অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা পর্ব -২৪

গল্প : #অপ্রত্যাশিত_ভালোবাসা
লেখক : #কাব্য_মেহেরাব
পর্ব : ২৪

বাসায় ফিরেছি আমি অলরেডি দুই ঘন্টা পার হয়ে গেছে। এখনো রাত 11:30 মিনিট।আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে অমিত বাবু আবার ক্লাবে চলে গেছেন। প্রবীশ বাবু কেন আসেন নি আর অমিত বাবু কেনই বা আবার ফিরে গেলেন সেটা আমি জানি না । জানতেও চাইনা আমি।

বারবার বলেছিলাম আমি কিছুতেই যাব না কিন্তু কেন শুনেনি এই মানুষটা? কতগুলো বিচ্ছিরি কথা শুনতে হল এই মানুষটার জন্য। সব থেকে বড় কথা আজ তার স্পর্শ গুলো আমাকে অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য করছে। আমি কিছু ভাবতে চাইনা। কিচ্ছুটি ভাবতে চাইনা আমি আমার মতন করে ভালো থাকতে চাই।

১২:০৫ মিনিট এখন। রামু চাচা ডাইনিং টেবিলে প্রবীশ বাবুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পরেছেন। আমি আমার রুমে বসে আছি মাঝে মাঝে নিচে তাকিয়ে দেখে আসছি প্রবীশ বাবুর ফিরেছেন কিনা।

হঠাৎ করে কলিং বেল বাজার শব্দ শুনে আমি দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখতে লাগলাম প্রবীশ বাবু এসেছেন কিনা।

এত ব্যাকুলতা লাগার একটা কারণ তখন প্রবীশ বাবুর যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন SK এর দিকে, তার সেই চাহনি আমার চোখে এখনো ভাসছে বারবার মনে করে রাখছে কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে না তো।

রামু চাচা দ্রুত দরজা খুললেই অমিত বাবু এবং প্রবীশ বাবু ভিতরে করেন। খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে প্রবীশ বাবুকে। মনে হচ্ছে মারামারি করে এসেছেন। মনে হচ্ছে না সত্যি করেছেন তার ঠোঁট কেটে গেছে কপাল এর পাশ থেকে ছুঁয়েছে রক্ত পড়া শুকনো দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

রামু চাচা : হায় ভগবান, তোমার চোখে মুখে এই অবস্থা কি করে হল প্রবীশ বাবা? তুমি কি মারপিট করছো?

প্রবীশ বাবু :…….( উপরে আমার দিকে তাকিয়ে দেখেন আমি দাঁড়িয়ে আছি। রামু চাচার কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজা ওপরে চলে আসলেন)

প্রবীশ বাবু আমার সামনে দিয়ে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। তার এমন ব্যবহারটা আমার কাছে কেমন যেন লাগল। নিচের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি কী হয়েছে..

রামু চাচা : কি হয়েছে আমিত বাবা প্রবীশ বাবার এই অবস্থা কি করে হলো?

অমিত : ক্লাবে আমাদের নতুন পাটনা SK মানে শেখ কবির এর সাথে প্রচুর পরিমাণ মারামারি হয় স্যার এর । মেঘা বৌরানী পুলিশকে ইনফর্ম করলে সেখানে পুলিশ এসে হাজির হয়। তারপর থানায় যেতে হয়েছে। SK এর অবস্থা বেশি ভাল নয়, সে হসপিটালে এডমিট। মারা মারির এক পর্যায়ে স্যারের একটু আঘাত লাগে। হসপিটালে নিয়ে তাকে ব্যান্ডেজ করাতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে কিছুতেই করলো না। বললো তার প্রয়োজন নেই।

রামু চাচা : কিন্তু এইসব হলো কি করে ?

অমিত বাবু : আসলে ডালিয়া…..(বাকি কথা না বলেই উপরে তাকিয়ে দেখলেন আমি দাঁড়িয়ে আছি তাই সে কথাটি এড়িয়ে গিয়ে বললেন) ডালিয়া কি রাতে খেয়েছে?

