অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -০৭+৮

#অনুভূতির_অন্তরালে❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৭

— “ভাইয়া কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন? কোথায়ও যাচ্ছি না আমি। প্লীজ শান্ত হও। আমি আছি, তোমার খুব কাছাকাছি।”

অরিশ ভাইয়া মাথা তুলে আমার দিকে অবলোকন করলেন। নিজেকে সুশীল করার পরিবর্তে ভারসাম্য হীন আচরণ শুরু করে দিয়েছে। নিজের সাথে আরো ঘন করে পেঁচিয়ে নিলো আমায়। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে আসার উপক্রম হলো এবার। নিজের কাঁপা কাঁপা হাতটা অরিশ ভাইয়ার পিঠে রেখে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললাম..– “ভাইয়া প্লীজ ছাড়ো আমায়। অস্বস্তি লাগছে!”
আচম্বিতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন আমার। নিজের নিয়ন্ত্রণ করে ললাট কুঁচকে বলল..
— “আমি তোকে ছুঁলে তোর অস্বস্তি হয়। আর যখন তোর বন্ধু তোকে বাজে ভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করে তখন। তখন অস্বস্তি হয় না বুঝি। তোর বন্ধু তোকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছে, তুই কিছু বলিস নি। তাই রাগের বসে তোকে ওভাবে মেরেছি।”

বেশ চমকে দৃষ্টিপাত করলাম তার দিকে। থমকিয়ে বললাম..

— “কিসব বলছো তুমি? ও আমার বন্ধু হয়।”

— “কালকেই তোর সব বন্ধুদের সাথে ব্রেকআপ করে আসবি। আমি আরশিকেও বলে দিবো। মেয়ে ছাড়া কোনো ছেলের সাথে কথাও বলবি না। বুঝতে পারছিস।

মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম আমি। ভাইয়ার তার হাত আমার মাথায় রেখে অধর প্রসারিত করে মুচকি হাসলেন। মাতাল করা দৃঢ় সেই হাঁসি। বললেন..

— “পিচ্চি তুই কেন এতো অবুঝ বল তো? কেন বুঝতে পারিস না, তোকে অন্যকারো সংস্পর্শে দেখলে ভেতরটা পুড়ে যায়।”

আগা মাথা না ভেবেই ফট করে বলে ফেললাম..
— “ভালোবাসো আমায়, ভাইয়া?”

মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেল ততক্ষণাৎ। তিনি এগিয়ে এলেন আমার দিকে। চপল মারলেন মস্তিষ্কের অগ্ৰভাগে। ত্রুব্ধ লোচনে তাকিয়ে বললেন..

— “এইসব আজবুড়ি কথা বার্তা বাদ দিয়ে পড়তে বস। আমি একটু পর পড়াতে আসছি। যা..

শেষ উক্তিটা কঠোর স্বরে উচ্চারণ করলেন তিনি। আমি এক ছুটে রুম প্রস্থান করলাম। এই ছেলেটা কখনো সহজ সরল এবং সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারে না।

__________
— “ঋনী, আজকে থেকে বাড়ির সকল রান্না তুই করবি! আমি পাশের বাড়ির তমাকে বলেছি আসতে, সে এসে তোকে রান্না শিখিয়ে যাবে কিছুদিন।”

প্রাতঃকালে মামুনি এমন কথায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম আমি। যিনি কখনো আমাকে কিচেনে ঢুকতে দেয় নি, তিনি বলছেন রান্না করতে। ব্যাপারটা অদ্ভুত তাই না। আমি আমতা আমতা করে বললাম..

— “মামুনি রান্না করলে ভার্সিটিতে যাবো কখন? পড়াশোনাই বা করব কখন?”

তিনি আমার কথনগুলো শ্রবণপথে নিলেন না। কিছুটা পাল্টা স্বরে বলতে শুরু করলেন..– “বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা করবি। তাছাড়া পড়াশোনা করে কি হবে, সেই তো অন্যর কপাল পোড়াবি।”

তীরে ন্যায় বক্ষে এসে লাগলো কথাটা। নয়নে সীমাবদ্ধ রইলো অম্বু ধারা। বিশ্বাস হচ্ছে না মামুনি আমাকে এইসব বলছেন। নত কন্ঠে বললাম, আমার কোনো সমস্যা হবে না।
আমাদের কথার মাঝেই এসে উপস্থিত হলেন দিদা। ফোড়ন কেটে বলল..

