অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -০৫+৬

#অনুভূতির_অন্তরালে❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৫

রাত গভীর। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। গভীর ঘুমে ব্যস্ত সকলে। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমিও ঘুমাচ্ছি। ডাক্তারের দেওয়া মেডিসিনের সাথে ঘুমের ওষুধও ছিলো।
মাঝরাতে আমার রুমে প্রবেশ করলো কেউ। খোলা দরজা আরেকটু ভিড়িয়ে দিলো সে। দরজার আওয়াজ এইটু কানে এলো আমার। পরক্ষণেই তার পায়ের শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সে। বসলো আমার পাশে। আমার শক্তিহীন নিস্তেজ হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। ভেতরের ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠলো। কিন্তু চোখ খুলতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে হাতটা ধরে ছিল। একসময় ব্যান্ডেজ করা হাতটায় ফোঁটা ফোঁটা পানিতে ভিজে উঠলো। অস্তির হয়ে উঠলাম আমি। বরাবরের মতো এবারও চোখ খুলতে ব্যর্থ হলাম আমি। কিছুটা ঝুঁকলো আমার দিকে। তার শরীরের উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস আমার চোখ মুখে আঁচড়ে পড়ছে। ভয়ে শরীরের গরম তাপমাত্রা উধাও হয়ে ঠান্ডা হতে লাগল।
গভীর ভাবে আমার ললাটে অধর ছুয়ে দিল অপর পাশের মানুষটি। এবার চোখের পাতার উপরে গড়িয়ে পড়ল অম্বু ধারা। কিছুটা কেঁপে উঠলাম আমি। পিঠের নিচে হাত রেখে কিছুটা শূন্যতায় ভাসিয়ে নিল আমায়। জড়িয়ে নিল তার বাহুডোর। কৌতূহল থেকে গেল আমার। এই মানুষটি আমার অপরিচিত নয়। আমার কাছে এবং আমার পরিচিত একজন মানুষ। অসহায় কাতর কন্ঠে বলছে..

— “এই তরী-রানী ব্যাথা করছে বেশি। কষ্ট হচ্ছে। আমার উপরে রাগ করেছ?”

গলায় সর্বশক্তি দিয়ে কেউ হাত দিয়ে চেপে রেখেছে। কিছুতেই আওয়াজ বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে বিরবির করে মৃদু শব্দে বললাম..– “ক-কে আ -আপনি?”

কথাগুলো হয়তো তার কর্ণপথে গিয়েছে। ধীরে ধীরে বেডের উপর পূর্বের জায়গায় শুইয়ে দিলো আমায়। ফেলে রাখা ব্লাঙ্কেট টা তুলে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিল। আবার একবার অধর ছুয়ে দিল আমার ললাটে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল..

— “তুমি ধীরে ধীরে জেগে যাচ্ছো? এখন আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। আজ আসি।”

তার হাতের মুঠোয় থাকা আমার হাত ছেড়ে দিলেন তিনি। শব্দহীন পায়ে বেরিয়ে গেলেন। সাথে সাথে উঠে বসলাম আমি। অবলোকন করলাম দরজার দিকে। দরজা বিড়িয়ে রাখা। মৃদু আলো আঁচড়ে পড়ছে দরজার ফাঁক দিয়ে। ক্ষান্ত হলাম না আমি। এক লাফে উঠে বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। সব আমার মনের ভুল। বারবার মনে হলো কেউ একজন ছিল। কিন্তু কেউ নেই।

_____________
পায়ে তোড়া, হাতের বালা, থাকে যদি সিটি গোল্ডের চেইন, দিয়ে যাবেন…
তাতে সমান সমান তোমরা বাদাম পাবেন। হুউউউউউ,,
বাদাম বাদাম দাদা কাঁচা বাদাম। আমার কাছে নাইতো বুবু ভাজা বাদাম।
আমরা কাছে পাবে শুধু কাঁচা… বাদাম

মনের আনন্দে কাঁচা বাদাম গান গাইছি। গানের তালে তালে হাত নাড়াচ্ছি, পা দুলিয়ে চলেছি। তদানীং মধ্য বয়স্ক লোকের ডাকে ধ্যান ভাঙল। তবে সেই কন্ঠস্বর অস্পষ্ট আমার কাছে। চোখ খুলে তাকালাম আমি। সাথে একশত আশি ডিগ্রী শক খেলাম। আমাকে ভীড় করে আশেপাশে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কান থেকে ইয়ার ফোন খুলে নিলাম। চোখ খুলতেই হামলে পড়লেন তারা। একজন বললেন..

