অদ্ভুত আসক্তি পর্ব -২৩+২৪

#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_২৩ (মা-মেয়ের সাক্ষাৎ)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

দেখতে দেখতে আরো দুই সপ্তাহ কেটে গেলো। এই দুটো সপ্তাহ, আরহানের ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে। আর আমার কেটেছে আরহানের খেয়ালে ডুবে। দিবারাত্রি উনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। দিনগুলো কেমন করে যেনো এগোচ্ছে। খুবই দ্রুত।
আর সাথে হাজারো অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছি। আরহান পাশে থাকলে আমার হৃদ পিন্ডের স্পন্দন গতি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ঠিক তেমনই দূরে থাকলে নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হয়। তখন বুকের বা পাশের হৃদযন্ত্রের উপস্থিতি বোঝা দায় হয়ে যায়।

হুট করেই কয়েক মাস আগের কথা মনে পড়লো। কতটা ভয় পেতাম উনাকে! আর এখন! এখনকার আরহানের কথা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে ভালো লাগার মিষ্টি এক হাসি চলে আসে।

সকালের নিষ্প্রভ রোদ খোলা জানালা দিয়ে মুখে এসে লাগতেই চোখ ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকালাম। আরহান আমার এক হাত নিজের বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন। হাসলাম আমি। উনার বন্ধন থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আরহান নড়েচড়ে উঠলেন। পুনরায় আবার ঘুমে মগ্ন হলেন। আরহানের চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে। হাত এগিয়ে উনার এলোমেলো চুলগুলো আরো খানিকটা অগোছালো করে দিলাম।

আরহান চোখে বুজে অধর যুগল প্রসারিত করে মিষ্টি হেসে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে উঠলেন,“সুপ্রভাত শুকতারা।”

“শুভ সকাল…”

কিছুক্ষণ বাদে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকালেন। আমাকে এক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, “কী ব্যাপার?”

“কী! কিছুনা।”

“কিছুনা তো?”

“না।”

“আচ্ছা তবে আবার ঘুমোও।”—বলেই আরহান পূর্ব ভঙ্গিতে আমার হাত জড়িয়ে চোখ বুজলেন। মুহূর্তেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলেন।

আমি হাসছি। এই লোকটার ভালোবাসা সত্যিই আমার ভাগ্যে ছিলো!

______________________
সকালের ব্রেক ফাস্ট শেষে রুমে ঢুকেই দেখি আরহান রেডি হয়ে আছেন এবং কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। না চেয়েও উনার কথা কানে এলো।

আরহান বলছেন,“বলেছিলাম না! খুব শীঘ্রই দেখা হবে। সব প্রমাণ জোগাড় করা হয়ে গিয়েছে। আর স্বয়ং আপনিও আছেন এখন। সব অপেক্ষার অবসান হবে আজ”।

আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। কথাটা বুঝে উঠতে পারিনি। আরহানকে প্রশ্ন করলাম, “কী হবে আজ?”

আরহান পিছু ঘুরে দরজার কাছে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে নম্র কণ্ঠে বললেন,“আমি একটু বাদেই ওকে নিয়ে আসছি। আপনি রেডি থাকুন।”

উনি ফোন রাখলেন। আমি এগিয়ে গেলাম উনার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে বলুন তো! কোনো সমস্যা?”

আরহান আমার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিলেন। মৃদু কন্ঠে বললেন,“আজ তোমার লাইফে যেমন একটা খুশির খবর পাবে, তেমনই কষ্টেরও। ইউ হ্যাভ টু বি স্ট্রং শুকতারা।”

“কী হবে আজ?”

“গেলেই দেখতে পাবে। রেডি হয়ে নিচে এসো।”

আরহান প্রস্থান করলেন। হাজার প্রশ্ন মনে নিয়ে আমিও রেডি হতে শুরু করলাম। আমি কষ্ট পাবো, এমন কোনো খবর আমাকে কেনো দেবেন উনি? যতদ্রুত সম্ভব রেডি হয়ে নিচে গেলাম।

গেটের বাইরে আরহানের গাড়ি দেখে এগিয়ে গিয়ে উনার পাশে বসলাম। আমার বসার সাথে সাথেই আরহান গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

কিছুদূর অতিক্রম করার পর আমি আরহানকে বললাম,“আমার না টেনশন হচ্ছে। কী যে হবে! আপনি বলছেন ও না।”

আরহান মৃদু হেসে বললেন,“যা হবে, ঠিকটাই হবে।”

“বললে কী এমন হবে! যদি না বলারই ছিলো, তবে কেনো আমাকে বললেন, খারাপ খবর পাবো!”