— “সমস্যা হলেও তোকে এই কাজ করতে হবে। জন্মের সময় তো নিজের মাকে খেলি, বাবার ব্যবসা লাটে তুলে দিলি। ভাইটাকে..! অন্তত তোর মতো অপয়া অলক্ষী দিয়ে ঘরের কাজ করাই যেতে পারে।”

ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল হৃদয়টা। দৃষ্টি সরিয়ে মামুনির দিকে অবলোকন করলাম। অন্তত তিনি কি বলবেন। কিন্তু আমার ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে কিছু বললেন না। হয়তো আমারই আশা করাটা অন্যায় দিলো। দিদা থামতেই মামুনি মুখ খুললেন..– “ঋনী আজকের পর থেকে তুই অরিশের ঘরে যাওয়া তো দূরের কথা, কথাও যাতে বলতে না দেখি! প্রয়োজনে কাল থেকে নতুন একাডেমিতে ভর্তি করে দিবো। কিন্তু অরিশের কাছে নয়।”

চলে গেলেন তারা। স্তব্ধ হয়ে তাদের গমন পথের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলাম। কোনো বাক্য অবশিষ্ট নেই আমার কাছে। আমি যখন এই পৃথিবীতে সবে এসেছি। সদ্য জন্ম নেওয়া একটা ফুটফুটে মেয়ে। আমার আসাতে কেউ খুশি হয়নি। বরং একরাশ অন্ধকার নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছিলাম। জন্মের সময় আমার মা চলে গেলেন। বাবা আগলে নিয়েছিলেন আমায়। আমার নামে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু কিছু বছরের মাথায় ব্যবসায় লোকসান হয়। বাবা আমার আর ভাইয়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আবার দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ভালোই চলছিলো কিছুদিন। কিছুটা বড় হয়ে উঠলাম আমি। নিজের মা বলতে তাকেই চিনতাম। ধীরে ধীরে আমার সৎ ভাইয়ের আগমন ঘটে। পাল্টে যেতে থাকে তার ব্যবহার। সেদিন ছিল মায়ের ৯ম মৃত্যু বার্ষিকী আর আমার ৯ম জন্মদিন। মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে বেশ কয়েকটি মসজিদে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। বাবা আর ভাইয়া বাইরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। স্কুল থেকে ফিরে রুমে গিয়ে দেখতে পেলাম, আমার সৎ মা আলমারি থেকে মায়ের জন্য রাখা টাকা চুরি করছে। তবুও চুপ করে ছিলাম। বাড়িতে ফিরলেন বাবা। টাকার কথা জিজ্ঞাসা করলে অস্বীকার করেন তিনি। বলেন, তিনি কিছু জানেন না। বাড়িতে আমি আর ভাইয়া ছিলাম। বাবা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সব সামলালেন। বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি মিথ্যা বললেন। তিনি নিঃশব্দে চলে গেলেন। বাবা বাড়িতে ফিরলেন। সৎ মা বাবাকে বললেন, আমরা মায়ের জন্য রাখা টাকা চুরি করেছি।
সৎ মায়ের প্ররোচনায় সেদিন মারলেন আমাকে আর ভাইয়াকে। মুচকি হেসেছিলেন তিনি। সেদিন দাড়োয়ান চাচা মামাকে ফোন করে জানিয়েছেন সবটা। সাথে সাথে মামা গিয়ে আমাদের সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলেন। ধীরে ধীরে কাঁটতে লাগল সময়। ভাইয়া নিজের পড়াশোনা শুরু করলেন। কিছুদিন পরে চলে গেলেন দূরে‌। একসময় হার্ট সার্জন হয়ে গেলেন। কিন্তু ফিরলেন না। ফোন করলে কথা হয়, আমার প্রয়োজনীয় কিছু পাঠিয়ে দেয়, তবে দেখা হয়নি। জানি না কখনো দেখা হবে কি-না। তবে সেদিনের পর থেকে ভাইয়ার সাথে দেখা যায় নি।

