#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_২১ (ভালোবাসি)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“আজ থেকে আঠারো বছর আগের ঘটনা….
এই চট্টগ্রামেই থাকতাম। আমার বীনুর বয়স তখন সবে পাঁচ। পিচ্চি মেয়েটা গুটি গুটি পায়ে পুরো বাড়ি দৌঁড়িয়ে বেড়াতো। বড্ড চঞ্চল মেয়ে ছিলো আমার। সারাক্ষণ মামা বাড়ি, মামা বাড়ি করেই থাকতো। অবশ্য ওর মামাবাড়ি বেশি দূরেও ছিলো না। গাড়িতে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা।
সে মাসে প্রায়শই ল্যান্ড লাইনে একটা কল আসতো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আমার স্বামী, বাসেদ আহমেদের নামে কেউ একজন যা তা বলতো। আমি ভীষণ ভালোবাসতাম বাসেদকে। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও ভালোবাসায় কমতি ছিলো না। তাই কখনো টেলিফোনের ওপাশের ব্যক্তির কথা শুনে বাসেদকে সন্দেহ করিনি।
তখন ছিলো বর্ষা কাল। সকাল থেকে গুরি গুরি বৃষ্টি। আর এদিকে বীনুও মামাবাড়ি যাবার জন্য কান্না জুড়ে বসেছে। অগত্যা বাড়ির গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম।
কিন্তু, আমার মন সেদিন বড্ড কু গাচ্ছিলো। ঐ বাড়িতে শান্তি পাচ্ছিলাম না। অশান্ত এই মনকে বোঝাতে না পেরে, বাড়ি ফেরার পথ নিলাম। বৃষ্টি থেমে যেতেই বিকেলের দিকে বেরোলাম।
বাসেদ আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছিলো। এজন্য একাই চলে এসেছিলাম। মাঝ রাস্তায় হুট করেই গাড়ির সামনে কারো উপস্থিতি লক্ষ্য করে ব্রেক কষলাম।
পাহাড়ি রাস্তা ছিলো। একটা মেয়েকে আমার গাড়ির সামনে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম।
মনের মাঝে একটা কথাই ছিলো,‘সুইসাইড করতে এসেছে নাকি এই মেয়েটি?’
জোরপূর্বক গাড়ি থেকে বেরোলাম। বেরোতেই মেয়েটা আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। মস্তিষ্কে অনেক কথারা এসে ভীড় জমাচ্ছে।
নিস্তব্ধতার মাঝেই সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,’তোমার সাথে কথা আছে।’
মুহূর্তেই অবাক বনে গেলাম। আমায় চেনে?
‘কী কথা?’
‘বাসেদকে ছেড়ে দিচ্ছো না কেনো?’
‘আজব! আপনি কে? আর বাসেদকে ছেড়ে দিতে বলছেন কেনো?’
‘তোমার স্বামী আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। শুধু তোমার জন্য আমাকে গ্রহণ করতে পারছে না।’
এমন কথা ল্যান্ডলাইনের সেই মেয়েটি বারবার বলতো। তবে কি এই সেই? মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো। রেগে গেলাম ভীষণ ভাবে।
তেজ মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,‘আমি বাসেদকে চিনি। এসব বানোয়াট কথা অন্য কাউকে গিয়ে বলুন না।’
‘ওহ্! বুঝেছি। এভাবে নিজ থেকে সরবে না। তোমার জন্য আরো একটা রাস্তা আছে।’
পাহাড়ি সরু রাস্তায় ছিলাম। হুট করে আমার হাত ধরে টেনে একদম কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিলো। আকস্মিক এমন আক্রমণ আমি বুঝতে পারিনি।
মহিলাটি বাঁকা হাসলো। পুনরায় বললো,‘বাসেদকে ছেড়ে যাবি নাকি এই দুনিয়া ছাড়ার ব্যবস্থা করে দেবো?’
