হৃদয়ের একাংশ তুই পর্ব -০৬

#হৃদয়ের_একাংশ_তুই
#Part_06
#Writer_NOVA

হাসপাতালের ভেতরে সেঁতসেঁতে ভাব। ডেটলের কড়া গন্ধে ভেতর থেকে সব গুলিয়ে আসছে বর্ষার। হৃদয়ের এসবে তোয়াক্কা নেই। রাশভারি ভঙ্গিতে বর্ষার পিছু পিছু হাঁটছে। মেয়েটা হঠাৎ হাসপাতালে কেন এলো তা সে জানে না। জিজ্ঞেস করেও লাভ হয়নি। বলে, ‘গেলেই দেখতে পাবি’। বর্ষার হাতে চার থেকে পাঁচটা গাঁদা ফুল। গাঁদা ফুল দিয়ে বর্ষা কাকে অভিবাদন জানাবে তা হৃদয়ের মাথা খেলছে না। হৃদয়কে দাঁড়া করিয়ে রেখে রিসিপশন ডেস্কের সামনে গিয়ে কেবিন নাম্বার জেনে নিলো।

‘হৃদয় আয়।’

রিসিপশন থেকে বেরিয়ে হৃদয়কে ডাকলো। হনহন পায়ে সামনে এগুলো। বাম দিকে হেঁটে ২০৭ কেবিনে ঢুকলো। হৃদয় ভেতরে ঢুকে ভড়কে গেলো। বেডে হাত-পা ছড়িয়ে অনিক শুয়ে আছে।পাশে এক মহিলা বসে আছেন। সম্ভবত উনি অনিকের মা হবেন। থমথমে মুখে বর্ষার দিকে তাকালো। বর্ষার কোন খেয়াল নেই। সে গুটিগুটি পায়ে ভদ্র মেয়ের মতো অনিকের মায়ের সামনে দাঁড়ালো।

‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন? অনিক কেমন আছে?’

অনিকের মা চোখ তুলে তাকালেন। অচেনা মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে বললো,

‘এখন একটু ভালো। তুমি…..?’

‘আমরা অনিকের ফ্রেন্ড।’

‘ওহ আচ্ছা। বসো।’

অনিকের বাড়িতে বর্ষা কখনো যায়নি। বর্ষার ছবিও অনিক বাড়ির কাউকে দেখায়নি। তাই অনিকের মা বর্ষাকে চিনলো না। হলুদের দিন রাজ্যের কাজ নিয়ে জান বেরিয়ে যাচ্ছিলো বর্ষাকে খেয়াল করবে কি করে? অনিক ঘুমোচ্ছে। চেহারা মলিন। আগের মতো প্রাণোচ্ছল ভাব নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব দুর্বল শরীর। বর্ষা অনিকের দিকে তাকিয়ে একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। শত হোক মায়ায় তো পরেছিলো। মন খারাপকে পাত্তা না দিয়ে অনিকের মায়ের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করলো।

হৃদয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে গল্প শুনছে। ঘুমে চোখ জ্বলছে। এই মুহুর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমে চোখ টেনে নিচ্ছে। বর্ষা কথায় কথায় জানলো অনিকের বিয়েটা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। হিমা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে এই ছেলেকে বিয়ে করবে না। তা নিয়ে অনিকের মায়ের আক্ষেপের শেষ নেই। কথার মাঝে অনিকের মা হৃদয়কে বললো,

‘আরে তুমি বসছো না কেন?’

‘না, আন্টি ঠিক আছি।’

অনিকের মা একটা স্টিলের দন্ডের উপরো ফোম সেট করা টুল এগিয়ে দিলো হৃদয়ের দিকে। হৃদয় সেখানে বসে ঘুমে ঝুমতো লাগলো।

অনিকের মা নিচে গেছে পানি আনতে। বোতলে পানি নেই। বর্ষা পানি খেতে চেয়েছে। আসলে পানি খাওয়াটা হলো একটা বাহানা। সে চেয়েছিলো অনিকের সাথে একা কথা বলতে।বর্ষা হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ স্বরে বললো,

‘কিরে মুরগীর মতো ঝুমোছ ক্যালা?’

হৃদয় চট করে তাকিয়ে বললো,
‘তুই আবার এখানে এসেছিস কেন?’

বর্ষা একগালে ভিলেনি হাসি দিয়ে বললো,
‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা মারতে।’

‘আর কত?’

