অপরিচিত ঘ্রাণ ( ৩য় + ৪র্থ পর্ব )শেষ

অপরিচিত ঘ্রাণ ( ৩য় + ৪র্থ পর্ব )

জিয়ান বাথরুমে উলঙ্গ হয়ে গোসল করেছিল; জ্বীনপরী তুরেছা তৈয়েবী সে অবস্থায় তাকে দেখে ফেলেছে ।

উলঙ্গ অবস্থায় তাকে দেখে বেশ পছন্দ হয়েছে জ্বীনপরীর, তাই সে বন্ধুত্ব চায়, চায় সে জিয়ানকে নিয়ে তার ডানায় করে আকাশে মেঘের আড়ালে ঘুরে বেড়াতে।

কিন্তু জিয়ান জ্বীনদের ভয় পায়, বিশেষ করে আদম সন্তান তুরেছা তৈয়েবীর ভাইয়ের দু’চোখের দুশমন, যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় তুরেছা তৈয়েবী তার সাথে সম্পর্ক করেছে, তাহলে তাকে নিশ্চিত মেরে ফেলবে।

অন্ধকার রুমে সে জ্বীনপরীকে লক্ষ করে বলল, ‘না, আমি বন্ধুত্ব করতে পারবো না।’

তুরেছা তৈয়েবী তখন বিগড়ে গিয়ে বলল, ‘ তোর তো সাহস কম নায় বে, জ্বীনের মুখে মুখে তর্ক করিস। কি বললি তুই ? বন্ধুত্ব করবিনা। তুরেছা তৈয়েবীর সাথে বন্ধুত্ব করবে নাকো সে ! হা – হা – হা।’

খানিক আগেই জিয়ানের কাছে তুরেছা তৈয়েবীর কথাবার্তা বেশ বন্ধু সুলভ ও বাচ্চাদের মতো মিষ্টি মনে হয়েছিল, এখন কেমন জানি সবকিছু ভয়ংকর লাগছে।