— “খালা আমাকে এক কেজি বাদাম দিন-তো?”

আরো একবার প্রচন্ড শক খেলাম আমি। আমি বাদামের গান গাইছি বলে বাদাম নিতে চলে এলো। আবার খালাও ডাকছে। মুহুর্তেই মনে প্রশ্ন জাগল, আচ্ছা আমি কি দেখতে খালাদের মতো। ফ্রেন্ডরা আমাকে ভালোবেসে কিউটি বলে ডাকে। যাক মেনে নিলাম আমি খালাদের মতো। কিন্তু এটা ভার্সিটি, বাদাম বিক্রি করার জায়গা নয়। সেখানেও চলে এসেছে। আমাকে অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিলো আরেকজন। একটা আস্ত নোট বের করে এগিয়ে দিলো আমার দিকে। বললেন..

— “ভালো ভালো দেখে তিন কেজি বাদাম দাও তো বাবু!”

একবার বাবু তো আরেকবার খালা। হচ্ছেটা কি, বুঝতে পারলাম না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম..

— “আমাকে দেখে আপনার বাদাম বিক্রেতা মনে হচ্ছে। দেখতে পারছেন না আমার কাঁধে ব্যাগ রয়েছে। না-কি সেটা চোখে পড়ছে না।”

— “তুমি তো বাদামের ডালাও নিয়ে বসেছো? তাহলে বুঝবো কিভাবে, তুমি বাদাম ওয়ালী নাকি ভার্সিটির শিক্ষার্থী।”

লোকটা আমার সামনে রক্ষিত বাদামের ডালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন। সাথে সাথে দৃষ্টি গেল সেদিকে। ঘনঘন পলক ফেলে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এখানে বাদামের ডালা এলো কিভাবে? অনেক কষ্টে তাদের এখান থেকে বিদেয় করলাম। অতঃপর সবার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলাম। নাক ফুলিয়ে বললাম..
— এখানে বাদামের ডালা এলো কোথা থেকে? তোরা আবার ফাজলামো শুরু করে দিয়েছিস?

নিলয় এগিয়ে এলো আমার দিকে। সাথে সাথে সরু চোখে তাকাতেই পিছিয়ে গেল কয়েকপা। আমতা আমতা করে বলল.. — “বিশ্বাস কর, দোস্ত এখানে কিভাবে এলো বুঝতে পারছি না। তবে তোর গান গাওয়ার ফাঁকে একটা পিচ্চি ছেলে এসেছিলো। তারপরে ধীরে ধীরে ভিড় জমে গেছে।”

এদের কথার মাঝেই আমার দৃষ্টি গেল দুতলায় অরিশ ভাইয়ার কক্ষের দিকে। তিনি তার হাত ভাঁজ করে রেলিং এ রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের কোণে মিষ্টি বাঁকা হাঁসি। আবার সিউর হলাম, এটা এই মানুষটির কাজ। দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম..

— “এই বিলাতি ইঁদুরের বাচ্চাকে যদি আমি শিক্ষা না দিয়েছি, তাহলে আমার নাম বাদাম ওয়ালা নয়..
আমার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সকলে। যখন বুঝতে পারলাম ভুল বলে ফেলেছি‌। তখন নাক ঘসতে ঘসতে বললাম.. — তরিন নয়!”

