেনি। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি ওকে চিনেন?’
আয়াজ স্মিত হাসলো। ভ্র এর কাছটা চুলকে বললো,
‘হ্যাঁ, ভালো করেই চিনি। তাই না মিস বুলবুলি?’
বর্ষা তড়িঘড়ি করে আবারো ঢকঢক করে পানি গিললো। হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছে বড় করে দম নিয়ে বললো,
‘আমার নাম বুলবুলি নয়।’
‘হুম জানি। সেদিন যে বুলবুল করে এড্রেস দিয়েছিলেন তাতে আমি এই নাম রেখেছি।’
আয়াজ বললো। বর্ষা বার্গারে একটা কামড় দিয়ে চিবুতে চিবুতে বললো,
‘আকিকা করছেন?’
আয়াজ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
‘কিসের?’
‘এই যে নতুন নাম রাখলেন। নাম রাখলে তো আকিকা করতে হয়।’
আয়াজ হো হো করে হেসে উঠলো। অনামিকা কপাল সংকুচিত করে তাকালো। তবে ওদের মধ্যকার কথপোকথনে নিজে কথা বলে ব্যাঘাত ঘটালোনা।দুজনের কথা শুনে তো মনে হচ্ছে একে অপরকে আগে থেকে চিনে। আয়াজ হাসি থামিয়ে বললো,
‘ওহ এই ব্যাপার। আমি আরো টেনশনে পরে গেলাম। কিসের জন্য আকিকা করতে বলছেন মিস বুলবুলি।’
বর্ষা প্রতিত্তোরে হাসলো। অনামিকার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘হলে উঠো।’
‘পুরোটা শেষ করি।’
অনামিকা বললো। আয়াজ পাশের থেকে চেয়ার টেনে বসে বললো,
‘একা একা খেলেন?’
বর্ষা ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘দোকলা পাবো কোথায়?’
‘আমায় চোখে পরে না?’
বর্ষা চোখ এদিক সেদিক নিয়ে আয়াজকে না দেখার ভান করলো। তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
‘কোথায় আপনি দেখছি না তো?’
আয়াজ হেসে উঠলো। মেয়েটা দুষ্টুমিতে বেশ পটু। এর সাথে কথা বলতে অনেক ভালো লাগছে। দুজনের খাওয়া হতেই অনামিকা বললো,
‘চলো এবার উঠি।’
আয়াজ শুকনো মুখে বললো,
‘এখনো চলে যাবেন?’
বর্ষা মিষ্টি হেসে বললো,
‘হ্যাঁ!’
‘আপনার বাসাটা কোথায়?’
‘কেন?’
‘একদিন বেড়াতে যাবো।’
‘সেদিন না বললাম। এলেন না তো।’
বর্ষা হাসতে হাসতে অনামিকার সাথে যেতে লাগলো। পেছন থেকে আয়াজ ডাকলো,
‘মিস বুলবুলি!’
বর্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে চোখের ইশারায় বুঝালো ‘কি?’ আয়াজ মাথা চুলকে বোকা ভঙ্গিতে বললো,
‘আপনার মোবাইল নাম্বারটা যদি দিতেন।’
বর্ষা দুষ্টু হাসি হেসে বললো,
‘ জিরো, ওয়ান ফাঁক ফাঁক চৌদ্দ কোটি পনেরো লাখ।রাতে কল দিয়েন কিন্তু। আমি আপনার কলের আশায় থাকবো।’
অনামিকা, বর্ষা হাসতে হাসতে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো। আয়াজ ঠোঁটে হাসির রেশ ফুটিয়ে তুলে বললো,
‘ইন্টারেস্টিং মেয়ে তো! আই লাইক ইট।’
★
নদীর পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছে। নাম না জানা পাখিরা উড়ে যাচ্ছে বহুদূর। কখনো বা নদীর পাড়ের ময়লার স্তূপ থেকে ভেসে আসছে কাকের কা কা ধ্বনি। নিরব পরিবশের বুক চিড়ে দিতে কাকের ডাকই যথেষ্ট। মৃদুমন্দ বাতাসে তালে তালে নড়ছে গাছের পাতা। এক পাতার সাথে আরেক পাতা ঘর্ষণে তৈরি হচ্ছে মহনীয় শব্দ।
বর্ষার চুলগুলো বাতাসের তালে পাল্লা দিয়ে উড়ছে। যতদূর চোখ যায় নদীর ঘোলাটে পানি। হৃদয় আড়চোখে বর্ষাকে একটু পরপর দেখছে। বর্ষার সেদকে ধ্যান নেই। সে নদীর পানিতে ভাসা একটা হেলেঞ্চা ডগার দিকে তাকিয়ে আছে। শত ঘাত-প্রতিঘাত, পানির আছড়েও সে তার জায়গা আঁকড়ে ধরেছে। মানুষের জীবনও তেমনি। হাজার আঘাতেও তাকে শক্ত থাকতে হবে। জিত একদিন হবেই।
‘কিরে ডেকে এনে কথা বলছিস না যে?’