ভয়ংকর হাসির শব্দে জিয়ান রুমে বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু বাতি জ্বলছে না ৷ সে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করছে; কিন্তু পারছে না। দরজা খোলার চেষ্টা করছে; কিন্তু দরজা খুলছেনা। অপরিচিত ঘ্রাণটা সময়ে সময়ে গাঢ় হচ্ছে।
পরিবেশটা আরও ভয়ংকর হচ্ছে, তুরেছা তৈয়েবী চড়াও হচ্ছে।
হঠাৎ মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসলো ‘ ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান-নাউম।’ সাথে সাথে রুমের বাতি জ্বলে গেলো, রুমে এখন আর অপরিচিত সেই ঘ্রাণ নেই। তুরেছা তৈয়েবীর হাসির শব্দ নেই। জিয়ানের কাপড় ঘামে ভিজে গেছে। সে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে কাদতে কাদতে মায়ের উপর পড়লো । মা হকচকিয়ে উঠলেন ঘুম থেকে, বাতি জ্বালিয়ে জিয়ানের অবস্থা দেখে কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখ ফেটে জল পড়তে লাগলো শায়লা বেগমের । জিয়ানের চোখমুখ ফোলে গেছে, চেহারায় স্পষ্ট ভয়ের ছাপ , শায়লা বেগম জিয়ানের গালে হাত দিয়ে আদুরে গলায় বললেন, ‘কি হয়েছে বাবা ?’
জিয়ান তুরেছা তৈয়েবীর সম্পর্কে সব বললো। শায়লা বেগম ভাবলেন এটা বোধহয় স্বপ্ন ।
কিন্তু যখন জিয়ান ভার্সিটি এবং বৃৃষ্টির রাতের কথা মা’কে জানালো, তখন তিনি নিজেই ভয় পেয়ে গেলেন। তাহলে কি আসলেই জ্বীন পরীর নজর পড়েছে উনার একমাত্র ছেলের উপর ! উনার বুক খালি করে তুরেছা তৈয়েবী কি জিয়ানকে তাদের রাজ্যে চিরদিনের জন্য নিয়ে যাবে ? শায়লা বেগম মনে মনে ডিসিশন নিয়ে নিলেন আজই গ্রামে চলে যাবেন, সবকিছু ঠিকঠাক হলে অন্য জায়গায় বাসা নেয়া যাবে। আজকে গ্রামে যাবার রাস্তায় কবিরাজও দেখিয়ে নিবেন ছেলেকে । অযু করে দু’জনে ফজরের নামাজটা পড়ে নিলেন, নামাজ শেষে মালামাল সব ফেলে রেখেই মা – ছেলে এই জ্বীনের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। তখন রাতের অন্ধকার কেটে গেছে, চারদিকে মিটিমিটি আলো।
জিয়ান মা’কে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘তুরেছা তৈয়েবী যদি মানুষের সুরত ধরে আমাদের সঙ্গে যায়। সেদিন বৃষ্টির রাতে যেভাবে মুখে গোঁফ আর শাদা কাচা চুলের এক ভদ্রলোকের সুরত ধরে এসেছিল অথবা ভার্সিটিতে যেভাবে শাদা ধবধবে পোশাকের সুন্দরীর সুরত ধরে এসেছিল।’
শায়লা বেগম ছেলের কথা শুনে ভয়ে জ্বীন থেকে রক্ষা পাবার দোয়া বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করলেন, ‘আউজুবি ওয়াজহিল্লাহিল কারিম ওয়া বি কালিমাতিল্লাহিত তামাতিল্লাতি লা ইউজায়ূজু হুন্না বাররা। ওয়ালা ফাজিরু মিন শাররি মা ইয়ানজিলু মিনাস সামায়ে ওয়া শাররিমা ইয়ারিজু ফিহা। ওয়া শাররি মা জারা ফিল আরদি। ওয়া শাররি মা ইউখরিজু মিনহা। ওয়া মিন ফিতানিল লাইলে ওয়ান নাহারে। ওয়া মিন তাওয়ারিকিল লাইলে ওয়ান নাহারে ইল্লা তারিকান ইয়াতরুকু বিল খাইরে ইয়া রহমান।’
মা – ছেলে হাটছেন, এতো সকালে গাড়ি নেই, সুনসান রাস্তা। বিশ মিনিট হাটলে পয়েন্টে যেয়ে বাস পাবেন, অসুস্থ শায়লা বেগম আজ অদ্ভুত কারণে হাটতে পারছেন। আজ উনি নিজের শেষ শক্তি দিয়ে হলেও ছেলেকে বুকে আগলে রাখতে চান, যেভাবে শিশু অবস্থায় ছেলেকে বুকে আগলে রেখেছিলেন। তিনি দোয়া – দুরুদ পড়ে হাটছেন। বাসে করে যেয়ে তারা প্রথমে সবুজপুর নামবেন, সেখানে একজন জ্বীন তাড়ানোর কবিরাজ আছে। কিছু তাবিজ – টাবিজ নিয়ে যাবেন। হাটতে হাটতে তারা বাস স্ট্যান্ড চলে এসছেন, খানিক্ষণ পর বাস এসেছে। জিয়ান বাসের গ্লাসের পাশে বসে বাহির দেখতে দেখতে যাচ্ছে, একটা বিষয় ভাবতেই বারবার তার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে, আজ সে গ্রামে গেলে মিলিহার সাথে দেখা হবে। মিলিহা তার মামাতো বোন, নানাবাড়ি তাদের গ্রামেই। মিলিহা এবং জিয়ান একজন আরেকজনকে ভালোবাসে।
