অনুতাপ পর্ব -০৯

#অনুতাপ
#নবম_প্রহর
#Yasira_Abisha (#Fatha)

ভরা ক্লাসে ক্রাশের কাছে অপমানিত হয়ে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ভালো ছাত্রী থাকা স্বত্তেও তার সামনে আমাকে আমি তুলে ধরতে পারিনি, তাই আরো কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করলাম। আলহামদুলিল্লাহ সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট ও করলাম ক্লাসে কিন্তু উনি ছুটিতে থাকার কারণে তার সাথে দেখাই হচ্ছিলো না, এতে আমার মন ও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। সেদিন ক্লাস শেষ করে বাসায় যাবো তখন দেখি উনি সামনের করিডর থেকে হেটে আসছেন। উনাকে দেখলে বরাবরের মতোই আমি নার্ভাস হয়ে যাই, আজকেও তাই হলো,
সে আমার সামনে এলো,
– আসসালামু আলাইকুম স্যার
– ওয়ালাইকুম আসসালাম
– ভালো আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
– আলহামদুলিল্লাহ,
আমি তাকে দেখেই ভাবছিলাম আল্লাহই জানে আজকে আবার বকা দেবার জন্য এলেন কি না?
– কংগ্রাচুলেশনস মিস রুহি, আই এম প্রাইউ অফ ইউ
উনার কথাটা শুনে আমি তার চেহারার দিকে তাকালাম। খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন, মুক্তার মতো দাঁত গুলো ফর্সা সুন্দর চেহারা একদম আয়নার মতো ঝিকঝিক করছিলো। আমি তাকে দেখে একদম মুগ্ধ হয়ে যাই, তার মুখ থেকে আমার নামটা শুনলেই আমি যেনো শিউরে উঠি। ভালোবাসা কি হয় জানি না, তবে আমার ধ্যানে জ্ঞ্যানে প্রেম, পছন্দ সম্মান আরাধনা সবকিছু যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে তাকেই আমি আমার মনে জায়গা দিয়েছি৷ কোনোদিন ভাবতেও পারিনি এই মানুষটার সাথে আমার সামনাসামনি কোনোদিন দেখা হবে, তার মুখে আমার নাম শুনবো, সে আমাকে চিনবে। সব কিছুই একটা স্বপ্নের মতো ছিলো আমার জন্য।
– মিস রুহি?
তার কথায় আমার আবার যেনো ধ্যান ভাঙলো।
– থ্যানক ইউ স্যার
– আপনি এতো ব্রাইট একজন স্টুডেন্ট আমি জানতাম না, আমার সেদিনের ব্যাবহারে আপনি কষ্ট পেয়ে থাকলে আই এম সরি।
– না স্যার, আপনি সরি কেনো বলছেন? আপনি আমার স্যার।
– আমি যেই হই না কেনো, যার ভুল থাকে তার অবশ্যই সরি বলা উচিত এই জিনিসটা আমি মনে করি।
– আপনি অনেক ভালো স্যার।
ইরাদ মুচকি হাসলেন,
– আসি তাহলে
বলে সে চলে যাচ্ছিলো। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো তার সাথে বসে কিছুক্ষণ কথা বলতে, ভাবছিলাম না কি রেখে কি বলি
হুট করেই পেছন থেকে একটা ডাক দিলাম
– স্যার
সে পেছন ঘুরে আমার দিকে তাকালেন,
– স্যার আজকে ডিনারে যাবেন?
সে আমার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে তাকালেন
আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
– না মানে স্যার আপনার কারণেই আসলে আমার রেজাল্টটা এতো ভালো হয়েছে, আমি একটু সেলিব্রেট করতে চাচ্ছিলাম। আর পুরো ক্রেডিটটা যেহেতু আপনার তাই স্যার যদি আপনি আসতেন আমি খুব খুশি হতাম।
এক নিঃশ্বাসে সব গুলো কথা বলে ফেললাম। ভেতরে ভেতরে যে আমি ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, তা তো আর উনাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।
সে কিছুক্ষণ চুল করে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললেন,
– আচ্ছা ঠিক আছে। কোথায় যাবেন?
