অন্তরালের কথা পর্ব ২৫

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ২৫

.
.
শান্তর কথা শুনে তিহান বাইকটি মাঝরাস্তা থেকে কিছুটা সাইডে নিয়ে থামিয়ে দেয়। বাইক থেকে নেমে রাস্তার পাশে থাকা ওভার ব্রিজের কাছে গিয়ে ব্রিজের নিচ থেকে উপরের ৩য় সিঁড়িতে বসে মাথা উঁচু করে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামনে থেকে শান্ত এসে তিহানের পাশে বসে বলল,
” কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস নিজেকে? তোর কি নেই বলতো? না আছে টাকা পয়সার অভাব, না আছে পার্সোনালিটির অভাব। তোর মতো ছেলে হাতে তুড়ি দিলেই তো মেয়েদের লাইন লেগে যাবে। শুধু কি মেয়েদের লাইন! অসংখ্য গার্ডিয়ানদেরও লাইন লাগবে তোকে মেয়ের জামাই করার আশায়। সেই তুই কি না এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছিস? ”
শান্তর কথাকে তিহান পাত্তা না দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
” জানিস শান্ত, আজ অনেকদিন পর এতো সুন্দর কিছু মুহূর্ত কাটিয়েছি। গল্প, আড্ডায় এতটা ডুবে গিয়েছিলাম যে, পুরনো সব কথা মাথায় আসেনি। ”
” এতই যখন ভালো লেগেছে তাহলে আমাকে এতগুলো কথা শুনিয়েছিস কেন? আর কেনই বা আড্ডার সমাপ্তি ঘটালি?”
” আরে আগামীকাল অফিস আছে না, সেজন্য! ”
” ও ভালো করেছিস। আচ্ছা তিহান… ”
” পুরনো কথা বাদ দিয়ে অন্য কোনো কথা বল। পুরনো কথা শুনতে ভালো লাগে না।”
” আচ্ছা পুরনো কথা না’হয় নাই বললাম কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে তো বলতে পারি! তো কি ভেবেছিস নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ”
” নতুন করে কি ভাবার আছে? এখন যেমন চলছে ঠিক তেমনভাবেই চলবে। ”
” এটা কি কোনো ভবিষ্যৎ হলো? তোর কি বিয়ে করা লাগবে না? ছেলেমেয়ের বাবা হওয়া লাগবে না? নাকি সারাজীবন চিরকুমার হয়েই কাটিয়ে দিবি? আর আমি কি পারবো সবসময় তোকে সময় দিতে এখনের মতো? আমারও তো কিছুদিন পর বিয়ে হবে, বউ আসবে ঘরে। তখন কি বউকে সময় দিব নাকি তোকে?”
” তোকে কি বলেছি আমাকে পাহাড়া দিতে? আর চিরকুমার থেকে যদি মনে শান্তি পাই তাহলে কেন সেই শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করব? ”
” মানে? ”
” মানে কিচ্ছু না। চল এবার উঠি। ঘন্টা খানেক বাদেই ফজরের আযান দিবে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তো আবার অফিসের জন্য বের হতে হবে নাকি? ”
” আজ না’হয় বাসায় নাই বা ফিরলাম তিহান! আর তো মাত্র ঘন্টা খানেক, এখানেই পার করে দিই। ”
” আর অফিস? ”
” সূর্যের আলো ফুটলে এখান থেকেই অফিস চলে যাবো। কি বলিস…. ”
” তোর মতো আজব প্রকৃতির মানুষই পারে এসব উদ্ভট কথা বলতে। তুই থাক এখানে বসে আর অপেক্ষা কর সূর্যের আলো ফুটবার। আমি চললাম বাড়ি। ”
” আরে তিহান! দাঁড়া আমিও আসছি। ”
” তুই আসবি কেন,সূর্যের আলো ফোঁটার অপেক্ষা করার পাশাপাশি রাস্তা বিলাসও কর। ”
” আমি কি এখানে একা বসে রাস্তা বিলাস করব নাকি? ওই তিহান! রাস্তা আবার বিলাস করা যায়? ”
” তোর মতো মানুষরা করতে পারে। এবার আয় তাড়াতাড়ি বাইকে উঠ। ”
” হুম হুম, আসছি দাঁড়া। ”
.
