অনুভূতি,পর্ব-১২+১৩

অনুভূতি
পর্ব ১২
মিশু মনি
.
১৯.
অরণ্য পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো দুপুরকে। একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো দুপুর। এই কাজটির জন্য ও প্রস্তুত ছিলোনা। অরণ্য এভাবে কেন কাছে টানছে ওকে? ও যে কিছুতেই অরণ্য কে মেনে নিতে পারছে না। বলাও যায়না, সহ্য করাও যায়না। শুধু নিরবে যন্ত্রণা টুকু হজম করে ফেলতে হয়।
অরণ্য দুপুরের কাঁধের উপর নিজের মাথাটা রাখলো। দুপুর একদম স্পন্দনহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্য ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে গতরাতে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিলো দুপুর।”
দুপুর ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে ভাবছে, অরণ্য ভাইয়ার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো আপুর সাথে। আমার সাথে হয়েছে এতে ভাইয়ার খুব অস্বস্তি হওয়ার কথা, এত সহজে আর এত অনায়াসে কিভাবে মিশে যেতে পারছে? ছেলেরা সবই পারে। খুব দ্রুত একজন অচেনা মানুষ কে ভালোবাসতেও পারে, ভূলে যেতেও পারে। রৌদ্রময়ীর মত মেয়েরাও পারে। কিন্তু দুপুর পারবে না। দুপুরের মন থেকে নিখিলকে সরাতে না জানি আরো কষ্ট মানসিক যন্ত্রণা পোহাতে হবে!
অরণ্য বললো, “মন খারাপ করে থেকো না দুপুরবেলা আমার। দুপুরে সবসময় রোদ ঝলমল করার কথা।”
– “রোদ ই তো নেই, ঝলমল করবে কোথ থেকে?”
– “উফফ দুপুর, তুমি প্লিজ ওর নামটা আমার সামনে উচ্চারক করবে না। সে আমাদের সবার সাথে যেরকম টা করেছে, তাকে কি বলা উচিৎ আমার জানা নেই। তুমি আর কক্ষনো ওর কথা বলবে না। প্লিজ আমার সাথে একটু সহজ হওয়ার চেষ্টা করো।”
দুপুর কিছুই বললো না। নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো। অরণ্য শক্ত করে চেপে ধরলো ওকে। কাঁধের উপর মাথাটা রেখে বাম গালটা দুপুরের ডান গালের সাথে একবার ঘষে দিলো। শিউরে উঠলো দুপুর! সমস্ত শরীর ঝনঝন করে উঠলো। অরণ্য’র দাড়ির খোঁচায় গা শিরশির করে উঠছে ওর। ভিতরে দহন হচ্ছে, নিখিলকে মন থেকে জোর করে সরানোর দহন। এদিকে নতুন মানুষ কে জোর করে মনে জায়গা দেয়ার দহন। দুটো আগুন একসাথে হয়ে দাউদাউ করে জ্বলছে, কাউকে বলা যায়না, কাউকে বোঝানো ও সম্ভব না। একদম ই বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না ওর। তবুও মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে সবকিছু।
অরণ্য ওকে শক্ত করে ধরেই রইলো। এভাবে অনেক্ষণ কেটে যাওয়ার পর শ্বাশুরি মায়ের ডাকে ছাড়া পেলো দুপুর। প্রতিবেশী রা নতুন বউকে দেখতা এসেছেন। বাইরে তাদের সামনে বসে থাকতে হলো। বারান্দায় চেয়ারে বসে থাকার সময় দুপুর অরণ্য’র উপস্থিতি টের পাচ্ছিলো। অরণ্য আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে। বউকে চোখের সামনে রাখাতেও ওর বোধহয় তর সইছে না, সবসময় ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। বুকটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে দুপুরের। গতরাতে তো ছাড়া পাওয়া গেছেক্স আজকে রাতে অরণ্য কত রকমের অধিকার খাটাতে আসবে কে জানে! আবারো একটা ভয়ংকর বেদনা ছুঁয়ে গেলো দুপুরকে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও।
