অন্যরকম ভালোবাসা, পর্ব:১০

#অন্যরকম_ভালোবাসা

#পর্ব_১০

মুশফিক সাহেবের অফিস নয় তলায়। উনি আজ সকালে অফিসে এসে দেখেন অফিসের দু’টো লিফটই বন্ধ। একটা সার্ভিসিং এর জন্য আগেই বন্ধ ছিল, আর বাদবাকিটাও বিনা নোটিশে আজ বিকল হয়ে অবসরে গেছে। কিন্তু তাই বলে তো আর জীবনযাত্রা থেমে থাকবে না ,তিনি বহুকষ্টে থেমে থেমে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন। অফিসে নিজের রুমে ঢুকে তিনি রীতিমতো অসুস্থবোধ করলেন। এমনিতেও অন্তরার ব্যপারটা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে তিনি এতই চিন্তিত ছিলেন যে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে চিন্তায় চিন্তায় তার শরীর খারাপ করছে, খুব সম্ভবত ব্লাড প্রেসারের গতি উপরের দিকে।

মুশফিক সাহেব রুমে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন , একগাদা পানি খেলেন , তারপর খানিকটা সুস্থ বোধ করার পর আস্তে আস্তে অফিসিয়াল কাজে ডুবে গেলেন।

বেলা এগারোটায় পিয়ন ছেলেটা এসে জানালো, একটা ছেলে তার সাথে দেখা করতে এসেছে। মুশফিক সাহেবের হুঁশ ফিরল, কাজের চাপে উনি ভুলেই গিয়েছিলেন যে আজকে তিনি স্পন্দনকে আসতে বলেছিলেন। তিনি ওকে রুমে পাঠিয়ে দিতে বললেন।

একটু বাদে যেই ছেলেটা রুমের দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল তাকে প্রথম দেখাতে খারাপ মনে হলোনা মুশফিক সাহেবের। দীর্ঘকায়া , শক্ত পোক্ত গড়নের সাথে দাঁড়াবার ঋজু ভঙ্গি ছেলেটার চরিত্রের আত্মবিশ্বাসী অংশটুকুর স্পষ্ট পরিচয় দেয়। জিন্স আর জলপাই রঙ্গা পাঞ্জাবি পরিহিত ছেলেটা বেশ ঘরোয়া ভঙ্গিতে রুমে ঢুকলো।

– আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।

বলেই হেন্ডশেক করার আশায় হাতটা উনার দিকে বাড়িয়ে দেয় স্পন্দন। ছেলেটার আন্তরিক ভাবভঙ্গি আর সরল হাসি দেখে মুশফিক সাহেব খানিকটা হকচকিয়ে যান, তিনি একটু অবাক হয়েই হাত বাড়িয়ে দেন হ্যান্ডশেক করার জন্য। প্রথম দেখাতে ছেলেটার এতটা সহজভাব তিনি আশা করেননি। তিনি সালামের উত্তর দিয়ে স্পন্দনকে ইশারায় বসতে বললেন।

– কেমন আছো স্পন্দন ?

– জ্বী আছি ভালই, আপনি কেমন আছেন?

মুশফিক সাহেব এবার ছেলেটাকে চমকে দেবার চেষ্টা করলেন। ছেলেটা বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে কথা বলছে, দেখাই যাক তাকে প্রথমেই অপ্রিয় কিছু প্রশ্ন করলে সে কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তিনি তাই স্পন্দনকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন,
– কী করো তুমি ? মানে বাই প্রফেশন ?

– আঙ্কেল আমি বুয়েট থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি গত বছর। বাই প্রফেশন আপাতত বেকার, কারণ আমি ছুটিতে আছি।
চেয়েছিলেন স্পন্দনকে চমকে দেবেন, কিন্তু ছেলেটার সহজ-স্বাভাবিক উত্তর শুনে তিনি নিজেই ভড়কে গেলেন!

– ছুটিতে আছো মানে !?

