অচিত্তাকর্ষক পর্ব -১৮

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৮|

স্মৃতি রাতে খেল না। বাড়ির সবাই খেলেও সে আজ খাবার রুমেই পা দিল না। জুভান তাকে এই নিয়ে কোনো প্রশ্নও শুধাইনি। নিজের খাবার শেষ করে সে যথারীতি রুমে ফিরে আসে। স্মৃতি তখন বারান্দায় ছিল। আকাশে কালো মেঘ। দূরে ঢিপ ঢিপ করে কিছু তারা জ্বলজ্বল করছে। রুমে জুভানের উপস্থিতি স্মৃতি টের পেলেও সে রুমে যায় না। জুভান ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে তার ফোনটা হাতে নেয়। সে একটা নাম্বারে কল লাগায়। কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে। জুভান লাগাতার অনেকগুলো কল দেয় সেই নাম্বারে। কিন্তু কল রিসিভ হয়না। এই নাম্বার তো সচরাচর বন্ধ থাকে না। জুভানের কাছে সেই ব্যক্তির আরো একটা নাম্বার ছিল। সে এবার ঐ নাম্বারেই কল লাগায়। কলটা রিসিভও হয়। ওপাশ থেকে একজন মধ্যবয়সী নারীর স্বর সে শুনতে পায়। জুভান মহিলাটি কে জিহাদের কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু মহিলা তাকে বলে, জিহাদের ফোন বিকেল থেকেই বন্ধ বলছে। ওর সাথে কেউই কোনরূপ যোগাযোগ করতে পারছে না। এমনি কী সে এই মুহুর্তে কোথায় আছে সেটাও কেউ জানে না। মহিলাটি হয়তো জিহাদের মা। তার কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে তিনি খুব চিন্তিত। ব্যাপারটা এবার জুভানের কাছেও ভীষণ খটকা লাগে। জিহাদের আবার কী হলো। এমন আচরণ তো ও এর আগে কখনো করেনি। তার এত ভাবনার রেশ কাটে স্মৃতি কে দেখে। স্মৃতি রুমে আসে। জুভান ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটার চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। জুভান কিছু বুঝতে পারে না। সে ফোন রেখে উঠে দাঁড়ায়। স্মৃতির কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে। স্মৃতি উত্তর দেয় না। জুভান আবারও বিরক্ত হয়ে একই প্রশ্ন করে। স্মৃতি তাকে আগের মতোই অবজ্ঞা করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। জুভানের ও আগে থেকেই মন মেজাজ খারাপ। এখন আবার স্মৃতির এমন ব্যবহারে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে সে, কিছুটা রাগও হচ্ছে হয়তো। সে লাইট অফ করে এসে স্মৃতির পাশে শুয়ে পড়ল। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করল স্মৃতির প্রত্যুত্তরের জন্য। কিন্তু স্মৃতির কাছ থেকে কোনরূপ সাড়া শব্দ না পেয়ে সে নিজেই তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার গলায় মুখ ডুবাল। স্মৃতির এবার আর সহ্য হলো না। জুভানের নিশ্বাসে যেন বিষ ঝরছে। এক ঝটকায় জুভানকে সরিয়ে দিল সে। ব্যাপারটা জুভান হজম করতে পারল না। সে উঠে বসে স্মৃতিকেও টেনে উঠাল। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘কী হয়েছে তোমার?’

স্মৃতি বরাবরের মতোই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। জুভান তার ডান হাতটা এবার চেপে ধরে বলল,

‘সমস্যা কী তোমার? বলবে তো কী হয়েছে, এমন ব্যাবহার কেন করছো?’

স্মৃতি তার দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি এতটা দুরূহ ছিল যে যার কঠিনতা দেখে জুভানও চমকে যায়। স্মৃতির চাহনী তো কখনো এত কঠিন ছিল না। তার চাহনী তো ছিল সর্বদা নরম কোমল। তাহলে আজ কী এমন হলো যে সে এমন কঠিন চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে?

জুভান নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বলল,

‘পিরিয়ড হয়েছে? পেটে ব্যাথা করছে খুব? হট ব্যাগে করে গরম পানি এনে দিব? পেটে গরম পানির সেঁক দিলে দেখবে ব্যাথাটা কিছুটা কমবে।’

‘মনে ব্যাথা করছে আমার। অনেক বেশি ব্যাথা করছে। এই ব্যাথা কী করে কমাবো বলুন? এই ব্যাথা কি গরম পানির সেঁকে কমবে? কমলে নিয়ে আসুন। আমি আর এই ব্যাথা সহ্য করতে পারছি না। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে, বুকের ভেতরেটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এই ব্যাথা আপনি বুঝবেন না। কী করে বুঝবেনই বা বলুন, বোঝার জন্য তো একটা মন থাকা দরকার। আর সেই মনটাই তো আপনার নেই। মনহীন পাষাণ একটা মানুষ আপনি। আপনার মতো এত পাষাণ মানুষ আমি আগে কখনো দেখিনি, কখনো না।’