সারাদিন অনেক ব্যস্ততার মধ্য দিয়েই কাটলো। বাসায় অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছেন। সবার সাথে কথা বয়াল্র মাধ্যমে বেশ সহজ হয়ে গেলো দুপুর। একসাথে খাওয়া দাওয়া করলো, বৌভাতের মেহমান দের সাথে বসে আড্ডা দিতে হলো। অরণ্য’র বন্ধুদের সাথেও অনেক কথা বলতে হলো। রাত নেমে আসতে আসতে মনটা অনেকটাই হালকা হয়ে গেলো দুপুরের। তবুও মাঝেমাঝে কেমন একটা অন্যরকম বেদনা এসে বুকে ভর করে। কিন্তু হুটহাট অরণ্য কোথ থেকে যেন দুটো ছোট বাচ্চাকে পাঠিয়ে দেয়, নয়ত কোনো বন্ধুকে পাঠিয়ে দেয়। তারা এসে দুপুরের সাথে কথা বলার মাধ্যমে ব্যস্ত রাখে ওকে। অরণ্য নিজেও সারাদিন নানান ভাবে ফাজলামো করে মাতিয়ে রেখেছিলো দুপুরকে। দুপুর বেশ বুঝতে পারে অরণ্য অনেক খেয়াল রাখছে ওর প্রতি। নয়ত এভাবে এত করে ওর মন ভালো করার জন্য পিছনে লেগে থাকতো না। অরণ্য ছেলেটা অনেক ভালো! যদি আগের জীবনে নিখিল নামে কেউ না থাকতো, তবে অনায়াসে ভালোবাসতে পারতো এই ছেলেটাকে। নিখিল যে অরণ্য’র চেয়েও বেশি খেয়াল রাখতো ওর, নিখিলকে কিভাবে ভূলে যাবে ও?
রাত হয়ে এলো। ভাবি ও ননদরা দুপুরকে ঘরে রেখে বিদায় নিলেন। আজ বুকটা কেমন ধুকপুক করছে ওর। গতরাতে অন্যদিকে কোনো খেয়াল ছিলোনা, কোনো অনুভূতি কাজ করছিলো না। কিন্তু আজকে রাতে অরণ্য’র আগমনের কথা ভেবেই গায়ে কাটা দিচ্ছে। না জানি আজ কি আছে কপালে!
জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো দুপুর। অরণ্য এসে দরজা লাগিয়ে বিছানার উপর বসলো। বুকের ভেতরে দুম দুম করে যেন হাতুরি পড়ছে। কষ্টের মাত্রাটা বেড়েই যাচ্ছে দুপুরের। অরণ্য একটু এগিয়ে এসে দুপুরের হাত ধরলো। এবার আরো কষ্ট হতে লাগলো দুপুরের। এ কেমন নিদারুণ কষ্ট! ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। বুকটা ভেঙে যাচ্ছে, একটা বিশাল ঝড় দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে সব। দুপুর দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো।
অরণ্য এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে বললো, “আমার বউটাকে এখন একদম পুতুলের মত লাগছে। দুপুর সোনা, তুমি কি আমার কাছে কিছু চাও?”
দুপুর দুদিকে মাথা নাড়লো। অরণ্য বললো, “ভালোবাসাও না?”
বুকটা আরো একবার কেঁপে গেলো দুপুরের। যেন রিখটার মানের ভূমিকম্প বয়ে গেলো। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড কান্না পেয়ে গেলো ওর। এতবেশি কান্না পাচ্ছে যে নিজেকে সামলাতেই পারলো না। দুম করেই অরণ্য’র বুকের উপর পড়ে গিয়ে দুহাতে অরণ্য’র টি শার্ট খামচে ধরে কাঁদতে লাগলো। ও শুধু কেঁদে কেঁদে নিজেকে হালকা করাতেই ব্যস্ত। এদিকে যে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সেটা খেয়ালেই রইলো না। অরণ্য ওর মাথায় হাত বুলাতে গিয়েও আর স্পর্শ করলো না। মেয়েটাকে এখন কাঁদতে দেয়াই উচিৎ, কেঁদে বুক ভিজিয়ে দিক।
২০.