জিয়ানের নাকে হঠাৎ অপরিচিত সেই ঘ্রাণ এসছে, সে সিট থেকে সোজা দাড়িয়ে বাসে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে, বাস ভর্তী মানুষ, জিয়ানের ধারণা এই মানুষগুলোর মধ্য নিশ্চিয় তুরেছা তৈয়েবী এসে গেছে। জিয়ান তার সামনের সিটের ভদ্রলোকের দিকে তাকায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত, এই লোকটা নয় তো তুরেছা তৈয়েবী ?’ বাস এতক্ষণে সবুজপুর চলে এসছে, শায়লা বেগম ছেলেকে নিয়ে বাস থেকে নামলেন। জিয়ান মা’কে বলল, ‘বাসে আমি সেই অপরিচিত ঘ্রাণ পেয়েছি মা, নিশ্চয় জ্বীনপরী আমাদের পিছু নিয়েছে।’
শায়লা বেগম ছেলেকে স্বান্তনা দেন, ‘এইতো খানিক পরেই আমরা কবিরাজের বাড়িতে পৌঁছে যাবো, তারপর আর ঘ্রাণ পাবেনা।’
হাটতে হাটতে তারা কবিরাজের বাড়িতে এসে পৌছে গেছেন, ‘কবিরাজারে বাড়িতে অদ্ভুত অদ্ভুত সব গাছগাছালি, বেশিরভাগ গাছ জিয়ানের কাছে অপরিচিত ভয়ংকর। বাড়ির উঠানে তুলসি গাছ, নীম গাছ। ঘরের দরজার সামনে সাপের মতো আঁকাবাকা লাঠি। শায়লা বেগম ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, ঢুকে দেখলেন সেখানে অনেক রুগী। জিয়ান উকি দিয়ে দেখলো কবিরাজ পুরোপুরি নগ্ন, সে অবাক বিস্ময়ে মায়ের দিকে তাকালো। মা এখানে কোথায় নিয়ে এসেছেন তাকে ? কবিরাজ তো বেটা নিজেই একটা পাগল, লম্বা কোঁকড়ানো চুল, কালো তেল তেলে বিরাট বাড়িওয়ালা উলঙ্গ একটা লোক । শুধু কপালে লাল একটা ফিতা বাধা, আর কাধের এক পাশ থেকে কোমরের অন্য পাশে কালো দড়ি ঝুলে আছে । সব মিলিয়ে গা ছমছম অবস্থা, তার এই জায়গায় কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে৷ বাড়িটা কেমন অন্য গ্রহ মনে হচ্ছে৷ অনেক্ষণ পড়ে কবিরাজ তাদেরকে ডাকলেন, জিয়ান কবিরাজকে সব বিস্তারিত বললো। উলঙ্গ কবিরাজ কিছুক্ষণ জিয়ানের দিকে তাকিয়ে তাবিজ লিখে বলল, ‘ কোমরে, গলায়, হাতে এই তাবিজ সবসময় বেধে রাখতে । আর একটা তাবিজ দিলেন প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে পানিতে ভিজিয়ে পানি খাবার জন্য। বৃহস্পতিবার রাত ঠিক বারোটা এক মিনিটে যেকোনো চার রাস্তার মোড়ে একটা কালো মুরগী জবাই দিয়ে কলা পাতায় করে রেখে আসতে হবে। তাহলে জ্বীনপরী অবশ্যই কাছে আসতে পারবেনা। তবে উনার এখানে না এলে জ্বীনপরী অবশ্যই জিয়ানকে তাদের রাজ্যে নিয়ে যেতো। শায়লা বেগমের ভয় কিছুটা কেটে গেলো, কবিরাজের আরজি এসছে বারোশো পঁয়ত্রিশ টাকা। শায়লা বেগম টাকাটা দিয়ে সেখানকার নিয়ম অনুযায়ী মাথা নুয়ে দিলেন, কবিরাজ মাথায় হাত বুলিয়ে তাদেরকে বিদায় দিলেন। শায়লা বেগম সেখান থেকে বাসে করে তাদের গ্রাম মায়াপুর চলে এলেন। জিয়ান অবশ্য বাসে আর অপরিচিত ঘ্রাণ আর পায়নি। বাড়িতে জিয়ানের বাবা আজমল সাহেব ছেলের জন্য অস্থির হয়ে বসে আছেন, তিনি আজ স্কুল থেকে ছুটিও নিয়েছেন, জিয়ানের মামার আতর মিয়ার সাথে জিয়ানকে নিয়েই আলোচনা করছেন। হেড মাস্টার আজমল সাহেব ও শায়লা বেগমের একমাত্র ছেলে হচ্ছে জিয়ান, সবার বেশ আদর – কদরেই তার বেড়ে ওঠা। বিকেল নাগাদ জিয়ানের মামী, মামাতো ভাই মোজাম্মেল আর মামাতো বোন মিলিহা এসেছেন তাকে দেখতে। সবার চোখ ফাকি দিয়ে প্রতিদিনের মতো মিলিহা আর জিয়ান বাড়ি থেকে সটকে পড়েছে, মায়াপুরে একটা নদী আছে, নদীর পাড়ে আছে কাশফুল। জিয়ান আর মিলিহা প্রায় সময় কাশফুলের মাঝখানে গিয়ে বসে, সেটা তাদের বাড়ির পাশেই অবস্থিত। মিলিহার পরনে পিংক কালারের ড্রেস, খোলা চুল বাতাসে উড়ছে, কপালের টিপ বাম দিকে একটু হেলে আছে৷ জিয়ানের