রামু চাচা : অমিত বাবুর চোখ অনুসরণ করে উপরে তাকিয়ে দেখলেন আমি দাঁড়িয়ে আছি। তাই অমিত বাবু কথাটি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু কি বলতে চাইছেন তা বুঝতে বাকি রইল না রামু চাচার।

আমি নিচে নেমে আমিত বাবুকে কিছু জিজ্ঞাসা করব তার আগেই মনে পড়ে গেল ক্লাবে প্রবীশ বাবুর করা ওমন বিহেভের কথা। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে আমার। তাই ডাইনিং টেবিলে জব থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেয়ে নিলাম। তখনই অমিত বাবু আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন_

আমিত বাবু : একটা কথা বলব রাখবে ডালিয়া…?

মেঘা : …….(আমি মাথা নিচু করে তার দিকে ফিরে দাড়ালাম।)

অমিত বাবু : স্যার কোন প্রকার মেডিসিন নেয়নি , যদি তুমি একটু বিষয় টা দেখতে..

মেঘা :……. (আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম। মাথা হালকা কাত করে তাকে বুঝালাম ,)ঠিক আছে।

আমি জানি প্রবীশ বাবু হয়তো না খেয়ে আছেন।কিছু খাবার প্লেটে বেরে ওপরে প্রবীশ বাবু রুমের উদ্দেশ্যে সামনে এগোলাম। প্রতিটা সিঁড়ির উপর পা ফেলতে যাচ্ছি অমনি প্রবীশ বাবুর সেই স্পর্শ র কথা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কেমন অদ্ভুত লাগছে বার বার।।

প্রবীশ বাবুর রুমে গিয়ে হালকা দরজাতে হাত দিয়ে ঠেলতেই দরজাটি খুলে গেল। প্রবীশ বাবু নিজের পোশাক চেঞ্জ না করেই সটান হয়ে শুয়ে আছেন। ডান হাত নিচে ছিল না তা থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত ফ্লোরে পড়ছে। আমার বুকের ভেতর টা ছ্যাত করে উঠলো।

সাইড টেবিলে খাবারের প্লেট টা রেখে আমি দ্রুত তার অড্রফ থেকে ফার্স্ট এইড বক্স টা বের করে নিয়ে তার সামনে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। প্রবীশ বাবুর বাম হাত টি আড়াআড়িভাবে চোখের ওপর দিয়ে রেখে ডান হাত ফ্লোরের দিকে ঝুলিয়ে রেখে চুপ করে শুয়ে আছেন।

আমি নিচে বসে প্রবীশ বাবুর হাত টা ধরতেই তিনি চোখের উপর থেকে বাম হাত টি সরালেন। আমাকে নিচে বসে থাকতে দেখে তিনি হাত টি সরাতে গেলেন কিন্তু আমি তার হাতটি জোর করে চেপে ধরলাম। তার দিকে তাকাতেই তিনি চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন।

যেখানে আমার রাগ হওয়ার কথা তার এমন কাজে সেখানে তিনি আমার প্রতি অভিমান করেছেন খুব বুঝতে পেরেছি আমি। কিন্তু এই অভিমান করার কারণটা আমি খুঁজে বের করতে পারলাম না। হাত ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলাম নিচে বসে। তারপর আমি দাঁড়িয়ে গেলে তিনি উঠে নিচে পা ঝুলিয়ে বসেন। তার পাশে বসে এক টুকরো তুলোতে একটু পভিসিফ লাগিয়ে তার ঠোট স্পর্শ করতেই তিনি চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিলেন। হয়তো জ্বলে উঠেছে ক্ষত স্থানটি। আমি আস্তে আস্তে ফু দিতে দিতে ক্ষত স্থানটি পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিলাম।

প্রবীশ মেঘার দিকে অপলক চেয়ে আছে। তা ঢেড় বুঝতে পেরেছে মেঘা। মেঘার এক একটি ফু্ঁক প্রবীশের পুরুষত্ত্ব জাগিয়ে তুলছে। গায়ের প্রতিটি লোমকূপ যেন দাঁড়িয়ে গেছে , নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে প্রবীশের। চোখ বন্ধ করে নিলো প্রবীশ , এইভাবে মেঘাকে প্রবীশের এতো কাছে দেখে প্রবীশ যেন নিজের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।

