হৃদয়ের একাংশ তুই পর্ব -০৫

#হৃদয়ের_একাংশ_তুই
#Part_05
#Writer_NOVA

হাতে থাকা ছোট এড্রেস কার্ডের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো আয়াজ। বিগত আধা ঘণ্টা যাবত এ গলি থেকে ও গলি ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। কিন্তু ঠিকানা মিলে না। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবে তাও পাচ্ছে না। যাদেরওবা পেয়ে জিজ্ঞেস করছে তারা সাফ সাফ জানিয়ে দিচ্ছে চিনে না। বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হয়ে আসছে। দুপুরের উত্তপ্ত রোদে কপাল বেয়ে দরদর ঘাম পরছে। শার্টের হাতায় ঘাম মুছে দু হাত কোমড়ে রেখে দাঁড়ালো। এবারই শেষ। এখন কাউকে পেলে জিজ্ঞেস করবে। নয়তে নিজের বাসার দিকে ছুটবে।শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে। সকাল থেকে এই অব্দি দৌড়ঝাঁপ কম হয়নি। পেটটা খুদায় মোচড় দিয়ে উঠছে। আশেপাশে তাকিয়ে আশার আলো খুঁজে পেলো। সে দেখলো একটা মেয়ে দীপ্ত পায়ে রাস্তার কিনার ঘেঁষে হেঁটে চলছে। মাঝে মাঝে দাড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে মুখ হাত দিয়ে আড়াল করে দিচ্ছে। রোদে মুখ রক্তিম বর্ণ হয়ে গেছে। আয়াজ দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে ডাকলো।

‘এই যে শুনেছেন? ও হ্যালো! আপনাকেই বলছি।’

প্রচন্ড গরমে গা পুড়ে যাওয়ার যোগাড়। শরীর চলছে না বর্ষার। পা দুটো ভেঙে আসছে। কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা রিকশার দেখাও মিললো না। আজকাল রিকশা ওয়ালা মামাদেরও দাম বেড়ে গেছে। বিশ টাকার ভাড়া চল্লিশ টাকা চেয়ে বসে থাকে। বসে থাকতে রাজী আছে কিন্তু মন মতো ভাড়া না হলে পেসেঞ্জার নিয়ে গন্তব্য যাবে না। অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে কি লাভ? জিনিসপত্রের দাম যা উর্ধ্বগতিতে হুরহুর করে উঠছে তাতে খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের মানুষকে কপাল ঠুকে মরতে হবে।

নিজের মনে কথাগুলো আওড়াতে আাওড়াতে হাঁটছে বর্ষা। আজ ছাতা আনতেও ভুলে গেছে।রোদে শরীর জ্বালা করছে। পায়ের তালু গরম হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সিদ্ধ হয়ে যাবে। কপাল কুঁচকিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। সূর্যের আলোয় চোখ মেলে রাখা ভার। দ্রুত হাত দিয়ে মুখ আড়াল করলো। তখুনি হুড়মুড় করে একটা ছেলে এসে ওর সামনে পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে বললো,

‘কখন থেকে আপনাকে ডেকে চলছি।কিন্তু ওর সাড়াশব্দ নেই। হনহনিয়ে হেঁটেই চলছেন। একটু আস্তে হাঁটলে কি আমায় এতো হয়রান হতে হতো?’

চোখ কুঁচকে তাকালো বর্ষা। এ এবার কোথাকার উটকো ঝামেলা। আগে কখনও দেখিনি তো।

আয়াজ দুই হাটুতে ভর দিয়ে হাঁপাচ্ছে। মেয়েটা এতো জোরে হাঁটে যে ওকে ধরতে শেষ পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে। আয়াজের অবস্থা দেখে বর্ষা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনি কি আমায় বলছেন?’

আয়াজ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললো,
‘আপনাকে ছাড়া আর কাউকে দেখছি না তো ম্যাডাম।’

‘আমার তো মনে হচ্ছে না আপনাকে আমি চিনি।’

‘আমিও আপনাকে চিনি না।’

‘তাহলে আমায় ডাকছিলেন কেনো?’

বর্ষার চোখ, মুখে আগ্রহী ভাব। আয়াজ ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আকুলতা নিয়ে বললো,

‘আপনার কাছে পানি হবে? অনেক তেষ্টা পেয়েছে।’

বর্ষা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো।তার ব্যাগে পানির বোতল আছে। একবার ভেবেছিলো দিবে না। কিন্তু আয়াজের ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে মানা করলো না। তৃষ্ণার্ত পথিককে পানি পান না করালে আল্লাহর কাছে তার জবাবদিহি করতে হবে। সেই ভয় মনে ঢুকতেই তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি দিলো। আয়াজ এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে আধা বোতল পানি খেয়ে নিলো। বোতলের খাপ লাগিয়ে হাত দিয়ে মুখ মুছে বর্ষাকে ফেরত দিলো।মলিন মুখে কৃতজ্ঞতার এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে বললো,

‘ধন্যবাদ, বড় উপকার করলেন।’

‘ওয়েলকাম।’

বর্ষা বোতল ব্যাগে ভরে নিলো। নিজের পথ ধরে হাঁটা শুরু করলো। পেছন থেকে আবারো আয়াজ ডাকলো,

‘শুনুন!’

