অপেক্ষার শেষ প্রহর পর্ব -০৮

#অপেক্ষার_শেষ_প্রহর
#পর্বঃ৮
#লেখনীতেঃহৃদিতা_ইসলাম_কথা

টিপ টিপ করে চোখ খুলতেই চোখে ঝাপসা দেখলাম আর শরীরটা বেশ ভারি ভারি লাগছিলো। আবার চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পর খুলতেই সবটা পরষ্কার দেখতে পেলাম।অনুভব করতে পারলাম আমি বিছানায় আছি।মাথার উপরে হোয়াইট পেন্ট করা ছাদ।ঘাড় বাকিয়ে পাশেই দেখতে পেলাম কেয়ার বিষন্নতায় ভরা মুখ।ওকে খুব উদ্বিগ্ন লাগছে।তারপর আশেপাশে তাকাতেই আরিফ ভাই চাচ্চু আর কাকিমাকে দেখতে পেলাম।সবার চোখে মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। অদূরেই স্রোত দেয়ালে পা ঠেস দিয়ে রাগী লুকে অন্যদিকে তাকিয়ে দেখেই মনে হচ্ছে বেশ রেগে আছেন উনি।কিন্তু কেনো রেগে আছেন আমি এমন কি করলাম? এসব ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু পরক্ষণেই আমি আমার ভাবনার ইতি টানলাম।তাকে নিয়ে এত ভাবতে কেনো যাবো আমি।কোনো প্রয়োজন নেই এই বদ আর বাজে লোকটাকে নিয়ে ভাবার। কিন্তু তারপরই মনে পরলো আমি তো কাল উনার বুকেই ঢলে পরেছিলাম।রাস্তায় ওই সময় ওভাবে তাহলে কি উনি বাসায় নিয়ে এসেছেন আমাকে।অল্পসময়ের মধ্যেই অনেক কথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।কাকিমা এবার আমার কাছে এসে আমার হাত মুঠো করে ধরলো আর বললো,

–এখন কেমন লাগছে তোর মা ?

— ভালো কাকিমা।

— কি দরকার ছিল এত রাতে বাইরে যাওয়ার কথা? তুই জানিস কত চিন্তা হচ্ছিল তোর জন্য? যখন স্রোত তোকে নিয়ে এলো আমরা তো ঘুমিয়ে ছিলাম। জানতামই না কিছু। এভাবে কাউকে কিছু না বলে এত রাতে বাইরে যাওয়া কি খুব প্রয়োজন ছিল।যদি বাজে কিছু হয়ে যেত।আর তুই এভাবে ভয় কেনো পেয়েছিলি কি হয়েছিল?

— আহ তুমি থামবা।দেখছো মেয়েটা ভয় পেয়েছে কি দরকার ওকে এভাবে জেরা করার।তারউপর সবে মাত্র জ্ঞান ফিরলো ওর।একটু বসতে দাও।না শুরু করে দিয়েছো।

— সরি চাচ্চু ঘুম আসছিলো না তাই হাঁটতে বেরিয়ে ছিলাম।রাতের শহর দেখার খুব শখ থাকলেও কখনো বের হতে পারিনি তাই আজ বেরিয়ে ছিলাম।তোমরা ঘুমে ছিলে তাই বিরক্ত করিনি।আমি কুকুর দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

মাথা নিচু করে অপরাধী কন্ঠে বলে ফেললাম সব।শুধু আইসক্রিমের কথাটা বলিনি।এটা বললে মামলা আরো ঘেটে যেত।তাই ওইটা না বলাই ভালো মনে হলো।

এবার মুখ খুললো ভাইয়া,,

— আমরা সবাই জানি তোর ডগ ফোবিয়া আছে।তাকে তোকে সবসময় আগলে রাখি।আর কাল ওত রাতে তুই একা বেরিয়ে গেলি।আমাকে তো বলতে পারতিস।আজ যদি স্রোত সঠিক সময়ে না থাকত ওখানে ভাবতে পারছিস কি হতো? সারারাত তোর চিন্তায় সবাই পাগর হয়ে যাচ্ছিলাম।সকালে ডক্টর বললো তুই ভয় পেয়েছিস আর তাই রাতে এত জ্বর এসেছিল। স্রোত বললো রাস্তায় পেয়েছে তোকে।জানিস বড় আব্বুর কানে গেলে কি হবে? ভাবতে পারছিস একটু।মানুষটার তোর জন্য জীবন দিয়ে দেয়।আর তুই তার কথাটা ভাববি না।এতটা ছেলেমানুষ কেনো তুই কথা?

