অনুতাপ পর্ব -১৬

#অনুতাপ
#ষষ্ঠদশ_প্রহর
#Yasira_Abisha (#Fatha)

মেঘা আর আফিয়া ওপর তলার ফুড কোর্টে বসে আছে। টুকটাক সংসার নিয়ে কথা হওয়ার মাঝে আফিয়া বললো,
– জানেন আপু কাল আপনাদের আরেক ফ্রেন্ডের সাথেও আমাদের দেখা হলো। ভাইয়া কি যে ভালো।
– তাই? কার সাথে?
– হুম, ইরাদ ভাইয়ার সাথে।
মেঘা কিছুটা চমকে উঠে,
মেঘার চেহারা দেখে আফিয়া ভাবলো ও হয়তো চিনতে পারে নি।
– ডক্টর ইরাদ আপনাদের ক্লাসেই ছিলেন। সুন্দর লম্বা যে ছেলেটা উনিই।
– ওহ আচ্ছা।
মেঘার জানতে ইচ্ছা করছে ইরাদ ওখানে কেনো গিয়েছে তাই সে কৌশলে জিজ্ঞেস করলো,
– কোনো গেট টুগেদার ছিলো?
– না, আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম আর ভাইয়া নিজের ওয়াইফকে নিয়ে এসেছিলেন হানিমুনে। নতুন বিয়ে করেছেন তো। বউটা এতো সুন্দরী মাশাল্লাহ। জানেন আপু অনেকটা আপনার চেহারার সাথে মিল আছে।
মাহিরার মাথাটা একদম চক্কর দিয়ে উঠলো। আফিয়া এক ধ্যানে কথা গুলো বলছে, ভেবেছে মেঘা শুনে খুশি হবে।
– জানেন আপু ভাইয়া এতো ভালো একজন মানুষ। উনার আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো, মেয়েটা উনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তারপর দীর্ঘদিন সে একা ছিলো শেষমেশ সে বিয়ে করেছে। আর পেয়েছেও একটা হুরের মতো বউ। মেয়েটা দেখতে যেমন ব্যাবহার ও তেমন। কাল নাদিমের মুখেই শুনলাম এসব কথা আর ও বললো, আগের বউটা খুব অহংকারী ছিলো। আমি সব মিলে খুব খুশি হয়েছি ইরাদ ভাইয়ার জন্য। ইরাদ ভাইয়া এখন কতো বেশি সাকসেসফুল আর দেখতেও কি সুন্দর। এমন মানুষকে কি ছেড়ে আসা যায়? নিশ্চিত মেয়েটা তাকে ভালোবাসতো না, ভালোবাসলে এমন করতেই পারতো না। এখন ভালোই হয়েছে এমন মেয়ের সাথে না থেকে অন্য কাউকে পেয়েছে ইরাদ ভাইয়া। তাছাড়া আপনিই বলেন আপু এমন কারো সাথে কি আর থাকা যায় যে এতো ভালো একটা স্বামীকে ফেলে চলে যায়?

মেঘা কথা গুলো শুনে চেষ্টা করছে একদম রিয়েক্ট না করতে তবে যখন সে এই কথাটা বললো তখন আর মেঘা চুপ করে থাকতে পারলো না,
– ইরাদ আপনাকে বলেছে তার আগের বউ খারাপ ছিলো
মেঘার চেহারায় রাগ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, আফিয়া ভাবলো হয়তো আগের বউটার ওপরে রাগ হচ্ছে মেঘার।
আফিয়া একটু অবাক হয়ে যায়।
– না আপু ভাইয়া বলেনি। ভাইয়া নাকি কোনোদিন নাকি তাকে নিয়ে আর একটাও কথা বলেনি। বলতেন সে তার পক্ষ রাখার জন্য উপস্থিত নেই এইখানে তাকে নিয়ে কোনো মন্তব্য তুলে ধরাই ঠিক না। আর সব সময় বলতেন আমাদের আন্ডারস্টান্ডিং প্রব্লেম ছিলো। এসবই নামিদের কাছে শুনেছি। ক্লাসের ছেলে মেয়েরাই নাকি বলতো এগুলো তার সম্পর্কে। নামটা যেনো কি ছিলো….
মাহিয়া না যেনো মায়রা কি যেনো..
তখন মেঘা নিজেই উত্তর দেয়।
– মাহিরা সিদ্দিকা… মাহিরা সিদ্দিকা মেঘা।
আর হ্যাঁ একটা কথা কেউ সুখে কারো সংসার ছাড়ে না। নিজেদের মধ্যকার সমস্যা যদি অন্য কেউ বুঝতো তাহলে তো হতো। যার সম্পর্কে জানেন না তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করে নিজেকে ছোট লোক বলে প্রমাণিত না করলেই ভালো দেখায়।