অতল অনেকক্ষণ হয়েছে ঘর থেকে বের হয়েছে কিন্তু কি কারণে বের হয়েছে তা তানহার অজানা।অতল যাওয়ার আগে তানহাকে কিছুই বলে যায়নি। আর না তানহা নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু এখন তানহার একা একা ঘরে মোটেও ভালো লাগছে না। এদিকে অতলেরও ঘরে আসার নাম নেই। তানহা একা একা ঘরে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।ঘরে একা বসে থাকলেই যে পুরনো স্মৃতিগুলো তাকে তাড়া করে বেড়ায়। মাঝে মাঝে তার হৃদয়কে তাক করে তীরও নিক্ষেপ করতে পিছপা হয় না। যেটা সে কিছুতেই হতে দিতে চায় না। সে পুরনো সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতে চায়। নতুন মানুষটিকে নিয়ে সে বাঁচতে চায় নতুন করে। যেখানে পুরনো স্মৃতিগুলো ধোঁয়াশার মতো উড়ে মুক্ত আকাশে মিশে যাবে। কেননা তানহা বিশ্বাস করে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এ তিনটি জীবনে একবারই আসে। একের অধিক নয়। তাহলে কেন সে পুরনো স্মৃতি মনে করে নিজে কষ্ট পাবে সেই সাথে তার সাথে জড়িয়ে যাওয়া মানুষটিকেও কষ্ট দিবে? তার তো সেই অধিকার নেই। সে হয়তো এই মানুষটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেনি কিন্তু.. এই মানুষটি তো তাকে ঘিরেই নিজের স্বপ্ন সাজিয়েছে। তাহলে কি করে তার নিজের সুখের জন্য অন্যের সুখে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে?সে পারবে না, কিছুতেই পারবে না। তাকে সব মেনে নিতে হবে। এমনকি তার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও তাকে সুখে থাকবে। হ্যাঁ সে সুখে থাকবে। তাকে সুখী হতে হবে শুধুমাত্র… অতলের জন্য তাকে সুখী হতে হবে।
কথাগুলো ভেবে তানহা বিছানা ছেড়ে দক্ষিণা বেলকনির কাছে গেল। বেলকনিতে দুটো চেয়ার রয়েছে। এক হচ্ছে রকিং চেয়ার আর অন্যটি ইজিচেয়ার। তানহার এই মুহুর্তে রকিং চেয়ারে বসতে একটুও মন চাচ্ছে না। তাই গিয়ে ইজিচেয়ারে বসল। আর তখনি সে বুঝতে পারল অতল কেন দু’রকমের দুটো চেয়ার একই বেলকনিতে রেখেছে।
তানহা চেয়ারে বসে পা ঝুলাচ্ছে আর প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একবার সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্চতা মাপার চেষ্টা করে , তো একবার দূরদূরান্তের গাছগাছালির বাতাসের বেগ বুঝার চেষ্টা করে , তো আরেকবার উন্মুক্ত আকাশের বুকে অসংখ্য সাদা মেঘের ছুটোছুটির ব্যবধান বুঝার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কিছুই যখন সে মন থেকে করতে পারছে না উল্টো পুরনো কথাগুলো মনে পড়তে শুরু করলো সে তখনি বেলকনি থেকে ফিরে গেল ঘরের ভেতর। আর কি করবে ভাবতে লাগল। তারপর তার মাথায় এলো সে ঘর গোছাবে। তাতে তো অন্তত সময় কিছুটা কাটবে। তাই গুছানো পরিপাটি ঘরকে ফের নতুন করে গোছাতে লাগলো। কিন্তু গোছানো ঘর গুছাতে কি আর সময় বেশি লাগে? তাইতো মিনিট বিশেকের মাঝেই ঘর গোছানোও শেষ হয়ে গেল। এখন তানহা কি করবে এটাই গালে হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছে। সে যে একমুহূর্তের জন্যও আনমনা হয়ে থাকতে চায় না। তাই বসা থেকে উঠে এগুতে লাগল রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরে গিয়ে থালাবাসনের রেক থেকে একটি মেলামাইনের ট্রে হাতে নিয়ে সেটাতে এক পট চাল ও এক পট ডাল মেশালো। তারপর সেই ট্রে টি হাতে নিয়ে ফিরে এলো তার শোবার ঘরে। ট্রে টি বিছানার কোণে রেখে ফ্যান ছেড়ে এসে বসল বিছানার উপর। তারপর ট্রে টি হাতে নিয়ে বেশ মনোযোগী হয়ে আলাদা করতে লাগল চাল থেকে ডালকে। এভাবে প্রায় দশ মিনিট পার হতেই কলিং বেল বেজে উঠল। তানহা হাতে থাকা ট্রে টি বিছানার উপর রেখে দ্রুত পায়ে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে দিতেই অতল একটি শপিং ব্যাগ তানহার হাতে দিয়ে ক্লান্ত ক্লান্ত মুখ নিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা বেড রুমে গিয়ে নিজের শরীরটুকু মেলে দিল বিছানার উপর। এদিকে তানহা দরজা লাগিয়ে শপিং ব্যাগটি ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে একটি গ্লাসে নরমাল পানি ও ফ্রিজের ঠান্ডা পানি মিক্সড করে নিয়ে গেল অতলের কাছে। আর মৃদু হাসি দিয়ে শান্ত গলায় বলল,