“খারাপ বললাম কখন?”

“বলেননি?”

“নাহ্!”

“তবে কী বলেছেন?”

“বলেছি, কষ্টের খবর।”

বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো। হালকা আওয়াজে “ধুর!” বলেই জানালার বাইরে তাকালাম আমি। এই লোকটা ভীষণ অসভ্য! ওপাশে আরহান আমাকে দেখে মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছেন।

হুট করেই আরহানের জরুরি কিছু মনে পড়ে গেলো, এমন ভাবে ব্রেক কষলেন। কিছু একটা খুঁজলেন। না পেয়ে রুদ্রকে কল লাগালেন। রুদ্র রিসিভ করতেই, আরহান ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন,“ফাইলগুলো আমার কাবার্ড এ রেখে এসেছি। নিয়ে এসো।”

ব্যাস! ওপাশে রুদ্রের কিছু বলার আগে যেমন নিজের কথা শুরু করেছিলেন। তেমনই নিজের কথা শেষ হতেই কল কেটে দিলেন।

ঘন্টাখানেক পর গাড়ি একটা বাড়ির সামনে থামালেন আরহান। প্রথমে নিজে নেমে এরপর এপাশে দরজা খুলে হাত এগিয়ে দিলেন। মুখে উনার বরাবরের মতো মিষ্টি হাসি। তা দেখে আমিও হাসলাম। হাত এগিয়ে উনার হাতে রেখে নেমে এলাম।

আমাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে অগ্রসর হলেন।

_______________________
গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে নিশা রুম থেকে বেরোচ্ছে। এই বয়সী মেয়েদের মন বোঝা বড্ড কঠিন। এই কান্নায় ভেংগে পড়ে তো এই আহ্লাদে নাচতে শুরু করে দেয়।
রুম থেকে বেরোতেই শক্ত কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগায় নিশা মনে মনে নিজেকে কতোগুলো গালি দিয়ে নেয়। ভেবেছে হয়তো সামনে দেয়াল। বেখেয়ালি ভাবে হাঁটতে গিয়ে এই অবস্থা। কিন্তু না! সামনে তাকাতেই নিশার হৃদপিন্ড থমকে যায়।

রুদ্র কপাল কুঁচকে নিশার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,‘আমার ভাগ্যে তো নেই তুমি, তবে কেনো সামনে আসো? কেনো প্রতিবার মনের মাঝে ভালোবাসা নামক তুমি হয়ে আগমন ঘটাও?’

কিন্তু এটা বলা সম্ভব নয় রুদ্রের পক্ষে। এক পলক নিজের মায়াবিনীকে দেখে নিলো। ভাগ্যে না’ই থাকলো, চোখের ক্যানভাসে না হয় থাকুক।

নিশা রুদ্রের সামনে এলেই কেমন যেনো অসুস্থ অনুভব করে। এই অসুস্থতা, ও রুদ্রের অনুপস্থিতিতেও টের পায়। তখন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না নিশা। প্রতিবারের মতো স্তম্ভিত হয়ে যায়। তবুও বর্তমান সময়ে এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকাটা বড্ড বেমানান লাগার দরুন, কিছু বলা নিশার জন্য আবশ্যক হয়ে গেলো।

মিনমিনে কন্ঠে নিশা প্রশ্ন করলো,“কেমন আছেন?”

রুদ্র স্থির চাহনি নিশার পানে আবদ্ধ করে গম্ভীর মুখশ্রীতে ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো,“ভালো।”

ভদ্রতার খাতিরে যে পুনরায় তাকেও জিজ্ঞেস করতে হবে,‘তুমি কেমন আছো?’ এর মিনিমাম সেন্স রুদ্রের ছিলো না। নিঃশব্দে প্রস্থান ঘটালো।

নিশা স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে রুদ্রের যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে ভীষন শকে আছে। নিশা বিস্মিত কন্ঠে আওড়ালো, “যাহ বাবা! রুদ্র ভাইয়া, সম্পূর্ণ আমার ভাইয়ার কোয়ালিটি সম্পন্ন হয়ে গেলো দেখছি। একেই বলে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”

স্তব্ধ নিশাকে এক দৃষ্টিতে স্থির একদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিশার মা নিজ রুম থেকে বেরোতে বেরোতে প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে? কী দেখছিস?”