– স্যার ওইদিকটায় অনেক ভালো একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে। ওখানে গিয়েছিলাম দু’দিন আগে বেশ সুন্দর।
– ওকে,
– আপনাকে কল দিবো স্যার রাতে?
– হুম?
– মনে করানোর জন্য।
– আমার মনে থাকবে তবে নাম্বার রাখতে পারেন
রুহিকে ইরাদ তার মোবাইল নাম্বার দিয়ে চলে এলো।
বাসায় আসার পর থেকে রুহি যেনো খুশি আটখানা হয়ে গেছে। তার মুখ থেকে হাসিই যেনো কোনো ক্রমে কমছে না। কখন সন্ধ্যা হবে? আর কখন রুহি যাবে ইরাদের সাথে ডিনারে। আলমারি থেকে সব কাপড়চোপড় সে বের করে ফেলেছে। সব কিছুতে মেয়েটার মুখে এখন হাসি ফুটে আছে। আর রুহি এমন একটা মেয়ে যে অল্পতেই অনেক খুশি হয়ে যায়, তার এইটুকু জীবনে সে সবসময় অন্যের সুখে নিজের সুখ খুজেছে। পরিবারের প্রতি তার যেনো এক অদেখা দ্বায়িত্ব কাজ করতো সর্বদা। নামাজ কালাম পড়া, নিজের ক্যারিয়ারের দিকে লক্ষ্য রাখা এসব নিয়েই তার দিন কাল কাটতো আর এর মাঝে যদি কিছু তাকে একান্তই নিজের করে সুখ দিতো তা হলো ইরাদের চেহারা। ইরাদকে নিয়েবতার ভাবনা।
এই মেয়েটার চোখে মুখে ইরাদকে দেখলেই একটা চকচকে ভাব চলে আসে৷ এতো ভালোবাসা কেনো? সে তো কোনোদিন ইরাদের সাথে মিশে নি দূর থেকেই ভালোবেসে গেছে। হয়তো রুহিও জানে না, কিছু কিছু ভালোবাসা আল্লাহ প্রদত্ত হয়। যেমনটা রুহির। এই রুহি মেয়েটা ভালোবাসতে জানে, নিজের সর্বস্বতা দিয়ে যে ভালোবাসতে জানে। তার কাছে ভালোবাসা মানে আরাধনা। নিজের উজার করতে দ্বিধাবোধ না করা। নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য সব কিছু ত্যাগ করতে পারা। রুহি চায় ইরাদকে তার করে পেতে কিন্তু এতো বড় একটা স্বপ্ন দেখা কি তার ঠিক হবে? ইরাদ কি তাকে গ্রহণ করবে? এসব কিছুই রুহি জানে না, সত্যি বলতে তার মনটা এখন এসব আর জানতেও চায় না কারণ ভালোবাসা তো বাধা মানে না। ভালোবাসা শুধু জানে নিজেকে অন্যের করে দিতে।

ইরাদ খুব একা দিন শেষে ওর পাশে কেউ নেই। মন খুলে সে কবে কথা বলেছে জানে না, ক্যারিয়ার গোছাতে গিয়ে এসব কিছুই জীবন থেকে বাদ পরে গেছে। সে কবে লাস্ট অফিসিয়াল মিটিং ছাড়া, রিলাক্সের জন্য রেস্টুরেন্টে বসে খেয়েছে তাও ঠিক জানে না। কারণ এরকম সময় তার হয় না। তাই আজকে যখন রুহি তাকে জিজ্ঞেস করলো, ইরাদেএ ইচ্ছে করে নি আর মানা করতে। ইরাদ যদিও জানে রুহি তার স্টুডেন্ট, কোনো বন্ধু না তবে মেয়েটা ভালো মনের তা রুহিকে দেখে ইরাদ বুঝতে পারছে। আর তা ছাড়া মেয়েটা যেহেতু ইরাদকে ওর এই ভালো রেজাল্টের জন্য ক্রেডিট দিচ্ছে যদি ইরাদ না করে দিতো হয়তোবা কষ্ট পেতো ও। আর এই বাচ্চা বয়সটায় আবেগ অনুভুতি সব বেশি থাকে, শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়াটা ইরাদের ভালো ও মনে হয় নি। এসব কিছু মিলিয়েই ও রাজি হয়েছে রুহির সাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য।