– মানে খুব সোজা আঙ্কেল। একটু বুঝিয়ে বললে আপনিও ব্যপারটা ধরতে পারবেন, আমার বাবার মত।

স্পন্দন কথা বলতে বলতে ঝুঁকে আসে মুশফিক সাহেবের দিকে , যেনো শিক্ষক ছাত্রকে পড়া বোঝাচ্ছে। ওর এমন অদ্ভুত আচরণে তাজ্জব হয়ে যান তিনি।

– আমরা সাধারণত বছর পাঁচে পা দিলেই স্কুলজীবন শুরু হয়ে যায়। তারপর পড়তে পড়তে আর ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে ভাবতে পুরো জীবনটাই একপ্রকার ব্যস্ততায় পার করে দেই। কিন্তু জীবন তো একটাই, আর এটা নিজের মনের মত উপভোগ করার অধিকার আমাদের সবার আছে, তাই না ? তাছাড়া আমি মনে করি জীবনের একঘেয়ে রুটিন থেকে বের হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে কাজে যোগ দিলে কাজে উৎসাহ আরো বাড়ে। তাই আমি আমার ছাত্রজীবন শেষ করে দু’বছরের জন্য অবসরে আছি। এই দুই বছর আমি প্রাণভরে ঘুরবো, আড্ডা দেবো… মন যা চাইবে তাই করবো। এরপর বাবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তার ব্যবসায় হাত লাগাব আশা করি।

মুশফিক সাহেব স্পন্দনের যুক্তি শুনে হাসবেন না কাঁদবেন বুঝে পান না। তিনি বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চান,

– এসব খোঁড়া ফিলসফি তুমি কোত্থেকে কুড়িয়ে পেয়েছো শুনি?

– খোঁড়া যুক্তি বলবেন না প্লিজ, এটা আমার বহু পরীক্ষিত মতামত।

স্পন্দনের জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব ভঙ্গি অসহ্য ঠেকে মুশফিক সাহেবের।

– আচ্ছা ! তো এরপর তুমি কাজে ঢুকেই এক ঝটকায় উন্নতি করে ফেলবে? সেইসঙ্গে বয়সটাও তোমার সাথে অবসরে যাবে, তাই না? সব কিছু এত সোজা !! জীবন থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ দুটো বছর চলে গেলো সেটা কিছুই না !!!

কথা বলতে বলতে মুশফিক সাহেব কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ তার ভীষণ রাগ হল অন্তরার ওপর, সামনে বসা স্পন্দন নামের ছেলেটার উপর। হুট করে এতটা প্রতিক্রিয়া কেন দেখাচ্ছেন সেটা তিনি নিজেও জানেন না। হয়তো এ কয়েকদিনে অন্তরা বিষয়ে তার উপর দিয়ে যে মানসিক চাপের ঝড়ো বাতাস বয়ে গেছে এটা তারই বহিঃপ্রকাশ ।

মুশফিক সাহেবকে হঠাৎ এভাবে রাগ হতে দেখে স্পন্দন নিজেও একটু ঘাবড়ে গেলো। সে ভেবেছিলো উনি যুক্তিবাদী মানুষ, যুক্তি দিয়ে বুঝালে উনি নিশ্চই তার ব্যাখ্যা বুঝবেন। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে এই কারণে প্রায় সবটাই এলোমেলো হতে চলেছে!! স্পন্দন বুঝে পায়না তার মুশফিক সাহেবের প্রশ্নের উত্তর দেয়া উচিত কিনা, তাই সে চুপ করে থাকে।

এদিকে স্পন্দনকে চুপ করে থাকতে দেখে মুশফিক সাহেবের উত্তেজনা চরমে গিয়ে পৌঁছায়। তিনি গর্জে ওঠেন,
– চুপ করে আছো কেন? জবাব চাই আমি, জীবন থেকে চলে যাওয়া দুইটা বছরের কী কোনই মূল্য নেই?