হৃদয়ের দিকে না তাকিয়ে বর্ষা বলে উঠলো। হৃদয় নদীর পানির কলকল ধ্বনি থেকে কান সরিয়ে বর্ষার দিকে তাকালো। বিকে চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস নামলো।দীর্ঘ শ্বাসের শব্দে বর্ষা চোখ তুলে তাকালো। হৃদয়কে আজ আনমনা দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে অনেক বেশি চিন্তায় আছে। বর্ষা হৃদয়কে নিজের দিকে ফিরিয়ে শান্ত গলায় বললো,
‘সব ঠিক আছে হৃদ?’
হৃদয় আবারো শব্দ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। মাথা উপরে নিচে ঝুলিয়ে বুঝালো সব ঠিক আছে।
‘তাহলে তোকে এতো মনমরা লাগছে কেন?’
হৃদয় এতখন পর কথা বললো,
‘কই?’
বলার সাথে সাথে মুখটা হাত বুলালো। বর্ষার মনে হচ্ছে হৃদয় কিছু আড়াল করছে। হৃদয়ের চোখে চোখ রেখে বর্ষা বললো,
‘তুই ঠিক নেই হৃদ।’
হৃদয়ের চোখ দুটো বর্ষার চোখে স্থির। দৃষ্টি সরিয়ে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে হৃদয় বললো,
‘রাফি তোকে অনেক ভালোবাসে রে। গত ১০ বছর ধরে।’
বর্ষা জুতো দিয়ে মাটি খুঁটতে খুঁটতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
‘হুম জানি।’
হৃদয় অবাক হলো না। চোখ, মুখে তার হতাশা ছেয়ে গেছে। বর্ষা হৃদয়ের চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো,
‘তুই আমাকে ভালোবাসিস না?’
হৃদয়ের বুকটা ধক করে উঠলো। চমকে বর্ষার দিকে তাকালো। বর্ষা উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে হৃদয়ের দিকে। হৃদয় কি উত্তর দেয় তা জানার জন্য। হৃদয় নিজেকে সামলে নিয়ে অপ্রস্তুত গলায় বললো,
‘না!’
‘একটা উত্তর দিতে এতো সময় লাগে?’
হৃদয় করুন চোখে তাকালো। বর্ষা হতাশ হয়ে গেলো।শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো। হৃদয় হুট করে বর্ষার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
‘রাফিকে তুই মেনে নে বর্ষা।’
হৃদয়ের চোখ টলমল। বর্ষা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে কড়া গলায় বললো,
‘অসম্ভব! যাকে আমি সহ্য করতে পারি না তাকে ভালোবাসবো কি করে?’
হৃদয় চাপা হাসি দিলো। হাসিতে যেনো বহু কষ্ট লুকানো ছিলো। ঢোক গিলে বেশ পায়তারা করে উত্তর দিলো,
‘রাফি তোকে অনেক ভালো রাখবে।’
‘আর তুই?’
হৃদয় দৃষ্টি লুকালো। বর্ষা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
‘তুই আমায় বহু আগের থেকে ভালোবাসিস হৃদ। তা আমি জানি। তাই বলে বন্ধুত্বের জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষকে দিয়ে দিবি?তুই কি ভাবিস আমি কিছু বুঝি না? একটা ছেলে সব ফেলে রেখে সবার আগে আমাকে প্রায়োরিটি দেয়। এটা শুধু বন্ধুত্বের জোরে যে নয় তা বোঝার বয়স আমার হয়েছে।’
বর্ষার কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো ছুঁড়ে বর্ষা এক মুহুর্ত দেরি করলো না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দৌড়ে বাসার পথ ধরলো। হৃদয় ধপ করে মাটিতে বসে পরলো।বর্ষাকে সেই কবের থেকে ভালোবেসে বসে আছে। বন্ধুত্ব নষ্ট হবে বলে কখনো বলেনি। এমন কি বুঝতেও দেয়নি। তবুও বর্ষা বুঝে গেছে। জানে জিগার দোস্ত রাফি বর্ষাকে পছন্দ করে। এটা জানার পর থেকে সে সরে আসার চেষ্টায় আছে। তবুও কেন জানি একটা পিছুটান থেকেই যায়। প্রথম ভালোবাসা বলে কি?