মেঘা প্রবীশের ঠোঁটে মলম লাগিয়ে দেওয়ার পর,কপালের কাছে ভ্রু্তে ক্ষত স্থানে আস্তে আস্তে ফু দিয়ে ড্রেসিং করে মলম লাগিয়ে দিলো তারপর সেখানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল।

মেঘা : এখানে তো হয়ে গেছে, আর কোথাও লেগেছে?( উঠে দাঁড়িয়ে জিঙ্ঘাসা করলাম)

প্রবীশ বাবু : ……(অপলক চেয়ে আছে মেঘার দিকে)

মেঘা : আর কোথাও লেগেছে কি?(নিজের এক হাত প্রবীশ বাবুর সামনে নাড়িয়ে জিগ্যেস করলাম)

প্রবীশ বাবু : (ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে তার তারপর বলে) লেগেছে , সেখানে মলম দিতে পারবে তুমি?

মেঘা : মানে…?(জানতে চাইলাম আমি)

প্রবীশ বাবু : না তেমন কিছু না খেয়েছ তুমি?

মেঘা : না ।

(কথাটি বলে টেবিল থেকে প্লেটটা নিয়ে এসে হাত ধুয়ে খাবার মাখিয়ে প্রবীশ বাবুর মুখে তুলে দিলাম। কোন বাক্য ব্যয় না করে প্রবীশ বাবু ছোট বাচ্চার মতন সব খাবার খেয়ে নিলেন।)

মেঘা : পার্টিতে এমনটা কেন করলেন আমি জানতে চাইব না। তবে একটা কথা বলতে চাই এসব মারপিট করে কি প্রমাণ করতে চাইছেন? আমার মন সম্মানের কথা না হয় নাই ভাবলেন ,নিজের মান সম্মানের তো কথা একটু ভাববেন? মান সম্মান নিয়ে খেলা করা এটা কি ঠিক হচ্ছে আপনার?

এবার প্রবীশের প্রচন্ড রাগ উঠে গেল। আমার হাতের দুই বাহু ধরে নিজের মুখের আমার কাছে নিয়ে এসে বলল_

প্রবীশ বাবু : আমি কোন মান সম্মান নিয়ে খেলা করি নি। যা করেছি তোমাকে ভালোবেসে করেছি।কজ আই লাভ ইউ ডেম ইট…!

প্রবীশ বাবুর মুখে এই কথাটা শুনে আমার মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল। তার আর আমার মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান অথচ সে কি বলছে এসব? আমি একজন বিবাহিত মেয়ে তাছাড়া আমি মুসলিম। আমার সম্পর্কে না জেনে শুনে এভাবে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কতটুকু চিনেন তিনি আমাকে? রেগে গিয়ে আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম_

মেঘা : কতটুকু চিনেন আপনি আমাকে? আর কতটুকুই বা জানেন? ভালোবাসা তাই না? ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয়ে যায় না… ভালোবাসার মানে কি আপনি যদি জানতেন তাহলে বলতেন না…

প্রবীশ বাবু : আমি জানি না …সত্যিই আমি জানিনা! তোমাকে কেন ভালোবাসি এর কারণটাও আমি জানিনা। তবে জানতে চাই । আর তোমাকে চাই আমি। যদি আমার চাওয়াটা ভালোবাসা হয় তাহলে হবে না হলে তুমি যা ইচ্ছা বলতে পারো। কারন আমি তোমাকে চাই আর তোমার কাছ থেকেই আমি তোমাকে জানতে চাই তোমার কাছ থেকে জানতে চাই ভালোবাসা মানে…

মেঘা : আপনার সাথে আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। (কথাটি বলে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে ধরি কিন্তু পারি না। তার আগেই প্রবীশ বাবু আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে)

প্রবীশ : আমার উত্তরটা না দিয়ে কোথায় যাচ্ছ?