‘দেখুন আপনি ভুল করছেন। বাসেদ আপনাকে না, আমাকে ভালোবাসে। আমাদের মেয়ে আছে। আপনি এরকম করবেন না। দোহায় লাগে, ছেড়ে দিন।’
‘ওকে, ছেড়ে দিলাম।’—বলেই আমার হাত ছেড়ে আমাকে ধাক্কা দিলো। নিচে গড়িয়ে যাচ্ছিলাম আমি।“
এটুকু বলে মিসেস শেফালী থামলেন। পাশ থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পুরো গ্লাস পানি পান করলেন। পুরনো স্মৃতি গুলো যখন নিজের বর্তমানে প্রভাব ফেলে, হয়তো তখন সবার অবস্থা মিসেস শেফালির মতোই নাজেহাল হয়।
আরহান প্রশ্ন তুললো,“এরপর? পাহাড় থেকে ফেলার পরও?”
শেফালী বেগম আরহানের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলা শুরু করলেন,“ভাগ্য! ভাগ্য চেনো? সেটাই।
আমাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিলেও, সে জানতো না, ওপাশে খানিকটা নিচেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটা রাস্তা আছে। বেশি নিচে ছিলো না বলে বেঁচে গিয়েছিলাম।
ঠিক তখনই ভারী বর্ষণ শুরু হয়। সে আর কিছু না করেই চলে যায়।
মাথায় আঘাত পেয়েছিলাম ভীষণ। সেই রাস্তা দিয়ে আশরাফ ভাই যাচ্ছিলেন। আমাকে ওরকম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, সাহায্য করেন। পার্শ্ববর্তী হসপিটালে এডমিট করেন।
জানেন? সেদিন আমার জীবনের দ্বিতীয় খুশির আগমনের কথা জানতে পারি। আমার প্রথম খুশি আমার বীনু ছিলো। আর দ্বিতীয় খুশি বাবুন।
সেদিন ডাক্তার আমাকে জানায়, আমি পুনরায় মা হতে চলেছি। এতো কষ্টের ভীড়েও সেদিন হেসেছিলাম আমি। আশরাফ ভাই সেই ক’দিন আমার পুরো খেয়াল রেখেছেন, যেমনটা আমার নিজের ভাই হলে রাখতেন।
প্রায় দুই মাসের মতো হসপিটালে ছিলাম আমি। উপর থেকে পড়ায়, তেমন চোট না পেলেও, মাথায়, হাতে আর পায়ে বেশ ব্যাথা পেয়েছিলাম। পায়েরটা মারাত্মক ছিলো।
ডাক্তারের একটা কথা এখনও আমার কানে বাজে,‘ইট’স মিরাকেল। নয়তো এরকম কেসে বেবি বাঁচে না।’
দুই মাসে কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমার একটা দোষ ছিলো। টেলিফোন নম্বর মনে রাখতে পারতাম না। সেজন্য সবসময় একটা ডায়েরি সাথে নিয়ে ঘুরতাম, ওটাতে সবার নম্বর থাকতো।
সেবার আমার কাছে কিছুই ছিলো না।
দুইমাস বাদে আশরাফ ভাই আমাকে উনার বাড়িতে নিয়ে যান, দু’দিন থাকার উদ্দেশ্যে। সেখানে তানিয়া আপা আমাকে পছন্দ করতেন না। তবে, আশরাফ ভাইয়ের দশ বছর বয়সী ছেলেটা দুদিনেই আমাকে আপন করে নেয়। আমি বুঝে যাই, ভালোবাসার বড্ড অভাব সেই বাচ্চাটার।
দুদিন বাদে, আশরাফ ভাই আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে এলেন। বাড়ির সামনে তাকাতেই আমি বড়সড় একটা ঝটকা খাই। নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
কি অদ্ভুত! মানলাম, আমি সবার কাছে মৃত। কিন্তু বাসেদ? সে কি করে এতো জলদি আমাকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে গেলো?
গেটের উপর বিশাল আকারে সাইনবোর্ডে লেখা আছে,‘বাসেদ ওয়েডস মনিরা…’
পাশে থেকে একজন মহিলার কথা কানে এলো,‘হুননিডে, বউ ইভার আস্ট বছরের একগুয়া মেইপুয়া আচে।’
(শুনলাম, বউএর নাকি আট বছরের একটা মেয়ে আছে।)
অন্যজন বললো,‘তুই জানো না কন বেডির কথা কইর? মনত ন পড়ের? আগে এই ঘরত আইতো যে? বাসেদের বান্ধবী আছিল দে।’
(তুমি জানো না কার কথা বলি? মনে পড়ে? আগে এই বাড়িতে প্রায় আসতো যেই মেয়ে। বাসেদের বান্ধবী লাগতো)
‘বেডি ইভার আগের টুন সম্পর্ক আচিল ল?’
