অনূসুয়া পর্ব -০৪

#অনূসুয়া
#পর্ব৪
#রাউফুন

সুসমা বাড়িতে এসেই মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ হাউমাউ করে কেঁদেছে। মা তো জানেন না মেয়ে কেন কাঁদছে। কারিমা ধরেই নিলেন মেয়ে তাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট পাচ্ছিলো তাই কাঁন্না করছে। কারিমা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

‘একদিনেই এতো কাঁন্নাকাটি করছিস সারাজীবন মাকে ছাড়া থাকবি কি করে? আমাদের ছাড়া তো থাকতেই হবে। এটাই তো মেয়েদের ভবিতব্য রে মা!’

‘মা আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না আর!’

‘দেখো পাগলী মেয়ের কথা! এটা কি করে হয়? মেয়েদের বিয়ে হলে শ্বশুর ঘরই তো আসল ঘররে মা!’

‘মা আমি আজকে তোমার থেকে কয়েক পদ রান্না করা শিখতে চাই! আজকে রুটি বানাতে পারিনি!’

‘সেকি রে, তুই নতুন বউ তোকে দিয়ে কি রান্না করিয়েছে তোর শাশুড়ী?’

মায়ের কথা শুনে সুসমা কাঁন্না থামিয়ে আমতা আমতা করে বললো, ‘আহা না মা, উনি খুব ভালো মানুষ! আসলে আমিই সাহায্য করতে চাইছিলাম। তাছাড়া তোমার জামাই তো ঢাকায় চাকরি করে, সেতো সেখানেই আমাকে নিয়ে যাবে৷ ওখানে কি আর শাশুড়ী মা থাকবেন রান্না করার জন্য? রাশেদকে তো আমারই রান্না করে দিতে হবে তাই না? সেজন্যই শিখতে চাইছি। তোমার জামাই কি অফিস করে এসে রান্না করে খাবে নাকি? তুমি কি মা, আমাকে তো একটু রান্না শিখাতে পারতে নাকি?’

‘আচ্ছা বুঝলাম! রাশেদ কবে ঢাকা যাবে?’

‘জানি না মা, শুনে বলবো!’

সুসমা একটু ইতস্তত করছে মোবাইল ফোনের কথাটা বলবে কি না। কারিমা মেয়েকে উসখুস কর‍তে দেখে নিজেই বললো, ‘কিছু বলবি মা?’

‘হ্যাঁ মা, আসলে রাশেদ একটা ফোন চাইছে। বাবার কাছে কি টাকা আছে? উনি বলেছেন মাস শেষে টাকা পেলে বাবাকে আবার ফেরত দিয়ে দিবেন। এখন নাকি ধার হিসেবে নিবেন টাকাটা। উনার নাকি খুবই প্রয়োজন একটা এন্ড্রয়েড ফোন!’

কারিমা বেগম কিছু একটা ভেবে বললেন, ‘তুই এতো চিন্তা করিস না। তোকে তো বিয়েতে তেমন কিছুই দেওয়া হয়নি। রাশেদও নিজে থেকে কিছু চাইনি। তোর বাবাকে আমি এই বিষয়ে বলবো।’

সুসমা একটু নিশ্চিন্ত হলো। সে ধরে নিলো এবার সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। দুপুরে মায়ের হাতের রান্না চেটেপুটে খেলো সুসমা। প্রায় দুই দিন থেকে অনাহারে যেনো ক্ষুধার্ত বাঘীনির মতো হয়ে গেছিলো সুসমা। মেয়ের খাওয়া দেখে তাকিয়ে রইলেন রহিম মিয়া আর কারিমা বেগম! তাকে ওভাবে খেতে দেখে রহিম মিয়া বললেন, ‘মা আস্তে খাও, গলায় খাবার আটকে যাবে তো!’

