হৃদয়ের একাংশ তুই পর্ব -০৪

#হৃদয়ের_একাংশ_তুই
#Part_04
#Writer_NOVA

ব্যস্ত নগরী, ব্যস্ত মানুষজন। এই নাগরীর মানুষদের সকাল হতেই যেনো ব্যস্ততা ঘিরে ধরে। যানবাহনের শব্দে শুয়ে থাকার জো নেই। কখনও রিকশা, সাইকেলের টুংটাং ধ্বনি, কখনও বা বড় গাড়ির হর্ণের শব্দে মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম।

প্রধান সড়কের পাশেই এক তিনতলা ভবনের দোতালায় বর্ষারা ভাড়া থাকে। সকাল হতে দেরী সবজি ওয়ালার হাঁক-ডাক, যানবাহনের শব্দ শুরু হতে দেরী নয়। এসব কানে সয়ে গেছে বর্ষার। তাই তো এখনো পরে পরে ঘুমোচ্ছে। সকালের মিষ্টি রোদ চোখে লাগতেই চোখ খিঁচে, কপাল কুঁচকে ফেললো বর্ষা। চোখ না খুলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,

‘ভাবী, পর্দাটা টেনে দাও।’

অনামিকা ফ্যান বন্ধ করে কাঁথা টান দিয়ে নিয়ে গেলো। সেটা ভাজ করতে করতে বললো,

‘রোদটা কি ঘুমোতে অনেক ডিস্টার্ব করছে ননদী?’

‘হ্যাঁ, ভাবী অনেক।’

‘বিরক্ত করতেই জানালা খুলেছি। কয়টা বাজে দেখছো? আর কত ঘুমাবে বলো? মা চেচামেচি করছে। এখন না উঠলে খুন্তি চালান দিবে পিঠে।’

‘উফ, আমার শান্তি কারো সহ্য হয় না।’

বিরক্তিতে সুরে টেনে বর্ষা কথাটা বললো। অনামিকা মুখ টিপে হেসে কাঁথাটা পাশে রাখলো। বর্ষার পাশে শুয়ে আছে জুনায়েদ ও অনামিকার একমাত্র মেয়ে বৃষ্টি। বয়স সাত বছর। এবার ক্লাশ টু তে উঠেছে। একেবারে বর্ষার ডুপ্লিকেট। দেখতে শান্তশিষ্ট মেয়ে মনে হলেও বৃষ্টি তার ফুপু বর্ষার মতোই ডেঞ্জারাস।

অনামিকা মেয়ের গা ঠেলতে ঠেলতে ডাকতে লাগলো,
‘বৃষ্টি মা-মণি, উঠো। স্কুলে যেতে হবে তো।’

বৃষ্টির তাল নেই। অনামিকা বেশ কয়েকবার ডাকায় সেও বর্ষার মতো কপাল কুঁচকিয়ে চোখ বন্ধ করেই বললো,

‘উহু, আম্মু! সকাল হলেই কি তোমাকে ভূতে ধরে? আমাকে আর পিপিকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য যুদ্ধ শুরু করো।’

মেয়ের পাকা কথা শুনে কান ধরে টান দিলো অনামিকা। বৃষ্টি চেচিয়ে উঠলো,

‘বর্ষা পিপি, বাঁচাও। আম্মুর সাথে থাকা ভুত আমার কান টেনে ধরেছে।’

বর্ষা মুখ টিপে হেসে কপট রাগী গলায় বৃষ্টিকে মিথ্যা শাসানোর ভান করে বললো,

‘এতো ঘুমাস কেন? জলদী উঠ।’

বৃষ্টি লাফ দিয়ে উঠে বসলো। মায়ের থেকে কান ছাড়িয়ে বর্ষার দিকে তাকালো। বর্ষা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বৃষ্টি মুহূর্তের মধ্যে বর্ষার পিঠে বসে মৃদুভাবে কিল দিতে দিতে বললো,

‘এই কি বললে তুমি? আমি বেশি ঘুমাই? আজ তোমার খবর আছে পিপি। তোমায় আমার থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’

বর্ষা চেচাচ্ছে। অনামিকা দুটোর কান আচ্ছামতো মলে দিলো। এটা ওদের দৈনন্দিন রুটিন। প্রতিটা সকাল ফুপু,ভাতিজী খামোখা কথা কাটাকাটি, মারামারি করবে। অনামিকা দুজনকে উঠিয়ে বসিয়ে শাসানো গলায় বললো,