(মানে আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো?)
‘হ! আইয়ো হুইনি বাসেদ মাইয়া ইভার লাই বিয়া ন গরে, ইতের বাপে পরে দি যাই শেফালির লি বিয়া করাই দিইয়ে।’
(হ্যাঁ! শুনেছি বাসেদ নাকি এই মেয়ের জন্য বিয়ে করতে চায়নি। এই মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়, পরে ওর আব্বা জোর করে শেফালির সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো।)
আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করলাম না। ধরে নিলাম, মেয়েটা আমাকে যা বলেছিলো, সত্যি বলেছিলো। বোরখা পরিহিত ছিলাম বলে, কেউ চিনতে পারেনি আমাকে।
ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্যের এক হাসি হেসে আশরাফ ভাইয়ের সাথে প্রস্থান করলাম। রওনা দিলাম বীনুর মামার বাড়ি।
কিন্তু….
সেদিন বাড়িতে পৌঁছতেই দেখি ঐ বাড়ি ফাঁকা। শুধু ঐ বাড়ি না। আশে পাশের প্রায় সব বাড়িই ফাঁকা। সরকার নাকি ওখানে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করবে, এজন্য কলোনী খালি করিয়েছে।
বুক ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এখন আমার বীনুকে কোথায় পাবো? মাথায় কিছুই আসছিলো না। একসাথে এতো ঝটকা আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছিলো না।
আশরাফ ভাই তখন আমাকে উনার বাসায় নিয়ে যান। সেখানে সেই বাচ্চা ছেলের চোখের মনি হয়ে উঠি। মিষ্টি করে আমাকে মামনি ডাকে। ধীরে ধীরে আমার বাবাইটার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাই আমি।
কিছুদিন বাদেই আশরাফ ভাই পরিবার সহ সিলেট শিফট করেন। আমিও তাদের সাথেই সেখানে চলে যাই।
নিজেকে যাতে বোঝা মনে না হয়, এজন্য আশরাফ ভাইয়ের অফিসে কাজে লেগে যাই। শুরু করি বাবুনকে নিয়ে নতুন জীবন।
সিলেট থাকতে থাকতে আমার বাবুন বড় হতে লাগলো। বাবুন থার্ড স্ট্যান্ডার্ডে ছিলো যখন, তখন একটা দুর্ঘটনায় আশরাফ ভাই আর তানিয়া আপা মারা যান।
বাবাই একরোখা হয়ে যায়। হুট করেই অনেক পরিবর্তন পাই বাবাইয়ের মাঝে। চোখে সবসময় কোনো এক আগুন জ্বলতো, যা ওর বুকটা পুড়িয়ে দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। আশরাফ ভাইয়ের ছেলেটা তখন থেকে আমার ছেলে হয়ে গেলো।
বীনুকে ওর মামার কাছে রেখে এসেছিলাম বলে নিশ্চিন্ত মনে ছিলাম আমি। তবুও বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু, যেই শহর জুড়ে বিশ্বাস ঘাতকতা ছেঁয়ে ছিলো, সেই শহরের হাওয়া সহ্য হতো না।
চার মাস আগে, বাবুন হুট করেই বলে ফেলে, ও চবিতে পড়বে। আমি মানা করে দেই। তাই ও গিয়ে ওর ভাইকে বলে। অগত্যা ওদের জোরাজুরিতে ফিরতেই হলো। আশরাফ ভাই ছাড়া কেউ আমার অতীত জানতো না। বড় হবার পর বাবাই জেনে যায়, আমিও ধোঁকা খেয়েছি, এই শহর থেকে। আর কিছুদিন আগে বাবুন আমার ডায়েরি পড়ে জেনে যায় সবটাই।”
মিসেস শেফালী কথা শেষ করেন। এটুকুই তো কাহিনী। কেটে ছেটে এটুকুই তো আছে।
এতক্ষণ গভীর মনোযোগে সবটা শোনার পর আরহান বললেন,“মিসেস মনিরা ডাবল গেইম খেলেছেন।”