___________________
ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। আমি আর আরশি পাশাপাশি বসে বই পড়ছি শান্তমনে। এখনো মামনির কথাটা বাড়ির কাউকে জানাই নি। বই পড়ছি বললে ভুল হবে। শুধুমাত্র বইয়ের পাতা নড়াচড়া করছি।
কোনো এক ছেলে ভুল করে আরশির বিকাশ একাউন্টে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন আর আরশি এই নিয়ে ১৫ বার একই কথা বলেছে। আমি গালে হাতে দিয়ে শুনে চলেছি। কানের অবস্থা শৌচনীয়। আরশির কথার ব্যাঘাত ঘটলো ফোনের রিংটোন বাজাতে। আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে ফোন রিসিভ করলো সে। অর্থাৎ অপরিচিত সেই ছেলেটি ফোন করেছে।

— “আসসালামু আলাইকুম অরমাতুল্লাহি অবারাকাতু আপু। আপনার বিকাশ একাউন্টে ভুল বশত পাঁচ হাজার টাকা চলে গেছে। যদি সেটা ফেরত দিতেন?”

আরশি ডাগর ডাগর আঁখি জোড়া দিয়ে আমার দিকে তাকালো। শ্রবণেন্দ্রিয় থেকে ফোন সরিয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। বিরবির করে বলল..

–” বইন, এর গলাটা পরিচিত লাগছে‌। আগের পোলা এটা না। স্পিকারে দিচ্ছে, দেখ তো চিনোস কি-না?”

স্পিকারে দিল আরশি। আমিও গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম কন্ঠস্বর।

— “ওয়া আলাইকুমুস সালাম অরমাতুল্লাহি অবারাকাতু। ভাইয়া ভলুবশত হোক, আর যাই হোক। টাকা যেহুতু আমার বিকাশে এসেছে তাই ফিরত যাচ্ছে না। ইটস্ ফাইনাল।”

এতোক্ষণ অপরপাশের লোকটার স্বাভাবিক কন্ঠস্বর শোনা গেলেও এবার গেল না। ত্রুব্ধ হলো সে। কটমট আওয়াজ করে বলল..

— “হ্যালো মিস্, আপনি জানেন না আপনি কার সাথে কথায় বলছেন? আমি গ্যাং স্টার অপূর্ব আহসান বলছি। আমার এক টাকা আত্মসাৎ করার ক্ষমতা কারো নেই, সেখানে এতো গুলো টাকা।”

মুহুর্তেই আরশি মুখে হাঁসির দেখে মিললো। আসন দিয়ে দু’পা ভাঁজ করে বসলো। বালিশে শরীর হেলিয়ে দিয়ে বলল..

— “আমি তো তোমার নিজের জানেমান। আমি কেন আত্মসাৎ করব। ভালোবাসার টানে টাকা আমার কাছে চলে এসেছে।”

— “কিসব আবোল তাবোল বকছেন আপনি? দেখুন,ভালোয় ভালোয় বলছি টাকা ফেরত দিন। নাহলে..

অপর পাশের মানুষটির কথা কেড়ে নিয়ে আরশি..
— “নাহলে কি জানেমান। তুলে নিয়ে বিয়ে করে নিবে‌। আমি একপায়ে রাজি! ধ্যাত, আপনাকে তো আমার পরিচয় দেওয়া হলো না। আমি আরশি।”

বলেই ,হাসিতে ফেটে পড়লো আরশি। দুবার উচ্চারণ করলো অপূর্ব, আর-শি, আর-শি। পরক্ষণেই শব্দময় উচ্চারণ করলো..– “আরশি নাকি আর-সি। কোন আরসি বলুন তো? কোকা কোলা না-কি মোজো?”

সাথে সাথে রাগে ফেটে পড়লো আরশি। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল.. — “আমার নাম আরশি। কান খুলে শুনে রাখুন, আর-শি। কালকে দুপুরে ভার্সিটির মোড়ে যে দেখা হলো। ভুলে গেছেন?”

পরের কথাটা বেশ মিষ্টি সুরে বলল আরশি। ওপাশের লোকটা এবার নড়েচড়ে উঠলো। স্মিত হেসে বলল..