‘ন’টার মধ্যে খাবার টেবিলে দুই ইমরোজকে দেখতে চাই। নয়তো বাবাকে দিয়ে আচ্ছা করে বকুনি খাবো।’

দু’জন ভদ্র মানুষের মতো মাথা নাড়ালো। অনামিকা দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। বর্ষা,বৃষ্টি আবারো হুলস্থুল শুরু করলো। অনামিকার গলা শোনা গেলো।

‘ন’টা বাজার পর এক মিনিট দেরী হলে খবর আছে।’

বর্ষা, বৃষ্টির কানে সেটা ঢুকলো না। তারা এখন যুদ্ধে নেমেছে কার আগে কে বাথরুমে ঢুকতে পারে।

বর্ষার পুরো নাম বর্ষা ইমরোজ। বাবা নজরুল ইসলাম। পেশায় একজন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। মা মিনা বেগম গৃহিণী। বড় এক ভাই জুনায়েদ ইসলাম। বর্তমানে একটা বেসরকারি এনজিও সংস্থায় কাজ করে। জুনায়েদকে অনার্স ২য় বর্ষে পড়া অবস্থায় পড়াশোনা না করার ভূতে ধরেছিলো। এর অবশ্য একটা জোড়ালো কারণ আছে। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে অনামিকার প্রেমে মজেছিলেন তিনি। বছর দুই চুটিয়ে প্রেম করে। সেই খবর পেয়ে অনামিকার বাবা মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। এদিকে অপরিপক্ক বয়সের ছেলেকে নজরুল সাহেবও বিয়ে দিবেন না। প্রেমিকাকে না হারাতে পরীক্ষার পরপর তাকে নিয়ে পালিয়েছিলেন। দুই দিন পর বিয়ে করে যখন বাসায় উঠেছেন তখন নজরুল সাহেব জুনায়েদের ওপর ভীষণ ক্ষ্যাপা। কিছুতেই ছেলেকে ঘরে তুলবেন না। মিনা বেগম কেঁদেকুটে স্বামীর পায়ে ধরে ছেলেকে বাসায় উঠিয়েছেন। একমাত্র ছেলে, বাপ বাসায় ঠাঁই না দিলে যাবে কোথায়?

ধীরে ধীরে দিন যেতে লাগলো। অনামিকাকে প্রথম মেনে না নিলেও খুব শীঘ্রই সবাই মেনে নিলো। চমৎকার গুণের মেয়ে অনামিকা। সব দিকে সমান খেয়াল। মিনা বেগম সংসার ছেলের বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বছর খানেক ঘুরতেই জুনায়েদ ও অনামিকার মেয়ে এলো ঘরে।বর্ষার নামের সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রাখা হলো বৃষ্টি ইমরোজ। নাতনীর মুখ দেখে অনামিকার বাবারও রাগ পরলো। সব মেনে নিয়ে মেয়ে, মেয়ের জামাইয়ের সাথে বর্ষার পুরো পরিবারকে বাসায় দাওয়াত করে খাইয়েছেন।বর্ষার বাবা গ্রামে গিয়ে বড় অনুষ্ঠান করে নাতনীর আকিকা পালন করেছে।

কলেজের জন্য তড়িঘড়ি করে নামতেই বাড়িওয়ালা মকবুল মোল্লার সাথে সিড়িতে দেখা হলো বর্ষার। মেজাজ তখুনি তুঙ্গে উঠে গেছে। এই লোকটাকে বর্ষা কেনো বাড়ির কোন মেয়ে মানুষ দেখতে পারে না। বয়স ষাটের কম না। কিন্তু ব্যাটার চোখ খারাপ। মেয়েদের দিকে সুযোগ পেলেই নোংরা নজর দেয়। বর্ষা সাইড কাটিয়ে যেতে নিলেই মকবুল মোল্লা পান খাওয়া দাঁতে বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো,

‘কই যাও বর্ষা?’