কথাগুলো বেশ খানিকটা রাগ নিয়েই বললো ভাইয়া।আমারও ভিষন অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে এভাবে সবাইকে টেনশন না দিলেও পারতাম। কেনো যে বেরিয়ে ছিলাম। নিজেকে নিজেরই কুব করে বকতে ইচ্ছে করছে। সব দোষ ওই কুকুরটার কি দরকার ছিল আমার সামনে আসার।হুহ শুধু ভয় পাই বলে না হলে দেখিয়ে দিতাম আমি কি চিজ।কিন্তু ওটাকে দুর থেকেই দেখলেই প্রান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় আমার।একথা সত্যি যে সবাই আমাকে আগলে রাখে। একা কোথাও ছাড়ে না।

আমি জানি সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে তাই আমার ভুলে বকাঝকা করার অধিকারটাও তাদের আছে।আমি এবার মাথা নিচু রেখেই কানধরে নিম্নস্বরে বললাম,

— সরি ভাইয়া বুল হয়ে গেছে আর হবে না।প্লিজ আব্বুকে কিছু বলো না।তাহলে খুব চিন্তা করবে।

এরমাঝে বারবার আমি কেয়াকে দেখছি ও চুপচাপ বসে আছে কিচ্ছুটি বলছে না।বুঝতে পারছি এটা জলোচ্ছ্বাসের পূর্ববর্তী শান্তি। এখনই ঝড় আসবে আর সে ঝড়ে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।কেয়া এমনিতে শান্ত শিষ্ট আর চুপচাপ হলেও আমাকে নিয়ে খুব সিরিয়াস। আমি এবার ঢোক গিলে দেখে নিলাম ওকে।ওর কোনো ভাবান্তর নেই।ও নিজের মত করে বসে আছে।

–আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে এবার ওকে একটু রেস্ট করতে দাও।কেয়া তুই বস। স্রোত চলো বাবা কিছু খেয়ে নিবে।কাল সারারাত আমাদের সাথে তুমিও জেগেছিলে।এখন চলো একটু ফ্রেস হয়ে নাও আর আমাদের সাথে নাস্তা করে নাও।বলেই কাকিমা চলে গেলেন। সাথে বাকিরাও।উনি কিছু বললেন না।শুদু অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। তারপর হনহনিয়ে চলে গেলেন।আমি এবার ভালো করে উঠে বসলাম।একটু এগিয়ে গেলাম কেয়ার দিকে।তারপর কান ধরে বললাম,

— সরি জানু আর হবে না প্লিজ মাফ করে দে।

— কেনো আমি মাফ করার কে? আমি কে হই তোর? আমার জন্য কোনো চিন্তা আছে তোর? যদি আমাকে নিয়ে ভাবতিস তবে একা একা চলে যেতি না।

ওর চোখ ছলছল করছে যেনো খুব কষ্ট পেয়েছে এ কাজে।আমি এবার ওকে জরিয়ে ধরলাম তারপর বললাম,

— সরি কলিজাটা আর এরকম হবে প্লিজ কাদিস না তুি কাদলে কিন্তু এখন আমি কান্না করে দিব।আর আমার কান্না তুই থামাতেও পারবি না বলে দিলাম। কেদে কেঁদে একদম সমুদ্র বানিয়ে ফেলবো বলে রাখলাম।

— হয়েছে হয়েছে আর কাঁদতে হবে না।তুই জানিস তোর চোখের জল আমাদের কারো সহ্য হয় না।চল ফ্রেশ হবি।আমি তোর খাবার আনছি ওষুধ খেতে হবে তো নাকি।কাল যা জ্বর হয়েছিল তোর আমরা সবাই খুব ভয় পেয়েছিলাম।স্রোত ভাইয়া তো ভোরের আলো ফুটতেই বাড়ি থেকে গিয়ে ডক্টরকে ঘুম থেকে তুলে এনেছে।