‘খুব খিদে পেয়েছে বাবা! মা এতো ভালো রান্না করেছে উফফ!’ খাবার মুখে নিয়েই বললো সুসমা।

‘এতো খিদে পেয়েছে যেনো তুমি তিন দিন না খেয়ে আছো! এভাবে খেতে হয় না সুসমা!’ কারিমা বেগম কিছুটা করুণ ভাবে বললেন।

‘আহা মা, তোমার রান্না আমি গতকাল থেকে আজ দুপুর অব্দি পায়নি। এভাবে আর কতদিনই বা খেতে পারবো বলো তো?’

কারিমা বেগম এর চোখ ভিজে উঠলো। তিনি নিজেকে সামলে রাশেদ কে গরুর গোশত দিতে দিতে বললেন, ‘আরে বাবা তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না। আরেকটু নাও!’

‘না মা ঠিক আছে!’ নম্র ভাবে বললো রাশেদ।

‘ওই দেখো, এই যে বাচ্চারা, রিয়া আর মিথুন। তোমরাও তো খাচ্ছো না। খাও খাও!’

রিয়া আর মিথুন চুপ করে খেতে খেতে ভাবলো, তার মা নতুন ভাবির সঙ্গে কেমন ব্যবহার করলো সকালে আর এদিকে নতুন ভাবির মা কত আদর যত্ন করছেন। তার মা ওমন কেন? নতুন ভাবির সঙ্গে একটু ভালো আচরণ তো করতে পারতো!

মেয়ে জামাই, মেয়েকে সুখী দেখে খুশি হলেন উনারা। দুই দিন আপ্যায়ন এর কোনো ত্রুটি রাখেন নি। সুসমাও হাসি খুশি ছিলো খুব। কারণ এই দুইদিন রাশেদকে এতোটা ভালো লেগেছে যা বলার মতো না। এই মানুষটাই কি বাসর রাতের সেই রাশেদ? সে মিলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলো৷ আসার সময় রাশেদের হাতে বিশ হাজার টাকা গুজে দিয়েছেন রহিম মিয়া। রাশেদের দু-চোখ চকচক করছিলো টাকা দেখে।

রাশেদের ছুটি শেষ হলে সুসমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলো। অবশ্য আসার সময় শাশুড়ীর কটু কথার অভাব হয়নি৷ যেটা মুখে এসেছে বলেছে। সুসমা দাঁতে দাঁত চিপে সবটা সহ্য করেছে। রাক্ষসী, ডায়নী, এসেই আমার ছেলেকে আমার থেকে আলাদা করে দিলো। আমার ছেলে আমার কথা শুনছে না, এমন নানান কটু কথা বলেও ক্ষান্ত হননি তিনি।

আজকে রাশেদকে নিজের হাতে রান্না করে অফিস গিয়ে চমকে দেবে সুসমা। একদিন হয়েছে তারা এখানে এসেছে। বিয়ের আট দিনের মাথায় সে জীবনে প্রথম বারের মতো রান্না করলো। আর অফিসে ঢুকেই দেখতে পেলো প্রাণ প্রিয় স্বামীর সাথে অন্য নারীকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায়।(যা প্রথম পর্বে উল্লেখ করেছিলাম, তাই এখানে আর উল্লেখ করলাম না।) নিজের কয়েকদিন আগে বিয়ে করা স্বামীকে অন্য নারীর সঙ্গে দেখে সহ্য কিভাবে করবে সে? সে তো মানুষ! অফিস থেকে উম্মাদের মতো দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো সে। কষ্টের মাত্রা বেড়ে তিন গুণ হয়ে গেছে রাশেদের চুপ করে থাকাই। কেবলই নির্বাক হয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। শাড়ির আঁচল লুটো পুটি খাচ্চে রাস্তায়। ঠোঁটের লাল লিপস্টিক, কাজল দুই হাতে মুছে ফেললো সে। সারা মুখের এলোমেলো অবস্থা, আর চোখের পানিতে ভিজে উঠা কপোল৷ আহ! এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? সে কি কল্পনাতেও ভেবেছিলো রাশেদকে চমকে দিতে এসে নিজেই এতো বড় চমক পাবে? রাশেদের এসব ভালো মানুষি কি তবে সব ছলনা? তখন স্বাভাবিক থাকলেও এখন নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। রাশেদ পেছনে পেছনে ছুটে আসছে সুসমাকে বোঝাতে।

‘সুসমা দাঁড়িয়ে যাও। তুমি যা দেখেছো তা সত্যি নয়। আমার কথা শুনো!’