— “তুমি!
আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, তুমি ছাড়া কেউ এভাবে কথা বলে না। টাকাটা বরং তোমার কাছেই রেখে দাও। বাই,,

কেটে দিল ফোন। মন খারাপ হয়ে গেল আরশির। কেন কল কেটে দিল। তাতে কি কন্টাক্ট নম্বর তো আছে, সারাদিন ফোন করে বিরক্ত করা যাবে। ভেবেই রহস্যময়ী হাসলো আরশি।
#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৮

ভূত! নামটা শুনলেই ভেতরে একটা ভয়ংকর অনুভুতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু বিজ্ঞানে তার কোনো ব্যাখা আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বর্তমান এবং অতীতে মানব সমাজের কুসংস্কার হিসেবে বিশ্বাস করে। বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখা না থাকলেও শিক্ষিত হয়েও ভূতকে বিশ্বাস করা আমি। অরিশ ভাইয়ার কাছ থেকে এর যুক্তিসংগত ব্যাখা পাই নি। তার একটাই কথা ভূত ভুতকে দেখে। আমি ভূত তাই ভূতকে দেখি। তাই ভূতের ব্যাখা দিতে আজ ভূত রুপে ভাইয়ার কক্ষে আবির্ভূত হবো আমি। উজ্জ্বল সাদা রঙের শাড়ি, মোটা এবং এলোমেলো সাজগোজ। দেখতে পাক্কা ভূত। চামড়া গুলো কসমেটিক ব্যবহার করে কুঁচকে নিয়েছি। শাড়ির আঁচলটা মাটি পর্যন্ত মিশে গেছে। আরশিকে ধোঁয়া ওঠার দায়িত্ব দিয়েছি। তবে আজও আমি জানি না, ভূতরা কেন শাড়ি বস্ত্র পরিধান করে। অন্য কোনো রং কি তাদের অপছন্দ।

গভীর রাত। চারদিকে অন্ধকার বিরাজমান। ল্যাপটপের আলোয় অরিশ ভাইয়ার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি শান্তমনে ল্যাপটপে কাজ করে চলেছে। পূর্বেই বেলকেনিতে লুকিয়ে ছিলাম আমরা। আরশি ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। ধীরে ধীরে ধোঁয়াশা হয়ে এলো কক্ষ। অরিশ ভাইয়া কেশে উঠলো। হাত দিয়ে নাড়িয়ে চশমার কাঁচ পরিস্কার করলেন। বললেন ..– “রুমের তার সার্কিটে সমস্যা হলো নাকি?”
উঠে দাঁড়ানোর পূর্ব মুহুর্তে অগোছালো চুলগুলো আরো অগোছালো করে টেনে টেনে এগিয়ে গেলাম ভেতরে। ফোকলা দাঁতের অদ্ভুত ঘর্ষণ দিয়ে টেনে টেনে অস্পষ্ট স্বরে বললাম..– “অরিশ..! তুই নাকি বিশ্বাস করিস না আমি এই পৃথিবীতে আছি। তাই তোকে আমার উপস্থিতি জানান দিতে এসেছি।”

বিনিময়ে দু’পা পিছিয়ে গেল ভাইয়া। চোখ থেকে চশমা খুলে চোখ পরিষ্কার করে পুনরায় পড়ে নিল। তার দৃষ্টি ভুল নয়। ভ্রু কুঁচকে বলল..– “আবে কে তুই!”

বিরাগী হয়ে উঠলাম আমি। আরশি তো বলল, আমাকে পাক্কা ভূত লাগছে। তাহলে এই ছেলে আমাকে দেখে কেন ভয় পাচ্ছে না। ভুতুড়ে আওয়াজ তৈরি করে বলল..– “আমাকে চিনতে পারছিস না অরিশ, আমি তোর দাদা, তার দাদার, তার দাদার, তার দাদার ফুফাতো বোন।”

ভয় পাওয়ার বদলে স্মিত হাঁসলো অরিশ ভাইয়া।‌ তার মুঠো ফোনটা খুজে নিয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে পরপর কয়েকটা ছবি তুলে নিল। স্ক্রিনে তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল..

— “আমি আর দাদুর দাদু, তার দাদু, তার দাদু, তার দাদুর ফুফাতো বোনকে দেখি নি। আমার বিশ্বাস বাবাও দেখে নি। কালকে এই ছবিগুলো দেখাবো।”

ভরকে গেলাম আমি। কি বলে এইসব। ভুতের ছবি তুলে বলছে, সবাইকে দেখাবে। নাক ছিঁচকে বললাম..
— “আমি ভূত!”