গরমে বর্ষার ভীষণ বিরক্তি লাগছে৷ মন মেজাজও খারাপ হয়ে আসছে। কিছুতেই বাইরে থাকতে মন চাইছে না। ইচ্ছে করছে বাড়িতে ছুটে গিয়ে ঠান্ডা পানিতে গোসল করে একটা লম্বা ঘুম দিতে। যত তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে পারবে তত তাড়াতাড়ি তার ইচ্ছে পূরণ হবে। কিন্তু ছেলেটা ডাকে কেন? বিরক্তি লুকিয়ে পিছু ঘুরে জিজ্ঞেস করলো,

‘কিছু বলবেন?’

‘আরেকটা হেল্প করবেন?’

‘জ্বি বলুন।’

আয়াজ হাতের এড্রেস কার্ড দেখিয়ে বললো,
‘এই ঠিকানাটা কোথায় বলতে পারবেন?’

বর্ষা কার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখলো। ওমনি তার মনে শয়তানি বুদ্ধি হানা দিলো। মুচকি হেসে বললো,

‘হ্যাঁ, বলতে পারবো।’

আয়াজ খুশি হয়ে গেলো। অবশেষে এমন কাউকে পাওয়া গেলো যে কিনা ঠিকানাটা চিনে। সত্যি বলতে বর্ষা ঠিকানা একেবারেই চিনে না।জীবনে দেখেওনি।

আসলে বিষয়টা হচ্ছে ধরুন আগারগাঁও আর আগারগাঁ দুটো জায়গার নাম।পার্থক্য শুধু একটা ও এর। এখন আপনি যদি আগারগাঁও এর ঠিকানা আগারগাঁ গিয়ে খুঁজেন তাহলে তো পাবেন না।আয়াজ জিজ্ঞেস করেছে অাশেপাশের পথচারীকে তারা চিনবে কি করে। ঐ যে একটা ও এর পার্থক্য রয়ে গেছে।

আয়াজ খুশিমনে বললো,
‘কি করে যাবো?’

বর্ষা মনে মনে হাসলো। তারপর বললো,
‘এখান থেকে সোজা আপনার নাক বরাবরি যাবেন। তারপর যেতেই থাকবেন। যেতেই থাকবেন। যতক্ষণ না আপনি সামনের তিন বৈদ্যুতিক পিলারে সাথে ধরাম করে বারি খান। বারি খেয়ে পরলে উঠে দাঁড়াবেন। মাথা ডলতে ডলতে বাম হাতের গলিতে ঢুকবেন। তারপর চলতেই থাকবেন, চলতেই থাকবেন, চলতেই থাকবেন। উষ্টা খেয়ে পরতে পরতে যখন বাঁচবেন তখন চোখ তুলে তাকিয়ে দেখবেন হালকা ইঁদুরের বিষ কালার একটা বিল্ডিং। সেই বিল্ডিং পার করে দুই বিল্ডিং ডানে চার বিল্ডিং এর বামে আরো দুই দালানের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন। সেই রাস্তা ফুরালে পিত্তি কালারের মধ্যে হালকার মধ্যে গর্জিয়াছ ডিজাইন করা দালান দেখবেন। সেটাকে পিছনে ফেলে দশ কদম ঈশান কোণে হাঁটলেই তিনতলা এক দালান পাবেন। সেটাই হলো এই কার্ডের ঠিকানা।’

আয়াজ ভেবাচেকা খেয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা কি বললো তা সব ওর মাথার ওপর দিয়ে গেছে। অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

‘আমি ঠিক বুঝলাম না।’

‘আমিও না।’

‘আপনি নাকি চিনেন?’

‘কি করে যাবেন তা বলে দিয়েছি। কিন্তু চিনি তাতো বলিনি।’

‘তাহলে এই ঠিকানাটা কোথায়?’