মিসেস শেফালী চকিতে চাইলেন। উনার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে আরহান বললেন,“আপনি যা জেনেছেন, তা ছিলো আংশিক সত্যি। পুরো মিথ্যের চেয়ে আংশিক সত্যি বেশি ভয়ংকর।”
_____________________
“ভালোবাসা! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখময় অনুভূতি কোনটা যদি আমায় জিজ্ঞেস করা হতো! তবে কোনো সময় ব্যয় না করে নির্দ্বিধায় বলে দিতাম, এটা ভালোবাসা। ভালোবাসার উপলব্ধির পূর্বকাল থেকেই সুখ অনুভব করা যায়। আর প্রতিক্ষণ মনটা উত্তেজিত হয়ে থাকে। কখন আমার প্রিয় মানুষটি আমার নেত্র সম্মুখে আসবে, দুচোখ ভরে দেখবো। আর…. হ্যাঁ! ভীষন লজ্জা পাবো।”
ডায়েরিতে এটুকু লিখে মুচকি মুচকি হাসা শুরু করে দিলাম। অবশেষে মনের ভালোবাসা মুখে নিয়ে এলাম। দুপুরের দিকে যে, আরহানকে বললাম। এরপর থেকে আর আরহানের সামনেই আসিনি। কেমন যেনো অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। উনি কাছে এলেই সব কথা আওলিয়ে যাচ্ছে।
খুব ইচ্ছে হচ্ছে একটু সাজতে। আচ্ছা! আরহান যদি বাড়ি ফিরে দেখেন, তার বউ তার জন্য সেজে বসে আছে, তখন আরহানের মুখখানা কেমন দেখাবে? বিস্মিত হবেন নিশ্চয়ই!
হালকা হেসে কাবার্ড থেকে একটা গোলাপী সুতির শাড়ি পরে নিলাম। সাথে কালো ব্লাউস। আয়নায় এক ফাঁকে কোমরের এই বেলী চেইন দেখে নিলাম। মাথা নিচু করে হাসলাম। সেদিন আরহান স্বীকার করেছেন, এটা উনিই দিয়েছিলেন।
চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর চুল খোঁপা করে নিলাম।
হুট করেই পেছন থেকে কারো আলিঙ্গনে আমি স্তব্ধ, পাথর বনে গেলাম। শরীরের থরথর কাঁপুনি আমার বিস্মিত হবার বহিঃপ্রকাশ। কানের কাছে কারো ওষ্ঠের স্পর্শ পেলাম। সর্বাঙ্গে শিহরন ছেয়ে যাচ্ছে।
ফিসফিসিয়ে বললেন,“ভালোবাসি শুকতারা…”
#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_২২ (একটা ভুল)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
ভালোবাসি শব্দটা এতটা শ্রুতি মধুর! আমি জানতাম না। বিশেষ করে যদি তা নিজের ব্যক্তিগত মানুষটির মুখনিঃসৃত হয়।
আরহানের মাত্র বলা ‘ভালোবাসি’ কথাটির দরুন খেই হারিয়ে ফেলেছি আমি। এতক্ষণের লজ্জাবতী এই আমিটা হুট করেই সব ভুলে বলে দিলাম,“আমিও ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।”
মুহূর্তেই পুনরায় চুপ মেরে গেলাম। চোখ নিচে নামিয়ে ফেললাম। আরহান আমাকে ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন।
“হঠাৎ এভাবে সাজলে যে!”
আরহানের প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। কি বলবো আমি? কেনো সেজেছি? গালে লাল আভা দৃশ্যমান। আরহান বুঝে গেলেন।
হেসে বললেন,“লজ্জাবতী বউ কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দ। ইচ্ছে করে, এভাবেই দেখে যাই তাকে।”
অজ্ঞাত কারণবশত আমি আরহানের এমন কথা নিতে পারি না। কেমন যেনো হাঁসফাঁস লাগে। বুকের ভেতরের এই ‘হৃদপিন্ড’ নামক বস্তুটি নিজের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য সর্বস্ব দিয়ে কম্পিত হয়। ভেবে রাখা শব্দ সব আওলিয়ে যায়। বাক্য মেলাতে পারিনা। এগুলো কেনো হয়?