মিশু ঘুমাচ্ছে মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে। আর ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মেঘালয়ের মুগ্ধ দুটি চোখ! একটা মেয়ে এতটা ইনোসেন্ট স্বভাবের কিভাবে হতে পারে! ঘুম থেকে উঠেই বলে, “আমার খিদে পেয়েছে। হাঁসের গোশত দিয়ে ভাত খাবো।”
কথাটা মনে করেই হাসলো মেঘালয়। মিশু ঘুমে ঢলে পড়ে যাচ্ছে ওর বুকে। মেঘালয়ের বুকটা কেমন ছ্যাত করে উঠলো। মিশুর গরম নিঃশ্বাস পড়ছে মেঘালয়ের বুকের উপর। স্তব্ধ হয়ে ফিল করছে মেঘালয়। মেয়েটাকে এখান বড্ড বেশি আপন মনেহচ্ছে। কেন যেন মনেহচ্ছে বহুদিনের সম্পর্ক ওর সাথে। যুগ যুগ ধরে একে অপরকে চেনে! একসাথে কত পথ চলে এসেছি!
কথাগুলো ভেবে আপন মনেই আবারো বললো, “ধ্যাত কি সব ভাবছি। এসব ভাবা যাবেনা। ভাবা ঠিক না। মেয়েটা অনেক বাচ্চা স্বভাবের। বুঝতে পেলে কেঁদে ফেলবে।”
মুখ টিপে হাসলো মেঘালয়। মিশু ঘুমাচ্ছে, যেন ঘুমিয়ে কত শান্তি পাচ্ছে মেয়েটা। একবার রৌদ্রময়ীর দিকে তাকালো মেঘালয়। কনের সাজে বসে থাকা মেয়েটার গাল বেয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে। কি এমন দুঃখ আছে ওই সুন্দর মেয়েটার? জানতে বড্ড ইচ্ছে হয়। কিন্তু এখন কিছুতেই উঠে যাওয়ার সুযোগ নেই, মিশু এক হাতে মেঘালয়ের এক বাহু জাপটে ধরে ঘুমাচ্ছে। ভাবলেই কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে মেঘালয়।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেলো কেউই বলতে পারেনা। ঘুম থেকে উঠে একবার মেঘালয়ের দিকে তাকালো মিশু। আড়মোড়া ভেঙে বললো, “এখন কোথায় আমরা?”
– “ট্রেনে।”
– “ট্রেনটা কোথায়?”
– “রেল লাইনের উপর।”
– “রেল লাইনটা কোথায়?”
– “ভূ পৃষ্ঠের উপর।”
মিশু ক্ষেপে গিয়ে বললো, “একদম মাইর দিবো। এরকম দুষ্টুমি করছেন কেন?”
– “বাচ্চাদের সাথে তো দুষ্টুমি ই করতে হয়।”
– “আমি বাচ্চা? বাচ্চামির কি দেখালাম শুনি?”
– “কিছুই তো দেখিনি। দেখলে নাহয় বুঝতে পারতাম বাচ্চা নাকি বাচ্চার মা।”
কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো মেঘালয়। সর্বনাশ! খুবই লেইম টাইপের ডায়ালগ দিয়ে ফেলেছে ও। মিশু যদি অন্যকিছু বুঝে নেয় তাহলে তো খুবই রাগ করবে। কিন্তু মিশু মেঘালয়ের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনি। ও অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “এখন মনেহয় আমরা ঈশ্বরদীর ওদিকে আছি।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “বাঁচলাম বাবা।”
– “বাঁচলাম মানে?”
– “না কিছুনা। কিছু খাবা?”
– “না, খিদে পায়নি। আচ্ছা ওই নতুন বউটা কোথায়?”
মেঘালয় রৌদ্রময়ীর সিটের দিকে তাকিয়ে বললো, “জানিনা তো। এখানেই তো ছিলো মেয়েটা। বোধহয় নেমে গেছে।”
-“মরে টরে যায়নি তো?”
– “মরলে আগেই মরতো, ট্রেনে উঠে বসে থাকতো না।”
– “হুম তাও ঠিক। সে যাই হোক, এরপর যেখানে ক্রসিং হবে আমরা সেখানেই নেমে পড়বো আচ্ছা?”
– “নেমে কি করবা?”
– “কি আবার? ওই ট্রেনে উঠে পড়বো। ঢাকায় ফিরে যাবো। কালকে আমাকে আপনার বাবার অফিসে যেতে হবেনা?”