এই বলে স্মৃতি আবারও পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। জুভান কিছুক্ষণ আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল তার দিকে। স্মৃতি এইসব কথা কেন বলল তাকে। তাকে সে পাষাণ বলল? কেন বলল? সে কি তবে সব সত্যি জেনে গিয়েছে? বুঝে গিয়েছে তার বাবার জমির আসল রহস্য? তবে যদি তাই হয়, তবে জুভান ও আর লুকিয়ে কিছু করবে না এবার যা হবে খোলাখুলি হবে, সামনা সামনি হবে। সেও দেখে নিবে স্মৃতি তার সাথে কীভাবে টক্কর নিয়ে টিকে থাকে। এবার স্মৃতি জুভান আহমেদের আসল আর ভয়ানক কুৎসিত রূপটা দেখবে। সেই রূপটাই দেখবে যেটা সে দীর্ঘ পাঁচ বছর সে স্মৃতির কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিল…
.

সকাল বেলা স্মৃতির ঘুম ভাঙতেই দেখল তার চারপাশ একেবারে নিরব নিস্তব্ধ। যেন শতশত বছর যাবত এখানে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। মিটমিট করে চোখ খুলে তাকিয়ে সে জায়গাটা প্রথমে চিনল না। চারদিক তো অন্ধকার। হঠাৎ কেন যেন গায়ে কাটা দিয়ে উঠল তার। এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসল। আশে পাশে অস্থির হয়ে তাকিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করল এখন সে ঠিক কোথায় আছে। কিন্তু বুঝতে ব্যর্থ হলো। চারদিক তার নিকষ কালো। ভয়ে শরীর ঝিম ধরে গেল। কিছু বুঝতে না পেরেই সে চেঁচিয়ে উঠল। প্রথমেই মুখ থেকে জুভান নামটাই বেরিয়ে এলো তার। সে জুভান, জুভান বলে চেঁচাতে লাগল। ক্ষানিক বাদেই সেই রুমের দরজা খুলে কেউ একজন প্রবেশ করল। সেই লোকটাকে দেখা মাত্রই স্মৃতি উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল,

‘জুভান, আমি এখানে কেন? কে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে? এটা কোন জায়গা? আমি এখানে কী করে এলাম?’

স্মৃতির এত অস্থিরতা দেখে জুভান হাসল। তার দিকে এগুতে এগুতে বলল,

‘আহা বউ, এত অস্থির হচ্ছো কেন? শান্ত হয়ে বসো তো। তোমার জন্য নাস্তা এনেছি, চলো একসাথে নাস্তা করি।’

স্মৃতি এতে উল্টো রেগে গিয়ে বলল,

‘আপনি আমাকে এখানে কেন এনেছেন জুভান?’

‘বললাম তো পরে এসব নিয়ে কথা বলবো। আগে নাস্তা করতে বসো।’

‘না, করবো না আমি নাস্তা। কিচ্ছু খাবো না আমি। আপনি আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন, তারপর অন্যকিছু।’

জুভান চোখ মুখ কুঁচকে কঠিন গলায় বলল,

‘রাতেও তুমি কিছু খাওনি। এখন চুপচাপ আগে খাবে তারপর আমি তোমার সব প্রশ্নের জবাব দিব। বুঝতে পেরেছ?’

ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও স্মৃতি জেদ দেখিয়ে এক পিস রুটি খেল। জুভানও খেল তার সাথে। তারপর স্মৃতি কিছু বলে উঠার আগেই সে খাবার নিয়ে আবার বাইরে চলে গেল। স্মৃতি তাকে অনেকবার ডাকল। অনেকবার দরজা ধাক্কাল। কিন্তু জুভানের কান অবধি সেই ডাক পৌঁছাল না। স্মৃতি রুমে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি করল। রুমটা অনেক বেশি অন্ধকার হওয়ায় আর আলাদা কোনো জানলা দরজা না হওয়ায় আরো বেশি কষ্ট হচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল দম আটকে এখনই মারা পড়বে। এখন প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে সে এই মানুষটাকে চিনতে পারছে। বুঝতে পারছে মানুষটা আসলে তেমন না যেমনটা সে প্রথমে ভেবেছিল। মানুষটা খুব খারাপ, খুব বাজে। স্মৃতি আর তার প্রতি কোনো অনুভূতি রাখতে চায় না। সে তার নিষ্প্রাণ ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকে এবার সে কীভাবে এই মানুষটার সাথে লড়াই করবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here