অনিন্দিতা পর্ব -০১

–“ইমতিয়াজ ভাইয়া এসে গেছে আপু।”

ছোটবোন অহির মুখে এমন কথা শুনে খুশি হয়ে যায় বউ সাজে নিজের রুমে বসে থাকা অনি। কিন্তু অহির মুখে চিন্তার রেশ দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে যায় অনি৷ অহি পাথরের মূর্তির মতো মেঝের দিকে চেয়ে আছে। অনি ওর কাঁধে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বলে,

–“ইমতিয়াজ চলে এসেছেতো! তুই মুখ এমন লক্ষী পেঁচার মতো করে রেখেছিস কেন? সবাই কি ইমতিয়াজকে বকাবকি করছে? আচ্ছা চল আমি দেখছি!”

বলেই বিয়ের ভারি লেহেঙ্গাটা দুই হাত দিয়ে ধরে উঠে দাঁড়ায় অনি। তারপর রুমের বাইরে যেতে-যেতে বলে,

–“বাইরে কাজ থাকতেই পারে। হয়তো জরুরি কোনো কাজ ছিল তাই কাউকে বলে যেতে পারেনি! তাই বলে বকাবকি করতে হবে! এসেতো গেছে এখন। এত কথার কি আছে..”

এইসব বলে রুমের বাইরে এসে নির্বাক হয়ে যায় অনি। ইমতিয়াজ ওর প্রিয় বান্ধবী পিহুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর সবাই ওকে নানা কথা শুনাচ্ছে। সেসব শুনেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ আর পিহু।

অনি প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও একটু পর ঠিকই বুঝতে পারলো যে, তার চাচাতো ভাই ইমতিয়াজ তাকে বিয়ে না করে তার প্রিয় বান্ধবী পিহুকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।

ধপাস করে ওখানেই বসে পড়ে অনি। ওর সাথে ওরা এটা কি করে করতে পারলো! ওর চোখের জলে কাজলগুলো গলে-গলে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে ওর খেয়াল নেই। ও বিশ্বাসঘাতক মানুষ দুটোর দিকে তাকিয়ে ভাবছে এটা হয়তো ওর স্বপ্ন! ও হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখ রগড়ে আবার সামনে তাকায়। কিন্তু না! এটা কোনো স্বপ্ন নয়!

অহি এগিয়ে এসে অনির হাত ধরে ওকে টেনে তোলার চেষ্টা করলে অনি অহির হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। তারপর কান্না করতে-করতে পাগলের মতো বলতে থাকে,

–“আমি এখন ঘুমিয়ে আছি৷ তাই না অহি? আমার ঘুম এক্ষুনি ভেঙে যাবে! দেখিস! সব ঠিক হয়ে যাবে। তাইনা অহি?”

অহি নিজের বোনকে টেনে তুলতে ব্যর্থ হলে ওর দিকে এগিয়ে আসে অনির বন্ধু তাজ। তারপর তাজ আর অহি মিলে অনিকে টেনে তুললে অনি তাজকে লক্ষ্য করে বলে,

–“ওটা কি সত্যিই পিহু? বল না তাজ? তুইও কি ওকে দেখতে পাচ্ছিস ইমতিয়াজ এর সাথে?”

ওর এই অবস্থা দেখে ইমতিয়াজ ওর দিকে এগিয়ে এসে অনির হাত ধরে করুণ গলায় বলে,

–“সরি অনি! আমি পিহুকে ভালবেসে ফেলেছি! তাই আমরা বিয়ে করে নিয়েছি! তোকে আমি শুধু আমার ছোটবোনের মতই দেখতাম! তোকে আমি অনেক বুঝাতে চেয়েছি, তুই মজা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিস! কিন্তু আমি ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম!”

অনি কান্না থামিয়ে ইমতিয়াজকে বলে,

–“আপনি এখনো আমার সাথে মজা করছেন। তাইনা? সব রেডি৷ সবাই চলে এসেছে। চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছেতো! আমি সেই তখন থেকে অপেক্ষা করছি!”