— “বইন, বিলাতি ইঁদুরের বাচ্চা অরিশ ভাইয়া না, আগামী প্রজন্মে চোর পেটের ভেতরে বেড়ে উঠবে।”

পুনরায় আড্ডায় মেতে উঠলাম আমরা। আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হলেন দত্বরী আঙ্কেল। ব্যাঘাত ঘটলো আমাদের আড্ডা-মহলে। অরিশ ভাইয়া তাকে পাঠিয়েছে। আমাকে তার সাথে দেখা করতে বলেছে। প্রথমে যেতে রাজি হইনি, পরে ওদের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়ে গেলাম।
একমনে কিছু একটা লেখে চলেছেন তিনি। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি দরজার কাছে। দরজা খোলা তবুও হাত বাড়িয়ে নক করলাম। এর আগেও অনেকবার ভাইয়ার কক্ষে এসেছিলাম। কখনো নক করা হয়নি। তিনি চোখ তুলে অবলোকন করলো আমার দিকে। অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি। পুনরায় তাঁর দিয়ে দৃষ্টিপাত করে দেখতে পেলাম তিনি নিজের মনে কাজ করে চলেছে। তাই গলা খাঁকারি দিয়ে বলল..– “মে আই কামিং স্যার..

— “হম।”

মৃদু শব্দে বললেও কান পর্যন্ত পৌঁছালো আমার। হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বললাম..– “স্যার ডেকেছিলেন আমায়?”

এবার উঠে দাঁড়ালো সে। এগিয়ে এলো আমার দিকে। ভ্রু কুঁচকে বলল..– “আমি না ডাকলে তুমি কি এখানে আসতে?”

আচ্ছা এই ছেলেটা কি কখনো ভালোভাবে কথা বলতে পারে না। না-কি জন্মের পরে মামুনি মধু দেওয়ার বদলে তিত করল্লা রস খাইয়ে দিলো। নাক ফুলিয়ে বললাম..
— “তা কেন ডেকে ছিলেন? যদি দয়া করে বলিতেন স্যার?”

একটা টিফিন ক্যারিয়ার বের করলেন তিনি। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “ফিনিশ ইট!” আমি মুখ ঘুড়িয়ে নিলাম। ফিনিশ ইট বললেই খেতে হবে। খাবো না। আরেক কদম এগিয়ে এলেন আমার দিকে। ব্যান্ডেজ করা হাতটা মুঠোয় চেপে ধরলেন। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলাম আমি। দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নয়ন যুগল থেকে। আমার কষ্টে বোধহয় তার কিছু যায় আসে না। আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। রক্তের ধারায় ভিজে উঠলো আমার মোটা ব্যান্ডেজ। তবুও ছাড়ল না তিনি। ব্যাথাটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছালে চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম। এতেও কাজ হলো না। আমিও চোখ মুখ খিঁচে সহ্য করার চেষ্টা চালালাম কিছুক্ষণ।

ছেড়ে দিলেন আমার হাত। পিছিয়ে গেলাম কয়েকপা। নিজের হাত গিয়ে ঠেকেছে অন্য হাতের ব্যান্ডেজের উপর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম..

— “আপনি কখনো কারো সাথে ভালো ব্যবহার করতে পারেন না। কেন বারবার আমাকে আঘাত করতে আসেন?”

— “এখনো খারাপ ব্যবহারের কিছুই করি নি। এবার করবো।”

বলেই কিছু একটা ছুঁড়ে মারলেন আমার শরীরের উপর। চিৎকার করে আরো দু’পা পিছিয়ে গেলাম আমি। তেলাপোকা দেখে রীতিমত আমার প্রান যায় যায় অবস্থা। এক লাফে উঠে দাঁড়ালাম তার টেবিলের উপর। টেবিলের উপর ক্রমাগত দৌড় ঝাঁপ করে চলেছি। জিনিস পত্র গুলো নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে আর আমি ভয়ে ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছি। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে। ইনোসেন্স ফেইস করে বললাম..