ইচ্ছে করছে সেটা হাত দিয়ে মাঝামাঝি বসিয়ে দিতে। মিলিহা আজকে খুব কম কথা বলছে, মনটা খানিক ভারী, বোধহয় জ্বীনপরীর জন্য মিলিহার ভয় হচ্ছে, যদি তার ভালোবাসার জিয়ানকে পরী ডানায় করে উড়াল দিয়ে মেঘের আড়ালে নিয়ে যায় সে কোথায় গিয়ে পাবে ? জিয়ান আর মিলিহা কাশফুলের মাঝখানে বসে আছে, সুনসান নীরবতা, কাশফুলের নরম ছোয়া তাদের শরীরে লাগছে, মিলিহা জিয়ানের দিকে একটু হেলে বসছে, মিলিহার ইচ্ছে করছে জিয়ানের কাধে একটু মাথা রেখে বসতে, ইচ্ছে করছে জিয়ান আমতা আমতা করে বলুক, ‘মিলিহা তোমার হাতটা একটু ধরি ?’
সে লজ্জা পেলেও অন্যদিকে তাকিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিবে, জিয়ান হাতটা ধরার সাথে সাথে তার মনে হবে শ্বাস বন্ধ হয়ে এসছে, পৃথিবীর সবকিছু থেমে যাচ্ছে। অথবা সে এই কাশফুলে শুয়ে পড়বে, জিয়ান থাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোবে, সাথে সাথে মিলিহার কাছে মনে হবে, এই জগতের সবকিছু তারা কেন্দ্রিক, জিয়ান জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে জোছনার রাত হয়ে যাবে, সোজা মাথার উপরে চাঁদ উঠবে, চাঁদ তাদেরকে জোছনা দিবে, হালকা বাতাস থাকবে, কাশফুলগুলো নড়বে, কানে লেগে কাতুকুতু করবে। খানিক পরে জিয়ান কাশফুলে শুয়ে পড়বে, মিলিহা জিয়ানের মুখের উপর মুখ নিয়ে খুব কাছ থেকে দেখবে, জোছনার আলোয় জিয়ানের মুখে চুলের ছায়া পড়বে, চোখ থাকবে জিয়ানের চোখ থেকে সামান্য উপরে, নাক থাকবে জিয়ানেত নাকের সামান্য উপরে, ঠোঁট থাকবে জিয়ানের ঠোটের সামান্য উপরে, খানিক পড়ে তাদের প্রতিটা অঙ্গ মিলে একাকার হবে।
অন্যমনস্ক মিলিহাকে জিয়ান একটা ঝাকুনি দিয়ে বলল, ‘কোথায় হারিয়ে গেলে মিলিহা ?’
-মিলিহা হকচকিয়ে উঠে বলল, ‘না কিছু না, চলো বাড়িতে চলে যাই, আমার ভালো লাগছে না।’
সূর্য ডুবে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে অন্ধকার আলোকে গিলে ফেলছে । মিলিহা আর জিয়ান বাড়িতে পৌঁছাল, জিয়ানের মামা – মামী সবাই চলে গেছেন, শায়লা বেগম তাদেরকে বলেছেন মিলিহা আজ এখানে থাকুক। মিলিহা আজ জিয়ানদের বাসায় থাকবে। মিলিহা বাথরুমে গেছে, অনেক্ষণ ধরে শায়লা বেগম অপেক্ষা করছেন অযু করার জন্য। ঘুরেফিরে এসে দেখছেন বাথরুম থেকে এখনও মিলিহা বের হয়নি। প্রায় এক ঘন্টা পর বের হয়েছে৷ বাথরুমের ব্যাপার তাই এত দেরি হবার কারণ জিজ্ঞেস না করে শায়লা বেগম চেপে গেলেন। রাতের খাবার শেষে শায়লা বেগমের সাথে মিলিহা ঘুমোতে গেলো, জিয়ান তার রুমে গিয়ে এতক্ষণে গভীর ঘুমি তলিয়ে গেছে । রাতে হঠাৎ জিয়ান লক্ষ করলো কেউ একজন তার দরজায় নক করছে, জিয়ান বাতি জ্বালিয়ে দরজা খুলে দেখলো মিলিহা। সে অবাক হয়ে বলল, ‘ এতো রাতে তুমি এখানে কেন মিলিহা ? মা দেখে ফেলবে তো।’
– ‘ ফুফু ঘুমোচ্ছে, আমি তোমার সাথে ঘুমাবো।’ কথাটা বলেই মিলিহা রুমে ঢুকে বাতি অফ করে দিলো।’
জিয়ান অবাক হচ্ছে মিলিহার পাগলামো দেখে, জিয়ান মিলিহাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে৷ খানিক পড়েই জিয়ান লক্ষ করলো মিলিহার চুল থেকে সে অপরিচিত সেই ঘ্রাণ পাচ্ছে। জিয়ান ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘মিলিহা তোমার চুলে এই ঘ্রাণ কোথা থেকে এসেছে!’
জিয়ানের কানে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি মিলিহা নায় বে, মিলিহা তো আর নেই, আমি তুরেছা তৈয়েবী।’
জিয়ান ভয়ে চিৎকার দিতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। সে বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু বাতি জ্বলছে না। সে দরজা খুলতে চাচ্ছে; কিন্তু দরজা খোলছে না।
-চলবে
– লেখক: jobrul islam habib