ইমতিয়াজ এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে গিয়ে অনিকে বলল,

–“আমি মজা করছি না অনি! আমরা বিয়ে করে নিয়েছি! আর তুইও নাকি এই বিয়ে জোর করে করছিস! তুইতো নাকি তাজকে ভালবাসিস? এখন এত নাটক কেন করছিস? আমাকেই শুধু দোষী বানাচ্ছিস!”

ইমতিয়াজ এর কথা শুনে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় অনি। তারপর পিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,

–“এই কথা কি তুই বলেছিস পিহু?”

পিহু চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো জবাব না পেয়ে অনি এবার তাজের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর তাজকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–“কথাটা কি তুই বলেছিস তাজ?”

তাজ কিছু বলার আগেই ইমতিয়াজ বলে,

–“কথাটা যেই বলুক সেটা বড় কথা নয় অনি! বড় কথা হচ্ছে… ”

ইমতিয়াজ আরকিছু বলার আগেই ওর বাবা সবার সামনেই কষে একটা থাপ্পড় মারলেন নিজের ছেলেকে। তারপর রেগে গিয়ে বললেন,

–“অনেকক্ষণ ধরে তোর তামাশা দেখছি!তোদের ছোটবেলা থেকেই বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এটা সবাই জানে! তারপরও তুই এইরকম জঘন্য কাজ কি করে করলি?”

ইমতিয়াজ এর এমন পরিস্থিতি দেখে অনির খুব মায়া হয়! একদিকে বান্ধবী আর অন্যদিকে ভালবাসার মানুষ! অনি তাজের হাত ধরে ওর চাচার সামনে গিয়ে বলে,

–“বড়বাবা প্লিজ উনাকে কিছু বলবেন না আর। উনি ঠিকই বলেছে। আমি তাজকে পছন্দ করি। কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি। আমি ইমতিয়াজকে ভালবাসি না। তাইতো পিহু….আচ্ছা আপনি আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করুন। ”

তাজ কিছু না বলে পুতুলের মতো অনির কথাগুলো শুনছে। ইমতিয়াজ এর বাবা এসে বলে,

–“ওই ইডিয়টটাকে বাঁচানোর জন্য তুই মিথ্যে কেন বলছিস? ওর শাস্তি পাওয়া উচিৎ! ওর জন্য আমি তোর জীবন নষ্ট করতে পারিনা! তুই কিছুতেই তাজের মতো একটা ছেলেকে পছন্দ করতে পারিস না!”

অনি ওর চাচার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তাজকে লক্ষ্য করে বলে,

–“কিরে তুই আমাকে বিয়ে করবিতো? নাকি উনার মতো তুইও আমাকে…”

আসলে তাজ নিজেও অনিকে পছন্দ করে৷ কিন্তু ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে জেনে কোনোদিন বলার সাহস পায়নি। পিহুকে অবশ্য একবার বলেছিল৷ এখন অনির মুখে ওকে বিয়ে করার কথা শুনে তাজ বলে উঠে,

–“হ্যাঁ, আমি করব বিয়ে!”

সবাই অবাক হয়ে যায় তাজের কথা শুনে। আর কনফিউজড হয়ে যায় কে সত্যি বলছে আর কে মিথ্যে বলছে তা ভেবে। তাজরা মোটেও বড়লোক নয়। আর ওর পরিবারের কাহিনীও ততটা সুবিধার নয়। তাই কেউ রাজি হতে চায় না। কিন্তু অনির জিদের কারণে কেউ সে ব্যাপারে কথা বলতে পারে না। সবাই রাজি না হওয়া সত্বেও অনির জিদের কাছে হেরে যায়। কারণ অনি প্রচুর জেদি!

অবশেষে নিরবভাবে অনি আর তাজের বিয়ে হয়ে যায়। ইমতিয়াজ পিহুকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়৷ যা অনি আর ইমতিয়াজ এর জন্য সাজানো হয়েছিলো!