কথা গুলো বলে মেঘা উঠে চলে যায়। আফিয়া ভেবাচেকা খেয়ে যায়। ও ভাবতেই পারে নি মেঘাই ইরাদের প্রাক্তন স্ত্রী। কি রকম একটা লজ্জাজনক বিষয় ঘটে গেলো। এই মুহুর্তে নাদিমের ওপরে একদম রাগ চেপে যাচ্ছে। ও কেনো আগে বললো না এই মেয়েটাই ইরাদ ভাইয়ার এক্স ওয়াইফ। যদি আফিয়া জানতো মেঘার কথা তাহলে কি ও এই বোকামি করতো কোনোদিন? কতো গুলো অপমানিত হতে হলো ওকে আজকে? আজকে নাদিম এলে ওর খবর নিবে ইচ্ছা মতো আফিয়া।

.

রাগে গজগজ করতে করতে মেঘা বাড়ি ফিরে এলো। মনে হচ্ছে সারা গায়ে কেউ কেরসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তার ওপরে ইরাদ বিয়ে করেছে এই কথাটা শুনেও অনেক বেশি অসহ্য লাগছে। কেনো লাগছে মেঘা জানে না। আচ্ছা এটা কি স্বার্থপর মানুষের মতো অচরণ হয়ে যাচ্ছে? কারণ মেঘা নিজেই তো বিয়ে করে ফেলেছে তাও কতো আগে। আর ইরাদের ও তো কথা ছিলো আগেই বিয়ে করার কিন্তু সে এতো দেরিতে আগে বাড়লো জীবনে তাহলে মেঘার কেনো এমন লাগছে? তবে মেঘা এতোটুকু জানে যে ইরাদের মুভ অন করা ওর ভালো লাগে নি। তার ওপরে নাদিমের বউয়ের এই কথা তো আরো না। মেঘা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে পানি চোখে মুখে উপচে পড়ছে আর ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে সাথে তাল মিলিয়ে। আচ্ছা সবাই কি আমাকে দোষী ভাবে? কিন্তু আমার কি দোষ এখানে? ইরাদকে তো ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম আমি। কে জানতো আমি এডজাস্ট করতে পারবো না? আমি তো চেয়েছিলাম থাকতে, কিন্তু ইরাদ আমার পরিবারের থেকে দেওয়া কিছু আমাকে নিতে ও দিতো না। এটা কি ও বাড়াবাড়ি করে নি? করেছিলো। কিন্তু কারো চোখে তা ধরা পরে নি। সবটা দোষ আমার ওপরে দিচ্ছে এরা? আমার ওপরে? আমি কতোটা সহ্য করেছিলাম ওই বাসায়? আমি নিজের সবটা বিসর্জন দিয়ে থেকেছি, আমার ত্যাগ, মানিয়ে নেওয়া এগুলো কারোর চোখেই পড়ে নি।

মেঘার ইচ্ছে করছে চিতকার করে কান্না করতে, তবে সে পারবে না। ইরাদের বউ তার মতো সুন্দরী এই কথা কেনো বললো আফিয়া? তার মতো সুন্দরী খুব কম আছে এটা মেঘা নিজেই জানে। নিশ্চয়ই আফিয়ার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, মেঘার মতো কোনো মতেই হতে পারে না অন্য কেউ। মেঘা আর রুহির মায়েদের চেহারা একরকম হওয়ার সুবাদে ওদের দুজনের চেহায়ায় অনেকটা মিল আছে। আর ওদের বোনদের মতো সুন্দর মেয়ে খুবই কম আছে। তাই মেঘা এতোটুকু নিশ্চিত যে আর যাই হোক ইরাদের বউ কোনোদিন ও তার মতো হতে পারে না। মেঘা মনে মনে চাইছে ইরাদের বউ তার থেকে সবদিক দিয়ে নিচু থাকুক। তবে একদম তাকে দেখতে ইচ্ছা করছে না। আর ইরাদের সম্পর্কে ও কিছু জানতে ইচ্ছা করছে না। তবে এই মাথাটা থেকে কোনোভাবেই ইরাদ আর এইসব চিন্তা সরছে না।

.