— “আমি খাবো, প-প্লীজ তেলাপোকা টা সরিয়ে দিন।”

তিনি এবার তেলাপোকা-টা সরিয়ে নিলেন। নিজে চেয়ারে গিয়ে বসলো। সাথে সাথে ভাব দেখিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। কিন্তু মাঝ পথেই তিনি তেলাপোকা বলে চিৎকার দিলো।‌ ভয়ে এক লাফে তার কোলে গিয়ে বসে পড়লাম। দুহাতে জড়িয়ে ধরে একদম শিটে গেলাম তার বুকের সাথে। তবুও তার সাথে কথা বলবো না, হমম।
#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥 (ধামাকা_এপি-.০১)
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৬

রক্তের ছড়াছড়ি। ভার্সিটির সামনের রাস্তার মোড়ে ভাংচুর চলছে। ঈগল গ্যাং এর লোকেরা মারছে। ভার্সিটির প্রবেশদ্বার বন্ধ রাখা হয়েছে। যাতে কেউ ভেতরে কিংবা বাইরে যেতে না পারে। সকলের মনে ভয়ের আতংক ছড়িয়ে আছে। তবে আরশির মনে লাড্ডু ফুটছে। নিজের চোখে সবকিছু দর্শন করার প্রবল ইচ্ছে তার। টিভিতে একটু আধটু দেখেছে। সামনাসামনি দেখা হয়নি তাকে। সকলে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ভিড় ঠেলে এক দৌড় বেড়িয়ে গেল আরশি। দারোয়ানকে সরিয়ে প্রবেশদ্বার বেড়ে চলে গেল বাইরে। পেছন থেকে প্রফেসরস, দাড়োয়ান, তার বন্ধুরা ডাকল। শুনলো না সে। দৌড়াতে দৌড়াতে পৌঁছে গেল সেখানে।

পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে ঈগল গ্যাং এর মেইন লিডার অপূর্ব আহসান। তাকে ঘিরে আছে বড় বড় লম্বা লম্বা লোকজন। হয়তো গ্যাং স্টার একেই বলে। সামনেই রক্ত পড়ে আছে। হয়তো একটু আগে মারামারি হয়েছিল। মন খারাপ হয়ে এলো আরশির। আরেকটু আগে এলে ডিসুম ডিসুম মারামারি দেখতে পারত। রিয়েল লাইফের মারামারি। তার ভাবনার মাঝেই অপূর্ব উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। পেছনে সারিবদ্ধ কয়েকটি গাড়ি। প্রথমটার দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। সাথে সাথে ভাবনার ছেদ ঘটল আরশি। হাঁটুতে ভর দিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বলল..

— “এই এই এই মিস্টার গ্যাং স্টার।”

পেছনে ফিরল অপূর্ব। চোখ মুখে বিরক্তিকর আভা ছড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকালো সে। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। পড়নের ব্লু কার্লার জিন্স। গায়ে লং টপস। পিঠে একটা ব্যাগ। গলার ওরনাটা এলোমেলো হয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ফর্সা শরীরে ঘাম গুলো মুক্তার মতো লাগছে তার কাছে। একদম সাজগোজ বিহীন রমনী। পাশের দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক বলতে শুরু করল..– “এই মেয়ে জীবনে ভয় ডর নেই তোমার? বাঁচতে চাইলে যাও এখান থেকে।”

এতে আরশির ভেতরে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। সে এগিয়ে এলো কয়েকপা। মোহনীয় চোখে তাকিয়ে রইলো অপূর্বে দিকে। নীল রঙের শার্টের সামনের দুটো বোতাম খোলা। যার ফলস্রুতিস্বরূপ বুকের বেশ খানিকটা উন্নুক্ত হয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে ফর্সা লোমহীন বুক। পড়নের জিন্সটায় একটা ভাঁজো নেই। চোখে নীল সান গ্লাস। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে পুরো মুখ ঢাকা। অধর জোড়া গোলাপি রঙের। যেন কোনো লিপ বাম ব্যবহার করেছে। নয়নজোড়া নীলাভ রঙের। কপালের উপরে বাম পাশে ছোট একটা লালচে তিল। লালচে কি-না জানা নেই, তবে রোদে জ্বলজ্বল করছে। অধর যুগল নাড়িয়ে মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলো ..
— “শুভ্র-নীল কুমার।”
— “কী?”
— “হাই, আমি আরশি। আপনার বিগ, বিগ, বিগ পাংখা। না-মানে ফ্যান। আপনি জানেন, আপনার মারামারি আমার এতো পছন্দ হয়। ”
হাত এগিয়ে দিলো অপূর্বের দিকে। অপূর্ব হাত মেলানো না। লজ্জায় পড়লো আরশি। হাত গুটিয়ে নিল সে। আমতা আমতা করে বলল..