নিশা নড়ে চড়ে দাঁড়ালো। মেকি হাসি দিয়ে বললো, “কোথায়? কিছু না তো!”

“কলেজে যাবি না? যা রেডি হয়ে নে।”

“আচ্ছা আম্মু।”

_______________________
সকাল থেকে মিসেস শেফালী তার বাবাই এর নম্বরে একটার পর একটা কল দিয়েই যাচ্ছেন। ধরছে না ওপাশ থেকে। তেমন কোনো প্রয়োজনে কল দিচ্ছেন না, ছেলেটা কেমন আছে এই খোঁজটার জন্যই এত উতলা হওয়া।

অষ্টম বার কল দিতেই ওপাশ থেকে তৃষ্ণা কল রিসিভ করলো। মাথা ভার তার। সারারাত কষ্ট লাঘব করতে নেশার সাগরে ডুবে ছিলো। ঘুমিয়েছে ভোরে। এটুকুতে ঘুম হয়নি। বারবার কানের কাছে ফোনের কর্কশ শব্দ হয়ে যাচ্ছে বলে রিসিভ করে কানে তুললো।

ওপাশ থেকে মিসেস শেফালীর কাতর কণ্ঠস্বরে শুনতে পেলো,“বাবাই! কী হয়েছে তোর? কল ধরছিস না! সকাল থেকেই কল দিয়ে যাচ্ছি তো।”

“ঘুমোচ্ছিলাম মামনি।”

“খেয়েছিস সকালে?”

“না। পরে খাবো।”

“শোন, তোকে কিছু বলার ছিলো।”

মিসেস শেফালী উত্তেজিত হয়ে আছেন। তৃষ্ণাকে বলেনি এখনও সে তার মেয়ের খোঁজ পেয়েছে। ভেবেছিলেন, সবটা সমাধান হবার পর বলবেন। যেহেতু আজ সমাধানের শীর্ষে সবটা। তাই জানিয়ে দিতে চাচ্ছেন।

“আমি, আমার মেয়ের খোঁজ পেয়েছি।”

তৃষ্ণা শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,“ফাইনালি পেলে! আমি তো সেই আগেই বলেছিলাম, আমাকে বলো। আমি খুঁজে দেবো। তুমি রাজিই ছিলে না।”

মিসেস শেফালী হালকা হাসলেন। বললেন,“আমি ভুল করে ফেলেছিলাম। আজ সবটা শুধরে নেবো।”

“আমি কী আজ ঐ বাড়িতে আসবো?”

“কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে, তোর ঘুম হয়নি। ঘুমিয়ে নে। রাতে চলে আসিস।”

তৃষ্ণা “আচ্ছা” বলতেই মিসেস শেফালী কল কেটে দিলেন। উচ্চকন্ঠে দীপ্তিকে ডাকলেন,“বাবুন! কই তুই? জলদি নিচে আয় না।”

দীপ্তি তার মায়ের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে এলো। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে মা? এভাবে ডাকছো কেনো?”

“এভাবেই। কী করছিস?”

“কিছুনা মা।”

মিসেস শেফালী হেসে বললেন,“তোর আপুকে দেখবি?”

“দেখার কী আছে?”
পরক্ষণেই আবার বলে উঠলো,“ওয়েট!”

প্রথমে দীপ্তি খেয়াল করেনি। পরে যখন বুঝতে পারলো, ওর মা কী বলেছে! চকিতে চাইলো তার মায়ের পানে। দীপ্তি এখনও বুঝে উঠতে পারছে না, সে কী শুনেছে?
তাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “কী বললে তুমি? আমি হয়তো ভুল শুনেছি। আবার বলো।”

“ঠিকই শুনেছিস। তোর আপুকে দেখবি?”

দীপ্তি অত্যধিক বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে বললো,“আপু!”

“হুঁ।”

“পেয়েছো আপুকে?”

“হ্যাঁ রে বাবুন।”

“কোথায় আছে আপু? কবে দেখা করাবে?”

“এই শহরেই আছে। আর আজ দেখা করাবো। একটু বাদেই চলে আসবে ওরা।”

দীপ্তি এখনও নিজের বিস্ময় রোধ করতে পারেনি। ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

তখন কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে মিসেস শেফালী উত্তেজিত হয়ে পড়েন। দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। দরজার বাইরে দিকটা অবলোকন করতেই তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আঠারো বছর! হ্যাঁ! আঠারো বছর পর, আজ সে দেখতে পেলো তার কলিজার টুকরোকে। নিজের আবেগ দমাতে হিমশিম খাচ্ছে। কিছু বলতে পরছে না। বাক্য মিলছে না। কণ্ঠস্বর কোনো শব্দ তৈরি করতে পারছে না।

কম্পনরত অধর যুগল অনেকখানি সময় নিয়ে উচ্চারণ করলো, “ববীনু!”