– “ওহ আচ্ছা। ঠিকাছে তাই হোক। কিন্তু এটাতে তো পুলিশকে বলে সিট নিয়েছি, ওটায় দাঁড়িয়ে থেকে যেতে হবে।”
– “যাবো, সমস্যা কি?”
মেঘালয় হেসে বললো, “পুরো জার্নিতে ঘুমালে সমস্যা না থাকার ই কথা।”
– “আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম না?”
– “আবার জিজ্ঞেস ও করে!”
দাঁত বের করে হাসলো মেঘালয়। মিশুর ও হাসি পেয়ে গেলো। মেঘালয় একটু মিশুর দিকে এগিয়ে আসতেই মিশু বললো, “এই এই দূরে থাকুন, দূরে থাকুন।”
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, “কেন?”
– “বারে, ঘুম থেকা উঠলাম না? এখন আমার মুখে গন্ধ, ওয়্যাক….”
মিশু মুখের ভঙ্গিটা এমন করলো যে হাসি পেয়ে গেলো মেঘালয়ের। নিজের মুখের গন্ধের কথা কেউ কখনো এভাবে বলেছিলো কিনা ওর জানা নেই। হাসত হাসতে সিটের পিছনে হেলান দিয়ে মিশুর দিকে চেয়ে রইলো মেঘালয়। আর মিশু তাকিয়ে আছে মেঘালয়ের হাতের দিকে। গরমে ঘেমে গেছে মেঘালয়ের শরীর। হাত ঘামে ভিজে গেছে, হাতের উপরের ঘন লোমগুলো একদম গায়ের সাথে লেগে গেছে। দেখলেই কেমন যেন অনুভূতি কাজ করে, মিশু তাকিয়ে আছে মেঘালয়ের হাতের দিকে! একদম অপলক ভাবে!
চলবে…

অনুভূতি
পর্ব ১৩
মিশু মনি
.
২১.
আজকে খুব ভোরেই দুপুরের ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে শাড়ির আঁচলে টান পড়তেই পিছন ফিরে দেখলো অরণ্য’র গায়ের নিচে পুরোটা আঁচল। সেটা টেনে বের করা এখন কিছুতেই সম্ভব না। ঘুম ভেঙে যাবে অরণ্য ‘র। আবারো শুয়ে পড়লো দুপুর। বালিশে মাথা রেখে অরণ্য ‘র দিকে তাকিয়ে রইলো অনেক্ষণ। অন্ধকার ঘরে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে ওর মুখটা। কিন্তু তাতেই কেমন যেন লাগছে ওর। সত্যিই খুন হয়ে যাওয়ার মত মায়া ওর চেহারায়।বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না।
চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইলো অনেক্ষণ। অরণ্য ঘুমের মাঝেই একটা হাত রাখলো দুপুরের গায়ের উপর। কেমন যেন ছ্যাত করে উঠলো বুকটা। তার স্পর্শ অসহ্য লাগে কিন্তু কিছুই করার নেই। সে তো এখন দুপুরের স্বামী, মেনে নিতেই হবে। স্বামীর সবটুকু অধিকার সে নেবেই। ভাগ্যিস অরণ্য আর সব ছেলের মত নয়। দুপুরকে রাতে কোনোরকম বিরক্ত করেনা বরং মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
নিখিলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে হঠাৎ। একদিন ফোনে চার্জ ছিলোনা বলে নিখিলকে ফোন দিতে পারেনি দুপুর। এদিকে ইলেকট্রিক লাইনে সমস্যার কারণে ফোনে চার্জও দেয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। সারাদিন কথা হয়নি, রাতেও কথা হয়নি। বাড়ির কারো ফোন দিয়ে ওকে জানায় ও নি দুপুর। নিজে দিব্যি আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। রাত সাড়ে এগারো টার দিকে হঠাৎ এভাবেই গায়ের উপর একটা হাত পড়লে চমকে ঘুম ভেঙে যায় দুপুরের। ও পাশ ফিরে শুতে যাচ্ছিলো। ফিসফিস করে কেউ একজন ডাকলো, “দুপুর, এই দুপুর…”
দুপুর চমকে উঠলো নিখিলের গলা শুনে। এতরাতে নিখিল কোথ থেকে এলো? তাছাড়া রৌদ্রময়ী তো ওর পাশেই ঘুমিয়েছিলো। আপুই বা গেলো কোথায়? লাফিয়ে উঠে বিছানার উপর বসলো দুপুর। নিখিল ফিসফিস করে বললো, “তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে টেনশন হচ্ছিলো। তাই চলে আসলাম।”
– “সেকি! আপু কোথায় গেলো?”