★
নজরুল সাহেব, জুনায়েদ বাবাও ছেলে বসে কথা বলছে। কথা নয় এক প্রকার তর্ক বলা যায়। দুইজনের আলোচনার বিষয় বর্তমান পরিস্থিতি ও দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্ব গতি নিয়ে। একজনের কথা আরেকজনের পছন্দ না হলেই তর্ক লেগে যাচ্ছে। আজ সরকারি বন্ধ। তাই তারা বাসায়।অনামিকা ও মিনা বেগম রান্নাঘরে রান্না করতে করতে বাপ-ছেলের তর্ক শুনছে। নিজেদের মধ্যে টুকিটাকি কথা হলেও তাদের কথায় মত কিংবা অমত দিচ্ছে না। তাদের মধ্যে কথা বলা মানে ফাঁদে পা দেওয়া। একটু পর নিজেরা সব ঠিক করে নিবে। মাঝে যে কথা বলবে সে ফ্যাসাদে পরবে।
বৃষ্টি তার দাদার কোলে বসে আছে। একবার দাদার দিকে আরেকবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে। দুজন যে বেশ সিরিয়সস বিষয় নিয়ে কথা বলছে তা বুঝতে পেরে কোল ছেড়ে উঠে গেলো। রান্নাঘরের সামনে এসে অনামিকাকে বললো,
‘মা, পড়াবে এসো।’
অনামিকা হাতের কাজ গুছাতে গুছাতে বললো,
‘তুই যা আমি আসছি।’
বৃষ্টি রুমের দিকে ছুটলো। মিনিট চার পর নজরুল সাহেব হাঁক-ডাক পেরে অনামিকাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘বর্ষা কই বউমা?’
জুনায়েদও বাবার সাথে গলা মিলালো,
‘হ্যাঁ, বর্ষাকে যে অনেকখন দেখছি না।’
অনামিকা চুপ করে রইলো। মিনা বেগম গম্ভীর স্বরে বললো,
‘কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেন অনামিকা? বর্ষা কোথায় গেছে?’
অনামিকা কি উত্তর দিবে খুঁজে পাচ্ছে না। নজরুল সাহেব, জুনায়েদ একটুও হৃদয়কে পছন্দ করে না। একটাই কারণ হৃদয় কারণে অকারণে মারামারি করে। তাদের ভাষ্যমতে ভদ্র ছেলেরা কখনো মারামারি করে না। তাই বর্ষাকে কড়া করে সাবধান করে দিয়েছে হৃদয়ের সাথে চলতে না। তাছাড়া মেয়ে হয়ে ছেলের সাথে কেন চলবে? বর্ষা এসব গায়ে মাখেনি। লুকিয়ে চুকিয়ে হৃদয়ের সাথে মিশে। এত বছরের বন্ধুত্ব কি ছুঁড়ে ফেলে দিবে নাকি? অনামিকা যদি বলে বর্ষা হৃদয়ের সাথে বাইরে গেছে। তাহলে বাসায় এখন ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে। আর অনামিকা তা হতে দিতে পারে না। এমনি মেয়েটার সাথে কদিন আগে যা ঝড় গেলো। তাতো সবই জানে সে। বর্ষাকে সে শুধু ননদ নয় নিজের ছোট বোন ভাবে।
‘ছাদে গেছে বাবা। একটু পর চলে আসবে।’
আমতাআমতা করে মিথ্যে বলে মনে মনে তোওবা করলো। তখুনি কলিং বেল বেজে উঠলো। অনামিকা ইতস্তত ভঙ্গিতে শাশুড়ীকে বললো,
‘ঐ তো বর্ষা চলে এসেছে।’
জুনায়েদ গলা উঁচিয়ে বললো,
‘অনামিকা দেখো তো কে এলো!’
নজরুল সাহেব বললেন,
‘বর্ষা বোধহয়।’
অনামিকা উত্তর দিলো,
‘যাচ্ছি।’
দরজা খুলতেই অনামিকা বর্ষাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখলো। কিছু বলার আগেই বর্ষা হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে নিজের রুমে চলে গেলো। নজরুল সাহেব মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কোথায় ছিলি এতখন?’
জুনায়েদ বললো,
‘বর্ষা শুনে যাস তো।’
অনামিকা চোখের ইশারা দিয়ে বললো,
‘ওকে একটু একা ছেড়ে দাও বৃষ্টির আব্বু।’
জুনায়েদ কিছু বুঝলো না। তবে অনামিকার কথার বিরুদ্ধেও গেলো না। নজরুল সাহেবও কিছু বুঝলেন না। জুনায়েদ ও তার বাবা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।বর্ষার কান্না ভেজা লাল চোখ অনামিকার চোখ এড়ায়নি। মাঝে মাঝে মানুষকে একা ছেড়ে দিতে হয়। তাই অনামিকা কথাটা বললো।বর্ষার কান দিয়ে এসব ঢুকেনি। সে দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে ধরাম করে দরজা আটকে দিলো। দরজার কাছ ঘেঁষে বসে হাঁটু মুড়ে কান্নায় ভেঙে পরলো।
#চলবে