— “আমাকে মারপিট শেখাবেন? আমিও আপনার মতো গ্যাং স্টার হতে চাই।”

— মেয়েদের জন্য রাজনীতি নয়, রান্না বান্না তাদের একমাত্র কাজ।

সাথে সাথে দাঁত কেলিয়ে আরশি বলল.. — “আমাকে বানাবেন? আমি রান্না করতে চাই!”
সাথে সাথে জিভ কাটলো আরশি। নিজের মাথায় একটা চপল মেরে বিরবির করে বলল..
— “আরু তুইও না? তুই কেন রাঁধুনী হবি? তুই তো গ্যাং স্টারের বউ হবি। তোদের অফিসে এতো লোক কাজ করবে আর তুই কি-না আরেকজনের বাড়িতে রাঁধুনীর কাজ করবি! ছাগল একটা।
বলছিলাম কি, বিয়ে করবেন আমায়। আমি রান্না শিখে নিবো। তবুও আমাকে রিজেক্ট কইরেন না।”

অধর বাঁকিয়ে হাসলো অপুর্ব। তার সামনে কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর পুচকি একটা মেয়ে বড় বড় কথা বলছে। করতালি দিলো সে। সান গ্লাসটা খুলে গার্ডের হাতে দিয়ে এগিয়ে গেল আরশির দিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল..
— “পাগলেও নিজের ভালোটা বুঝে। আর তুমি একজন মানুষ হয়ে বুঝতে পারছো না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো? তোমার জায়গায় একটা ছেলে থাকলে তার অবস্থা কি করতাম আমি, সেটা কেউ ধারণাও করতে পারত না।”

— “আরে গ্যাং স্টার, ছেলেরা কেন আপনাকে বিয়ে করতে চাইবে। কিসব বলছেন আপনি?”

তিনি আরশিকে কিছু বলতে নিয়ে থেমে গেলেন। আরশির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি আরশির পিছুপিছুই এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। বিনা বাক্যে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। মুখোমুখি দাঁড়ালেন সোজা হয়ে। গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কেন জানো তার চাওনীতে কোনো প্রকার অস্বস্তি খুঁজে পেলাম না। হাত উঠিয়ে আমার গাল স্পর্শ করতে চাইলেন। সাথে সাথে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম আমি। পরক্ষণেই গালে আস্তে আস্তে তিনটা চপল পড়লো। চোখ খুলে তাকালাম এবার। তিনি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! বললেন..

— “তোমার বোন হয় নিশ্চয়ই?”

মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম আমি। তিনি আবার বললেন..
— “ভালো মেয়ে, দেখতেও মাশাআল্লাহ। আমি চাইনা তার ক্ষতি হোক। বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাও!”

চপল মারা গালে হাত রাখলাম আমি। তিনি এবার আমার হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। মুহুর্তেই তার চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। দাঁতের সাথে দাঁতের সংঘর্ষ ঘটালেন। ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলেন..
— “হাতে কি হয়েছে?”
— “জানি না।”
— “তাহলে কি জানো তুমি?”
বলেই তিনি উল্টো হাঁটা দিলেন। তার ধমকে কেঁপে উঠলাম আমি। হঠাৎ তার রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে ব্যর্থ হলাম আমি। সকলে গাড়িতে উঠে একে একে চলে গেল। যাওয়ার আগে অপূর্ব নামক ছেলেটি আমার দিকে এক নজর তাকালো। তবে সেই চাওনির মানে আমার দ্বারা বোঝা সম্ভব হলো না। এগিয়ে গেলাম আরশির দিকে। সে কদাচিৎ হা করে জনশূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁধে হাত রাখতেই ফিরে তাকালো। সন্দিহান স্বরে বললাম..