মুশফিক সাহেব সজোরে টেবিলে চাপড় মেরে দাঁড়িয়ে পড়েন। রাগে উত্তেজনায় তার শরীর থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ বুকে সুক্ষ একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। তার মনে হল, গলার টাইটা যেন ফাসের মত তার কন্ঠ নালিতে চেপে বসেছে। যার ফলে উনার শ্বাস নিতেও কষ্ট হতে থাকে। উনি ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন আবার।

স্পন্দন অন্তরার বাবাকে এভাবে রেগে যেতে দেখে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সেকি চলে যাবে না উনার রাগ কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ? ভাবতে ভাবতেই স্পন্দনের চোখ গেলো মুশফিক সাহেবের দিকে। অপ্রতিভ স্পন্দন অবাক হয়ে দেখে, উনি কাঁপা হাতে উনার গলার টাইয়ের নড ধরে টানছেন। হঠাৎ করেই উনার ফর্সা মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেছে! মুশফিক সাহেব ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছেন, মুখ হা করে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব সম্ভবত উনার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

ব্যাপার কি দেখার জন্য স্পন্দন দ্রুত টেবিল টপকে মুশফিক সাহেবের পাশে এসে দাঁড়ায়, তার কাঁধে হাত রেখে আন্তরিক ভঙ্গিতে জানতে চায়,
– আঙ্কেল, ঠিক আছেন আপনি? কী হয়েছে আপনার ?

মুশফিক সাহেব দেখলেন স্পন্দন তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে তাকে কি যেনো বলছে। তবে ওর কোন কথাই বুঝতে পারছেন না তিনি , শব্দগুলো যেনো বার বার মস্তিষ্কে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলে চারদিকে এলোমেলোভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। বুকের ব্যথাটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে …. অসংখ্য সুচ ফোটার মতো অসহ্য বেদনায় তিনি মুখ বিকৃত করে ফেলেন। চোখের সামনে পৃথিবীটা যেন চরকির মত বন বন করে ঘুরছে। তিনি বুঝতে পারলেন তার হাত পা অসাড় হয়ে আসছে।

স্পন্দন স্পষ্ট বুঝতে পারলো মুশফিক সাহেবের অবস্থা ভালো না। সে সাহায্যের জন্য এদিক সেদিক দেখলো, টেবিলের কল বেলটা চোখে পড়তেই তাতে এলোপাতাড়ি কয়েকটা থাবা চালায় স্পন্দন।

পিয়ন বদি মিয়া মুশফিক সাহেবের রুমের বাইরেই বসা ছিলো। বেলের শব্দ শুনে ভিতরে ঢুকে মুশফিক সাহেবকে প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সে চোখ বড় বড় করে হা করে তাকিয়ে থাকে।

– তাকিয়ে দেখছেন কি? জলদি কাউকে ডাক দিন, দেখছেন না উনার অবস্থা সিরিয়াস!!

ধমকে ওঠে স্পন্দন। স্পন্দনের ধমক শুনে হুঁশ ফেরে পিয়ন বদির। সে সাহায্য চাইতে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। স্যারের শরীর যে ভালো না সেটা সে সকালেই বুঝেছিল যখন উনি অফিসে এসেই পুরো এক লিটারের একটা পানির বোতল নিমিষেই শেষ করে ফেললেন। আল্লাহ্ জানে, উনার কি হল! বদি খবরটা জানাতে ম্যানেজার সাহেবের রুমে গেলো সবার আগে ।

একটু পরে…

অফিসের সবাই থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে মুশফিক সাহেবের রুমে। কেউ কেউ ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। মুশফিক সাহেবকে ধরাধরি করে রুমের একমাত্র সোফাটাতে শুইয়ে দেয়া হয়েছে। উনি চেতনা হারিয়েছেন অনেক আগেই। শুধু থেকে থেকে গলা দিয়ে বিচিত্র ঘড়ঘড় জাতীয় শব্দ বের হচ্ছে থেকে থেকে। স্পন্দন অন্তরার সাথে ফোনে কথা বলছে আর অস্থিরভাবে পায়চারী করছে ঘরময়।