বিয়ে শেষে তাজ অনিকে নিয়ে গাড়িতে উঠে। অনি ওর বোন অহি, বাবা আর বাকি সবাইকে বিদায় জানিয়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

অনিরা দুইবোন। ওর মা মারা গেছে তিন বছরের মতো হয়েছে। ওর বাবারা দুইভাই৷ আর ওর বড় চাচার ছেলেই ইমতিয়াজ যার সাথে ছোট থেকেই ওর বিয়ে ঠিক হয়ে ছিলো। আর পিহু ওর প্রিয় বান্ধবী। যে ওদের ভার্সিটির নাম্বার ওয়ান সুন্দরী! আর সেই রূপের মোহেই আটকে ফেলেছে ইমতিয়াজকে! আর তাজও অনির প্রিয় বন্ধু। তাজ, অনি আর পিহু তিনজন খুব ভালো বন্ধু ছিলো। যা এখন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো!

বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করে মাস দুয়েক আগেই ইমতিয়াজ দেশে ফিরেছে। তারপর পিহুর সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো অনি। কিন্তু সেটা যে ওর সর্বনাশের কারণ হবে তা কে জানতো! ইমতিয়াজ এর ছোটবোন আছে একটা ওর নাম ইমা। এইবার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। আর অনির অনার্স শেষ হয়েছে মাস চারেক হলো।

অনির মা মারা যাওয়ার পর ওর চাচি ওকে আর অহিকে নিজের মেয়ের মতই দেখেছে। মায়ের অভাবটা কখনো বুঝতে দেয়নি।

তাজের মা খুব ধার্মিক একজন মহিলা। তাজেরও একটা ছোটবোন আছে। ওর নাম আফিয়া। আফিয়া কলেজ শেষ করার সাথে-সাথেই ওর মা একজন আলেমের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আফিয়াও ওর মায়ের মতই খুব ধার্মিক!

তাজ ছোট থাকতে ওর বাবা সৌদি আরবে চলে যায়। মাঝেমধ্যে দেশে আসতো। কিন্তু তারপর একবার দেশে আসা বন্ধ করে দেয়। কারণ উনি ওখানে আরেকটা বিয়ে করে সংসার শুরু করেছেন।প্রথমদিকে তাজের মাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাতো। উনি এও বলেছিল যে, তাজের মা যদি আবার বিয়ে করতে চায় তাহলে উনি ডিভোর্স দিয়ে দিবেন।

কিন্তু তাজের মা আবার বিয়ে করবে না জানায়। এবং ডিভোর্স না নিয়ে ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। কয়েক বছর পর তাজের বাবা ওদের খোঁজ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। আর টাকাও পাঠায় না। হয়তো উনার দ্বিতীয় বউয়ের পছন্দ নয়! ওদের বাসাটাই ওর মায়ের একমাত্র সম্বল! বাসা ভাড়ার টাকা দিয়েই উনাদের সংসার চলতো। কিছুদিন হলো একটা ছোট কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে তাজ।

তাজের মা অনিকে একদম পছন্দ করেনা। কারণ উনার ভাষ্যমতে অনি উচ্ছৃঙ্খল একটা মেয়ে। যার ইসলামিক কোনো আদব-কায়দা নেই! যেখানে অনিকে তাজের সাথে মেশাটাই পছন্দ করতো না সেখানে উনি কি অনিকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবে! অনি জিদের বশে কোনো ভুলতো করে ফেললো না!

–“চল অনি, আমরা চলে এসেছি।”

তাজের কথায় ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে অনি। তারপর গাড়ি থেকে নেমে দরজার বাইরে গিয়ে কলিংবেল চেপে অপেক্ষা করতে থাকে ওরা। একটু পরে দরজা খুলে দেয় তাজের মা।

ওদের দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে ওর মা বলে ওঠে,

–“তাজওয়ার! অনিন্দিতা! এসব কি?”

চলবে…?

#অনিন্দিতা
#সূচনা_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here