‘দেখতেই পাচ্ছেন কাঁধে কলেজ ব্যাগ। কলেজ ব্যাগ নিয়ে কেউ নিশ্চয়ই নাচতে যায় না।’

মকবুল মোল্লা থতমত খেয়ে গেলো।বর্ষার মনটা একটু শান্তি লাগলো। প্রতিদিন একই প্রশ্ন শুনতে শুনতে বিরক্ত সে। মকবুল মোল্লা থেমে রইলেন না। সিঁড়ি পাশে একদলা পানের পিক ফেলে বললেন,

‘আজকালকার মাইয়ারা কলেজের নাম কইরা কত আকাম-কুকাম করতে যায়। তা কি কেউ কইতে পারে।’

বর্ষার রাগ হলেও হাত মুঠ করে তা হজম করে নিলো। তারপর কড়া গলায় বললো,

‘চাচা একটা কথা বলি?’

‘আরে একটা কেন দশটা কও।’

‘আমারে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েন তো।’

মকবুল মোল্লা চোখ গোল করে জিজ্ঞেস করলো,
‘পাঁচ হাজার টেকা কেন?’

‘আপনার বউয়ের জন্য হারবাল ঔষধ কিনতে। এমন হারবাল কিনবো যা সেবন করলে আপনার বউ যেনো বিশ বছরের যুবতী হয়ে যায়। আর আপনি শুধু চাচী ছাড়া আরো কোন মেয়ে মানুষের দিকে নজর না দেন।’

মকবুল মোল্লা খুক খুক করে কেশে উঠলো। বর্ষা কয়েক সেকেন্ড থেমে নিচু গলায় থ্রেট দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,

‘এরপরও যদি মাইয়া মানুষের দিকে তাকান তাহলে চোখ দুইটা খেজুর কাটা দিয়ে উঠাইয়া কাউয়ারে দিয়ে দিমু। তারপর চোখে টিনের চশমা পরাইয়া রাখমু। কেউ বলতেও পারবো না যে আপনার চলখ নাই।এখানেই শেষ না। মেইন গেইটের সামনে ভাঙা থালা নিয়া বসামু।তখন কিন্তু মাথা নিচু কইরা রাইখেন। নয়তো ঝাড়ুর বারিও পরতে পারে। আমারে চিনেন না চাচা। এই বর্ষা কি চিজ তার উদাহরণ এখনো পান নাই।’

মকবুল মোল্লা খেঁকিয়ে উঠলো,
‘আমার বাড়ি থাইকা আমারেই হুমকি দাও মাইয়া। দাঁড়াও আইজকাই তোমার বাপেরডায় বিচার দিতাছি।’

বর্ষা ভয় পেলো না। হাই তুলতে তুলতে বললো,
‘যাকে মন চায় তাকে বলেন। আমিও আপনার বদমাশির একটা ভিডিও বানায় রাখছি। আমার বাবার কাছে বিচার দিলে তা অনলাইন ছেড়ে দিবো।তখন এই চেহারার সুরত কই যায় তা আমিও দেখবো।’

একটু আগের দপদপ করে জ্বলে উঠা মুখটা নিমিষেই মিইয়ে গেলো। চোখ কপাল তুলে মকবুল মোল্লা জিজ্ঞেস করলো,

‘কিসের বিডুও?’

বর্ষা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
‘তা আপনার না জানলেও চলবে।’

হাসতে হাসতে সাইড কাটিয়ে চলে গেলো বর্ষা। মকবুল মোল্লা এখনো সিঁড়িতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে আল্লাহর নাম জপলেন। কেন এই মেয়ের সাথে লাগতে গেলো। কোন ভিডিও করেছে কে জানে। গত কয়েক বছরের নানা আকাম-কুকামের কথা মনে পরতে লাগলো তার। পা দুটো টেনে উপরে উঠতে পারছেন না। গলা শুকিয়ে আসছে। এই মুহুর্তে এক গ্লাস পানি পান করা তার অতী জরুরি।

বর্ষা একবার পিছু ফিরে মকবুল মোল্লার শুকিয়ে যাওয়া ভয়ার্ত মুখটা দেখে মুখ টিপে হাসলো। ভিডিও এর কথা শুনে ব্যাটার মুখ যা হয়েছে না একেবারে দেখার মতো। বর্ষার কাছে কোন ভিডিও নেই।মাঝে মাঝে এমন ভালো মুখোশধারী শয়তান মানুষকে মিছে ভয় দেখাতে ভালোই লাগে। বর্ষা একদলা থুথু রাস্তায় নিক্ষেপ করে বিরবির করে বললো,

‘শা’লার বুইড়া!’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here