– “আপু তো বাসায় নেই। পাশের বাড়িতে তামিমার বিয়ে হচ্ছেনা? তামিমা আপুকে এসে নিয়ে গেছে, আপু তামিমার সাথে ওর শ্বশুরবাড়ি যাবে।”
– “তুমি কিভাবে জানলা?”
– “আমিই তো তামিমাকে বলেছি যাতে আপুকে নিয়ে যায়। আমি নিজেই বিদায় দিয়ে আসলাম।”
– “আপু কিছু বুঝতে পারেনি তো?”
– “না। ফোন বন্ধ থাকলে টেনশন হয়না বলো?”
দুপুর খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলো নিখিলকে। সে রাতে পুরোটা রাত নিখিল আর ও একই বিছানায় ঘুমিয়েছে। কিন্তু নিখিল একবার ও দুপুরকে অন্য কোনো মতলবে স্পর্শও করেনি। পুরোটা রাত দুপুর শুধুমাত্র নিখিলের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে। এতটাও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ও সত্যিকার একজন মানুষ ছিলো নিখিল। ভোরবেলা চলে যাওয়ার সময় দুপুর একবার জিজ্ঞেস করেছিলো, “তুমি আমাকে নিজে থেকে একবার টাচ ও করলা না। ভেবেছো আমি কষ্ট পাবো? তুমি টাচ করলে আমি বাধা দিতাম না।”
নিখিল দুপুরের হাত শক্ত করে ধরে বলেছে, “আমি তোমাকে পবিত্র ভাবে ভালোবাসি দুপুর। আর স্পর্শটা একান্তই তোমার স্বামীর হক। যেদিন আমাদের বিয়ে হবে,সেদিন থেকে সবরকমের স্পর্শের অধিকার আমার। আর যদি কোনো কারণে আমাদের বিয়ে না হয়, আজীবন এই অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে বেড়াবে।”
সেদিন নিখিলের কথা শুনে খুব বেশি অবাক হয়ে গিয়েছিলো দুপুর। তামিমা রোদের বান্ধবী, নিখিলের ও বান্ধবী। সেই মেয়েটাকে রাজি করিয়ে আপুকে বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দিয়ে তারপর সে কিভাবে যেন দুপুরের ঘরে ঢুকেছে। অথচ সারাটা রাত দুপুরকে একবার স্পর্শ ও করলো না, এরকম মানুষ ও আছে দুনিয়ায়! এই আলাদা বৈশিষ্ট্যের জন্যই নিখিলকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো দুপুর। এখনো বাসে, কিন্তু এখন…. শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস!
গাল ভিজে চোখের জল বালিশে গিয়ে পড়েছে। চোখ মুছলো দুপুর। নিরব কান্না, এই কান্না কেউ দেখেনা, কেউ জানেনা। কিন্তু অরণ্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি কাঁদছ দুপুর?”
দুপুর চমকে উঠে বললো, “কই না তো।”
চোখের জল মুছতে যেতেই অরণ্য নিজেই আলতো করে দুপুরের মুখটা স্পর্শ করলো। তারপর গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বললো, “কাঁদছ কেন?”
দুপুর নিজের হাত দিয়ে অরণ্য ‘র হাত ধরে ফেলে বললো, “এমনি।”
– “এমনি কেউ কখনো কাঁদেনা, আর কাঁদলেও সেটা অন্তত সারাক্ষন স্থায়ী হয়না।”
দুপুর কোনো কথা বললো না। অরণ্য ওকে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকে। তারপর বললো, “কাঁদছ কেন বলবা না? আমি ঘুম ভাঙার পরই তোমার নাক টানার শব্দ শুনেই টের পেয়েছি তুমি কাঁদছ।”
– “আমি নাক টেনে কাঁদি?”