চলবে…!#অদ্ভুত_আসক্তি
#পর্ব_২৪ (অপরাধীর অপরাধের শাস্তি)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

তেজহীন রোদ। চারিপাশে শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। তবুও ঘামছি আমি। শুধু ঘামছি বললে চলবে না। ঘেমে নেয় একাকার হয়ে যাচ্ছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এমনও হয়? যাকে পুরোটা জীবন মৃত বলে আখ্যায়িত করে এসেছি, সে আমার সামনে আজ জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছে। হুট করেই নিজেকে ভীষণ ভারী অনুভূত হলো। শরীরের ভার আমার পা জোড়া সইতে পারছে না। পা ভেঙ্গে আসছে। নিজের ভর রাখতে, আমি হাত এগিয়ে আরহানের বাহু খামচে ধরলাম। দৃষ্টি এখনও আমার সামনেই। আমার সামনের মানুষটা যেমন আমাকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। ঠিক তেমনই আমি অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছি।

নিজেকে বিশ্বাস করতে না পেরে আমি আরহানের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিক্ষেপ করলাম। আরহান উপরনিচ মাথা দুলিয়ে আমাকে বোঝালেন, এটাই সত্যি।

তৎক্ষণাৎ আমার মস্তিষ্কে সেদিনের ঘটনা চলে এলো, যেদিন আমি এই শহরের রাস্তায় মাকে দেখেছিলাম। তখন নিজের চোখের দেখাকে ভুল মনে করে, ভুলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ! পুনরায় আমি আবার আমার সামনে তাকালাম।
অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললাম, “মা!”

মুহূর্তেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দুই হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদছি আমিও। তবে নিঃশব্দে।

“মা! আপু এসেছে?”—প্রশ্নটি করেই দীপ্তি এগিয়ে এলো এদিকে।

আমিও ততক্ষণে সামনে আরো একজনের উপস্থিতি টের পেলাম। সেদিকে তাকিয়ে আমি আরো বিস্মিত হলাম, যেমনটা দীপ্তি হয়েছে। চমকিত দীপ্তি চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলেছে।

দীপ্তি আমার দিকে ইশারা করে মাকে প্রশ্ন করলো,“আপু?”

মা অশ্রুসিক্ত নয়নে দীপ্তির পানে তাকিয়ে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,“হুঁ।”

দীপ্তি আর অপেক্ষা করলোনা। তৎক্ষণাৎ দ্রুত বেগে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। দীপ্তিও কেঁদে দিয়েছে। যেমনটা আমি আর মা কাঁদছি। দীপ্তি কেঁদে কেঁদেই বলছে,“জানো বীনুপু? তোমার মতো একটা বোন চাইতাম আমি। আর তুমিই আমার বোন। আমার সত্যিকারের বোন!”

একের পর এক চমকের দরুন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি। বোন! আমার বোন!
দীপ্তি আমাকে ছাড়তেই আমি আর দেরি না করে মায়ের কাছে গেলাম। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম মা কে। এইতো আমার মা।

কাঁদতে কাঁদতেই মাকে বললাম, “ক’কোথায় ছিলে মা? জানো ত’তোমাকে ছাড়া আমি ভালো ছিলাম না। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিলো মা!”

মা ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,“আমাকে মাফ করে দে মা। আমি তোর কাছে অপরাধী।”

ঘটনা আমার কাছে একদম ঘোলা। অনেকটা স্বপ্নের মতোই লাগছে। তবুও আমি এই স্বপ্ন থেকে বেরোতে চাচ্ছি না।

আমাকে নিয়ে মা ভেতরে গেলো। আমি এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছি। অপূর্ণতায় ঘেরা জীবনে, হুট করেই অনেক কিছু পেয়ে গেলে যেমনটা লাগে। তেমনটাই লাগছে।

বাড়িতে ঢুকে ড্রইং রুমের সোফায় আমাকে নিয়ে মা বসলো। আমি মাকে ছাড়িনি। জড়িয়ে ধরেই আছি। যেনো ছেড়ে দিলেই মা হারিয়ে যাবে।

আমার এই অবস্থা দেখে মা ঠোঁট চেপে কেঁদে যাচ্ছে। আরহান আমার এই কান্না আর সহ্য করতে না পেরে বললেন,“কেউ চলে যায়নি, হারিয়ে ফেলোনি কিছু, যার জন্য এভাবে কাঁদছো। পেয়েছো তুমি। খুশি হও না রে!”