এদিকে সকাল ১০টার দিকে রুহির ঘুম ভেঙে গেলো, তাকিয়ে দেখে ইরাদ জুস রেডি করছে। বেগুনী রঙের একটা শার্ট পড়া, বোধহয় একটু আগেই গোসল সেড়ে এসেছে। মোচা দাড়ি ফর্সা চেহারা। খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে সে জুস নিচ্ছে মেডিসিন প্যাকেট থেকে বের করছে। রুহি চোখ খুলে ইরাদকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। একে দেখলে একদম ক্লান্তি চট জলদি উড়ে যায়। মানুষটা চোখ খুলে দেখতে কি ভালো লাগে। ঘুমাতে যাওয়ার সময় এই মানুষটাকে দেখে ঘুমাতে গেলেও একটা শান্তি পাওয়া যায়। এই শান্তি কি আগে কোনোদিন পেয়েছে রুহি?
নাহ পায় নি। ইরাদই তো জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম অনুভূতি, প্রথম ভালোবাসা। রুহির জীবনে ইরাদই প্রথম, আর ইরাদ যেনো শেষ হয় এই দুয়া রুহি সারাজীবন ধরে করে।

রুহিকে উঠে বসতে দেখে ইরাদ বল্ব,
– গুড মর্নিং
-গুড মর্নিং কখন উঠেছেন?
– আজকে লেইট করে ফেলেছি কিছুক্ষন আগেই উঠলাম। কখন জেগেছেন?
– যখন আপনি জুস ঢেলে, মেডিসিন মিক্স ব্যাস্ত ছিলেন। কথাটা বলে রুহি হেসে ফেলে।
ইরাদ আড় চোখে রুহিকে দেখে মুচকি হাসে,
মেয়েটা কথায় কথায় দুষ্টুমি করে। প্রথম দিকে ইরাদ রাগ করলেও এখন হাসে, কিভাবে নিজে এতো অসুস্থতার মাঝেও হাসিখুশি থাকে। মাতিয়ে রাখতে পারে চারপাশ। রুহি সাথে থাকলে যেনো সবাই হাস্যজ্বল থাকতে বাধ্য, চারদিকে নিজের সুবাস ছড়িয়ে চলে এই ফুলটা।
– জ্বর কমেছে?
– আমি জানিনা,
মুখটা বাচ্চাদের মতো করে বলে রুহি,
ইরাদ এসে ওর কপালে হাত রেখে বলে,
– এটুকু সাধারণ জিনিস যদি বুঝতে না পারেন নিজে তাহলে কিভাবে হবে?
– অন্যদেরটা বুঝি তো।
চোখ বড় বড় করে রুহি বলে
ইরাদ হেসে দেয়।
– আলহামদুলিল্লাহ জ্বর কমে গেছে।
এখন ফ্রেশ হয়ে আসেন খাবেন।
– হ্যাঁ, আপনি জুসটা শেষ করতে থাকেন আমি আসছি।
বলে রুহি হেসে উঠে যায় আস্তে আস্তে।

-রুহি শুনুন
রুহি মাথায় হাত খোপা করতে করতে উত্তর দেয়
– জ্বি, আপনার জন্য এটা।
রুহির হাতে একটা প্যাকেট দেয় ইরাদ।
-এটা কি?
– দেখেন খুলে
রুহি ব্যাগটা খুলে দেখে খুব সুন্দর একটা লাল শাড়ী।
-ওয়াও শাড়ী? আমার জন্য?
বাচ্চাদের মতো রুহির রিয়েকশন দেখে ইরাদ খুব ইঞ্জয় করে।
– হুম আপনার জন্য।
– আমার কাছে লাল খুব ভালো লাগে জানেন?
– উহুম জানতাম না আজকে জানলাম
– থ্যাংক ইউ সো মাচ
রুহি হাতিয়ে দেখলো সাথে ব্লাউজ আর পেটিকোট এবং সেফটি পিন ও আছে ব্যাগে।
রুহি বাথরুমে চলে গেলো
ভাবছে ছেলেটা আসলেই সব দিকে খেয়াল রাখে। এবং সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ব্লাউজটা রুহির একদম ফিট হয়েছে।

রুহি গোসল করে নিলো। জর্জেটের লাল শাড়ীটা পড়েছে কানে গলার একটা ডায়মন্ডের সেট ছিলো সেটা পড়া আছে। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক পড়েছে ও।
বেশ দেখাচ্ছে রুহিকে যেনো কোনো অপ্সরাও হার মানবে ওর রূপের কাছে।