রাত ৭ঃ৪০ বাজে রুহি নামাজ পরে নিয়েছে এবং সে বের হবার জন্যেও একদম রেডি। লাল একটা জর্জেটের শাড়ি পরেছে ও, লম্বা সিল্কি চুল গুলো খোলা, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। গালে হালকা ব্লাশঅন। কানে গলায় ডায়মন্ডের একটা ছোটো সেট আর চোখে মাশকারা।
রুহিকে দেখতে অপরূপা লাগছে।
হাতে পরার জন্য চুড়ি বের করে রেখেছে, ঠিক যাওয়ার আগ মুহুর্তে পরে নেবে বলে,
ইরাদকে একটা কল দেওয়া দরকার। রুহির যা ভাবা তাই কাজ। ইরাদকে সে কল দিলো
– হ্যালো স্যার। আমি রুহি
– জ্বি রুহি
-স্যার আজকে বের হওয়ার কথা ছিলো
– মনে আছে আমার
– আচ্ছা স্যার
– আমার পৌছাঁতে আর ১০ মিনিট লাগবে
– স্যার আপনি বের হয়ে গেছেন? আমি তাহলে এখনি রওনা দিচ্ছি।
এই বলেই রুহি বাসা লক করে বের হয়ে গেলো ওর পার্স আর মোবাইল নিয়ে। রেস্টুরেন্টটা রুহির বাসা থেকে খুব একটা দূরে না তাই সেও তাড়াতাড়িই চলে এলো রেস্টুরেন্টে।
রাতের সময় হলুদ লাইটিং করা অনেক সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট। হালকা সাউন্ডে গান হচ্ছে, বেশ রোমান্টিক একটা আমেজ আছে এই রেস্টুরেন্টের মধ্যে। ঢুকেই রুহির ভালো লাগছে কারণ আজ সে ইরাদের সাথে এসেছে।
রেস্টুরেন্টের দক্ষিণ দিকটায় গোল একটা ছোট টেবিল আছে সেদিকটা বেশ আকর্ষণীয়। রুহির চোখ পরতেই ও দেখতে পেলো। খুব সুদর্শন একটা পুরুষের পেছন দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছিলো ইরাদ আর একটু এগিয়ে দেখলো,রুহি যা ভেবেছে তাই এটা ইরাদ। সে পাশে বসে আছে, একটা সাদা শার্ট, স্লিভ ফোল্ড করা সাথে গ্রে কালারের প্যান্ট পরে, চুল গুলো স্পাইক করা, মুখে খোচাখোচা দাড়ি। ইরাদকে দেখে রুহির এতো ভালো লাগছিলো যা বলার বাইরে ইচ্ছে করছিলো সারাক্ষণ বসে ওকেই দেখবে।

রুহি সামনে এসে দেখে ইরাদ নিচু হয়ে মোবাইলে কিছু একটা করছে।
– একটু লেট করে ফেললাম
রুহির মিষ্টি কণ্ঠে ইরাদ তাকালো, দেখতে পেলো সামনে যেনো এক পরি দাড়িয়ে আছে।
কি সুন্দর চোখ, কি সুন্দর হাসি, এই প্রথম ইরাদ রুহিকে শাড়িতে দেখলো এমন লাল লিপস্টিকে দেখলো৷ এর আগে কখনো রুহিকে এমন সাজে ও দেখে নি। ইরাদ ওর জীবনে দেশে বিদেশে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখেছে তবে রুহির সাজের ধরণ তার চোখ চেহারা ইরাদের ভালো লাগলো। মেয়েটা দেখতে যেমন তার গুণেও সে তেমনি।
– ইটস ওকে, বসুন।
রুহি বসার পরে ইরাদ ওকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এটা আপনার জন্য
– আমার জন্য?