– “না, তবে একটা ফ্লেভার আছে কান্নার। বোঝা যায়।”
– “কান্নার কখনো ফ্লেভার থাকে?”
– “তোমার কান্নার আছে। তুমি অনেক দূরে থাকলেও কাঁদলে আমি বুঝতে পারবো। বুঝেছো?”
দুপুর কিছু বললো না। অরণ্য ওকে জাপটে ধরে রইলো। সকালের পাখির কিচিরমিচির কানে আসছে। এখন উঠতে হবে। অরণ্য বললো, “নাস্তা করে এসে দুজন মিলে ব্যাগ গোছাবো। আজ আমাদের সিলেট যাওয়ার কথা।”
দুপুর কিছুই বললো না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। অরণ্য’র শরীরে একটা গন্ধ আছে, সেটা অনুভূতি ইন্দ্রিয়েরা জানিয়ে দিচ্ছে ওকে। ধীরেধীরে এই গন্ধটাই সবচেয়ে চেনা আর প্রিয় হয়ে উঠবে।
২২.
ট্রেন থেকে নেমে আবারো ঢাকার ট্রেনে উঠে পড়েছে মিশু ও মেঘালয়। কাউন্টারে কথা বলে জেনেছে কোনো সিট ফাঁকা নেই, কিন্তু একটা কেবিন ফাঁকা আছে। মেঘালয়ের কাছে অতবেশি টাকা ছিলো না। বাসায় ফোন দিয়ে টাকা নিয়ে পুরো কেবিনটাই বুক করে ফেলেছে।
মিশু একদম অবাক! এতবড় কেবিন বুক করে হবেটা কি? আর দুজন মানুষের জন্য একটা কেবিন নিতে হয়? ছেলেটা সত্যিই অদ্ভুত রকমের। বিশাল সাইজের একটা মন আছে বলতে হবে। তবে অযথা টাকা খরচ করার অভ্যাস টা ভালো লাগেনা মিশুর।
কথাটা বলতেই হেসে ফেললো মেঘালয়। জবাব দিলো, “অযথা খরচ করলাম কোথায়?”
– “এত টাকা দিয়ে একটা কেবিন পুরোটাই বুক করার কি দরকার ছিলো? সিট না পেলে আমরা দাঁড়িয়ে থেকে যেতাম।”
– “প্রথমত এখনো রাত বাকি আছে, আর দ্বিতীয়ত আমি সজ্ঞানে তোমাকে কষ্ট দিয়ে দাঁড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবো না।”
মিশু বেশ অবাক হয়ে বললো, “একটা অচেনা মেয়ের জন্য এত দরদ কেন আপনার শুনি?”
– “যার মনে দরদ আছে তার চেনা অচেনা সবার জন্যই আছে।”
এর কোনো জবাব খুঁজে পেলো না মিশু। ট্রেনের কেবিন খুঁজে সেখানে ঢুকে পড়লো। মেঘালয় কেবিনে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো। মিশু আঁৎকে উঠে বললো, “খোলা থাক, খোলা থাক।”
– “সেকি! খোলা থাকবে কেন?”
– “আমার ভয় করে।”
– “আমাকে?”
মেঘালয় জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে মিশুর দিকে। মিশু কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। মেঘালয়কে ভয় লাগছে বললে অন্যায় হয়ে যাবে। যে ছেলেটার সাথে বারবার দেখা হওয়ার পরও কখনো বদ নজরে তাকায় নি, তাকে তো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ ই নেই। তাছাড়া মেঘালয় কতটা মহান সেটা মিশু ভালোভাবেই জানে। তবুও কেন যে কথাটা বললো নিজেও বুঝতে পারছে না। অবশ্য হঠাৎ একজনের সাথে বদ্ধ কেবিনে থাকতে একটু ভয় তো লাগবেই।
মিশুকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে মেঘালয় বললো, “কি ভাবছো?”
– “কিছু না। লাগিয়ে দিন।”
মেঘালয় দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে সিটে বসতে বসতে বললো, “আমি কোনো সুযোগ নিবো কিনা সেটা ভয় পাচ্ছো?”