ইরাদ রুহিকে দেখে চোখ নামাতে পারছে না, এমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজকে ওকে। মেয়েটা এতোটা মায়াবী হতে পারে লাল শাড়ী পরলে। ইরাদ তা কোনোদিন ভাবতেও পারে নি।
নাস্তা খাওয়া শেষে ইরাদ রুহিকে বলে,
– শরীর ভালো লাগছে একটু?
– জ্বী একটু ভালো
– আপনি বাসায় যাবেন?
রুহির চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
– এখন?
– না এখন না শরীরটা ভালো লাগলে আপনার বাসায় নাহয় দিতে আসতাম। পরিবারের সাথে থাকলে একটু ভালো লাগতো। এই সময় মায়ের কাছে থাকলে ভালো লাগবে।
– আমার আম্মু নেই। কথাটা বলে রুহির চোখ গুলো পানিতে টলমল করছে
ইরাদের খারাপ লাগলো কথাটা এভাবে বলায়।
– আই এম সো সরি।
– ইটস ওকে। আমরা ঢাকাই যাই। চলুন
– ওখানে আপনি একা থাকেন না?
– হুম আমি আর কেয়ারটেকার আন্টি, উনি এখন ছুটিতে উনার ছেলের বিয়ে।
রুহি উঠে কাপড় গুলো গুছানো শুরু করে।
ইরাদ চায়নি এভাবে মেয়েটার মন খারাপ করে দিতে তাই সে নিজে থেকেই বলে
– রুহি, আমরা আপনার সুস্থ লাগলে ব্যাক করবো,দরকার পড়লে সন্ধ্যায় যাবো। এখনি যাওয়া লাগবে না। আর তা ছাড়া শহরটা তো ঘুরেই দেখা হলো না। যাবেন? আজকে ঘুরতে?
রুহি একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
– হুম যাবো
-আচ্ছা আপনি কতোদিনের ছুটি নিয়েছেন?
– এই সপ্তাহ পুরোটা।
– জানলেন কি করে?
– নাদিম ভাইয়াকে যখন বলছিলেন তখনই শুনেছিলাম
– আমারো ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস নেই তাই সমস্যা হচ্ছে না।
– হ্যাঁ আসলেই
-চলুন তাহলে।
-ওকে
ইরাদ চেঞ্জ করে একটা হোয়াইট শার্ট পড়ে স্লিভস ফোল্ড করে নিলো। চোখে সানগ্লাস একদম সুদর্শন দেখাচ্ছে ওকে। রুহি আর ইরাদ যখন রেসোর্ট থেকে বের হচ্ছিলো তখন সবাই ফিরে ফিরে ওদের দিকে দেখছিলো। কি অসম্ভব সুন্দর একটা কাপল ওরা।
দেখলে যে কারোর ইচ্ছা করবে ওদের দেখতেই থাকতে।

রুহি আর ইরাদ গাড়িতে বসে আছে, কেউ কিছু বলছে না এমন সময় রুহি নিজে থেকেই গান ছেড়ে দিলো,

আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে (২)
সেই অঙ্গীকারের রাখী পরিয়ে দিতে
কিছু সময় রেখো তোমার হাতে।

কিছু স্বপ্নে দেখা, কিছু গল্পে শোনা
ছিলো কল্পনা জাল এই প্রাণে বোনা (২)
তার অনুরাগের রাঙা তুলির ছোঁয়া
নাও বুলিয়ে নয়ন পাতে।

আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে।

তুমি ভাসাও আমায় এই চলার স্রোতে
চির সাথী হয়ে রইব পথে। (২)

তাই যা দেখি আজ সবই ভালো লাগে
এই নতুন গানের সুরে ছন্দ রাগে (২)
কেন দিনের আলোর মতো সহজ হয়ে
এলে আমার গহন রাতে।

আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে
সেই অঙ্গীকারের রাখী পরিয়ে দিতে
কিছু সময় রেখো তোমার হাতে।

আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে।

গানটা চলছে রুহি নিজের ডায়েরিতে কি যেনো লিখছে একদম আশার সময়ের মতো আজকেও। ইরাদ ওকে দেখছে আড় চোখে, একটা নতুন প্রেমের জন্ম নিয়েছে ইরাদের মনে, যা ধীরে ধীরে বুঝার আগেই হয়তো বা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

(চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here