আমি কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। তবুও পারছি না। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কোথায় ছিলে মা? আমাকে কেনো একা রেখে গিয়েছিলে!”

হুট করেই মায়ের কান্না থেমে গেলো। মা ভয় পাচ্ছে। আমার এই প্রশ্নেরই তো ভয় পেয়েছে এই কয়দিন। মায়ের কাছে আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই। মাথা নিচু করে চুপ হয়ে আছে।

মাকে চুপ থাকতে দেখে আমি আরহানের দিকে তাকালাম। আরহান একবার মাকে দেখে পুনরায় আমার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পুরো ঘটনা বলা শুরু করলেন। আমি হতভম্ব হয়ে শুনে যাচ্ছি।

আরহানের কথা বলা শেষ হতেই দীপ্তি বলা শুরু করলো,“আমি বুঝতেই পারিনি, ভার্সিটির বড় আপু, যাকে নিজের আপুর মতোই ভাবতাম, সে আমারই আপু।”

সবাই সবার কথা ব্যক্ত করছে। আমি এখনও চুপ হয়ে আছি। কান্না থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে। মাকেও ছেড়েছি বেশ খানিকক্ষণ আগেই। আমার নিস্তব্ধতা দেখে সবার মনে ভয় ছেঁয়ে গেলো। তারাও চুপ হয়ে গেলেন। স্থির দৃষ্টিতে আমার সামনের এই তিনজন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার চাহনি ফ্লোরে। মাথা নিচু করে বসে আছি।

অনেকক্ষণ বাদে হালকা কন্ঠে বলে উঠলাম,“আমাকে চাইলেই তো খুঁজে পেতে! তোমার সাথে যা হয়েছে, এতে আমার কী দোষ ছিলো মা?”

মা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। আমার এমন প্রশ্নের জন্য একদম অপ্রস্তুত ছিলো সে। নিজেকে এক্সপ্লেইন করার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা করলো না। তবে অনুতপ্ত সে। ভীষণ অনুতপ্ত।
অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,“আমি বুঝিনি বীনু। আমাকে মাফ করে দে মা।”

আমি মায়ের দিকে তাকালাম। কাঁদছি না আমি। তবে চোখ ছলছল করছে। আমি মাকে দোষ দিতে পারবো না। তার কোনো দোষ নেই এতে। হয়তো মায়ের জায়গায় থাকলে আমিও এসব ভেবে নিতাম। হয়তো আমিও এমনটাই করতাম।

ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম,“আমি আর কোনো প্রশ্ন করবো না তোমাকে। তোমাকে পেয়েছি আমি, এই অনেক আমার জন্য। এখন অতীতের হিসেব কষতে গেলে আমার বর্তমান নষ্ট হবে।”

_______________
বিকালের দিকে চারজন মিলে রওনা হলাম বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। অপরাধীর অপরাধ একদিন না একদিন প্রকাশ্যে আসে। আর সে তার ন্যায্য শাস্তি পাবেই।

আজ দুপুরে মা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। সবকিছু সুখময় লাগছে। আমার মতো, আমার মা আর আমার বোনও ভীষণ খুশি আমাকে পেয়ে। তবে জানিনা এই খুশির মেয়াদকাল কতক্ষন।

গাড়ি দ্রুত গতিতে চলছে। আরহান ড্রাইভ করছেন। আর আমি উনার পাশের সিটে বসে আছি। ঘাড় ঘুরিয়ে আরহানের দিকে তাকালাম। উনি উনার সব কথা রেখে যাচ্ছেন। বিনা প্রত্যাশায়।

আরহান দৃষ্টি সামনে রেখেই আমাকে বললেন,“আমার ফোন থেকে রুদ্রের নম্বরে কল দাও।”

উনার ফোন আমার কাছেই ছিলো। কল লাগাতেই আরহান বললেন,“স্পিকারে দাও।”

আমি দিলাম। ওপাশ থেকে রুদ্র কল রিসিভ করতেই আরহান বললেন,“কতদূর আছো?”