সুসমা চোখের পানি মুছে ফিরে চাইলো। ক্রুর কন্ঠে বললো, ‘আমাকে মিথ্যা বলে লাভ নাই। আমি এতোটাও বোকা নয়।’

‘দেখো মাঝে মধ্যে চোখের দেখাও ভুল হয়! আমাকে বলার সুযোগ দাও!’

‘আপনি বলতে চাইছেন আমি নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবো?’

‘দেখো আমি বলছি না তুমি ভুল দেখেছো। আমার কথাটা তো শুনবে?’

‘আমার কিছুই শোনার নাই।’ তীব্র রাগে বললো সুসমা। একটা অটো পেতেই তাতে চেপে বসলো। রাশেদ এখানে আর বোঝাতে চাইলো না কিছু। যা বোঝানোর বাড়ি গিয়ে বোঝাবে ভেবেই আবার ফের অফিস চলে গেলো!

রাশেদ অফিস থেকে এসে সুসমাকে বোঝাতে চাইলো ভালো ভাবে। কিন্তু সুসমা তার কথায় শুনতে চাইছে না। কোনো ভাবেই যখন কাজ হচ্ছিলো না তখন সে জোর করে সুসমার হাত টেনে ধরে রুমে নিয়ে এলো। সুসমা তীব্র রেগে বললো,

‘এভাবে হাত ধরে টানছেন কেন?’

‘কি করবো, আমার কথায় শুনতে চাইছো না তুমি!’

‘অল্পতেই যে জিনিস পাওয়া যায় তা তো সব সময় মূল্যহীন তাই না? আমিও তো আপনার কাছে তেমনই একটা জিনিস মাত্র! তাই আমার মূল্যটা এতোটা ফিকে আপনার কাছে!’

‘কে বলেছে তোমার মূল্য নেই? তুমি যেনো জেনে বসে আছো সবকিছু।’

‘বোঝা যায়, জানতে হয় না। মানুষ চিনতে আমি পারিনি।

‘তুমি ভুল বুঝছো!’

‘কি দারুণ এক্টিং করছেন। বাহ!’

‘আচ্ছা, তুমি আমাদের ওরকম ফ্রাংকলি চু’মু খেতে দেখেও এতোটা নির্লিপ্ত ছিলে কি করে?’

‘বাইরের টাই দেখেছেন, ভেতরের দংশিত হওয়া ক্ষ’ত দেখতে পান নি? আচ্ছা, ধরুন আমি কোনো ছেলের সঙ্গে ঐভাবে চিপকে আছি আপনার ঠিক কেমন অনুভূতি হবে?’

‘ছিঃ এসব কি কথা? তুমি কেন অন্য একটা ছেলের সঙ্গে ওভাবে থাকবে, এরকম কিছু আমি মেনেই নিবো না!’

সুসমা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো রাশেদের উত্তর শুনে। বলল, ‘আহা বলুন আপনার কেমন অনুভূতি হতো?’

‘যার সঙ্গে ওভাবে চিপকে থাকতে তাকে খুন করার মতো অনুভূতি হতো!’