বর্ষা হে হে করে হেসে বললো,
‘আমি জানি না।’

ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে বর্ষা চলে গেলো। আয়াজ নির্বাক ভঙ্গিতে হা করে রইলো। তারপর বিরবির করে বললো,

‘কি সাংঘাতিক মেয়ে রে বাবা! কেমন ঘোল খাওয়ালো আমায়।’

কখন থেকে হৃদয়ের মোবাইল বেজে চলছে। কিন্তু হৃদয়ের হুশ নেই। সে ক্যাফে থেকে এসে গোসল সেড়ে না খেয়েই ঘুম দিয়েছে। সেই গভীর ঘুমকে ব্যাঘাত ঘটাতে মোবাইলের রিংটোন বিচ্ছিরি শব্দ করে বেজে চলছে। এক সময় বিরক্তিতে ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ বন্ধ করে হাতড়ে কল রিসিভ করে মোবাইল কানে দিতেই অপরপাশ থেকে বর্ষার ঝাঁঝালো কণ্ঠ ভেসে এলো,

‘ঐ কুত্তা কই মরছিস তুই? কখন থেকে কল করতাছি তোর ধরার নাম নাই।’

হৃদয় বালিশে মুখ গুঁজে ঘুম জড়ানো কন্ঠে থেমে থেমে বললো,

‘কি হয়েছে?’

বর্ষা ফোঁস করে উঠলো,
‘কি হইছে মানে? তোকে কখন থেকে কল করতেছি আমি। আর তুই কুম্ভকর্ণের মতো মরার ঘুম দিছিস।’

‘বলবি তো কি হইছে? তোর নানীর বিয়া লাগছে নাকি তোর? নাকি তোকে তোর ব্রিটিশ বাপ বাসা থেকে বের করে দিছে। কোনটা বল তো?’

‘মেজাজ আমার চরম খারাপ হৃদ। আমি মোটেও মজার মুডে নাই। তুই জলদী পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোর বাসার নিচে আসবি। নয়তো তোর কপালে শনি আছে।’

‘আমার বাসার নিচে কেন?’

‘টানা বিশ মিনিট ধরে আমি তোর বাসার নিচে দাড়িয়ে আছি। তুই বলছিস বাসার নিচে কেন? আজকে আয় তুই। তোর পিন্ডি চটকাবো আমি।’

‘আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না। বাসায় যা তুই।’

‘তোকে গুণে গুণে পাঁচ মিনিট সময় দিবো। এর মধ্যে এক সেকেন্ড দেরী হলো আমি তোর রুমে হাজির। তারপর কেলানি কি খাস তা দেখবি।’

কথাটা বলেই বর্ষা কল কেটে দিলো। হৃদয় লাফ দিয়ে উঠে বসলো। এই মেয়েকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। দেরী হলে সোজা বাসায় হামলা করতে পারে। ব্যাচালর ছেলের রুমে মেয়ে মানুষ দেখলে আশেপাশের মানুষ কুৎসা রটাবে। বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে। দ্রুত গতিতে বেসিন থেকে মুখে পানি ছিটালো। লুঙ্গি পাল্টে প্যান্ট পরে টি-শার্ট পরতে পরতে সিঁড়ি দিয়ে দৌড় মারলো।

চার মিনিটের মাথায় বাসার গেইটে পৌঁছালো হৃদয়। হাঁপাতে হাঁপাতে বর্ষার মাথায় একটা চাটি মেরে জিজ্ঞেস করলো,

‘এতো প্যারা দেস কেন আমারে?’

বর্ষা দাঁত কেলিয়ে বললো,
‘তোরে জ্বালাইতে আমার অনেক ভালো লাগে।’

হৃদয় চোখ কচলে বর্ষার ওড়না টেনে মুখ মুছলো। বর্ষা চেচিয়ে উঠলো,

‘আমার নতুন ওড়না!’

‘তো কি হয়েছে?’

‘ওড়না নষ্ট হলে তুই কিনে দিবি।’

‘পানিতে ওড়না নষ্ট হয়, বলদ?’

‘সেই যাই হোক। তুই মুছবি কেন?’

‘মন চাইছে তাই।’

‘তোর সাথে ঝগড়া করার মুডে নেই আমি।এক জায়গায় যেতে হবে চল।’

‘আবার কার ধর থেকে মুন্ডুপাত করতে যাবি?’

বর্ষা চোখ পাকিয়ে বললো,
‘কথা কম বলবি।’

‘এতো জ্বালাস কেন?’

‘আমি বেঁচে থাকবো যতদিন, তোকে জ্বালাবো ততদিন।’

‘জানিস, তোর জ্বালায় আমার এখন খালি একটা গান গাইতে ইচ্ছে করে।’

বর্ষা সন্দেহী চোখে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি গান?’

হৃদয়ের চোখ থেকে এখনো ঘুম কাটেনি।চোখ দুটো টানছে। পানি দেওয়ায় কাজ হয়নি। বর্ষা উৎসুক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কি গান গায় তা শোনার জন্য। হৃদয় চোখ কচলিয়ে সুর টেনে বয়স্ক মানুষের গলায় গাইতে লাগলো,

‘আমি পারি না আর পারি না।
আমি কেন মরি না।
আজরাইল কি চোখে
দেখে না আমারে।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here