মেঘা : আমার কথার মানে এখোনো আপনি বুঝেন নি ,আমি কি বলতে চাইছি? আপনাকে আমি কোনদিনও ভালবাসতে পারব না।

প্রবীশ বাবু : সেটা তোমার ব্যাপার কিন্তু আমার তোমাকে চাই চাই মানে চাইইই

আমি কোনমতেই আমার হাত ওখান থেকে ছাড়িয়ে বেরিয়ে চলে আসি আমার রুমে।

প্রবীশ বাবু; মেঘা মেঘাআআআ মেঘা আমার কথা শোনো মেঘাআআআ…

প্রচন্ড জোরে চিল্লিয়ে ডাকে আমাকে। আমি চোখ মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমার রুমের বেলকুনিতে।
*
*
*
*
*
কেটে গেল আরও দুটি দিন। আমি প্রবীশ বাবুর সামনে এই দুদিনের একবার ও যায়নি। হয়তো তিনি ভাবছেন আমার সময়ের প্রয়োজন, তাই তিনি সে সময় টুকু আমাকে দিচ্ছেন। তবে সে সময় করে আমার রুমে উঁকি দিয়ে আমাকে ঠিকই দেখে যান। আবার আমি রাতে ঘুমিয়ে গেলে প্রবীশ বাবু আমার রুমে আসেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ হয়তো আমার দিকে তাকিয়ে থেকে পরে চলে যান। ভালোই বুঝতে পারি আমি। তবে আমি ধরা দিতে চাই না।

আমার খাবারগুলো রামু চাচা সব উপরে দিয়ে যান এই দুইদিন। অমিত বাবুর সাথে এই দুদিনে আমার এখনো পর্যন্ত দেখা হয়নি। তবে রামু চাচার কাছে শুনেছি সেই মেয়েটার সাথে নাকি অমিত বাবুর রেলেশন সেট আপ হয়ে গেছে। অমিত বাবুর এই খবরটা শোনার পর বেশ ফুরফুরে লাগছিল। বিকাল তিনটার দিকে গোসল করে এসে তোয়ালেটা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ব্যালকনিতে চলে আসলাম। ব্যালকনিতে তোয়ালে টা রাখতেই চোখ পড়ে নীচে গেটের সামনে 6 ফুট মত লম্বা একটি ছেলের উপর।

বুকের ভেতর শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। কে যেন হাতুড়িপেটা করছে। চোখে আমার আনন্দে পানি চলে এসেছে।আমাদের এক্সিডেন্ট যেদিন হয়েছিল সেইদিন কাব্য যে শার্ট পড়েছিল সেই শার্ট ঐ ছেলেটার পরনে। পিছন থেকে দেখেই কাব্যই মনে হচ্ছে।

দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উপর নিচে নিয়ে বুকের সাথে ঠেসে ধরলাম। আমার কাব্য খুঁজতে খুঁজতে ঠিকই আমার কাছে চলে এসেছে। আমার অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা পূর্ণতা দিবে এবার। আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠছে মন।

কয়েক সেকেন্ড পর মনে হলো ছেলেটা ভিতরে আসতে চাচ্ছে কিন্তু দারোয়ান ভিতরে আসতে দিচ্ছে না। অমিত বাবু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু বলছেন তাকে। হয়তো কাব্য আমার কথাই জিজ্ঞাসা করছে, ভাবতে বিন্দু ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পরলো।

আমি দূরত্ব নিচে নেমে এসেন জোরে গেটের দিকে যাচ্ছি ।প্রবীশ বাবু ডিভাইনে বসে পেপার পড়ছিলেন। এইভাবে তার সামনে দিয়ে জোরে দৌড়ে আমি বাইরে বেরোচ্ছি দেখে তিনি ভুরু কুঁচকে আমার পিছন পিছন দ্রুত পা ফেলে চলে আসলেন আমার পিছন পিছন।

আমি দ্রুত গেটের কাছে যেয়ে পিছন থেকে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরি……

মেঘা : আমি জানতাম কাব্য, তুমি ঠিকই ফিরে আসবে আমার কাছে। অনেক খুজেছো আমাকে তাই না? সরি আর কোনদিন তোমাকে ছেড়ে আমি দূরে যাব না এই পাক্কা প্রমিস করছি…..

# চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here