অপরিচিত ঘ্রাণ ( ৪র্থ পর্ব: শেষাংশ )

অন্ধকার রুম । অপরিচিত সেই ঘ্রাণ ! জ্বীনপরীর ভয়ংকর হাসি, গা ছমছম পরিবেশ। জ্বীনপরী তুরেছা তৈয়েবী সময়ে সময়ে আরও চড়াও হচ্ছে।
জিয়ান ভয়ে চিৎকার দিতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না।
সে বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করছে; কিন্তু বাতি জ্বলছে না।
দরজা খুলতে চাচ্ছে; কিন্তু খুলছে না।

অসহায় হয়ে ভাবছে, কাল রাতের মতো হঠাৎ মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ভেসে আসুক, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান – নাউম।’
সাথে সাথে রুমের বাতি জ্বলে যাক, দরজা খুলে যাক, দূর হোক সেই অপরিচিত ঘ্রাণ, দূর হোক তুরেছা তৈয়েবী। কিন্তু না এরকম কিছুই আজ হচ্ছে না। জ্বীনপরী তুরেছা তৈয়েবী হাসছে, ভয়ংকর ভাবে হাসছে।

জিয়ান ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আপনি মিলিহার সুরত ধরে এসেছেন, তাহলে আমার মিলিহা কি মায়ের পাশে ঘুমোচ্ছে ?’

– ‘না বে, তোর মিলিহা যখন বাথরুমে গিয়েছিল, তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে মেঘের দেশে বন্দী করে রেখেছি, আর আমি মিলিহার কাপড় পরে বাথরুম থেকে বের হয়েছি। ভাবছি তোর মিলিহাকে ভাইয়ের পতিতালয়ে পাঠিয়ে দিবো। সেটা জ্বীনদের পতিতালয়।

– ‘জ্বীনদের পতিতালয় মানে! আপনি মিলিহার সাথে এমন করছেন কেন! ওর কি দোষ ?’

– ‘নাকো না, ওর কোনো দোষ নেই। কিন্তু তুই যে এই মিলিহাকে ভালোবাসিস; বড্ড জ্বলে। আমার ভাইয়ের পতিতালয় আছে, সেখানে জ্বীনেরা টাকার বিনিময়ে পরীদের সাথে রাত কাটাতে যায়। মিলিহাকে সেখানে পাঠাবো, ভাই খুশি হবেনে।’

– ‘আপনি না বলেছিলেন আপনি ভালো জ্বীন, আপনার ভাই খারাপ, সে ইবলিস জ্বীনদের সাথে থাকে আর আপনি মানুষের উপকার করেন।’

– ‘সব সত্য বলিনি, আমি স্বার্থের জন্য অনেক খারাপ বে। কাল রাতে তোকে সব আজগুবী কথা শুনিয়েছি, যাতে আমার সাথে বন্ধুত্ব করিস, কিন্তু বন্ধুত্ব করবিনা নাকো, তুই ঠিকই বাসা ছেড়ে চলে এসেছিস।

– ‘আপনি দয়াকরে মিলিহাকে পতিতায়ে দিবেন না, আমি আপনার সাথে বন্ধুত্ব করবো, আপনার সাথে মেঘের দেশে যাবো, মিলিহাকে ভুলে যাবো।

– ‘সত্যি যাবি ? তুই মিলিহাকে ভুলে আমার সাথে মেঘের দেশে যাবি ? ঠিক আছে, তোর মিলিহাকে মুক্ত করে দেবো। চল আমার সাথে।’