— “আপনি বলেছেন, আমি শুনতে পেয়েছি। ধন্যবাদ আপনাকে। আমি এখন এই ছবি দেখিয়ে সবাইকে বলতে পারব, আপনি আছেন মহিশয়ী।”

— অ্যা..

— অ্যা নয় হ্যা। আচ্ছা আপনার এখানে একা একা থাকতে কষ্ট হচ্ছে, তাই না। দাঁড়ান আমি ব্যবস্থা করছি।

বলেই ল্যাপটপে মুখ গুঁজে দিলেন। একটা ভুতের ফ্লীম অন করলেন। তার ছবিটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। ভয়ে আমার দম বন্ধ অবস্থা। ল্যাপটপ-টা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। ঝাঁপিয়ে পড়লাম ভাইয়া বুকে। পারলে ভাইয়ার বক্ষ ছিঁড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। তিনি আমাকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কদাচিৎ হেসে বলল..– “এটা কি হচ্ছে ভূত ভূতকে ভয় পায়।”
তিনি হাত ধরে আমাকে ল্যাপটপের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেদিকে যাওয়ার আগেই ভাইয়ার হাত খামচে ধরে চিৎকার করে উঠলাম। অতিশয় ভয়ে জ্ঞান হারালাম 😐। ভাইয়া দুহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন আমায়। কোলে তুলে শুইয়ে দিলেন বেডের মাঝ বরাবর। পরপর কয়েকটা ডাক দিল। শুনতে পেলাম তার কন্ঠস্বর কিন্তু জবাব দেওয়ার মতো ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই আমার। ধীরে ধীরে শোনার ক্ষমতাটুকুও লোপ পেল। মস্তিষ্ক তলিয়ে গেল অতল অন্ধকারের। পুরোপুরি জ্ঞান হারালাম নিজের।
____________
শীতের কুয়াশামাখা ভোরে নিদ্রা ভঙ্গ করতে হয়েছে আমাকে। আর পাঁচটা দিন যেখানে ব্লাঙ্কেটের তলে শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে ছিলাম। আজ সেখানে রান্না করে কাটাতে হয়েছে আমাকে। রান্না করে একে একে সাজিয়ে দিয়েছি ড্রাইনিং টেবিলে। কিন্তু সেই খাবার জুটে নি আমার ভাগ্যে। জুটেছে কালকে পান্ত ভাত আর বাসি তরকারি। অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ধাত রয়েছে আমার। কিন্তু পেটের ভেতরের ক্ষুধা পিড়া দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে খেতে লাগলাম সেই খাবার। দু-লোকমা মুখে তোলার আগেই ফেলে দিতে হলো।
সুন্দর করে মেখে না ছিটকে মুখে পড়তেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো অরিশ ভাইয়া। সচরাচর তিনি কিচেনে আসেন না। হঠাৎ আজকে আসার যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পেলাম না। হাতে থাকা প্লেটটা নিজের পেছনে লুকিয়ে মলিন হাসলাম। তিনি আমার দিকে শান্ত চাওনি দিয়ে বললেন..

— “সেই কখন থেকে আমি তোকে খুঁজে যাচ্ছি, কোথায় ছিলি তুই?
কি খাচ্ছিস এভাবে, মুখে লেগে আছে আর আমাকে দেখে কি লুকালি?”

সাথে সাথে মুখের অপর্যাপ্ত খাবারগুলো মুছে নিলাম। আমতা আমতা করে বললাম..
— “কই, কিছু খাচ্ছি না তো!”

তিনি এগিয়ে এলেন আমার দিকে! ভ্রু কুঁচকে বললেন..– “আমি এখনো দেখতে পারছি, তুই খাচ্ছিস। আবার বলছিস, খাচ্ছিস না। তাহলে হাত পেছনে কেন তোর?

বাক্য উচ্চারণ করার আগেই আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। পেছন থেকে খাবারের প্লেট টা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম। সরু চোখে তাকিয়ে বললেন..– “এইসব কি খাচ্ছিস তুই?”