– এ্যাম্বুলেন্স আসতে কতক্ষণ লাগবে স্পন্দন ?
অন্তরার কন্ঠে উদ্বেগের ছোঁয়া।

– খবর তো দিয়েছি, ওরা বলল বিশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে। সমস্যা সেটা না, সমস্যা হলো লিফট নেই। এ্যাম্বুলেন্স এসে এই নয় তলায় উঠে আঙ্কেলকে নিয়ে নামতে সময় লাগবে প্রচুর, এমনিতেই অনেকটা সময় নষ্ট হচ্ছে।

– কিন্তু এতটা সময় তো নেই আব্বার হাতে। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে! এখন কী হবে স্পন্দন !!?
কোকিয়ে ওঠে অন্তরা।

স্পন্দন নিজের ঠোঁট কামড়ে খানিকটা ভেবে নিয়ে বলে,
– চিন্তা কইরো না, আমি দেখছি কি করা যায়।
বলেই ফোন কেটে দেয় স্পন্দন। তারপর অফিসের সবার দিকে ফিরে বলে,
– এ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে উনাকে কোনভাবে নীচে নামিয়ে নেয়া যায় না?

– কীভাবে? লিফট দুটোই তো বন্ধ , তার উপর স্যারের একেবারে অচেতন অবস্থা !!! তারচেয়ে আমাদের এ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করাই ভাল।

গম্ভীরমুখে পরামর্শ দিলেন ম্যনেজার সাহেব। স্পন্দন অবাক হয়ে দেখে সবাই কম বেশি তার কথায় সায় দিচ্ছে। অথচ চাইলে কয়েকজন মিলে ধরে উনাকে নীচে নামানোর চেষ্টা করতে পারে।

স্পন্দন খানিকটা সময় এই বেকার ভদ্রলোকগুলোর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে, তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুশফিক সাহেবের হাত ধরে আলতো করে টান দিয়ে তার ভারী শরীরটা অবলীলায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে রওনা দেয়।

যারা এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে দেখছিল তাদের মধ্যে থেকে কিছু অতি চালাক লোক , যারা জানে এই মুহূর্তে স্যারের সাথে থাকলে উনি অফিসে ফিরলে উনার সুনজরে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে তারা স্পন্দনের পিছে পিছে সরু সিঁড়িপথ দিয়ে ছুটলো সাহায্যের মিথ্যে অভিনয় করতে করতে।

মুশফিক সাহেবের সবকিছু কেমন ভাসা ভাসা স্বপ্নের মত লাগছে। দূরে কোথাও সানাই বাজছে কি? নাকি উনার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? অফিসে সানাইয়ের শব্দ আসবে কোথা থেকে? তবে কি সাইরেন বাজছে দূরে কোথাও?
উনি পরিষ্কার করে কিছু ভাবতে পারছেন না। সবকিছু কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নের মত লাগছে তার কাছে। তার মনে হল, কেউ একজন উনাকে ধরে যত্ন করে শুইয়ে দিচ্ছে। এদিকে বুকের ব্যথাটা স্রোতের মত ছড়িয়ে পড়েছে শরীরময়। চোখের সামনের ধোঁয়াটে ভাব সরিয়ে উনি তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার মনে হল তার চোখের সামনে থেকে সব আলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
– আলো নিভিয়ে দিয়ো না প্লীজ!

পুরোপুরি জ্ঞান হারাবার পূর্বে মুশফিক সাহেব দেখলেন একটা উদ্বিগ্ন মুখ তার উপর ঝুঁকে আছে। কী সুন্দর শিশু সরল তার চোখদুটো !!! তার মনে হলো উনি চেনেন একে, ওই চোখ দুটোর মালিককে উনি চেনেন… তবে মনে করতে পারছেন না সে কে !!?

চলবে ….

#আফসানানীতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here