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। তৎক্ষণাৎ আরহানের পুনরায় এরকম কথা শোনার আগেই প্রসঙ্গ এড়াতে বললাম, “কোথায় গিয়েছিলেন?”
আরহান চুপ থাকলেন। খানিকক্ষণ বাদে বললেন,“তোমার ছোট খাটো সব ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব নিয়েছি। এবার পাওয়া না পাওয়া সব ফিরিয়ে দেবার দায়িত্ব নিলাম।”
__________________________
নিজ রুমে বসে নিশা আধা ঘন্টা যাবৎ কেঁদেই যাচ্ছে। কেনো কাঁদছে তা অজানা ওর কাছে। শুধু একটা জিনিসই জানে, তার বুকের মধ্যেখানে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। হয়তো কিছু না পাবার হাহাকার এটা।
এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখলো, স্ক্রিনে ‘রাহা’ নামটা ভেসে উঠেছে।
রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে রাহা বলে উঠলো,“আজ কলেজে আসিসনি কেনো?”
নিশা কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“কিছু ভাল্লাগেনা রে বইন। প্রেম করার আগেই ছ্যাকা খাইয়া গেলাম গা রে।”
“তোর আবার কি হলো?”
“কি হয়নাই এইটা বল। জিবনডা তেজপাতা হইয়া গ্যাছে রে বইন।”—বলেই নিশা আবারও ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো।
রাহা এবার ধমকের শুরে বললো,“বেশি ঢং করলে ফোন রেখে দেবো। ফটাফট বল কি হয়েছে?”
নিশা কান্না থামালো। মুখশ্রী ভাব গম্ভীর হয়ে গেলো। কণ্ঠস্বরে কিছুক্ষণ আগের ন্যাকামির রেশ মাত্র নেই। অনুভূতিহীন গলায় বললো,“জানিনা।”
“জানিস না মানে?”
“সমস্যাটা কী এটা জানলে সমাধান অনেক আগেই বের করে ফেলতে পারতাম।”
“সিরিয়াস কিছু নাকি?”
“হ্যাঁ!”
“তুই ঠিক আছিস নিশু? শরীর ঠিক আছে তোর?”
“না। অসুখ করেছে আমার।”
“মানে? কী হয়েছে?”
“প্রেমময়ী এক অসুখে গভীর ভাবে আক্রান্ত আমি। এই অসুখের নিবারণ তখনই হবে, যখন সে….”
নিশা থমকে যায়। রাহা, নিশাকে থেমে যেতে দেখে প্রশ্ন করে,“যখন?”
“কিছু না। কারণ সে আসবে না। ভালোবাসার রোগাক্রান্ত আমি। একতরফা ভালোবাসার।”
________________________
মিসেস শেফালী অফিস থেকে ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে গেলেন। ড্রইং রুমে দীপ্তি বসেছিলো। তার মাকে এমন ভাবে যেতে দেখে দীপ্তি ও ছুটলো তার পিছু পিছু।
মিসেস শেফালীকে কিছু খুঁজতে দেখে দীপ্তি পেছন থেকে প্রশ্ন তুলে,“কী খুঁজছো মা?”
মিসেস শেফালী দ্রুত পেছন ফিরে দেখেন, দীপ্তি দাঁড়িয়ে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে শুধালো,“আমাকে একটু স্পেস দে বাবুন।”
দীপ্তি “আচ্ছা মা” বলে প্রস্থান করলো। মিসেস শেফালী গিয়ে দরজা লক করে পুনরায় খোঁজ করা শুরু করলেন। ফাইনালি পেলেন। ডায়েরিটা পেলেন। সেদিন দীপ্তি যেই ডায়েরি হাতে নিয়েছিল, এটা সেটাই।
বসে পড়লেন তিনি। একটা কলম তুলে নিলেন। ডায়েরির বেশ কিছু জায়গায় অভিমান মিশ্রিত বাক্য ছিলো। সবগুলো কেটে যাচ্ছেন তিনি। একটা একটা করে এমন ভাবে কাটছেন, যাতে কি লেখা ছিলো তা বোঝা না যায়।
বার বার অস্থির ভঙ্গিতে অস্পষ্ট স্বরে বলে যাচ্ছে,“আমি দুঃখিত। আমি অনুতপ্ত। তোমাকে ভুল বোঝার জন্য আমার আঠারোটি বছর অভিশপ্ত।”
পুনরায় স্মৃতিচারণ করা শুরু করলো আজ দুপুরে আরহানের বলা সেই কথা গুলো।
আরহান বললো,“আপনি যা জেনেছেন তা আংশিক সত্য। আর আংশিক সত্য,পুরো মিথ্যের চেয়ে ভয়ংকর।”
মিসেস শেফালী চকিতে চাইলো আরহানের পানে। অবাক ও বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“মানে?”