‘এক্সাক্টলি আমারও ঠিক এমনই অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু আপনি তো আমার স্বামী, আপনাকে না পারছি ঘৃণা করতে আর না পারছি ভালোবাসতে। ঐ মেয়েটাকে যদি খু”নও করতাম আমার লাভের লাভ কিছুই হতো তাই না।

‘আসলে আমি যেমনই হয় না কেন, আমি তোমাকে অন্য কারোর সঙ্গে সহ্য করতে পারবো না। আর তোমার মতো পবিত্র একজন মেয়েকে নিয়ে এরকম বাজে চিন্তাভাবনা আমার মনে কখনোই আসেনি৷ আমি কল্পনাতেও তোমাকে নিয়ে এসব ভাবতে পারিনা। আমি আমার জীবনে অনেক নারীর সান্নিধ্যে পেয়েছি কিন্তু তোমার মতো একটাও মেয়ে আমি পায়নি। তুমি পবিত্র ফুল তোমার কোনো কলঙ্ক নেই। আর আমি নিশাকে কিস করিনি। ওঁ আমাকে করেছে। আমি সত্যি বলছি আমি ওর প্রতি একটুও ইন্টারেস্ট না। আমাকে ও আগে থেকেই ভালোবাসতো, আর আজকে আমার বিয়ের খবর টা মানতে পারেনি তাই ওভাবে। প্লিজ ভুল বুঝিও না।’

‘আপনি সত্যিই বলছেন?’

‘হ্যাঁ রে বাবা। আমি আমার বউকে মিথ্যা বলবো?’

‘আপনি শুধুই আমাকে ভালোবাসেন? এর আগে কাউকে কখনোই ভালোবাসেন নি?’

‘উঁহু একদম না। কোনো মেয়েকেই ভালোবাসতে পারিনি আমি। আমি তোমাকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তাই অনেক কষ্ট করে বাড়িতে তোমার কথা বলি। আমি তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি এটা মা জানলে কখনোই তোমাকে দিয়ে বিয়ে দিতেন না। মা এসব পছন্দ করেন না। তাই আমি মাকে অন্য ভাবে হাত করে তোমাকে আমার করে নিয়েছি।’

‘আপনি মাকে কি বলেছিলেন?’

‘সেসব তোমার না জানলেও চলবে। আসো তো বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে তুমি বিহীন!’

‘মানে?’

‘মানে এখন একটু বুকে আসো?’

সুসমা রাশেদকে বিশ্বাস করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। মনের রাগ পুষে রাখলে সম্পর্ক নষ্ট হয় । অভিমানে দুরত্বের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সব ভুলে ক্ষমা করে দিলে প্রত্যেকটি সম্পর্কই স্থায়ী হয় ! সুসমা আর রাগ করে থাকতে পারলো না রাশেদের উপর।
রাশেদ যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসলো অদ্ভুত ভাবে।

সুসমার এখন মনে হয় তার মতো সুখী এই ধরনীতে আর কেউ নেই। কারণ রাশেদ আগের থেকে অনেকটাই ভালোভাবে কেয়ার করছে এখন। তার মা ঠিকই বলে ভালোবাসা দিয়ে দুনিয়ার সবকিছু জিতে নেওয়া সম্ভব। রাশেদ অফিস থেকে এসে জানালো কালকে তার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই আসছে। এখন থেকে তারাও শহরে থাকবে। সুসমার মুখটা শুকিয়ে একটু খানি হয়ে গেলো। তারা সবাই আসছে এটার জন্য না। শাশুড়ী মায়ের কড়া ব্যবহার এর কথা ভাবতেই ভয় পাচ্ছে সে। তার কি তবে সুখ কপালে নেই?

#চলবে

বিঃদ্রঃ আজকের পর্ব যদি বুঝতে প্রব্লেম হয় তবে পর্ব এক পড়বেন। পর্ব একে উল্লেখিত বিষয়সমূহ আজকের পর্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত!

গল্পে এখনো অব্দি ২০১৩ চলছে হুট করেই বর্তমানে যদি আনি গল্পে তবে সালটা উল্লেখ করে দিবো। অতীতের যখন যে সালে যাবো সেই সালটা উল্লেখ্য করেই দিবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here