‘এটাই শেষ।’

বর্ষা অনিকের মুখের সামনে ঝুঁকে দাঁড়ালো। বর্ষার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস অনিকের মুখে আছড়ে পরতেই অনিক ঘুম থেকে উঠে পরলো। অনিক আড়মোড়া ভেঙে বর্ষাকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। চমকে উঠতে নিলেই বর্ষা চোখ দিয়ে শাসিয়ে বললো,

‘যেভাবে আছিস সেভাবেই থাক। গলা দিয়ে আওয়াজ বের করলে ধোর ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।’

অনিক পিছনে লেপ্টে গেলো। বর্ষাকে অসম্ভব ভয় করছে তার। করবেই না কেনো? সেদিনের বাঁশের বারির ব্যাথা তো এখনো শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে লেগে আছে। বর্ষা হাতে থাকা গাঁদা ফুলগুলো অনিকের দিকে বারিয়ে দিয়ে বললো,

‘নে ধর, গাধার জন্য গাঁদা ফুল আনছি।’

অনিক ধরলো না। বর্ষা ধমকে উঠলো,
‘নে ধর।’

অনিক চমকে উঠে কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলগুলো ধরলো। বর্ষা কপালে হাত রেখে আফসোসের সুরে বললো,

‘আমি আরো ভাবলাম তোর অবস্থা অনেক খারাপ।মুখে অক্সিজেনের মাস্ক লাগানো থাকবে। তাই মনে মনে ভাবছিলাম আসার সময় আস্তে করে তোর মুখের মাস্ক খুলে চলে যাবো। তাতে যদি তুই টপকে যাস। তোর হলুদের অনুষ্ঠানের বিরিয়ানি তো খেতে পারিনি। চল্লিশার বিরিয়ানি জুটলে জুটতেও পারে।এখানে এসে দেখি তুই দিব্যি সুস্থ।’

হৃদয় হাই তুলতে তুলতে বললো,
‘বাড়িতে যাবো। আমার ঘুমে ধরছে।’

‘তোর ঘুমের খেতাপুরি।’

বর্ষা গর্জে উঠলো। অনিক এতখনে প্রথম মুখ খুললো।

‘আম্মু কই?’

বর্ষা গলার আওয়াজ ভারী করে বললো,
‘আছে।’

‘কই?’

‘বললাম না আছে। এতো চিল্লাস কেন?’

বর্ষার ঝাড়িতে অনিক ঢোক গিললো। আগের বর্ষার সাথে এখনকার বর্ষার কত তফাত। বর্ষা মেয়েটাই এমন। তবুও অনিকের প্রেমে পরে সে একেবারে মাখন হয়ে গিয়েছিলো। তার এক মেয়ে বান্ধবী থেকে শুনেছিলো ছেলেরা নাকি ভদ্র মেয়ে পছন্দ করে। তাই বর্ষা পুরো ভদ্র রূপে অনিকের কাছে ধরা দিয়েছিলো।আর এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কটকটির মতো শক্ত থাকলে এ ছেলে না ওর সাথে ফ্লাট করতে পারতো। না আজ এই দিন দেখতে হতো।

‘ঐ হৃদ ফলের প্যাকেট কোথায়?’

হৃদ জিহ্বায় কামড় দিয়ে বর্ষার দিকে তাকালো। বর্ষা কটমট চোখে ওর দিকে তাকাতেই অপরাধী ভঙ্গিতে বললো,

‘সেটা বোধহয় ভুলে ফলের দোকানে ফেলে এসেছি।’

বর্ষা ফোঁস করে উঠলো।
‘এতো মন ভুলো হলি কবে?’

ফের অনিকের দিকে তাকিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,

‘তোর কপালটা আসলেই খারাপরে। দেখ তোর জন্য একটা আপেল, একটা মালটা, একটা আনার, এক থোকা আঙুর দিয়ে একটা প্যাকেট বানিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। তাও এই হাঁদারাম ফলের দোকানে ফেলে এসেছে। ওহ হ্যাঁ আরেকটা আধপচা আনারসও ছিলো। অনেক দোকান ঘুরে ৫০ টাকা দিয়ে আধপচা আনারসটা কিনেছিলাম। তাও তোকে দিতে পারলাম না। শুনলাম তোর বিয়েটা নাকি ভেঙে গেছে। শুনে ভীষণ খারাপ লাগছে রে।ইশ এমনটা না হলেও পারতো।’

অনিকের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো, ‘তোর জন্য তো ভেঙেছে।’ কিন্তু বলতে পারলো না। গলা অব্দি শব্দগুলো এসে থেমে গেলো। বর্ষা মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললো,

‘তোর ভাগ্যটা আসলেই খারাপ।’

‘কার ভাগ্য খারাপ?’

অনিকের মা বোতল ভর্তি করে পানি নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বর্ষার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো। বর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। হৃদয়ে পরিস্থিতি সামলাতে বললো,

‘আমার কথা বলছে আন্টি।’

অনিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। বর্ষা দ্রুত বিদায় নিলো। যাওয়ার আগে অসহায় চোখে একবার অনিকের দিকে তাকালো। সেই চাউনি হৃদয়ের অগোচর হলো না। হৃদয়ের হৃদয়ে আঁচড় কাটলো।নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো বর্ষার অসহায় চাহনীতে তার বুকটা ধক করে উঠলো কেনো?