মিশু তাকালো মেঘালয়ের দিকে। কিছু বললো না মুখে। মেঘালয় বললো, “ট্রেনে যখন আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলে, তখন চাইলে অনেক সুযোগ নিতে পারতাম। সেটা যখন করিনি, এখন ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া একটা মেয়ে যখন আমার সাথে থাকে, তাকে সেফলি বাসায় পৌছে দেয়াটাকে আমি আমার দায়িত্ব মনে করি। সেখানে তুমি তো মিশু…”
মিশু আগ্রহ ভরা চোখে জিজ্ঞেস করলো, “আমি মিশু তো?”
মেঘালয় থতমত খেয়ে বললো, “না মানে খুবই ইনোসেন্ট একটা মেয়ে।”
কিন্তু মনে মনে বললো, “আমার মনের ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছো সেটা কিভাবে বলি বলো? এত তাড়াতাড়ি নিজের মনের কথা বুঝতে দিতে নেই। একটু সময় নিতে হয়। তুমি নিজে থেকেই বুঝবা এই মেঘ তোমার প্রতি কতটা আসক্ত হয়ে পড়েছে, তারপর নিজেও একটু একটু করে দূর্বল হতে শুরু করবা। তখন জানাবো মনের কথাটা।”
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছেন এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে?”
– “তোমার দিকে তাকিয়ে আছি?”
– “তো? আপনার চোখ তো আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।”
লজ্জা পেয়ে হাসলো মেঘালয়। মিশুও হাসলো। আর মনেমনে ভাবল, “কি চাইছে এই ছেলেটা? এত আপন মনেহচ্ছে কেন ওকে? কিন্তু ওকে তো আপন ভাবা যাবেনা। মিশু যে বড্ড গরীব আর অসহায় ঘরের মেয়ে। তাকে নিজেকেই রোজগার করে বাঁচতে হয়। আর মেঘালয়! সে তো অনেক উঁচুতে। মেঘ যাকে ছুঁয়ে চলে যায়, সেখানে শুধু মেঘেদের বসবাস। অত উঁচুতে ওঠার সাহস হবেনা মিশুর। আর মেঘালয় অনেক ভালো গান গাইতে পারে, একদিন নিশ্চয় ই অনেক বড় শিল্পী হয়ে যাবে।
এবার একই প্রশ্ন মেঘালয় করলো, “আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি ভাবছো?”
মিশুও মেঘালয়ের মত লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলো। সুন্দর হাওয়া আসছে। বাইরে হাত বাড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো মিশু। তারপর মেঘালয়কে বললো, “এখন তো কেউ নেই। একটা গান শোনান না।”
বলামাত্রই মেঘালয় গান গাইতে আরম্ভ করলো। মিশু গান শুনছে আর বাইরে তাকিয়ে আছে। মেঘালয় ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক্ষণ ধরে গান গাওয়ার পর সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো মেঘালয়। মিশুকে বললো ঘুমিয়ে পড়তে। কিন্তু তখন অত যাত্রীর ভিড়ে ঘুম পেলেও এখন ফাঁকা কেবিনে ঘুম আসছে না ওর।
দুজন দুদিকের আসনে বসে মুখোমুখি বসে আছে। হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনাতে। মিশুর বুকের ভেতর টা কেমন যেন করে উঠলো। ধুকধুক করে উঠলো। এদিকে মেঘালয়ের ও একই অবস্থা। এর আগে কখনো এমন হয়নি ওর। কেমন যেন মায়া কাজ করছে। অন্যরকম একটা মায়া যার কোনো নাম দেয়া যায়না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও মিশুর দিকে। একদম নির্জনে এভাবে মিশুকে দেখলে মনটা কেমন যেন বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়। এত কাছে তবুও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বড্ড ছুতে ইচ্ছে করছে ওর লাজুক চিবুক, কিন্তু সেটা তো হয়না। সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সীমা লংঘন ব্যাপার টা ভালো লাগেনা মেঘালয়ের, তবুও আজ বড্ড ইচ্ছে করছে একটু সীমা অতিক্রম করতে। এতবেশি মিশুকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে যে নিজেকে শেষ পর্যন্ত কন্ট্রোল করতে পারবে কিনা সেটা নিয়েই ভয় হচ্ছে মেঘালয়ের।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here