“প্রতিটা কাহিনীর দুটো পাতা থাকে। একটা সেটা, যেটা আপনি দেখছেন। আর অন্যটা সেটা, যেটা আপনার চক্ষুগোচর।”
পুনরায় আরহান মিসেস শেফালীর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা নয়নের পানে তাকিয়ে বললো,“অন্যটা আমি আপনাকে বলছি….
মিসেস মনিরা, বাসেদ আহমেদের প্রাক্তন ছিলেন। এটা সত্যি ছিলো যে, সে একসময় তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে ভালোবাসতেন এবং তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাননি।
কিন্তু মিসেস মনিরা বড়লোক ঘরের প্রস্তাব পেয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। আর এদিকে বাসেদ আহমেদ দেবদাস থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর আপনার বাবার আর বাসেদ আহমেদের বাবার বন্ধুত্বের রেশ ধরে জোরপূর্বক আপনার সাথে বিয়ে দেয়। অতঃপর সে মুভ অন করতে সক্ষম হয়।আপনার প্রতি তার ভালোবাসার বিন্দুমাত্র মিথ্যে ছিলো না। দ্বিতীয় বার যেভাবে ভালোবাসা যায়! ঠিক সেভাবে আপনাকে ভালোবেসে ফেলে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে দিব্যি চলছিলো তার জীবন।
নয় বছর পর একদিন শোনা যায়, মিসেস মনিরার হাসব্যান্ড দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মিসেস মনিরা একটা মাত্র সন্তানকে নিয়ে একাকী জীবন কাটাতে না চেয়ে পুনরায় বাসেদ আহমেদের জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছেন। এতে বাসেদ আহমেদ আপনার ও আপনাদের মেয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে, মিসেস মনিরার প্রস্তাব নাকচ করেন।
এরপর মিসেস মনিরার টার্গেটে পড়ে যান আপনি। সে চেয়েছিলো আপনার কানে বাসেদ আহমেদের নামে বিষ ঢেলে আপনাকে রাস্তা থেকে সরাবে।
কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। অবশেষে পরিকল্পনা করে আপনাকে শুধু রাস্তা থেকে না, দুনিয়া থেকে সরাবার।
সেদিন আগে থেকেই আপনার উপর নজর রেখেছিলো মিসেস মনিরা। আপনি সেই রাস্তা অতিক্রম করবেন যখন, তখন সামনে এসে যায়।
বাকি কাহিনী আপনার জানা নিশ্চয়ই। তারপর আপনার গাড়িটা, মিসেস মনিরা হালকা ধাক্কিয়ে একদম খাদের পাশে এনে রাখে এবং ড্রাইভিং সিটের দরজাটা খুলে রাখে।“
এটুকু বলে আরহান থামলো। মিসেস শেফালী বললো,“বিয়েটা?”