ওর কথায় ভ্রু কুঞ্চিত হলো আমার।আমার জন্য উসি এসব করেছেন। আবার কাল সারারাত জেগেও ছিলেন।কাল ওভাবে রাস্তা থেকে বাড়িতে এনেছেন। এসব কেনো করেছেন উনি? ভাবনার জগতে বিচরন আমার। পরক্ষণেই মাথায় উনার জানে জিগার বন্ধুর এত আদরের বোন তাই হয়ত করেছে।রমনিতে তো সারাদিন আমার সাথে লেগে থাকে।আঙ্কেল আন্টির সাথে এতদিনে ভালো সখ্যতা হয়েছে আমার।পাশাপাশি বাড়ি হওয়াতে প্রায়ই সেখানে যাতায়াত হত।কেয়ার সাথেি যেতাম।আঙ্কেল আন্টি এত ভালো কত্ত ভালোবাসে আমায়।আর এই বদমাইশ সারাদিন রাগায় আমায়।পায়ে পারা দিয়ে ঝগড়া করে।যেনো আমার সাথে ঝগড়া না করলে উনার পেটের হাত হজম হয় না।

আমাকে এভাবে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে কেয়া বললো,

— কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি? চল তোকে ওয়াশরুমে দিয়ে আসি আর তোর জন্য সুপ নিয়ে আসি।আচ্ছা সাথে আর কি খাবি বল? আমি নিজের হাতে বানাবো।

আমি কিছু না ভেবেই বললাম,
— আজ তোর পছন্দের খাবার দিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো দুজন একসাথে।

ও মুচকি হেসে আমাকে ওয়াশরুমে দিয়ে চলে গেল।শরীরটা বেশ খানিকটা দুর্বল লাগছে।যাই হোক ফ্রেশ হয়ে নিই আগে।হঠাৎই স্রোতের কথা মনে পড়ে গেল।আয়নায় নিজেকে।কেমন অন্যরকম একটা অনুভুতি হচ্ছে। বুঝতে পারছি না আমি। যাই ভাবনা থেকে বেরিয়ে মুখ মুচতে মুছতে টাওয়ার সাথে করে বের হচ্ছিলাম।আর তখনই পথে একটা খাম্বা পড়লো।আরে আজব তো এখানে খাম্বা কোত্থেকে আসবে।পড়ে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি ওই বদমাইম বিলাইটা দাড়িয়ে আমার সামনে তাো আবার ওয়াশরুমের ভিতর।মাথাটা পুরোই গরম হয়ে গেল আমার।দাঁত চেপে ছোট ছোট চোখে বললাম,

— এইযে মিস্টার এটা কোন ধরনের ম্যানারস্ আপনি যখন তখন হুটহাট যার তার ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েন।এত অসভ্য কেনো আপনি বলতে পারেন?

উনি কিছু কিছু না বলেই ওগোতে লাগলেন।আমার কপালে বাজ পড়লো।এই লোকের চাহনি আর এভাবে আগানো একদমই ঠিক লাগছে না আমার।এমনিতেই চরিত্রে দোষ আছে এর।লুচু ছেলে একটা।আমার ভাবনার মাঝেই উনি একদম আমার কাছে এসে দাড়িয়েছেন।ভাবনা থেকে বেরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলাম উনি একদম আমার কাছাকাছি এসে পড়েছেন। উনার ভারি নিশ্বাস আমার মুখে আচরে পড়েছেন। আমার নিশ্বাসের ঘনত্ব আর উনার নিশ্বাসের ঘনত্ব এক হয়ে গভীর হয়ে উঠছে।আমি এবার শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

— আ্ আপনি এখানে কি করছেন? আ্আমার এত কাছে কেনো এসেছেন? স্ সরে দাড়ান বলছি।আ্আমি না্নাহলে চেচাবো বলে দ্ দিচ্ছি।
আমার ভয়ার্ত চেহারা দেখে উনি বেশ মজা পাচ্ছেন বুঝতে পারছি।

— এত রাতে বাইরে যাওয়ার সাহস কেনো দেখিয়েছো? কুব সাহস হয়েছে না তোমার! এর শাস্তি তো পেতেই হবে তোমাকে।

দাঁতে দাঁত চেপে রাগী স্বরের উনার থ্রেট আমার অন্তর আত্ম কাপিয়ে দিচ্ছি। আগে কখনো কারো সাহস হয়নি এভাবে আমাকে থ্রেট দেওয়ার। আর আমি কাউকে ভয়ো পাই না তবে উনাকে কেনো ভয় করছে আমার।ভয়ে ঢোক গিলে বললাম,

— ক্ কি শাস্তি? আ্ আর আপনি ক্ কেন আমায় শাস্তি দিবেন?