জিয়ানকে নিয়ে তুরেছা তৈয়েবী আকাশে উড়াল দিলো, শরীরে ঠান্ডা বাতাস লাগছে, আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। জিয়ান নিচের দিকে তাকাচ্ছে, তার খুব কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে মা – বাবার জন্য। হঠাৎ করে যখন দেখবেন তাদের একমাত্র সন্তান নেই, তখন কি করবেন ? খুব কাদবেন হয়তো।
আর মিলিহা ! মিলিহার কি হবে ? সে হয়তো খুব কষ্ট পাবে, খুব কাদবে, মনমরা হয়ে সারাক্ষণ বসে থাকবে। একসময় সব স্বাভাবিক হবে, সে একটা বিয়ে করবে, তার একটা ছোট বাবু হবে। বাবুকে হয়তো সব সময় কাপড় পরিয়ে রাখবে, যেনো কোনো পরীর দুষ্ট নজর না লাগে।
তারা এতক্ষণে মেঘের কাছাকাছি চলে এসছে, বাতাসে ছোট বড় মেঘের দল এদিক সেদিক যাচ্ছে। মেঘের আড়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে পরীরা, তুরেছা তৈয়েবী তাকে নিয়ে বড় একটা মেঘের ভেতরে ঢুকলো। সেখানে মিলিহাকে দেখে তার চোখ ফেটে জল পড়ছে, মিলিহা এখনও তাকে দেখেনি। সে মিলিহাকে দেখা দিতেও চাচ্ছে না। মেঘের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। মিলিহাকে নিয়ে তুরেছা তৈয়েবী নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। জিয়ানের চোখ ঝাপসা হয়ে এসছে নোনা জলে৷ পরীরা তার আশেপাশে এসে ভীড় করছে। তুরেছা তৈয়েবী ফিরে এসেছে, সাথে সাথে পরীদের ভীড় কমে গেছে। জিয়ান দাড়িয়ে বলল, ‘মিলিহাকে কোথায় রেখে এলে।’
তুরেছা তৈয়েবী জিয়ানকে স্বান্তনা দিয়ে বলল, ‘তোমার মায়ের পাশেই রেখে এসছি।’

– ফজরের আজান শোনে ঘুম ভেঙে গেলো শায়লা বেগমের। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখলেন মিলিহা পাশে নেই। তিনি অবাক না হয়ে ভাবলেন হয়তো বাথরুমে গিয়েছে। শায়লা বেগম অযু করার জন্য বেডে শুয়েই অপেক্ষা করছেন মিলিহার, সে এলে অযু করতে যাবেন। অনেক্ষণ অপেক্ষা করলেন, কিন্তু মিলিহা আসার কোনো নাম নেই। তিনি একটু অবাক হয়ে বাথরুমের দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে দেখলেন দরজা খোলা। শায়লা বেগম বিস্ময় নিয়ে সারা বাড়ি খুজতে শুরু করলেন, কিন্তু মিলিহাকে পাওয়া গেলো না। তাড়াতাড়ি গিয়ে আজমল সাহেবকে ডেকে জানালেন মিলিহাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা। আজমল সাহেব চোখ কচলাতে কচলাতে শান্ত গলায় বললেন, ‘কি পাওয়া যাচ্ছে না।’
– ‘মিলিহাকে।’
– ‘আরে বাবা বাথরুম রান্নাঘর একটু দেখে এসো, অস্থির হবার কি আছে।’
– ‘আমি সব দেখেছি, কোথাও নেই।’
আজমল সাহেব একটু অবাক হয়ে নিজেও খুজে দেখলেন মিলিহা আসলেই নেই। শেষমেশ জিয়ানের দরজায় ধাক্কা দিলেন, দরজা খুলে গেলো। রুমের বাতি জ্বালিয়ে দেখলেন জিয়ানও নেই। জিয়ানের ফোনে কল দিলেন কিন্তু ফোন বন্ধ দেখায়। আজমল সাহেব হাটা শুরু করলেন নদীর পাড়ের দিকে, না সেখানেও নেই। খবর দেওয়া হল মিলিহার বাবা আতর আলীকে। সবাই চিন্তা করে পাচ্ছেন ওরা কোথায় গেলো। এলাকার লোকজনের মুখে মুখে উড়তে শুরু হলো আজমল মাস্টারের ছেলে আতর আলীর মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু আজমল সাহেব এবং শায়লা বেগমের ধারণা তাদের ছেলে এরকম কোনো কাজ করতেই পারেনা। এদেরকে নিশ্চিত জ্বীনপরী তুলে নিয়ে গেছে।
আজমল সাহেব রাস্তা দিয়ে হাটার সময় লোকে আমতা আমতা করে যখন প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘মাস্টার সাব, শুনলাম আপনার ছেলে নাকি আতর আলীর মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে ?’
আজমল সাহেব তখন সবাইকে পরীর গল্প বলে বিশ্বাস করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনা, এমন শিক্ষিত লোকের মুখে আজগুবী গল্প শোনে সবাই ঠাট্টা – তামাশায় মেতে ওঠে।
পাশের বাড়ির মহিলা যখন পান চিবতে চিবতে শায়লা বেগমকে জিজ্ঞেস করে, ‘তারা কি বিয়ে করতে চাইছিল, বিয়ে দিলেই তো পারতেন, আপনাদের মুখে এমন চুনকালি দিতো না।’
উত্তরে শায়লা বেগম তাদেরকে পরীর গল্প শুনিয়ে যান, তখন কেউ ভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাচ্ছেন শায়লা বেগম আর কেউ ভাবছে ছেলের শোকে মহিলাটা পাগল হয়ে গেছে।
আজমল সাহেব আর শায়লা বেগমের দিনকাল যায় তাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে না খেয়ে না ঘুমিয়ে।
অন্যদিকে আজকাল গ্রামের চায়ের দোকান জমে যায় তাদেরকে নিয়ে সমালোচনায় আর হাসি – তামাশায়।
জমে যায় আশপাশের মহিলাদের পানের আড্ডাও।