আমি উত্তর দেওয়ার আগেই প্লেটটা ছুঁড়ে মারলেন বেসিনের মাঝে। বিকট শব্দে কেঁপে উঠলাম আমি। হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলেন। সবার সামনে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন..– “এইসব কি হচ্ছে মা? কি বলেছো তুমি ওকে? কেন ও পান্তা ভাত খাচ্ছে?”

অতিশয় ক্ষোভে তার শরীর কাঁপছে। তার এই রাগের সাথে পূর্ব পরিচিত নয় আমি। মামনি সামনে এসে বললেন..

— “কেন ও এইসব খাচ্ছে, আমি কিভাবে বলবো।”

— “মা আমি তোমার ছেলে হই। তোমার চেয়ে আমি তোমাকে সবচেয়ে ভালো চিনি। তরী কখনো তোমার অবাধ্য হয়নি। তাই তুমি না বললে এইসব ও কখনোই খাবে না!”

— হ্যাঁ! আমি ওকে এইসব থেকে বলেছি! এই বাড়িতে থেকে শুধু শুধু খাবার নষ্ট করছে আর আমাদের পেছনে ছুরি মারার চেষ্টা করছে। তাই এই বাড়িতে থাকতে হলে, কাজ করে খেতে হবে।

সবাই যেন বাক রুদ্ধ হয়ে গেল। সবাই অবাক চোখে মামুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মামুনির কথা হয়তো বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাদের কথোপকথন চললো বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু মামুনিকে শান্ত করতেন পারলেন না। এবার পূর্বের তুলনায় বেশ রেগে উঠলেন তিনি। বলল..– “তরী খাওয়া নিয়ে যদি এতোই সমস্যা হয়। তাহলে আমার খাবারটা তরী খাবে।”

মামুনিকে কোনো কথা বলতে দিয়ে একে একে টেবিল ত্যাগ করলো সকলে। মামুনি ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এখনই হয়তো আমাকে বকে দিবেন। কিন্তু তেমন কিছু করলেন না। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল..

— “শান্তি হয়েছে তোর? এবার সব খাবারগুলো গেল।”

বলেই হনহন করে চলে গেল সে। পেছনে পেছনে ছুটলো দিদা। হয়তো আবার কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
___________
বিকেল চারটা পেরিয়ে গেছে আরো আগে। মেলা আরো জমজমাট হয়ে উঠেছে। ভিড় ভাট্টা হয়ে উঠেছে চারপাশ‌। চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষজন। মিনিট বিশেক হয়েছে আমরা মেলায় এসেছি। আরশি বন্দুক দিয়ে বেলুন ফুটানোর চেষ্টা করছে। ভয় ভয় করছে তার। অনেকবার বেলুন ফুটানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তখন অরিশের জন্য সক্ষম হয়নি। তাই আজকে অরিশকে না জানিয়ে এসেছে। অপূর্ব নামক ছেলেটার সব টাকা শেষ করবে।
এক চোখ বন্ধ করে বন্দুক তাক করলো বেলুন দিকে। ছুঁড়ে মারলো প্লাস্টিকের বুলেট। বেলুন‌ তো ফুটলোই না উল্টো অন্যকারো মাথায় আঘাত করলো। সাথে সাথে ঘুরে গেল সে। আরশি ভাগ. বলে দৌড় দিতে চাইলে পেছনে থেকে ডেকে উঠলো কেউ। ধমকের সুরে বললেন..

— “এই বিচ্ছু মেয়ে, কি করলে এটা?”

আরশি ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকাতেই চমকে গেল। উবে গেল ভয়। এগিয়ে গেল কয়েক কদম। অপূর্বের গাল ধরে টেনে নিয়ে এলো কাছে। উষ্ণ গরম ফুঁ দিলো চক্ষু দর্পনে। অনুসূচনা মাখা কন্ঠে বলল..– “বেশি ব্যাথা লেগেছে জানেমান? এখনই সেরে যাবে।”

অপূর্ব নিভু নিভু নয়নে অবলোকন করলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল..

— “এভাবে কেউ বন্দুক চালায়। বন্দুক চালাতে হয় এইভাবে।”
সময় না নিয়ে আরশির হাত সমেত বন্দুট নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। একদম মাঝখানের লাল রঙের বেলুন বরাবর করে ছুঁড়ে মারলো। সাথে সাথে গিয়ে লাগল কাঙ্খিত জায়গায়।

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here