— বাহ রে এতটা রাস্তা আমার কোলে চরে এসেছেন আমাকে এতটা টেনশন দিয়েছেন তার জন্য শাস্তি আর উপহার দুটোই দিতে হবে।

— পারবো না।আপনাকে বলিনি আমাকে আনতে।

— হুম এখন তো বলবেন আর কাল যে আমার কোলে চরে আসলের তার বেলা।ছাড়তেই তো চাইছিলেন না।শক্ত করে আকড়ে ধরে ছিলেন আমার শার্ট। এই দেখুন ইস্ত্রি করা শার্টটাকে কিভাবে আহত করেছেন আপনি।

— দেখুন ফালতু কথা বলবেন না একদম।আমি কিচ্ছু করি নাই।

বলেই মুক ঘুরিয়ে দাড়ালাম।উনি হুট করেই আমার কোমর চেপে ধরলেন।উনার এমন কাজে আমি হতবাক।বড়বড় চোখে তাকিয়ে উনার দিকে। উনার মতিগতি ঠিক লাগছে না।আমি এবার নিজেকে ছাড়াতে উনাকে ধাক্কাতে লাগলাম।উনি বললেন,

— এই পিচ্চি এত নড়াচড়া করো কেন?

— কিহহহ আমি পিচ্চি! আপনি আমাকে পিচ্চি বললেন।

— হুম বললাম, পিচ্চি পিচ্চি বলবো না তো কি ওল্ড লেডি বলবো।তবে সেটা বলা যায়। কারন তুমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছো।কদিন পর একটা ক্রিকেট টিম জন্মদিবে তুমি।
বলেই হো হো করে হাসলাম।আর আমি বোকার মত চেযে আছি।কি বলছে এই লোক সব যেনো মাথার একহাত উপর দিয়ে গেল।আমি এবার রেগেই বললাম,

— শুনন একদম বাজে কথা আর ফালতু কথা বলবেন না।ছাড়ুন! ছাড়ুন আমায়। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।

— কেনো?

বলেই আমার দিকে আরো খানিকটা ঝুকে গেলেন উনি।আমি মুখ ঘুরিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছি।সাথে পরনের জামা শক্ত করে খামচে ধরেছি।এই লোক আমার কাছে আসলে এক অন্য রকম শিহরন অনুভব হয়।। যা এর আগে কখনো হয় নাই।কারো কাছেই না।মনের মাঝে ভালোলাগা কাজ করে আমার অগোচরেই।আমায় ওইভাবে দেখে উনার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।যা আমার অগোচরেই রয়ে গেল।খানিকবাদে উনার নিশ্বাসের আভাস না পেতেই আমি পিটপিট করে চোখ খুললাম।উনি দরজার কাছে দুষ্টু হেসে বললেন,

— তুমি সত্যিই পিচ্চি। পুচকি একটা।

বলেই চলে গেলেন।আমি আনমনেই হাসলাম।
হুট করে আবারে দৌড়ে এসে গালে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালেন আমার।তারপরই বেরিয়ে গেলেন।আমি শুধু বড়বড় চোখের অবাকের চরম পর্যায়ে অবস্থানের এক্সপ্রেশন নিয়ে দাড়িয়ে। মনে হচ্ছে সব যেনো থমকে গেছে। আমার হাত আচমকাই আমার গাল ছুয়ে দিল।উনার ঠোঁটের আলতো ছোয়া মনের মাঝে নাম না জানা এক অনুভূতির জন্ম দিল।আমি শুধু শিহরিত সাথে এক রাশ ভালোলাগারা এসে ভর করলো আমার মাঝে।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here