“স্যার! এই তো রাস্তায় আছি। আধা ঘন্টা লাগবে।”

“ওকে।”

কল রেখে দিলাম। পেছনে দীপ্তি আর মা বসে আছে। দীপ্তি বিভিন্ন কথা বলেই যাচ্ছে। ছোট থেকে ওর সব ঘটনা, আমার সাথে ওর দেখা হাওয়া, ওর যেনো খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে।

মিনিট বিশেক বাদে বাড়িতে চলে এলাম। মা আমাদের পেছনে আছেন। কলিং বেল বাজানোর দুই মিনিট পর ছোট মা দরজা খুললো। দরজার এপাশে আমাকে দেখেই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললো। আমার দিকে তার দৃষ্টি স্থির ছিলো সেকেন্ড পাঁচেক। অতঃপর আমার ডানে, আরহানকে দেখে তৎক্ষণাৎ ভয়ে ঘামা শুরু করলো। এমন নাজেহাল অবস্থার মানে আমার অজানা। যদি মাকে দেখে এমনটা হতো, তবে মেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু মাকে তো দেখেনি।

কিছুক্ষণ বাদে মা সামনে এলো। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে যখন ছোটমার দিকে তাকালাম তখন দেখি, ছোটমার চোখ ছানাবড়া। ভয়ে জমে গেছে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। ছোটমা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। তার অবাক মুখশ্রীতে ভয়ের ছাপ দৃশ্যমান। মুখে অস্পষ্ট বুলিতে “ভুত!” কথাটি লেগেই আছে।

ছোটমায়ের সাথে সাথে আমরাও ঢুকলাম ভেতরে। ছোটমা উচ্চ কণ্ঠে বারবার ডাকছে, “ব’বাসেদ! বাসেদ! ক’কোথায় তুমি?”

একবার পেছনে আমাদের এগিয়ে আসতে দেখে আবারও ডাকা শুরু করলো, “মীরা! বাঁচা আমাকে। মীরা!”

বাবা বাইরে বেরিয়ে এলেন। আজ অফিসে যাননি। ছুটির দিন তো! বাইরে এমন হট্টগোল শুনে বললেন, “কী ব্যাপার! কী হয়েছে এখানে?”

বাবা দেখেনি আমাকে কিংবা মাকে। দৃষ্টি সামনে এগিয়ে দিতেই যখন মায়ের সাথে বাবার চোখাচোখি হয়ে যায়, আঠারো বছর পর! বাবা চোখের চশমা খুলে আবারো পরে নিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন, “শ’শেফালী!”

ছোটমা দ্রুত পায়ে বাবার দিকে অগ্রসর হলো। ভীত কণ্ঠে বললো,“কিছু বলছো না কেনো? ভয় করছে আমার।”

ছোটমায়ের এমন ব্যবহার আমার কাছে পাগলামো ঠেকছে না। দীর্ঘকাল কাউকে মৃত বলে জেনে আসার পর, যদি সে আপনার সামনে জীবন্ত দাঁড়িয়ে থাকে, ব্যাপারটা যে কারো কাছে অবিশ্বাস্য লাগবেই।

বাবা এখনও চুপ। তবে তার চশমার ভেতর দিকে অশ্রুসজল নয়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদিকে মা ও আবেগ প্রবন হয়ে গেছে। হাজার হোক! কোনো এক সময় দুজন মানুষ একে অপরকে পাগলের মতো ভালবেসেছিলো তো!

তখন সেখানে আগমন ঘটলো রুদ্রের। সাথে আছে পুলিশ। দুজন মহিলা কনস্টেবল এগিয়ে গিয়ে ছোটমায়ের কাছে যায়। একজন ছোট মায়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। ছোট মা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। এক প্রকার চিৎকার করছে। উপস্থিত যেসব মানুষ অতীত সম্পর্কে অজ্ঞাত, তাদের সবার মনেই বিভিন্ন প্রশ্নেরা উঁকি দিচ্ছে।

তখন মীরা আপুও এলো। বাইরে আমাদের সবাইকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো আপু।

মীরা আপুকে দেখে ছোটমা আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “কী হচ্ছে দেখ! বাঁচা না!”

মীরা আপু এগিয়ে এলো। ছোটমাকে ছাড়াতে চাইলো। কিন্তু পারছে না।

ছোট মা, “এসব কী হচ্ছে?’’ জানতে চাইলে আরহান বাঁকা হাসেন। রুদ্র ফটাফট উত্তর দেয়,“স্বর্গের টিকিট কেটে দেওয়া হয়েছে। আরামসে যান।”

চলবে…!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here