“বলছি…”
“হুঁ…”
“সেদিন আপনার বাড়িতে না পৌঁছনোর কারণে অনেক খুঁজেছে সবাই আপনাকে। অবশেষে পাহাড়ি রাস্তায় আপনার গাড়ি একদম খাদ ঘেঁষে রাখা দেখে সবাই আন্দাজ করে নেয় আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে। পুলিশ বলে, যদি আপনি বেঁচে থাকেন তবে আপনার বডি পাওয়া যাবে। কিন্তু বডি পাওয়া যায়নি, তাই ধরে নিয়েছে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছেন। আর সেখান থেকে বেঁচে ফেরা অসম্ভব।
বাসেদ আহমেদ পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলো। অবুঝ বীনিও সেদিন আপনার অপূর্ণতায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদেছে। আপনি ছিলেন না। বাসেদ আহমেদ এমনিতেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তন্মধ্যে বীনিকে সামলানো তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিলো। সেই সুযোগ কাজে লাগালো মিসেস মনিরা।
বাসেদ আহমেদের নিজের মেয়ের জন্য একটা মা আর মিসেস মনিরার একটা সংসার প্রয়োজন ছিলো। অতঃপর আপনার যাবার কিছুদিন বাদেই ও বাড়িতেই চলে আসেন তিনি।
মাস খানেক ওভাবে থাকার দরুন বাড়ির বাইরের লোক নানা ধরনের গুজব রটাচ্ছিলো। যেহেতু তাদের বিয়ে হয়নি, তাই এটা স্বাভাবিক। জোরপূর্বক তাকে বিয়েটা করে নিতে হয়।
আর সেদিনই আপনি এসেছিলেন।”
“মানে আমার বীনু ওখানে ছিলো?”
“হুঁ…”
“মনিরা ওর কোনো ক্ষতি করেনি? মেয়েটা কেমন আছে আমার?”
আরহান বাঁকা হাসলো। পরপর চোয়াল শক্ত করে বলা শুরু করলো,“প্রথম কয়েকদিন ভালো মতোই ব্যবহার করেছিলো। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যায়। সৎমায়ের নির্যাতন বোঝেন? সেরকম।
প্রথম কয়েকমাস বীনি তার বাবার ভালোবাসায় নিজের মায়ের অপূর্ণতা বোঝেনি। তবে পুরুষ মানুষ তিনি। ধীরে ধীরে সে নারীতে ঝুঁকে যায়। হাজার হোক, প্রথম ভালোবাসা তো!
মিসেস মনিরার প্রায় সব কথা তখন বাসেদ বিশ্বাস করা শুরু করেন। এমতাবস্থায় সে বাসেদ আহমেদের ব্রেইন ওয়াশ করে। তাকে বোঝায়, আপনার মৃত্যুর জন্য বীনি দায়ী। সেদিন যদি আপনাকে জোর করে ওর মামার বাড়ি নিয়ে না যেতো, তবে হয়তো আপনি তাদের সাথে থাকতেন।
এসব কথা বিশ্বাস করে মেয়ের প্রতি অবহেলা শুরু করে দেন উনি। আর বীনির প্রতি নির্যাতন শুরু হয়ে যায়।
রহিমা খালাকে কোনো কাজ করতে দিতেন না। বাচ্চা বীনিকে দিয়ে সব কাজ করাতেন। এজন্য ওর স্কুল এডমিশান ও অনেক দেরিতে হয়ে যায়। বীনির বাবার জোরাজুরি আর মামার হুমকিতেই পড়া লেখা করতে দেন।
মা হীনা এক মেয়ের সাথে কি কি ঘটতে পারে, তার সবটাই ঘটেছে ওর সাথে।”
কথাগুলো শুনে মিসেস শেফালির চোখ দিয়ে অজান্তেই অশ্রুপাত হচ্ছে। সে জানতো না এরকম কিছু। কিন্তু, না চাইতেও সে তার মেয়ের জীবনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরহান মিসেস শেফালীকে শান্ত হতে বললো। তখন মিসেস শেফালী প্রশ্ন তুললো,“এসব ঘটনা আপনি কি করে জানেন? বিশেষ করে আমার বীনুর ব্যাপারে?”