বর্ষা আজ কলেজ যায়নি। গতকাল অনিককে দেখে আসার পর থেকে কেমন জানি অপরাধবোধে ভুগছে। এক মন বলছে এমনটা করা ঠিক হয়নি। আবার সেই মনই বলছে ঠিক হয়েছে। দ্বিধাদ্বন্দে সবকিছু অসহ্য লাগছে। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। কালো হয়ে আসছে। এই বুঝি ঝুম বৃষ্টি নামবে।বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বর্ষা। হৃদয়ের সাথে এই অব্দি আর কথা হয়নি। আকাশের সাথে তার মনেও বিষাদের আনাগোনা।

চুপচাপ সেখান থেকে সরে মায়ের রুমে এলো। প্রচন্ড মন খারাপ হলে মায়ের কোলে মাথা রেখে কিছু সময় শুয়ে থাকে বর্ষা। এতে একটা অন্য রকম প্রশান্তি পায়। মিনা বেগম সবেমাত্র আছরের নামায শেষ করে জায়নামাজে বসে তিন তবজি আদায় করছিলেন। হুট করে মেয়ে কোলে মাথা রাখায় কিছুটা চমকে গেলো।ধীরেসুস্থে তিন তবজি আদায় করে তবজিতে চুমু খেয়ে জায়নামাজের পাশে রাখলেন।মেয়ের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে?’

বর্ষা মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝালো কিছু না। মিনা বেগম কথা বাড়ালেন না। আলতো হাতে চুলে বিলি কাটাতে লাগলেন।

‘মা, আপনি একটু বৃষ্টিকে দেখেন তো। আমি আর বর্ষা একটু মার্কেটে যাই।’

রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলো অনামিকা। মিনা বেগম কথার পিঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেনো?’

‘কিছু কেনাকাটা আছে। বৃষ্টি ঘুমোচ্ছে। উঠলে একটু খাইয়ে দিয়েন। আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।’

মিনা বেগম প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। অনামিকা আসার পর সংসারের সবকিছু সে দেখছে। তাদের শাশুড়ী, বউয়ের মেলবন্ধন বেশ শক্তপোক্ত। নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। কিন্তু সেটা আবার নিজেরাই ঠিক করে নেয়। জুনায়েদ বা নজরুল সাহেবের কানে তা পৌছায় না।

‘বর্ষা তৈরি হয়ে নাও।’

‘আমি যাবো না ভাবী।’

‘তা বললে হবে না। তোমার যেতে হবে। উঠো!’

‘প্লিজ ভাবী জোর করো না।’

অনামিকা কেমড়ে এক হাত রেখে শাশুড়ীকে বিচার দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,

‘মা, ওকে উঠতে বলেন তো। বর্ষা চলো।তুমি না গেলে আমি যাবো না।’

মিনা বেগম বললো,
‘তোর ভাবী যখন এতো করে বলছে যা।’

অগত্যা বর্ষাকে উঠতেই হলো।অনামিকা আজ খেয়াল করছে বর্ষার মন খারাপ। সেই সকাল থেকে মুখ ভার করে রেখেছে। সারা বাসা মাতিয়ে রাখা মানুষ হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো কিছু ভালো লাগে না।অনিমিকারও তেমন ভালো লাগছে না। তাই সে ভাবলো ওকে নিয়ে বাইরের থেকে ঘুরেও আসা যাবে আবার কিছু টুকিটাকি সংসারি জিনিসপত্র কেনাও হবে।’

হৈ-হল্লায় এতখন বিরক্ত লাগলেও এখন মন্দ লাগছে না বর্ষার। অনামিকা বর্ষাকে নিয়ে একটা ফাস্টফুডের দোকানে বসে আছে। দুটো বার্গার অর্ডার করে নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে কথা বলছে। বর্ষাকে আগের থেকে অনেকটা প্রাণোচ্ছল দেখে অনামিকা খুশি হলল। তার মিশন সাকসেসফুল হয়েছে।

‘তোমার কি হয়েছে বলো তো?’

‘কিছু না ভাবী।’

‘তাহলে তোমাকে আজ অনেক উদাস দেখাচ্ছে কেনো?’

বর্ষা ম্লান হেসে বললো,
‘সব সময় কি আমাদের মন একরকম থাকে ভাবী?’

‘হৃদয়ের সাথে কিছু হয়েছে কি?’

অনামিকার কন্ঠে উৎকন্ঠা। বর্ষা হেসে বললো,
‘আরে না ওর সাথে কি হবে?’

ওয়েটার বার্গার,পানির বোতল দিয়ে যাওয়ায় কথা ধামাচাপা পরে গেলো। দুজনে খাওয়ায় মন দিলো। পাশের টেবিল থেকে একটা ছেলে বর্ষাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘আরে আপনি সেই বুলবুলি না?’

বর্ষা ছেলেটাকে দেখে বিষম খেলো।অনামিকা দ্রুত বোতলের খাপ খুলে বর্ষার দিকে পানি এগিয়ে দিলো। বর্ষা পানি খেয়ে নিলো।ছেলেটা হাসিমুখে পকেটে হাত গুজে বর্ষার পাশে দাড়িয়ে আছে।অনামিকা খেয়াল করলো বর্ষার চোখে পালাই পালাই ভাব। কিন্তু কেনো? কেই বা এই ছেলে? তা বোধগম্য হলো না।

#চল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here