-জ্বি
রুহি খিলখিল করে হেসে উঠলো, সে ভাবতেও পারেনি ইরাদ তাকে উপহার দিবে।
প্যাকেটে ছিলো খুব সুন্দর একটা ঘড়ি, রুহি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে সে আজকে কিছুই পরে নি হাতে, যে চুড়ি গুলি বের করে রেখেছিলো তা তো মনেই ছিলো না পরে আসার কথা।
গিফটটা দেখে রুহি খুব খুশি হয়ে যায়।
– মিস রুহি আমি ভাবলাম আমাদের এতো ব্রাইট একজন স্টুডেন্ট এর জন্য এর থেকে বেটার গিফট হতে পারে না। আপনি সময়টা সবসময় মেইনটেইন করে চলবেন, আমি চাই আপনি আপনার ইন্টালিজেন্স দিয়ে আমাদের দেশের অন্যতম একজন বড় ডাক্তার হয়ে উঠেন। ইউর প্যারেন্টস মাস্ট বি সো প্রাউড অফ ইউ।
– ইট রিয়েলি মিনস এলট। মাই মাদার ইস নো মোর
রুহি কথাটা বলে তার চোখে পানি চলে এলো, কথাটা শুনে ইরাদের মনে ধক করে উঠলো। মেয়েটর জন্য ওর খারাপ লাগলো, ইরাদ চায়নি মেয়েটার মন খারাপ করে দিতে কিন্তু না চাইতেও এমন কিছু হয়ে গেলো। এরপর ইরাদ আর রুহি অনেক গল্প করলো, রুহি আস্তে আস্তে ইরাদের সাথে কিছুটা ফ্রী হয়ে গেলো, ইরাদকে হাসাচ্ছে, তার শিশুসুলভ আচরণ গুলো দেখে ইরাদ বেশ ইঞ্জয় করছে। অনেক দিন পরে যেনো ইরাদের আজকে মন খুলে হাসছে, এই দুইটা মানুষের বয়সে ১৪ বছরের পার্থক্য। তা দেখে কারোরই বুঝার উপায় নেই, মন মানসিকতা থেকে শুরু করে, তাদের একে অপরের সাথে বোঝাপরার ও খুব ভালো মিল। রুহি এখন ইরাদকে আর ভয় পায় না, কারণ সেদিন রাতে ইরাদের সাথে কথা বলার পর ও বুঝেছে ইরাদ আসলে রাগি না, ইরাদ অনেক যত্ন করে ওর সাথে কথা বলেছে। ইরাদ অনেক যত্ন করে ওর আশে-পাশের মানুষ গুলোর। যদিও এটা দেখায় না ও তবে রুহি ঠিক ধরতে পেরেছে। রুহির সাথে ইরাদের সেদিন রাতের পর থেকে টুকিটাকি অনেক কথাই হয়। কেমন যেনো একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওদের। এই ব্যাপারটা আরিফ ও জানে, আরিফ তো প্রথম দিনই রুহিকে খেয়াল করেছিলো। আরিফ এটাও জানে রুহি ইরাদকে ভালোবাসে তবে ও চাইছে ইরাদ আর রুহি আরো ঘনিষ্ঠ হোক ইরাদের মনেও রুহির প্রতি ভালোবাসা জন্মাক। এইজন্য ও ইরাদকে কিছুই বলছে না, তবে রুহির সাথে মেশার পর থেকে ইরাদ এখন হাসে, সে তো হাসতেই ভুলে গিয়েছিলো। একটা জীবনের এতো গুলো বছর নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলো ইরাদ। এখন ও হাসে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে এতে যেনো আরিফের অনেক খানি চিন্তা দূর হয়ে যাচ্ছে, বন্ধুর জীবনটা আবারো রঙিন হতে চলেছে। রুহি মেয়েটা অনেক অল্প বয়সের হলেও ইরাদকে বোঝার এক অসীম ক্ষমতা রাখে ওকে সামলে রাখার মতো এক গুণ যেনো রুহির ভেতরেই সুপ্ত হয়ে ছিলো যা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। হয়তো ইরাদ এখনো জানে না রুহি ওকে ভালোবাসে তবে রুহি দিনে দিনে ইরাদকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলছে। ইরাদের জন্য অনেক কিছুই অজানা আর রুহির জন্যেও ভাগ্যে কি আছে এরা কেউ জানেনা…

(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here