আরহান হালকা হেসে বললো,“কারণ আমি বীনির লিগ্যাল হাসব্যান্ড।”
মিসেস শেফালী চমকিত হলেন। আরহান আবারও বললেন, “বীনিকে আমি পছন্দ করি দুইবছর ধরে। কিন্তু একটা সমস্যার কারণে তৎক্ষণাৎ বিয়ে করতে পারিনি। সমস্যার রেশ কাটিয়ে উঠার পর যখন বিয়ের প্রপোজাল পাঠাই, তখন না করে দেয় মিসেস মনিরা।
ঘটনার আগা গোড়া বুঝতে না পেরে সেদিনই খোঁজ চালাই। পাড়া প্রতিবেশী ও পুরনো মেইড, রহিমা খালার কাছে। উনাকে খুঁজতেও অনেক সমস্যা হয়েছিলো। এরপর প্রতিবেশীর কাছে কিছু ঘটনা জানি, আর বাকিটা রহিমা খালার কাছে। শুনেছি আপনার চলে যাবার বছর যেতে না যেতেই ব্যবসায় বিশাল বড় লস খান বাসেদ আহমেদ। এতে করে, বাসেদ আহমেদ তার এতো বছরে গড়ে তোলা নিজস্ব সব প্রপার্টি হারিয়ে ফেলেন। বাদ বাকি বেচে ছিলো তার পৈতৃক সম্পত্তি, যার একাংশও তার নামে ছিলো না।
তবুও একটা ঘটনা আমার কাছে ক্লিয়ার ছিলো না। যদি বীনিকে তারা বোঝাই মনে করে, তবে বিয়ে দিয়ে দিলেই তো পারে। কেনো দিতে চায়নি? এজন্য আরো খোঁজ লাগিয়ে দেখি, আপনার শ্বশুর মশাই, তার সম্পত্তির সবটাই আপনার নামে উইল করে গিয়েছেন। এবং আপনার অবর্তমানে তা আপনার মেয়ে, তার পঁচিশ তম জন্মদিনে পাবে। এই পদক্ষেপ নেবার পেছনেও একটা কাহিনী ছিলো। সেটা হচ্ছে, বাসেদ আহমেদ আপনাকে বিয়ে করতে চায়নি। জোর করে বিয়ে দেবার দরুন যাতে আপনার সাথে কোনোরূপ অনাচার করতে না পারে, এজন্য তার প্রপার্টি সব আপনার নামে লিখে গিয়েছেন।
এজন্য মিসেস মনিরা আর যাই করুক, বীনিকে মারেনি বা অন্য কিছু করেনি।
এরপর আমি যেদিন তার কুকর্মের কিচ্ছা-কাহিনী জানতে পারি, সেদিনই মিসেস মনিরা আর তার আদরের মেয়েকে ছোট্ট একটা পানিশমেন্ট দিই। তবে তারা আরো ডিসার্ভ করে।
কয়েকদিন যেতেই সব ঘটনা পরিষ্কার হয় এবং আমি জানতে পারি, সেদিন অনেক খোঁজার পরও আপনার বডি পাওয়া যায়নি। কৌতূহল দমাতে না পেরে আমি সেদিনের সব ঘটনা জানার চেষ্টা করি। তখন আমি জানতে পারি, আপনি বেঁচে আছেন এবং আমি আপনাকে খোঁজা শুরু করি। তখন বীনিকে আমি বিয়ে করে নিই। তাদের পারমিশন ছাড়াই। ঐ ফ্যামিলিতে রাখার আর ইচ্ছে হয়নি আমার।
এরপর আপনাকে পেলাম।’’
“আচ্ছা, আমার বীনু এখন কেমন আছে?”
“সুখে আছে।”
মিসেস শেফালী অধরযুগল প্রসারিত করে হেসে বললেন,“আমার মেয়েকে এখন দেখতে পাবো?”
“না..”
আরহানের কথার প্রেক্ষিতে মিসেস শেফালীর মুখশ্রীতে ঘন কালো আঁধারের দেখা মিললো। মিনমিনে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,“আমার শাস্তি এটা?”
“না, আমি চাইনা বীনি আপনাকে ভুল বুঝুক। সময় মতো আপনার সাথে দেখা করাবো।” —কথাটি বলেই আরহান উঠে দাঁড়ালো। পুনরায় বললো,“জলদি দেখা হবে আবারও। আসছি।”
এটুকু স্মৃতিচারণ করে মিসেস শেফালী পুনরায় কান্নায় মনোযোগী হলেন। আজ তার একটা ভুলের জন্য তার কলিজার টুকরো মেয়ে, বীনিকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।
মুখ ফুটে বলে উঠলো,“আমাকে মাফ করবি তো তুই বীনু?”
চলবে…!
চলবে…!