” কষ্টকরে একটু উঠে পানিটুকু খেয়ে নিন ভালো লাগবে। ”
অতল মুচকি হাসি দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে তানহার হাত থেকে পানিটুকু নিয়ে গটগট করে খেয়ে ফেলল। অতলের খাওয়ার ভঙ্গি দেখলে যে কেউ বলবে সে হয়তো এই পানি টুকুর-ই অপেক্ষায় ছিল। গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে বিছানার পাশে থাকা সাইড টেবিলের উপর গ্লাসটি রেখে বিছানায় বসেই একহাত দিয়ে তানহাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো। দুহাত দিয়ে তানহাকে জড়িয়ে ধরে তানহার মেদহীন পেটে অতল তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িপূর্ণ থুতনি রেখে মাথাটা একটু উঁচু করে চোখ দুটো তানহার চোখ বরাবর রেখে বলল,
” তুমি বুঝলে কি করে আমার তৃষ্ণা পেয়েছে? ”
” না বুঝার তো কিছু নেই।এই কড়া রোদে বাহির থেকে যে-ই আসুক না কেন,তৃষ্ণা তো পাবেই। ”
” জানো তানহা, আমার না এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপার গুলো খুব ভালো লাগে। সোজা ভাষায় বলতে পারো বেশ উপভোগ করি এই জিনিস গুলোকে। কত রাত যে এদিন গুলোর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েছি এ কেবল আমিই জানি। ”
” হুম, এটাই স্বাভাবিক কারণ এ দিনগুলোকে ঘিরে যে প্রতিটি মানুষেরই অনেক কল্পনা জল্পনা মনের গহীনে লুকোনো থাকে। ”
” তবে আমার মনে হয় অন্যদের থেকে আমার কল্পনাটা ক্ষানিকটা বেশি গভীর। কেননা বর্তমানে বেশিরভাগ ছেলেরই এক্স বলতে একটা শব্দ থাকে যার ফলে তাদের স্বপ্নটা বেশি একটা গভীর হওয়ার সুযোগ পায় না। আর আমি…আমি তো বউয়ের অপেক্ষায় এক্স শব্দটির সাথে পরিচিত-ই হইনি। তাই বউকে ঘিরে আমার স্বপ্নের মাত্রাটা তাদের তুলনায় অনেকটাই বেশি। বুঝতে পেরেছ? ”
” হুম, বাহিরে যে গিয়েছিলেন কিছু কি খেয়েছেন? ”
অতল তানহার নরম তুলতুলে পেটে নিজের নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
” উহু.. বউকে ছাড়া যে কিছু খেতে ভালো লাগে না। ”
” ওহ্! ”
” তবে বউকে নিয়ে একসাথে খাওয়ার জন্য একটা জিনিস এনেছি। হয়তো তোমার বেশ পছন্দ হবে কেননা আমার জানামতে বেশিরভাগ মেয়ের-ই এই খাবারটি খুব পছন্দ। ”
মনে ” ও তাহলে সেই খাবারটি দিন আমি প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে আসি। ”
” দিয়েছি তো তোমায়। ”
” কখন দিলেন? ”
” কেন? ঘরে ঢুকার সময় একটি শপিং ব্যাগ তোমার হাতে দিলাম না? ওটাতেই তো খাবার। কোথায় রেখেছ ব্যাগটি? ”
” ও ওই ব্যাগটি? ওটা তো আমি ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে এসেছি। একটু অপেক্ষা করুন আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি। ”
” আচ্ছা, যাও। তবে দ্রুত এসো। ”
” জ্বি আচ্ছা। ”
তানহা যেতে নিলেই তুহিন বলে উঠলো,
“কি এটা? ”
” তেমন কিছু না। ”
” তোমার হাতে দেখছি কিছু আছে কিন্তু তুমি বলছ তেমন কিছু না! এটা আবার কেমন কথা? দেখি দেখি কি আছে ট্রে তে। চাল ডাল! এই এখানে চালে ডালে মেশানো কেন? রাতে খিচুড়ি রান্না করবে বুঝি? ”
” না.. মানে…”
“তাহলে কী করবে?”
“আসলে..
” বুঝেছি, কাজ খুঁজে পাচ্ছিলে না তাই চালে ডালে মিশিয়ে বসে সময় পার করছিলে তাই তো? ”
তানহা মুখটা মলিন করে বলল,
” হুম। ”
তানহার উত্তর শুনে অতল হো হো করে হেসে উঠল। আর বলল,
” তোমার মতো পাগলী এ জীবনে আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি।কাজ নেই বলে চালে ডালে মিশিয়ে বসে পড়ে। হো… হো…”
” কি করবো বলুন? একা একা কতক্ষণ থাকা যায়? তাই আর কি…”
” তাই তুমি এসব নিয়ে বসবে? আচ্ছা যাই হোক এখন আর এসব বাছার প্রয়োজন নেই। নাহলে বাছাই করতে করতে কোমড় বাঁকা হয়ে যাবে। তারচেয়ে ভালো এগুলো যখন মিশিয়েই ফেলেছ রাতে ভাত রান্না না করে এগুলো দিয়ে ভুনাখিচুড়ি রান্না করে ফেলো। সাথে ডিম ভাজা। অস্থির হবে খেতে। ”
” জ্বি আচ্ছা। ”
” এবার যাও, দ্রুত ওই খাবারগুলো সার্ভ করে নিয়ে এসো। নাহলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। ”
” আচ্ছা। ”
.
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here