– মেঘ থেকে বের হয়ে জিয়ানকে নিয়ে তুরেছা তৈয়েবী জ্বীন জগতে যাচ্ছে, আজই সে বিয়ে করতে চায়, জিয়ানের সাথে মিলনের সুখ নিতে চায়৷ যে জিয়ানকে উলঙ্গ দেখে সে প্রেমে পড়েছিল, জ্বীন ও মানুষের ভেদাভেদ ভুলেছিল। সেই জিয়ানকে আজই তার নদীতে ডুবিয়ে পুরোপুরি ধারণ করতে চায় তুরেছা তৈয়েবী।

– মিলিহার চোখেমুখে ভয়, অপরিচিত জায়গা, ভয়ংকর জ্বীনদের আনাগোনা। সে বুঝতে পারছেনা তার সাথে কি হচ্ছে। চিৎকার দিয়ে কাদছে, আব্বু – আম্মু বলে চিৎকার দিয়ে কাদছে সে। অসহ্য কান্নার শব্দে বিরক্ত হয়ে খানিক আগে তুরেছা তৈয়েবীর ভাই থাপ্পড় দিয়েছে৷
– এভাবে অনিচ্ছায় তুরেছা তৈয়েবীর সাথে জিয়ানের দিন কাটতে থাকে। কিন্তু সে খানিক পরে এটা ভেবে শান্তি পায়৷ তার এই অসহ্য জীবন যাপনের জন্য হলেও মিলিহাকে জ্বীনদের পতিতা হওয়া থেকে মুক্তি দিতে পেরেছে। অথচ তার অজান্তে ভালোবাসার মিলিহা সেই পতিতায় দিন কাটাতে শুরু করেছে।
– হঠাৎ একদিন আতর আলী একজন জ্বীন বন্দী করার হুজুর নিয়ে উপস্থিত হলেন জিয়ানদের বাড়িতে, তিনি কিছু মুসলান জ্বীনদের হাদীস কোরআন তালিম দেন। উনাকে বিস্তারিত বলা হলে উনি কাজ শুরু করেন৷ হুজুর উনার ছাত্র জ্বীনদের পাঠালেন, তারা জ্বীন রাজ্যে খুজতে খুজতে পতিতা থেকে মিলিহাকে উপস্থিত করলো আর জিয়ানকে তুরেছা তৈয়েবী থেকে চিনিয়ে এনে শায়লা এবং আজমল সাহেবের বুকে ফিরিয়ে দিলো। গ্রামে আবার চায়ের দোকান জমে উঠলো জিয়ান আর মিলিহা জ্বীন জগত থেকে ফিরে আসা নিয়ে৷ জমে উঠলো মহিলাদের পানের আড্ডাও।
-সমাপ্তি
-লেখক: jobrul islam habib

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here