— “আরু কে উনি?”

— “আরে এনাকে চিনিস না। অপূর্ব তার নাম। দেখতে যেমন অপূর্ব, মারামারিতেও অপূর্ব। আমার ক্রাশ, আমার জান, আমার শুভ্র-নীল কুমার।”

মুখ ভেংচি কাটলাম আমি। পাশ দিয়ে চলমান একটা রিক্সার দিকে নজর গেল। আরশিকে টেনে রিক্সায় তুলে ছুটলাম বাড়ির দিকে।

_________________
— “অরিশ, তোর সাহস হয় কি করে আমার খুকিকে বেত দিয়ে আঘাত করার। আমি তোর ভরসায় আমার কলিজাকে ওখানে রেখে এসেছি আর তুই তাকে মেরে রক্তাক্ত করেছিস। আমি তোর কাছে এটা আশা করি নি। আমি কালকেই আমার পুচকুকে নিজের কাছে নিয়ে আসবো।”

— ভাইয়া আমি ভূল করেছি। কিন্তু তুই যেভাবে ভাবছিস তেমন কিছু নয়।

ফোনে ওপাশের ব্যাক্তিটিকে বলল অরিশ। বিনিময়ে আরো বাজখাঁই গলায় বলল..

— “আমাকে তোর অবুঝ মনে হয় অরিশ। তুই ভালো করেই আমার ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত। আমি কখনো ভুল কিছু শুনি আর বলিও না।”

কিছুক্ষণ নিঃশব্দ রইলো দুজনের গলা। অতঃপর অরিশ বলতে শুরু করল..

— “তুই জানিস আমি পিচ্চিকে কতোটা ভালোবাসি। ও কারো সাথে কথা বললে, আমি সহ্য করতে পারি না। তাই রাগের বশে..

— রাগ ভালো অরিশ। কিন্তু আমার কলিজার সাথে নয়। তাহলে আমি সেই কাজটা করতে বাধ্য হবো, যেটা আমি কখনো করতে চাইনি। ওর আমার আর আমি ওর সবকিছু।

অরিশ বেশ বুঝতে পারল তরীকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। সাথে সাথে তার বুক মুচড়ে উঠলো। আমতা আমতা করে বলল..– “ভাইয়া আমি সব ঠিক করে নিবো। কিন্তু প্লীজ তুই আমার পিচ্চিকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাস না।”

— “এটাই তোর ফাস্ট অ্যান্ড লাস্ট সুযোগ। দুজনের মাঝখানের ব্যবধানটা মিটিয়ে নে। আর খেয়াল রাখিস ওর। আমি পিচ্চির কষ্ট সহ্য করতে পারব না।”

দরজা কাছ থেকে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি। অরিশ ভাইয়ার অস্পষ্ট কষ্ঠস্বর কানে আসতেই ফিরে তাকালাম। পরক্ষণেই তিনি ফোন রেখে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসার জন্য উদ্দেগ নিলাম। কিন্তু সক্ষম হলাম না। তার আগেই একটা শক্তপোক্ত হাত আমার হাত ধরে থামিয়ে দিল। এটা অরিশ ভাইয়া বুঝতে আমার সময় লাগলো না। আচম্চা তিনি আমাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলেন। শক্ত করে নিজের সাথে পেঁচিয়ে নিয়ে বললেন..

— “আ’ম স্যরি পিচ্চি। আমি তোকে খুব ব্যাথা দিয়েছি, কষ্ট দিয়েছি‌। তাই বলে আমার উপর রাগ করে আমাকে ছেড়ে যাস না। তোকে ছাড়া আমি নিঃস্ব, নিঃপ্রাণ।”

তার কথার আগা মাথা বুঝতে পারলাম না আমি। কৌতূহলী কন্ঠে বললাম..

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here